img

গ্যাস উত্তোলনে পেট্রোবাংলার পরিকল্পনা কতটা বাস্তবসম্মত?

প্রকাশিত :  ১২:৪৩, ২৮ ফেব্রুয়ারী ২০২৩

গ্যাস উত্তোলনে পেট্রোবাংলার পরিকল্পনা কতটা বাস্তবসম্মত?

বদরূল ইমাম 

গ্যাসের চাহিদা মেটাতে উচ্চ মূল্যের এলএনজি আমদানির ওপর নির্ভরশীলতা যে আর্থিক খাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে, সে আশঙ্কা আগে থেকেই করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এর প্রভাবে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি এবং রিজার্ভ-সংকট ইতিমধ্যে জনসাধারণ ও সরকার—উভয়ের জন্যই অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে।

আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির দামের ওঠা ও নামা জ্বালানি খাতে বিশ্বব্যাপী অস্থির পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য দায়ী। বাংলাদেশ ২০১৮ সালে যখন এলএনজি আমদানি শুরু করে, তখন এর দাম তুলনামূলক কম ছিল, কিন্তু গত বছর নাগাদ এর দাম এতটাই বেড়ে যায় যে বাংলাদেশ স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনার সামর্থ্য হারায়।

এ কারণে গ্যাস-সংকটে দেশে যে লোডশেডিং হয়, তার অভিজ্ঞতা আমাদের সবারই হয়েছে।

উচ্চ মূল্যের এলএনজির ওপর নির্ভরশীল না হয়ে দেশের নিজস্ব গ্যাস সম্পদ সর্বোচ্চ সক্ষমতায় উত্তোলন ও তার ওপর নির্ভর করার যৌক্তিকতা ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। এ বিষয়ে আগে থেকেই বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিয়ে আসছেন। তাঁদের মতে, ভূতাত্ত্বিকভাবে বাংলাদেশ গ্যাসের জন্য যথেষ্ট সম্ভাবনাময়, কিন্তু গ্যাস অনুসন্ধান নিয়ে অবহেলা ও দুর্বল উদ্যোগের কারণে গ্যাস–সংকট আজ এই পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে গড়ে প্রতিবছর মাত্র একটি অনুসন্ধান কূপ খনন করা হয়, গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা আছে, এমন দেশগুলোর মধ্যে অনুসন্ধানের এ হার বিশ্বে ন্যূনতম।

তবে দেরিতে হলেও আশার কথা হচ্ছে সম্প্রতি দেশের নিজস্ব গ্যাসসম্পদ অনুসন্ধান ও উত্তোলন বাড়ানোর লক্ষ্যে একটি জরুরি ও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার ঘোষণা করা হয়েছে। ২০২২ সালের আগস্ট মাসে পেট্রোবাংলা ২০২৫ সালের সালের মধ্যে ৪৬টি কূপ খনন পরিকল্পনা ঘোষণা করে। এর মধ্যে ১৭টি অনুসন্ধান কূপ, ১২টি উন্নয়ন কূপ ও ১৭টি ওয়ার্কওভার কূপ অন্তর্ভুক্ত।

বাংলাদেশে গড় সাফল্যের হার বেশি এবং তা হলো, তিনটি অনুসন্ধান কূপ খনন করলে একটিতে সাফল্য। সেই হিসাবে ১৭টি অনুসন্ধান কূপ খনন করলে তার এক-তৃতীয়াংশ সফল হতে পারে এবং গ্যাস প্রাপ্তির প্রাক্কলন সেভাবেই করা উচিত। সব কটি কূপে সাফল্য ধরে যে পরিমাণ উৎপাদন হিসাব করা হয়েছে, তা বাস্তবসম্মত নয়। এরপরও বলি, নতুন গ্যাস কূপ খননের যে উদ্যোগ পেট্রোবাংলা নিয়েছে, তা সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। গ্যাস অনুসন্ধানে দীর্ঘদিনের স্থবিরতা কাটিয়ে উঠে যথেষ্ট মাত্রায় কূপ খনন করা হলে বর্তমান গ্যাস-সংকট থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে।

পেট্রোবাংলার আশা, এসব কূপের মাধ্যমে দৈনিক প্রায় ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা যাবে। উল্লেখ্য, বর্তমানে কমবেশি এ পরিমাণ গ্যাস এলএনজি আমদানির মাধ্যমে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হয়। এখন প্রশ্ন হলো, পেট্রোবাংলার পরিকল্পনাটি কতটা সন্তোষজনক এবং এর মাধ্যমে প্রত্যাশা অনুযায়ী গ্যাস তোলার সম্ভাবনা কতটুকু?

সাধারণ পাঠকদের জন্য বোঝার জন্য বলছি, ‘অনুসন্ধান কূপ’ অজ্ঞাত স্থানে খনন করা হয় এবং গ্যাস পাওয়া গেলে তা দেশের গ্যাস মজুত বাড়ায়। ‘উন্নয়ন কূপ’ হচ্ছে ইতিমধ্যে আবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য নতুন কূপ খনন। আর ‘ওয়ার্কওভার কূপ’ নতুন কূপ নয়; বরং আগে খনন করা ও পরিত্যক্ত কূপে মেরামত বা কোনো যন্ত্রাংশ সংযোজনের মাধ্যমে সেখানে রয়ে যাওয়া বা ফেলে আসা গ্যাস তোলার চেষ্টা করা।

পেট্রোবাংলা গত আগস্টে যে পরিকল্পনা ঘোষণা করেছিল, এ বছর ফেব্রুয়ারিতে তা সংশোধন করেছে। নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী ৪৬টি কূপ খননের কাজ ২০২৫ সালের পরিবর্তে ২০২৪ সালের মধ্যেই শেষ করা হবে। অর্থাৎ, তিন বছরের পরিবর্তে এখন দুই বছরের মধ্যেই ৪৬টি কূপ খনন করা হবে। এ সময়ে যে ১৭টি অনুসন্ধান কূপ খনন করার কথা, এর ৬টি ২০২৩ সালে এবং ১১টি ২০২৪ সালে খনন করা হবে। কেবল এই অনুসন্ধান কূপগুলো বিবেচনায় নিয়ে পরিবর্তনের যৌক্তিকতা বিচার করে দেখা যেতে পারে।

বাংলাদেশের নিজস্ব গ্যাস অনুসন্ধান কোম্পানি বাপেক্স তার বর্তমান লোকবল ও রসদ সামর্থ্য নিয়ে বছরে দুই থেকে তিনটি অনুসন্ধান কূপ খনন করতে পারে। সেই বিবেচনায় ২০২৩ সালে ৬টি অনুসন্ধান কূপ খননের পরিকল্পনাই উচ্চাভিলাষী। আর ২০২৪ সালে ১১টি অনুসন্ধান কূপ খনন করার পরিকল্পনাকে বলতে হয় অতি উচ্চাভিলাষী।

আমাদের মনে আছে, ২০১৬ সালে পেট্রোবাংলা ‘পাঁচ বছরে ১০৮টি কূপ খননের’ পরিকল্পনা ঘোষণা করেছিল। এর মধ্যে ৫৫টি ছিল অনুসন্ধান কূপ। পাঁচ বছরে তা করতে হলে প্রতিবছর ১১টি খনন করা প্রয়োজন। কিন্তু বাপেক্স পরিকল্পনাটি কার্যকর করতে পুরোপুরিভাবে ব্যর্থ হয়েছে।

দেশীয় কোম্পানি বাপেক্স যে তার সীমাবদ্ধতার কারণে পেট্রোবাংলার নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২৩ সালে ৬টি ও ২০২৪ সালে ১১টি অনুসন্ধান কূপ খনন করতে পারবে না, তা সহজেই বোঝা যায়।

এ ক্ষেত্রে কূপ খননের জন্য আউটসোর্সিং ব্যবস্থাপনার পরিকল্পনা করা হয়েছে, যাকে সাধারণভাবে যৌক্তিক হিসেবে বিবেচনা করা যায়। কিন্তু অতীত অভিজ্ঞতা এর সীমাবদ্ধতার দিকটি ও আমাদের সামনে তুলে ধরে। এক বছরে এতগুলো আউটসোর্সিং প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনার সামর্থ্য কি আমাদের আছে?

কূপ খননে আউটসোর্সিং কোম্পানি ও পেট্রোবাংলার বিরোধ অনেক সময় আদালত পর্যন্ত গড়ায়। কয়েক বছর আগে সেমুতাং-৫ ও বেগমগঞ্জ-৪ কূপ দুটি আউটসোর্সিং ব্যবস্থাপনায় আজারবাইজানের রাষ্ট্রীয় তেল–গ্যাস কোম্পানি সোকারকে খনন করতে দেওয়া হয়। কিন্তু পেট্রোবাংলার সঙ্গে ব্যবস্থাপনা ও আর্থিক বিষয়ে বিরোধ হওয়ার কারণে তারা বেগমগঞ্জ কূপটি খনন না করে চলে যায়। এ জন্য আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়া হয়েছে কিন্তু আজ পর্যন্ত বিষয়টির কোনো নিষ্পত্তি হয়নি।

আইনি নিষ্পত্তি না হওয়ায় এখন বেগমগঞ্জ-৪ কূপটি এখন আমাদের বাপেক্সও খনন করতে পারছে না। একইভাবে ছাতক গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাস তোলার জন্য কানাডার অখ্যাত নাইকো কোম্পানিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। নাইকো কূপটিতে দুর্ঘটনা ঘটায় এবং তাতে কূপটি নষ্ট হয়ে যায়। বাংলাদেশ ক্ষতিপূরণের জন্য আন্তর্জাতিক আদালতে গেছে কিন্তু ১৭ বছরেও তার নিষ্পত্তি হয়নি।

ফলে এ গ্যাস-সংকটের দিনেও ছাতক গ্যাসক্ষেত্র থেকেও গ্যাস উত্তোলন সম্ভব হচ্ছে। এদিকে অনেক কূপ বাপেক্সকে দিয়ে খনন না করিয়ে রাশিয়ার গাজপ্রম কোম্পানির মাধ্যমে করানো হচ্ছে, যেখানে গাজপ্রম প্রতিটি কূপ খননে বাপেক্সের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ দাম নিচ্ছে।

বর্তমানে ঘোষিত ৪৬টি কূপ খনন তিন বছরের (২০২৩-২০২৫) পরিবর্তে দুই বছরে (২০২৩-২০২৪) সম্পন্ন করার পরিবর্তিত পরিকল্পনা সুচিন্তিত নয় বলে মনে হয়। মাঠপর্যায়ের অভিজ্ঞতাবিহীন প্রশাসনের উচ্চ মহলের সুপারিশে এ রকম সিদ্ধান্ত হয়ে থাকতে পারে। এত বেশিসংখ্যক কূপ তাড়াহুড়ার মধ্যে করতে যাওয়ার যে ঝুঁকি রয়েছে, তা আমলে না নেওয়া অদূরদর্শিতার সাক্ষ্য বহন করে। একটি বছর তেমন বড় কিছু সময় নয়, যেখানে বাংলাদেশ বছরের পর বছর গ্যাস-সংকটে ভুগে আসছে।

অন্যদিকে ৪৬টি কূপ খননের মাধ্যমে ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদনের যে হিসাব করেছে, তা-ও সুচিন্তিত নয়। পেট্রোবাংলার হিসাবে প্রতিটি অনুসন্ধান কূপে সফলতা ও গ্যাসপ্রাপ্তি ধরে কূপপ্রতি ১৫ থেকে ২০ মিলিয়ন ঘনফুট উৎপাদন হিসাব করা হয়েছে। কিন্তু বিশ্বের কোথাও অনুসন্ধান কূপের প্রতিটি সফল হয় না।

বাংলাদেশে গড় সাফল্যের হার বেশি এবং তা হলো, তিনটি অনুসন্ধান কূপ খনন করলে একটিতে সাফল্য। সেই হিসাবে ১৭টি অনুসন্ধান কূপ খনন করলে তার এক-তৃতীয়াংশ সফল হতে পারে এবং গ্যাস প্রাপ্তির প্রাক্কলন সেভাবেই করা উচিত। সব কটি কূপে সাফল্য ধরে যে পরিমাণ উৎপাদন হিসাব করা হয়েছে, তা বাস্তবসম্মত নয়। এরপরও বলি, নতুন গ্যাস কূপ খননের যে উদ্যোগ পেট্রোবাংলা নিয়েছে, তা সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। গ্যাস অনুসন্ধানে দীর্ঘদিনের স্থবিরতা কাটিয়ে উঠে যথেষ্ট মাত্রায় কূপ খনন করা হলে বর্তমান গ্যাস-সংকট থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে।

ড. বদরূল ইমাম অধ্যাপক, ভূতত্ত্ব বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


মতামত এর আরও খবর

img

গাজা যুদ্ধ বন্ধে বাইডেন কেন এতটা মরিয়া

প্রকাশিত :  ১১:৪১, ১২ মে ২০২৪
সর্বশেষ আপডেট: ১১:৪৮, ১২ মে ২০২৪

জনাথন ফ্রিডল্যান্ড

দ্বিতীয় দফায় নির্বাচিত হবেন কি না তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের উদ্বেগ একেবারে প্রান্তে এসে পৌঁছেছে। জো বাইডেনের পরামর্শ বারবার উপেক্ষা করে আসছিলেন বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। এই উপেক্ষার মূল্য কী হতে পারে, এই সপ্তাহে ইসরায়েল সেটা দেখতে পেল।

ইসরায়েলের ৩ হাজার ৫০০ বোমার চালান আটকে দিয়েছে বাইডেন প্রশাসন। এই অস্ত্র ইসরায়েল গাজার দক্ষিণের শহর রাফা আক্রমণে ব্যবহার করবে, সেই বিবেচনায় অস্ত্রের চালানটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। রাফায় এখন ১০ লাখের বেশি শরণার্থীর আশ্রয়শিবির।

ইসরায়েলের প্রতি জো বাইডেন তাঁর ‘লৌহদৃঢ়’ সমর্থন থেকে সরে আসছেন না। কিন্তু ইসরায়েল রাফা হামলার জন্য যে হুমকি দিয়ে চলেছে, সেটা সফল করতে অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করবেন না। সিএনএনকে বাইডেন বলেছেন, ‘ইসরায়েলের নিরাপত্তা দেওয়া থেকে আমরা সরে আসছি না। অন্যখানে যুদ্ধ করার সক্ষমতা তৈরির পথ থেকে সরে আসছি আমরা।’

ইসরায়েলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিত্র যুক্তরাষ্ট্র। ইসরায়েলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী আইজাক রবিন বলতেন, তাঁর দেশের ১ নম্বর কৌশলগত সম্পদ এই সব অস্ত্র, এমনকি পারমাণবিক অস্ত্র নয়; বরং ওয়াশিংটনের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক। দশকের পর দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় অস্ত্রের জোগানদাতা ও কূটনৈতিক অভিভাবক। 

কিন্তু মাত্র ছয় সপ্তাহের ব্যবধানে ওয়াশিংটন এমন দুটি পদক্ষেপ নিল, যা পুরোপুরি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গেল। গত মার্চ মাসে নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ভেটো দেওয়া থেকে বিরত থাকে যুক্তরাষ্ট্র। ফলে ইসরায়েল প্রস্তাবটি আটকে দিতে চাইলেও ব্যর্থ হয়। আর এখন তো ওয়াশিংটন অস্ত্রের চালান আটকে দিল।

এর থেকেও বড় বিষয় হলো, এই সিদ্ধান্তগুলো এমন একজন রাজনীতিবিদ নিয়েছেন, যিনি ব্যক্তিগতভাবে ইসরায়েলের খুব নিবেদিতপ্রাণ সমর্থক। বাইডেন সেই যুগের একজন ডেমোক্র্যাট, যখন দুই সহস্রাব্দের নির্বাসন ও শাস্তির পর মধ্যপ্রাচ্যে ইহুদিদের আদি বাড়ি প্রতিষ্ঠার বিষয়টি গতি পেতে শুরু করেছে। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের উদারপন্থীদের চোখ তখন রহস্যজনকভাবে বন্ধ ছিল।  

গোল্ডা মেয়ার থেকে শুরু করে ইসরায়েলের প্রত্যেক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বাইডেন দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে। ইসরায়েলের প্রতি বাইডেনের টান বাড়ার ক্ষেত্রে এর একটার ভূমিকা আছে। পূর্বতন প্রেসিডেন্টদের মতো বাইডেনের ইসরায়েলের প্রতি ভ্রাতৃত্ববোধ শুধু নির্বাচনী হিসাব-নিকাশের বিষয় নয়।  

গাজা নিয়ে কোনো চুক্তি হচ্ছে না। কেননা, নেতানিয়াহু কিংবা সিনাওয়ারা কেউই বিশ্বাস করেন না, চুক্তি করলে তাঁদের স্বার্থ রক্ষিত হয়। যেমনটা যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক কর্মকর্তা অ্যারন ডেভিড মিলার বলেছেন, ‘এই সংঘাত বন্ধে একটি পক্ষেরই কেবল সত্যিকারের তাড়া আছে, সেই পক্ষটি হলেন জো বাইডেন।’

অন্যদিকে ১৯৮০-এর দশকে নেতানিয়াহু প্রথম আলোচনার পাদপ্রদীপে উঠে আসেন। তিনি এমন একজন কূটনীতিক, যিনি আমেরিকানদের সঙ্গে সাবলীলভাবে কথা বলতেন। সে সময় থেকেই তিনি নিজেকে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে দাঁড় করান। ইসরায়েলের একজন হবু নেতার জন্য এই দক্ষতা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। 

কয়েক দশক ধরে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তাঁর ভোটারদের এই বার্তা দিয়ে আসছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের মধ্যকার সব ধরনের গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ক্ষেত্রে তিনিই একমাত্র বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তি।

কিন্তু বাস্তব অবস্থাটা এখন কী দাঁড়াল?  চার দশকের বেশি সময়ের মধ্যে বাইডেনই প্রথম প্রেসিডেন্ট যিনি ইসরায়েলকে সামরিক সহায়তা দেওয়া বন্ধ করলেন। (১৯৮২ সালে ইসরায়েলের লেবানন অভিযানের সময় রোনাল্ড রিগ্যান যুদ্ধবিমান দিতে বিলম্ব করেছিলেন।) বাইডেন কেন এটা করলেন? কারণ, নেতানিয়াহু যুক্তরাষ্ট্রের একটি অংশের জনগোষ্ঠীর মধ্যে এমন তিক্ততা তৈরি করেছেন, যেটা আগে দেখা যায়নি।

ইসরায়েলের প্রতি যে যুক্তরাষ্ট্রের সমাজের নিরেট সমর্থন, তাতে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যেভাবে ছাত্র আন্দোলন আছড়ে পড়েছে, সেটা বিস্ময়করই। আন্তর্জাতিক জরিপ সংস্থা গ্যালাপের মার্চ মাসের জরিপ বলছে, ৫১ শতাংশ ইসরায়েলের পক্ষে সমর্থন দিয়েছে, ২৭ শতাংশ সমর্থন দিয়েছে ফিলিস্তিনের পক্ষে। কিন্তু ডেমোক্র্যাট ও তরুণ জনগোষ্ঠী—দুই ক্ষেত্রেই ফিলিস্তিনিদের পক্ষে সমর্থন অনেকটাই বেড়েছে।

জরিপের এই তথ্য বাইডেন ও তাঁর নির্বাচনী প্রচারণা দলকে চিন্তার মধ্যে ফেলেছে। এই অংশের দ্ব্যর্থহীন সমর্থনই ২০২০ সালের নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে পরাজিত করতে ভূমিকা রেখেছিল। গাজাবাসীর দুর্ভোগ সেই ভোটারদের সমর্থন অনিশ্চিত করে তুলেছে। হোয়াইট হাউস নেতানিয়াহুর কাছে পরিকল্পনা চেয়েছিলেন, বেসামরিক জনসাধারণকে হতাহত না করে কীভাবে রাফায় অভিযান করতে পারে ইসরায়েল। 

কিন্তু নেতানিয়াহু সেই পরিকল্পনা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। সেই কারণে ইসরায়েলকে থামানোর জন্য অস্ত্রের চালান আটকে দেওয়ার সরাসরি পথ বেছে নিয়েছে ওয়াশিংটন।

রাফা বাইডেনের জন্য শক্তি পরীক্ষার জায়গাও হয়ে উঠেছে। বাইডেন রাফাকে বিপদরেখা হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন। নেতানিয়াহু যদি সেই বিপদরেখা অতিক্রম করেন, তাহলে বাইডেন দুর্বল হিসেবে চিহ্নিত হবেন।

কিন্তু নেতানিয়াহু এখন পর্যন্ত রণেভঙ্গ দিতে অস্বীকার করেছেন। ইসরায়েলের স্বাধীনতা আন্দোলনকে সামনে রেখে জনগণের উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র ছাড়া আমরা একাই লড়ে যাব। প্রয়োজনে আমরা আমাদের নখ দিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাব।’ 

নেতানিয়াহু চার্চিলের মতো আওয়াজ তুলতে চাইছেন। কিন্তু তাঁর কথাগুলো দুর্বলের কণ্ঠস্বর, সবলের নয়। ওয়াশিংটন চায়, নেতানিয়াহু যেন রাফা অভিযান থেকে সরে আসেন। কিন্তু জোট সরকারের অতি ডানপন্থী মিত্ররা তাঁকে আরও কঠোর হতে বলছেন, রাফা অভিযানের মাধ্যমে হামাসের বিরুদ্ধে পুরোপুরি বিজয়ের জন্য বলছেন।

এই নিরানন্দ নাটকে বাইডেন ও নেতানিয়াহুই কেবল কুশীলব নন; হামাস নেতা ইয়াহিয়া সিনাওয়ারেরও নিজস্ব হিসাব-নিকাশ আছে, নেতা হিসেবে টিকে থাকার সংকল্প রয়েছে। খুব ঘনিষ্ঠভাবে যাঁরা সিনাওয়ারকেও পাঠ করেছেন তাঁরা বিশ্বাস করেন, নির্দোষ মানুষের জীবন রক্ষা করা তাঁর অগ্রাধিকার নয়; বরং যত বেশি গাজাবাসী নিহত হবেন, আন্তর্জাতিক পরিসরে তাঁর শত্রু ইসরায়েলে অবস্থান ততই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সেই পরিস্থিতি তাঁকে বিজয়ী দাবি করতে সহায়তা করবে। সম্প্রতি হামাস যুদ্ধবিরতি চুক্তি মেনে নেওয়ার ঘোষণার পেছনে সিনাওয়ারের এই ভাবনায় কাজ করেছে। 

সিনাওয়ারা সাময়িক কোনো যুদ্ধবিরতি (তাতে অনেক মানুষের প্রাণরক্ষা হয়, দুর্ভোগ কমে) চান না, তিনি চান স্থায়ী যুদ্ধবিরতি। আর তার জন্য সিনাওয়ারা অপেক্ষা করতেও রাজি।

গাজা নিয়ে কোনো চুক্তি হচ্ছে না। কেননা, নেতানিয়াহু কিংবা সিনাওয়ারা কেউই বিশ্বাস করেন না, চুক্তি করলে তাঁদের স্বার্থ রক্ষিত হয়। যেমনটা যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক কর্মকর্তা অ্যারন ডেভিড মিলার বলেছেন, ‘এই সংঘাত বন্ধে একটি পক্ষেরই কেবল সত্যিকারের তাড়া আছে, সেই পক্ষটি হলেন জো বাইডেন।’


জনাথন ফ্রিডল্যান্ড, ব্রিটিশ গণমাধ্যম গার্ডিয়ানের খ্যাতিমান কলামিস্ট

মতামত এর আরও খবর