টেকসই উন্নয়ন বঞ্চিত মৌলভীবাজারঃ

img

একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল স্থাপন কতদূর?

প্রকাশিত :  ১৩:৩১, ১৩ জুলাই ২০২১
সর্বশেষ আপডেট: ১৪:৪৬, ১৩ জুলাই ২০২১

একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল স্থাপন কতদূর?

|| ডা: নিজাম আহমেদ চৌধুরী ||

গত কিছুদিন যাবত মৌলভীবাজার জেলায় একটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ব্যাপারে ব্যাপকভাবে আলোচনা-সমালোচনা চলছে এরই প্রেক্ষিতে তথ্য-উপাত্তসহ আমার এই উপস্থাপনা।

স্বাধীনতা-উত্তর বহত্তর সিলেট রাজনৈতিক অঙ্গনে অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তিদের জন্ম দিলেও উন্নয়নের দিক থেকে বৃহত্তর সিলেট ছিল অবহেলিত।নব্বই দশক পর্যন্ত দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থা খুব একটা মজবুত ছিল না। অর্থনৈতিক দুর্বলতা মধ্যে নব্বই দশক পর্যন্ত দেশের যোগাযোগ ও অবকাঠামোগত বিভিন্ন উন্নয়ন হলেও সিলেট বিভাগ  কিছুটা বঞ্চিত ছিল। তখন বড় আকারের প্রাপ্তি বলতে ১৯৮৬ সালে এরশাদ সরকারের সফল কূটনীতিবিদ ও সাংসদ (পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে সিলেট-১ আসন থেকে নির্বাচিত হয়ে জাতীয় সংসদের স্পিকারের দায়িত্ব পালন করেন) শিক্ষিত, মার্জিত সিলেটের সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী প্রচেষ্টায় সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়। এমনিতেই এমসি কলেজ শিক্ষার দিক দিয়ে সিলেটকে বৃহত্তর সিলেটের অন্যান্য জেলা গুলোর তুলনায় পার্থক্য তৈরী করে রাখে। যার প্রমাণ দেশের সামরিক- বেসামরিক প্রশাসনের উচ্চপদে বৃহত্তর সিলেটের এই অঞ্চলের মানুষের পদচারণা বেশি ছিল। পরবর্তীতে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সিলেটের পরিবারগুলোর মধ্যে শিক্ষা-দীক্ষার ব্যাপারে আমূল পরিবর্তন আনে।

নব্বই দশক পর্যন্ত মৌলভীবাজার সদর আসন থেকে বিভিন্ন সময়ে গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী, আজিজুর রহমান ও সাইফুর রহমান সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরশাদ সরকারের শাসনামলে ১৯৮৪ সালে মৌলভীবাজার মহকুমাকে জেলায় উন্নীত করে কিছু প্রশাসনিক ভবন নির্মাণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থার কিছু উন্নয়ন কাজ ও রুটিন কাজ ব্যতীত স্বাধীনতা-পরবর্তী থেকে নব্বই দশক পর্যন্ত চোখে পড়ার মতো এ জেলায় কোনো উন্নয়ন হয়নি। তৎকালীন সময়ে এ জেলার নেতৃবৃন্দ এবাদুর রহমান চৌধুরী, আজিজুর রহমান, গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী, নবাব আলী আব্বাস সহ সকল নেতৃবৃন্দ ছিলেন জনবান্ধব। তারা দলীয় কর্মকান্ড, মানুষের ব্যক্তিগত-পারিবারিক সমস্যার সমাধান, চাকরি, বেসরকারি উন্নয়নে সুপারিশ ও সহযোগিতা, রুটিন উন্নয়ন কাজ, ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠান সহ অন্যান্য জনহিতকর কাজে নিজেদের নিয়োজিত রাখতেন। এরা সকলেই নিজেদের পকেটের পয়সা খরচ করে রাজনীতি করেছেন, রাজনীতি করে পকেটে পয়সা আনেননি।

৯০ এর পট পরিবর্তনের পর মৌলভীবাজার ৩ আসন থেকে পরাজিত এম সাইফুর রহমান টেকনোক্রেট কোটায় বিএনপি সরকারের অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। প্রভাবশালী এই মন্ত্রী দায়িত্ব পেয়ে বিএনপিকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি জেলায় প্রচুর উন্নয়ন কাজ শুরু করেন। তার উন্নয়নের ছোঁয়ায় মৌলভীবাজার জেলায় (৪ টি নির্বাচনী আসনে সমানতালে) রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজ ও প্রশাসনিক বিভিন্ন অফিস-আদালতের নতুন নতুন ভবন নির্মিত হতে থাকে। তখনকার সময়ে বৃহত্তর সিলেটের অন্য জেলার মানুষ জন মৌলভীবাজারে আসলে রাস্তাঘাট দেখে ঈর্ষান্বিত হত। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমানের চেষ্টায় মৌলভীবাজার একটি সাজানো গোছানো শহরে রূপ লাভ করে।

প্রবাসী অধ্যুষিত এ জেলার বেশিরভাগ তরুণেরই এক সময়ের স্বপ্ন হয়ে উঠে ইংল্যান্ড/আমেরিকায় মাইগ্রেশন, একইভাবে অভিভাবকরাও একটি নিরাপদ সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য নিজেরা ত্যাগ স্বীকার করেও সন্তানদের বিদেশমুখী করে দেন। এ কারণে এলাকার মানুষজন তাদের নিজ এলাকায় উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠুক তা নিয়ে তাদের তেমন কোন মাথা ব্যাথা ছিল না। না হলে ১৯৯২  সালে বগুড়া, দিনাজপুর, ফরিদপুর ও খুলনায় নতুন চারটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অনুমোদন লাভ করে। জেলার নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ জন একটু স্বাস্থ্য-শিক্ষা সচেতন হলেই তখনই প্রভাবশালী মন্ত্রী এম সাইফুর রহমান এর মাধ্যমে একটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল স্থাপন করা যেত (যেহেতু তখন সমগ্র সিলেট অঞ্চলে একটি মাত্র মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ছিল)। তখনকার সময়ে নব্য জাতীয়তাবাদী আদর্শের কিছু স্বার্থান্বেষী মহল সাইফুর রহমানের আশেপাশে ঘুরঘুর,করতেন,ক্ষমতার সুযোগে তারা তাদের নিজেদের আখের গুছিয়ে নিয়েছেন।এলাকাবাসীর বৃহত্তর স্বার্থে প্রিয় নেতাকে কোন সুপরামর্শ দেওয়ার মতো যোগ্যতা তাদের ছিল না।

পরবর্তীতে ৯৬ নির্বাচনে ক্ষমতার পট পরিবর্তনে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসে, যদিও মৌলভীবাজার ৩ নং আসন থেকে জনাব এম সাইফুর রহমান সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। মৌলভীবাজার জেলা থেকে প্রভাবশালী হিসেবে আবির্ভূত হন শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জ থেকে নির্বাচিত উপাধ্যক্ষ আব্দুস শহীদ এমপি। মৌলভীবাজারে তখন ব্যাপক হারে শুরু হয় দলীয় কোন্দল। পূর্বের চলমান উন্নয়ন কাজগুলো সমাপ্ত ও রুটিন উন্নয়ন কাজ ছাড়া স্তিমিত হয়ে পড়ে উন্নয়নের দৌড়। একইভাবে সিলেটে দেশ কাঁপানো হেভীয়েট আওয়ামী লীগ নেতা সামাদ আজাদ ও সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের কোন্দলে পরে চোখে পড়ার মতো কোনো উন্নয়ন হয়নি। বরং কোন উন্নয়ন প্রকল্প আসলে কোন্দলের জেরে তাও স্তিমিত হয়ে যেত। বাংলাদেশের জাদরেল এই দুই নেতা তাদের নিজের এলাকা সুনামগঞ্জের জন্যই তেমন কিছু করে যাননি। এ সময় স্পিকারের দায়িত্ব পালন করা হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী একান্ত প্রচেষ্টায় সিলেট আধুনিক রেলস্টেশনের প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়, যদিও তা কোন্দলের জেরে অনেক বাধার সম্মুখীন হয়েছিল।

মৌলভীবাজার বাসীর জন্য তখন আবার একটি বড় দুঃসংবাদ হয়ে আসে ঢাকা সিলেট মহাসড়ক মৌলভীবাজার শহরকে পাশ কাটিয়ে হবিগঞ্জ থেকে শেরপুর হয়ে সিলেট পৌঁছে যাবে। হাইওয়ে থেকে বাদ যাওয়ায় মৌলভীবাজারের অর্থনীতি বিরাট ধাক্কা খায়, যদিও সার্বিকভাবে মৌলভীবাজার ও শ্রীমঙ্গল শহরকে পাশ কাটানোতে ঢাকা-সিলেট হাইওয়ের দূরত্ব এবং ঝুঁকি দুটোই কমে আসে।

আবার ক্ষমতার পালাবদল ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জনাব এম সাইফুর রহমান পুনরায় মৌলভীবাজার ৩(সদর আসন) সিলেট ১ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং তার দল বিএনপি সরকার গঠন করে। মর্যাদাপূর্ণ সিলেট ১ আসন রেখে মৌলভীবাজার ৩ আসন উনি ওনার ছেলে এম নাসের রহমানকে ছেড়ে দেন। দ্বিতীয়বারের মতো বিএনপি সরকারের ক্ষমতা কালীন সময়ে অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে তিনি সরকারের প্রভাবশালী নীতিনির্ধারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। মন্ত্রিত্বের দায়িত্ব নিয়েই তিনি সিলেটের উন্নয়নে ঝাঁপিয়ে পড়েন।

আমি নিজে ২০০১ সালে মেডিকেল শিক্ষার উদ্দেশ্যে মৌলভীবাজার থেকে যখন সিলেটে আবাস গড়ি, তখন আমার চোখে মৌলভীবাজার- সিলেটের মধ্যে খুব একটা পার্থক্য ছিল না বরং রাস্তাঘাটের দিক দিয়ে মৌলভীবাজারের রাস্তা ছিল প্রশস্ত ও উন্নত। সাইফুর রহমানের ছোঁয়ায় বদলে যেতে শুরু করে সিলেট। সুরমা নদীর উপর কয়েকটি ব্রিজ, অসংখ্য নতুন নতুন রাস্তা, স্কুল কলেজের নতুন নতুন ভবন, নতুন নতুন প্রশাসনিক ভবন, নতুন সার্কিট হাউজ, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ (যা পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর হওয়ার কথা ছিল), বিভিন্ন ধর্মীয় স্থাপনালয়ে উন্নয়ন কাজ। নিজের স্বচক্ষে দেখেছি রাস্তাঘাটের একই সাথে এত উন্নয়ন চলছিল যে তখন মনে হতো ধ্বংসস্তুূপে বাস করছে সিলেটবাসী। উন্নয়নের ছোঁয়ায় বদলে যায় সিলেটের জীর্ণশীর্ণ রাস্তাগুলো, পুরাতন সার্কিট হাউজ ও তার সংলগ্ন কিন ব্রিজ এলাকার ময়লার ভাগার, শোকরের আস্তানা, সুইপার কলোনি সরিয়ে নান্দনিক রূপ দেয়া হয়। 

ঠিক এরকম ভাবেই বদলে যায় সিলেটের আরো অনেক স্থান। তখন মন্ত্রী সিলেট আসলে সকালবেলা সার্কিট হাউস থেকে নিজে হেঁটে হেঁটে উন্নয়ন কর্মকান্ড দেখতেন। তৎকালীন সময়ে এও বলতে শোনা যেত উন্নয়ন কর্মকান্ডের কোন ফাইল পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে গেলে সাথে যদি বৃহত্তর সিলেটের কোন প্রকল্প না থাকতো উনি পরোক্ষভাবে ফাইল ফেরত দিতেন। সিলেটে একটি গ্রুপ ছিল যারা সাইফুর রহমান এর কাজ থেকে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্প আদায় করে নিতেন। আরিফুল হকের মত কর্মদক্ষ, উদ্যমী তরুণ কর্মী ছিলেন যিনি সাইফুর রহমানের সাথে থেকে সিলেটের উন্নয়নের তদারকিতে দিনরাত ছুটে বেড়াতেন, মন্ত্রীর অনুপস্থিতিতে তিনি সমস্ত উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড তদারকি করতেন। সিলেট সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর হয়ে মন্ত্রীর ছত্রছায়ায় অদৃশ্য এক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন এবং তিনি তাঁর ক্ষমতা সিলেটের উন্নয়নে কাজে লাগিয়েছেন। মন্ত্রীর হাত ধরে শেখানো পথে তিনি আজও ছুটে চলছেন নিজের মেধা মনন ও বুদ্ধিমত্তা কে কাজে লাগিয়ে বিরোধী দলে থেকেও সিটি কর্পোরেশনের মেয়র হিসেবে সিলেট সিটি কে আধুনিক, পরিবেশবান্ধব, জনবান্ধব সিটিতে রূপান্তরে দিনরাত পরিশ্রম করে চলছেন।

তৎকালীন সময়ে সাইফুর রহমান এর হাত ধরে শুধু সিলেট নয় সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জেও উন্নয়নমূলক কাজ হয়। সাইফুর রহমান তার মৌলভীবাজারের গন্ডি ছাড়িয়ে হয়ে উঠেন সিলেট বিভাগের নেতা, উন্নয়নের রূপকার। মন্ত্রী নিজে সিলেট নিয়ে মহাব্যস্ত সাথে থাকা নেতাকর্মীরাও উনার কাছ থেকে একের পর এক প্রকল্প পাস করিয়ে নিচ্ছে, স্বাস্থ্য, শিক্ষা,যোগাযোগ সবক্ষেত্রেই উন্নয়নের ছোঁয়ার পাশাপাশি বেসরকারি ভাবে নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে থাকে। গড়ে ওঠে বিশাল আকার মার্কেট, বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বিশ্ববিদ্যালয় বদলে যায় সিলেট।

অপরদিকে মৌলভীবাজারে দলীয় কোন্দল, সংসদের গ্রহণযোগ্যতা, ক্ষমতা ঘেষা নেতাকর্মীদের দূরদর্শিতার অভাব সর্বোপরি মন্ত্রীর নজর কম পড়া সবকিছু মিলিয়ে গ্রামাঞ্চলে কিছু রাস্তাঘাট নির্মাণ অন্যান্য কিছু ছোটখাটো উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়। যার বেশিরভাগই ছিল নির্বাচনকেন্দ্রিক। টেকসই উন্নয়ন বলতে যা বুঝায় সেরকম উন্নয়ন তখন হয়নি। শহর বাঁচাতে হলে একটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং একটি বিশ্ববিদ্যালয় তখনই বাস্তবায়ন করার সুবর্ণ সময় ছিল। শুধুমাত্র সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের কোন্দল, সমন্বয়হীনতা এবং দূরদর্শিতার অভাবে, সুযোগ থাকা সত্ত্বেও মৌলভীবাজারবাসী তা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। তৎকালীন সময়ে যারা সাইফুর রহমানের আস্থাভাজন ছিলেন তারা এলাকার স্বার্থ থেকে নিজের স্বার্থ হাসিলে বেশি ব্যস্ত ছিলেন, অযোগ্য ও অদূরদর্শী ছিলেন। ক্ষমতার শেষ পর্যায়ে এসে হঠাৎ নেতাকর্মীদের ঘুম ভাঙলো, মনে হলো একটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল  দরকার। সাইফুর রহমান নেতাকর্মীদের ভৎসর্না করলেন। মেডিকেল কলেজে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ না পেলেও পরবর্তীতে কোন সময়ে যাতে একটি মেডিকেল কলেজের অনুমোদন নেয়া যায়, সেজন্য উনি মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালকে ২৫০ শয্যায় উন্নীত ও অবকাঠামো নির্মাণের সকল ধরনের ব্যবস্থা করে গেলেন এবং উনার নিজ উদ্যোগে শমশেরনগর রোডে একটি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট নির্মাণ প্রকল্প পাশ করিয়ে ভিক্তি প্রস্তর স্থাপন করে যান।

তার পরের ইতিহাস সবারই জানা। ক্ষমতায় এলো ১/১১ সরকার। দু’বছর পর একটি নির্বাচন দিল। সে নির্বাচনে এম সাইফুর রহমান সিলেট ১ এবং মৌলভীবাজার ৩ দুটি আসনে পরাজিত হলেন। মৌলভীবাজার থেকে নির্বাচিত হলেন তৃণমূল থেকে উঠে আসা জনবান্ধব নেতা জনাব সৈয়দ মহসীন আলী (পরপর তিনবার নির্বাচিত সাবেক পৌর চেয়ারম্যান)। আর সিলেট ১ আসনে তিনি হেরে যান সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবুল মুহিতের কাছে। এর কিছুদিন পরেই এক সড়ক দুর্ঘটনায় এম সাইফুর রহমান নিহত হন। সিলেট এবং মৌলভীবাজারে তার জানাজায় লাখো মানুষের উপস্থিতিতে, নারী পুরুষ কান্না, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় বৃহত্তর সিলেটবাসী তাদের প্রিয় নেতাকে শেষ বিদায় জানায়। শেষ হয় সাইফুর রহমান যুগের।

আওয়ামী লীগ সরকারের অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পান আবুল মাল আবুল মুহিত। বিভাগীয় শহর হিসেবে উন্নয়নের গতি মোটামুটি চলমান থাকে। আর কিছুদিন পরেই সিলেট সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মেয়র হিসেবে জয়লাভ করেন সাইফুর রহমানের ডানহাত হিসেবে খ্যাত জনাব আরিফুল হক চৌধুরী। তিনি তার নিজস্ব বুদ্ধিমত্তা এবং প্রশাসনিক জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে বিরোধীদলে থেকেও অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতকে আস্থায় নিয়ে এসে সিটি কর্পোরেশন এলাকা উন্নয়নে ঝাঁপিয়ে পড়েন, এখনো যে উন্নয়ন চলমান। অপরদিকে মৌলভীবাজার সদর আসন থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য কে পাশ কাটিয়ে পার্শ্ববর্তী এক সংসদ প্রভাবশালী ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। মিছিল-মিটিংয়ে মারামারি-হানাহানি, তোরন ভাঙ্গা সহ রাজনৈতিক ফ্যাসাদ লেগেই থাকে। রাজনৈতিক কোন্দল মৌলভীবাজারে উন্নয়নকে স্তিমিত করে ফেলে। সেই নেতার অদৃশ্য ইশারায় মৌলভীবাজার সদরের বিভিন্ন প্রকল্প কাটছাঁট করে নিজ এলাকায় নিয়ে যেতেন। মরহুম সাইফুর রহমান মৌলভীবাজার থেকে উঠে এসে উন্নয়নের মাধ্যমে নিজ যোগ্যতায় সমগ্র সিলেট বিভাগের নেতায় পরিণত হন, অন্যদিকে আওয়ামী লীগের তত্কালীন সেই প্রভাবশালী নেতা নিজের সংকীর্ণমনার কারণে মৌলভীবাজারবাসির বিরাগভাজন এ পরিণত হন। আওয়ামী সরকারের দ্বিতীয় দফার শাসনামলে ২০১১ ও ২০১২ সালে মোট ৬ ছয়টি সরকারি মেডিকেলের অনুমোদন দেয়া হয়। যেহেতু ইতিমধ্যেই মৌলভীবাজার সদর হাসপাতাল ২৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয় সেহেতু দেশে নতুন যেকোনো মেডিকেল কলেজ স্থাপনে অগ্রাধিকার পাবে মৌলভীবাজার কারণ একটি মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত ২৫০ শয্যার হাসপাতাল। তখনকার সময়ে সেই প্রভাবশালী নেতার অদৃশ্য অনীহা, কোন্দল এবং লোকাল সংসদের কেন্দ্রে লবিংয়ের দুর্বলতাই এর কারণ।

২০১৪, আবারো আওয়ামী লীগ সরকার নির্বাচিত হয়। মৌলভীবাজার ৩ আসন (সদর) থেকে পুনরায় নির্বাচিত হয়ে জনাব সৈয়দ মহসীন আলী ১২ ই জানুয়ারি সরকারের মন্ত্রিসভায পূর্ণমন্ত্রী হিসেবে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। মৌলভীবাজারবাসি আশায় বুক বাঁধে, এবার হয়তো তাদের এলাকায় একটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন হবে। দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় গ্রহণ করেই আবারও নতুন করে ৬ ছয়টি সরকারি মেডিকেল কলেজের অনুমোদন দেয়। এ বারও আশায় গুড়েবালি। মন্ত্রীর অতিরিক্ত সংস্কৃতি প্রেমী মনোভাব, জনবান্ধব নেতা হলেও নিজের এলাকার টেকসই উন্নয়নে করণীয় কি এ সম্পর্কে অজ্ঞতা অথবা উদাসীনতার কারণে আবারো মৌলভীবাজারবাসী বঞ্চিত হয়। নিজের ব্যর্থতা এবং মৌলভীবাজারবাসীর দাবীর মুখে তিনি আশ্বস্ত করেন অচিরেই এলাকার না পাওয়ার হতাশা তিনি লাঘব করে দিবেন। আশ্বাসকে অপূর্ণ রেখেই ১৪ই সেপ্টেম্বর ২০১৫ ইং তৃণমূলের আস্থাস্থল, গরিবের বন্ধু, স্পষ্টভাষী, আগাগোড়া আওয়ামীলীগ মহান মুক্তিযোদ্ধা হঠাৎ মৃত্যু বরণ করেন। সৈয়দ মহসিন আলীর মৃত্যুর পর ২৩ শে নভেম্বর ২০১৫ ইংরেজি এই আসন থেকে উপনির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তারই সহধর্মিনী সৈয়দা সায়েরা মহসীন। এই সরকার আবারও দেশে বেশ কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং শেষ দিকে এসে আরো ৫ টি সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অনুমোদন দেয়। এবারও মৌলভীবাজার বঞ্চিত। 

হবিগঞ্জের নেতৃবৃন্দরা জোর লবিং চালিয়ে হবিগঞ্জ একটি সরকারি মেডিকেল কলেজের অনুমোদন পাশ করিয়ে নেন। ২০১৮তে একসাথে আরো ৬ ছয়টি সরকারি মেডিকেল কলেজ যাত্রা শুরু করে। সরকারের উচ্চ পর্যায মৌলভীবাজারের থেকে কোন নেতার সরব উপস্থিতির অভাব, সদর আসনের সংসদ সদস্যের সংসদে নিরব উপস্থিতি, দলীয় কোন্দল, উচ্চপর্যায়ের লবিংয়ের অভাবের খেসারত আবারও মৌলভীবাজার বাসীকে গ্রহণ করতে হলো।

মৌলভীবাজারের নেতৃবৃন্দরা বারবার যখন ব্যর্থ হচ্ছে তখন পার্শ্ববর্তী জেলা হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জের সাংসদরা তাদের এলাকায় উন্নয়নের জোয়ার বইয়ে দিচ্ছেন। সুনামগঞ্জ থেকে নির্বাচিত সাংসদ জনাব এম এ মান্নান ২০১৪থেকে ২০১৯ পর্যন্ত অর্থ প্রতিমন্ত্রী এবং ২০১৯ থেকে এখন পর্যন্ত পরিকল্পনা মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। তার মন্ত্রিত্বকালীন সময়ে থেকে এখন পর্যন্ত তিনি সুনামগঞ্জে উন্নয়নের জোয়ার বইয়ে দিচ্ছেন। সুনামগঞ্জে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, রাস্তাঘাট,২০২০ সালে মেডিকেল কলেজের অনুমোদন (চলতি বছর থেকে ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি শুরু হয়ে গিয়েছে), অতিসম্প্রতি তিনি চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন সিলেট থেকে সুনামগঞ্জ পর্যন্ত নতুন রেললাইন স্থাপন। পিছিয়ে পড়া হাওর এলাকায় মানুষগুলোকে তিনি নতুন স্বপ্ন দেখাচ্ছেন। সাথে সুনামগঞ্জ সদর আসন থেকে নির্বাচিত বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্য পীর মিসবাহউর রহমান এলাকার উন্নয়নের দাবি-দাওয়া নিয়ে এলাকায় এবং সংসদে জোরালো ভূমিকা রাখছেন। তাদের সকলের প্রচেষ্টায় বদলে যাচ্ছে সুনামগঞ্জ, বদলে যাচ্ছে হাওরবাসীর ভাগ্য।

৩০শে ডিসেম্বর ২০১৮ইং জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মৌলভীবাজার সদর আসন (৩ নং) থেকে নির্বাচিত হয়ে আসেন জনাব নেছার আহমদ। তিনি নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে জাতীয় সংসদে মৌলভীবাজারে একটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে কয়েকবার প্রস্তাবনা দিয়েছেন। উনার চেষ্টায় অতিসম্প্রতি মৌলভীবাজারে একটি টেক্সটাইল কলেজ স্থাপনের অনুমোদন হয়েছে। (মৌলভীবাজারবাসী তা সান্ত¡নাসূচক প্রাপ্তি হিসেবে ধরে নিয়েছে)। মৌলভীবাজার-হবিগঞ্জ আসনের মহিলা আসনের সংসদ জনাব সৈয়দা জোহরা আলাউদ্দিন ও এলাকার উন্নয়নের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

পার্শ্ববর্তী জেলা সুনামগঞ্জে এত এত উন্নয়ন, অতি সম্প্রতি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন, তড়িৎগতিতে সরকারি মেডিকেল কলেজের কার্যক্রম শুরু, হবিগঞ্জে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন, সরকারি মেডিকেল কলেজের যাত্রা বিগত ৩ বছর থেকে চলমান Ñ এই সবকিছু দেখে মৌলভীবাজারবাসি ক্ষুব্ধ ও হতাশাগ্রস্থ। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে আমাদের ব্যর্থতা অথবা আমাদের নেতৃবৃন্দের ব্যর্থতায় আমরা অন্যের উন্নয়নে ক্ষুব্ধ হতে পারি না। আমরা ক্ষুব্দ হব আমাদের নিজেদের বোকামীর জন্য, শিক্ষার মর্ম উপলব্ধি করতে না পারার জন্য, নিজেদের অধিকার আদায়ে উদাসীন হওয়ার জন্য এবং সর্বোপরি আমাদের নেতৃবৃন্দের অদক্ষতা ও ব্যর্থতার জন্য।

নতুন করে বলা হচ্ছে এ গ্রেডের মর্যাদাপ্রাপ্ত মৌলভীবাজারে উপজেলার সংখ্যা ন্যুনতম ৮ টি (বর্তমানে ৭টি উপজেলা) না হলে মেডিকেল কলেজের অনুমোদন দেয়া হবে না। গত কয়েক বছরের কয়েকটি জেলায় সরকারি মেডিকেল কলেজের অনুমোদন এর দিকে তাকালেই এর সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে! ২০১১ সালে নতুন মেডিকেল কলেজের অনুমোদন প্রাপ্ত গোপালগঞ্জ ও সাতক্ষীরায় উপজেলার সংখ্যা ৭ টি, ২০১৪ সালে নতুন অনুমোদন প্রাপ্ত জামালপুর ও রাঙ্গামাটি জেলায়ও উপজেলার সংখ্যা ৭টি। ২০১৮ সালে অনুমোদনপ্রাপ্ত নীলফামারী ও মাগুরা জেলায় উপজেলার সংখ্যা যথাক্রমে ৬ ও ৪ টি।

সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান যখন মন্ত্রী ছিলেন সেই সময়টা সুবর্ণ সময় ছিল একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল অনুমোদনের। একটি এলাকার শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ ও শিল্পক্ষেত্রে উন্নয়ন হলে সেই উন্নয়ন হয় টেকসই। যেই টেকসই উন্নয়ন হচ্ছে এখন সুনামগঞ্জে। তৎকালীন সময়ে উন্নয়ন হলেও সেই উন্নয়ন টেকসই হয়নি যার খেসারত এখনো মৌলভীবাজার বাসি দিচ্ছে। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা সুবাদে সারাদেশব্যাপী ব্যাপক উন্নয়ন হচ্ছে পদ্মা সেতু, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মেট্রোরেল, শিল্প জোন সহ বড় বড় মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে বদলে যাচ্ছে দেশের অর্থনীতি বদলে যাচ্ছে দক্ষিণাঞ্চল বদলে যাচ্ছে হাওর অঞ্চল, শুধু বদলাচ্ছি না আমরা। এ থেকে উত্তরণ ঘটাতে হলে আমাদের সকল জনপ্রতিনিধিদের এলাকার উন্নয়নের ব্যাপারে দল-মত-নির্বিশেষে এক হতে হবে।এখন পর্যন্ত ১১টি সংসদ নির্বাচনে সদর আসন থেকে বেশিরভাগ সময় আওয়ামী লীগ জয়লাভ করেছে।সুতরাং এলাকাবাসী অবশ্যই বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের কাছে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও একটি সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল স্থাপনের দাবি করতেই পারে। আমাদের আশার কথা মৌলভীবাজারে ইতিমধ্যে মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল স্থাপনের জন্য ২৫০ শয্যার হাসপাতাল দরকার তা আমাদের বিদ্যমান আর নিরাশার কথা সিলেট বিভাগের চারটি জেলায় মধ্যে ইতিমধ্যে তিনটি জেলায় সরকারি মেডিকেল কলেজের অনুমোদন প্রাপ্ত হয়েছে। বাংলাদেশের কোন বিভাগে এখন পর্যন্ত সব কটি জেলায় মেডিকেল কলেজ স্থাপনের নজির নেই। তারপরও আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যদি নেতৃবৃন্দ স্থানীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে এলাকার বৃহত্তর স্বার্থ চিন্তা করে সবাই এক হয়ে মাঠে নামেন অবশ্যই মৌলভীবাজারবাসি একটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং যে কোন প্রকারের একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন লাভ করবে। আর এক্ষেত্রে মৌলভীবাজার সদর হবে (বিশেষ করে মৌলভীবাজার - শ্রীমঙ্গলের এর মাঝামাঝি স্থান) উপযুক্ত স্থান।

 এমনিতেই সিলেট বিভাগের চারটি জেলার মধ্যে শিক্ষার দিক দিয়ে মৌলভিবাজার জেলা সবচেয়ে পিছিয়ে আছে। এর প্রমাণ শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নরত সিলেট অঞ্চলের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে খুব কমসংখ্যকই মৌলভীবাজারের। বিসিএস/সরকারি চাকরির প্রতি অনীহার কারণে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মরত কর্মকর্তাদের মধ্যে মৌলভীবাজারবাসীর সংখ্যা খুবই নগণ্য। এর অন্যতম কারণ তরুণÑতরুণী এবং অভিভাবক উভয়ের বিদেশমুখিতা। বিদেশমুখীতার কারণে তৈরি হচ্ছে জেনারেশন গ্যাপ, রাজনীতিতে দক্ষ নেতৃত্বের অভাব, প্রশাসন ক্যাডারের নিজেদের উপস্থিতির অভাব।একটি মেডিকেল কলেজ ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হলেই এলাকার সব তরুণরা উচ্চ শিক্ষিত হয়ে যাবে এমন কোন কথা নেই। তবে বিভিন্ন এলাকার শিক্ষার্থীরা যখন এসব প্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা করতে আসবে পরোক্ষভাবে এর প্রভাব পড়বে আমাদের তরুণ-তরুণীদের উপর যার ফলে মৌলভীবাজারে শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আসবে। ঠিক তেমনি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল স্থাপিত হলে সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার যেমন উন্নতি হবে তেমনি বেসরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা ব্যাপক অগ্রগতি হবে। এর ফল ভোগ করবে এলাকাবাসী।

দল মত নির্বিশেষে সকল রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সুশীল সমাজ, সাংবাদিক, পেশাজীবী, প্রবাসী ও সরকারের উচ্চ পর্যায়ে কর্মরত অত্র এলাকার গুণী ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটি নাগরিক কমিটি গঠন করে এই এলাকার ন্যায্য দাবি একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও একটি সরকারি মেডিকেল কলেজ স্থাপনে কি করনীয় তা নির্ধারণ করতে হবে? আর এক্ষেত্রে চালকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে অবশ্যই সরকারদলীয় জনপ্রতিনিধিদের। সকলের সমন্বিত উদ্যোগ ইনশাআল্লাহ একদিন প্রিয় মৌলভীবাজারবাসী আলোর মুখ দেখবে।

লেখকঃ ডা: নিজাম আহমেদ চৌধুরী, চিকিৎসক ও লেখক। রেজিস্টার, শিশু বিভাগ, সিলেট উইমেন্স মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল


img

যুদ্ধ উত্তেজনায় ইরান-ইসরায়েল, কে জিতল, কে হারল?

প্রকাশিত :  ১১:৪৯, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
সর্বশেষ আপডেট: ১১:৫৬, ২৫ এপ্রিল ২০২৪

সিমন টিসডল

ইসফাহানের সামরিক ঘাঁটির কাছে ও অন্যান্য লক্ষ্যবস্তুতে গত শুক্রবার আকাশপথে ইসরায়েল যে হামলা চালায়, ইরান সেটা ততটা পাত্তা দিতে নারাজ। বাইরে থেকে হামলার বিষয়টা তেহরান অস্বীকার করেছে। 

ইসরায়েলি মুখপত্ররা আর সব বিষয়ে অনর্গল বাক্যবর্ষণ করে চললেও এ ঘটনায় অদ্ভুতভাবে নীরব। দেখেশুনে মনে হচ্ছে, ঘটনাকে গুরুত্বহীন করে তুলতে দুই পক্ষের মধ্যে যেন একটা চুক্তি হয়েছে, যাতে ধীরে ধীরে উত্তেজনার পারদ এমনিতেই নিচে নেমে যায়।

এটিকে উনিশ শতকের সেই চোরাগোপ্তা কোনো এক ডুয়েল লড়াইয়ের মতো মনে হচ্ছে; যেন দুই প্রতিদ্বন্দ্বী ইংরেজ ব্রিটেনে কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে তৃণভূমির মধ্যে পরস্পরের দিকে অবৈধভাবে পিস্তল তাক করেছে। ইরান ও ইসরায়েল দুই দেশেরই মানমর্যাদা পরিপূর্ণভাবে রক্ষা করতে হবে, কিন্তু সেটা আবার করতে হবে জনগণের মধ্যে যেন আবার চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু না হয়, সেটা মাথায় রেখে। 

দুই দেশই একে অন্যের দিকে সরাসরি হামলা করেছে। তাতে প্রতীকী ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এখন তারা এবং তাদের সাঙ্গপাঙ্গরা এই ইঙ্গিত দিচ্ছে যে খেলা শেষ, অন্তত এবারের মতো।

এটা যদি সত্যি (যদিও সম্ভাবনাটা সাময়িক সময়ের জন্য) হয়, তাহলে সেটা অনেক বড় স্বস্তির বিষয়। এ ঘটনা এই ইঙ্গিত দেয় যে সংযত হতে ইসরায়েলের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের তীব্র চাপ (যুক্তরাজ্য ও অন্য দেশগুলোও তাতে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে) কাজে এসেছে। 

গত সপ্তাহে ইসরায়েলে ইরানের অভূতপূর্ব ও বড় পরিসরে হামলার পর প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইসরায়েলের প্রতি ‘জয়টাকে ধরে রাখার’ আহ্বান জানিয়ে ছিলেন। বোঝা যাচ্ছে, এই বার্তার মর্মোদ্ধার সফলভাবেই করতে পেরেছে ইসরায়েল। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের নেতৃত্ব কখনোই কোনো বিষয়ে পুরোপুরি ঐকমত্য হতে পারে না।

অবশ্য ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ডিএনএর মধ্যেই সংযমের বালাই নেই। সাবেক এই কমান্ডো ইরানের হামলার পর সহজাতভাবেই পাল্টা শক্তি দেখাতে চেয়েছিলেন। আর তাঁর কট্টর ডানপন্থী মিত্ররা যুদ্ধের উন্মাদনা সৃষ্টি করেছিল। 

এই প্রেক্ষাপটে ইসরায়েল যে মাপা পদক্ষেপ নিয়েছে, তাতে বোঝা যায়, যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে মানাতে পেরেছে। আর ইরানের ড্রোন ও মিসাইল হামলা থেকে ইসরায়েলকে সুরক্ষা দিতে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে, সেটাও নেতানিয়াহুর পক্ষে উপেক্ষা করা সম্ভব হয়নি।

আবার ইসরায়েলের সামান্যতম উদ্‌যাপনের কোনো কারণ নেই। এটা ঠিক যে এবার ইসরায়েল ইরানের হামলা ঠেকিয়ে দিয়েছে। কিন্তু অজেয় বলে ইসরায়েলের যে সুখ্যাতি, সেটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। ইসরায়েল অভেদ্য দুর্গ বলে যে মিথ, সেটা গুঁড়িয়ে গেছে। একইভাবে গাজায় এখনো হামাসের হাতে বন্দী ১৩০ পণবন্দী রয়ে গেছে। হামাস এখনো অপরাজেয়।

অবশ্য এখানেই বিষয়টা মীমাংসা হয়ে গেল এটা ধরে নেওয়াটাও বোকামি হয়ে যাবে। রাজনৈতিক ও মতাদর্শিকভাবে গভীর বৈরিতা ইরান ও ইসরায়েল—এই দুই শত্রুকে পরস্পর থেকে আলাদা করে রেখেছে। 

দুই দেশের সরকারের মধ্যেই অভ্যন্তরীণ বিভাজন রয়েছে, যা চরম অনিশ্চয়তা ও প্ররোচনাময় পরিবেশ সৃষ্টি করছে। তারই একটা ভয়ানক নজির আমরা গত কয়েক দিনে দেখতে পেলাম। একেবারে মুখোমুখি যুদ্ধের প্যান্ডোরার বাক্সটি সরাসরি খুলে গিয়েছিল।

বছরের পর বছর ধরে দুটি দেশ যে ছায়াযুদ্ধ লড়ে যাচ্ছিল, সেই যুদ্ধ তারা সবার চোখের সামনে দিনের আলোয় নিয়ে এসেছিল। ইরান দেখিয়ে দিয়েছে যে তারা ইসরায়েলের যেকোনো জায়গায়, যেকোনো সময়, প্রত্যক্ষভাবে হোক আর পরোক্ষভাবে হোক, হামলা চালাতে সক্ষম। আর ইসরায়েল দেখাল যে তারা যদি চায়, তাহলে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালাতে সক্ষম, পরেরবারের হামলা হবে আরও ভয়াবহ।

ইসরায়েল-ইরানের এ অচলাবস্থা ফিলিস্তিন সংঘাতের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। কিন্তু ফিলিস্তিন সংকট নিরসনে কোনো ভূমিকা রাখছে না। আর ফিলিস্তিন সংকটে পশ্চিমাদের দোটানা অবস্থান আগের চেয়ে তীব্র হলো। 

যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন একপেশে, দ্বিমুখী নীতির প্রতীক হয়ে উঠলেন। গাজায় মানবিক সহায়তা পৌঁছতে তিনি প্রাণান্ত চেষ্টা করে চলেছেন, কিন্তু যুদ্ধবিরতির চেষ্টায় সমানভাবে ঢিলেমি করে যাচ্ছেন। ফলে তাঁর নীতি খুব সামান্যই সফলতার মুখ দেখছে।

এর একটা কারণ হতে পারে, ঋষি সুনাকের সরকার ইসরায়েলের কাছে অস্ত্র বিক্রির সুযোগ হাতছাড়া করতে চায় না। আরেকটি কারণ হলো, ১ এপ্রিল দামেস্কে ইরানি কনস্যুলেটে ইসরায়েলের বিমান হামলার (এই হামলায় ইরানের জ্যেষ্ঠ কয়েকজন কমান্ডার নিহত হন, ইসরায়েলে প্রতিশোধমূলক হামলা চালায় ইরান) নিন্দা জানাতে ক্যামেরন অস্বীকৃতি জানান।

জাতিসংঘ–বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইরানের কনস্যুলেটে ইসরায়েলের হামলা ছিল আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। গত সপ্তাহে ক্যামেরন অবশ্য স্বীকার করেছেন, যুক্তরাজ্যের কোনো দূতাবাসে এ ধরনের হামলা হলে তারা কঠোর ব্যবস্থা নিত। 

কিন্তু তিনি কখনোই বলবেন না, ইসরায়েল অন্যায় করেছে। এ ধরনের ইসরায়েলপন্থী অবস্থান বেশির ভাগ পশ্চিমা দেশের সরকারগুলোর চারিত্রিক অবস্থান।

হারজিতের প্রশ্নটি বড় পরিসর থেকে বিবেচনা করা হলে এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে গত সপ্তাহের ঘটনাপ্রবাহে ইউক্রেনীয়রাও সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তারা আরেকটি পশ্চিমা ভণ্ডামির শিকার। 

দুই বছরের বেশি সময় ধরে কিয়েভ ন্যাটোর কাছে আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ও মিসাইল প্রতিরক্ষাব্যবস্থা চেয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তাদের সেই চাওয়া বৃথা পর্যবসিত হয়েছে।

অথচ ইরান যখন ইসরায়েলে ড্রোন ও মিসাইল হামলা করল, তখন পশ্চিমা দেশগুলো তেল আবিবের সুরক্ষা দিতে কী না করেছে। ইরান ৩০০ ড্রোন ও মিসাইল ছুড়লেও প্রায় অক্ষত থাকে ইসরায়েল। অথচ প্রতি সপ্তাহে রাশিয়া সমানসংখ্যক ড্রোন ও মিসাইল হামলা করে ইউক্রেনে।  

একইভাবে অবরুদ্ধ গাজাবাসীর হতাশা আরও প্রলম্বিত হলো এ–ই দেখে যে নেতানিয়াহুর প্রতি পশ্চিমা সমালোচনা রাতারাতি পাল্টে গেছে। পশ্চিমাদের এই সংহতির ঐকতানের জন্য ইরান অবশ্যই নেতানিয়াহুর ধন্যবাদ পেতে পারে। 

দাতা সংস্থাগুলো ফিলিস্তিন নিয়ে অব্যাহতভাবে সতর্ক করে যাচ্ছে যে সেখানে দুর্ভিক্ষ আসন্ন। ইসরায়েলের হাতে ৬ মাসে ৩৪ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। রাফায় ভয়াবহ আগ্রাসন চোখরাঙানি দিচ্ছে। গাজা ও পশ্চিম তীরে কোনো বিজয়ী নেই, কেবল পরাজিত রয়েছেন।

ইরান দাবি করেছে, তারা খুব সফলভাবে দামেস্কে ইরানি কনস্যুলেটে বোমাবর্ষণের শাস্তি দিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ইরানের এই হামলাকে একটা পরাজয়ই বলা যায়। কেননা, এতে তাদের সামরিক সীমাবদ্ধতা প্রকাশ হয়ে গেছে। 

এ হামলার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ইরান আরও একঘরে হয়ে গেছে, তেহরানের ঘাড়ে নতুন নিষেধাজ্ঞার বোঝা চেপেছে এবং ফিলিস্তিনিদের সুবিধা হয়—এমন কোনো কিছু করতে পারেনি ইরান। অবশ্য সেটা তাদের নেতারা তোয়াক্কা করেন না।

আবার ইসরায়েলের সামান্যতম উদ্‌যাপনের কোনো কারণ নেই। এটা ঠিক যে এবার ইসরায়েল ইরানের হামলা ঠেকিয়ে দিয়েছে। কিন্তু অজেয় বলে ইসরায়েলের যে সুখ্যাতি, সেটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। ইসরায়েল অভেদ্য দুর্গ বলে যে মিথ, সেটা গুঁড়িয়ে গেছে। একইভাবে গাজায় এখনো হামাসের হাতে বন্দী ১৩০ পণবন্দী রয়ে গেছে। হামাস এখনো অপরাজেয়।

অনেকের কাছেই শক্তিশালী যুক্তি হলো, মধ্যপ্রাচ্যের মূল সংকট সমাধান করতে হলে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের অবসান করতে হবে। এর জন্য অনেক বেশি কূটনৈতিক সময়, শক্তি ও সম্পদ ব্যয় করা প্রয়োজন। 

এই সংঘাত আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় বিষ ছড়াচ্ছে। এই সংঘাত পশ্চিমা নীতিকে ভারসাম্যহীন করে তুলছে। ইরানের মতো দুর্বৃত্ত খেলোয়াড়ের ক্ষমতা বাড়াচ্ছে।


সিমন টিসডল: বৈদেশিক সম্পর্কবিষয়ক ভাষ্যকার ও কলাম লেখক;
(গার্ডিয়ান থেকেঅনূদিত)

মতামত এর আরও খবর