img

গ্যাস উত্তোলনে পেট্রোবাংলার পরিকল্পনা কতটা বাস্তবসম্মত?

প্রকাশিত :  ১২:৪৩, ২৮ ফেব্রুয়ারী ২০২৩

গ্যাস উত্তোলনে পেট্রোবাংলার পরিকল্পনা কতটা বাস্তবসম্মত?

বদরূল ইমাম 

গ্যাসের চাহিদা মেটাতে উচ্চ মূল্যের এলএনজি আমদানির ওপর নির্ভরশীলতা যে আর্থিক খাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে, সে আশঙ্কা আগে থেকেই করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এর প্রভাবে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি এবং রিজার্ভ-সংকট ইতিমধ্যে জনসাধারণ ও সরকার—উভয়ের জন্যই অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে।

আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির দামের ওঠা ও নামা জ্বালানি খাতে বিশ্বব্যাপী অস্থির পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য দায়ী। বাংলাদেশ ২০১৮ সালে যখন এলএনজি আমদানি শুরু করে, তখন এর দাম তুলনামূলক কম ছিল, কিন্তু গত বছর নাগাদ এর দাম এতটাই বেড়ে যায় যে বাংলাদেশ স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনার সামর্থ্য হারায়।

এ কারণে গ্যাস-সংকটে দেশে যে লোডশেডিং হয়, তার অভিজ্ঞতা আমাদের সবারই হয়েছে।

উচ্চ মূল্যের এলএনজির ওপর নির্ভরশীল না হয়ে দেশের নিজস্ব গ্যাস সম্পদ সর্বোচ্চ সক্ষমতায় উত্তোলন ও তার ওপর নির্ভর করার যৌক্তিকতা ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। এ বিষয়ে আগে থেকেই বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিয়ে আসছেন। তাঁদের মতে, ভূতাত্ত্বিকভাবে বাংলাদেশ গ্যাসের জন্য যথেষ্ট সম্ভাবনাময়, কিন্তু গ্যাস অনুসন্ধান নিয়ে অবহেলা ও দুর্বল উদ্যোগের কারণে গ্যাস–সংকট আজ এই পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে গড়ে প্রতিবছর মাত্র একটি অনুসন্ধান কূপ খনন করা হয়, গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা আছে, এমন দেশগুলোর মধ্যে অনুসন্ধানের এ হার বিশ্বে ন্যূনতম।

তবে দেরিতে হলেও আশার কথা হচ্ছে সম্প্রতি দেশের নিজস্ব গ্যাসসম্পদ অনুসন্ধান ও উত্তোলন বাড়ানোর লক্ষ্যে একটি জরুরি ও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার ঘোষণা করা হয়েছে। ২০২২ সালের আগস্ট মাসে পেট্রোবাংলা ২০২৫ সালের সালের মধ্যে ৪৬টি কূপ খনন পরিকল্পনা ঘোষণা করে। এর মধ্যে ১৭টি অনুসন্ধান কূপ, ১২টি উন্নয়ন কূপ ও ১৭টি ওয়ার্কওভার কূপ অন্তর্ভুক্ত।

বাংলাদেশে গড় সাফল্যের হার বেশি এবং তা হলো, তিনটি অনুসন্ধান কূপ খনন করলে একটিতে সাফল্য। সেই হিসাবে ১৭টি অনুসন্ধান কূপ খনন করলে তার এক-তৃতীয়াংশ সফল হতে পারে এবং গ্যাস প্রাপ্তির প্রাক্কলন সেভাবেই করা উচিত। সব কটি কূপে সাফল্য ধরে যে পরিমাণ উৎপাদন হিসাব করা হয়েছে, তা বাস্তবসম্মত নয়। এরপরও বলি, নতুন গ্যাস কূপ খননের যে উদ্যোগ পেট্রোবাংলা নিয়েছে, তা সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। গ্যাস অনুসন্ধানে দীর্ঘদিনের স্থবিরতা কাটিয়ে উঠে যথেষ্ট মাত্রায় কূপ খনন করা হলে বর্তমান গ্যাস-সংকট থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে।

পেট্রোবাংলার আশা, এসব কূপের মাধ্যমে দৈনিক প্রায় ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা যাবে। উল্লেখ্য, বর্তমানে কমবেশি এ পরিমাণ গ্যাস এলএনজি আমদানির মাধ্যমে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হয়। এখন প্রশ্ন হলো, পেট্রোবাংলার পরিকল্পনাটি কতটা সন্তোষজনক এবং এর মাধ্যমে প্রত্যাশা অনুযায়ী গ্যাস তোলার সম্ভাবনা কতটুকু?

সাধারণ পাঠকদের জন্য বোঝার জন্য বলছি, ‘অনুসন্ধান কূপ’ অজ্ঞাত স্থানে খনন করা হয় এবং গ্যাস পাওয়া গেলে তা দেশের গ্যাস মজুত বাড়ায়। ‘উন্নয়ন কূপ’ হচ্ছে ইতিমধ্যে আবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য নতুন কূপ খনন। আর ‘ওয়ার্কওভার কূপ’ নতুন কূপ নয়; বরং আগে খনন করা ও পরিত্যক্ত কূপে মেরামত বা কোনো যন্ত্রাংশ সংযোজনের মাধ্যমে সেখানে রয়ে যাওয়া বা ফেলে আসা গ্যাস তোলার চেষ্টা করা।

পেট্রোবাংলা গত আগস্টে যে পরিকল্পনা ঘোষণা করেছিল, এ বছর ফেব্রুয়ারিতে তা সংশোধন করেছে। নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী ৪৬টি কূপ খননের কাজ ২০২৫ সালের পরিবর্তে ২০২৪ সালের মধ্যেই শেষ করা হবে। অর্থাৎ, তিন বছরের পরিবর্তে এখন দুই বছরের মধ্যেই ৪৬টি কূপ খনন করা হবে। এ সময়ে যে ১৭টি অনুসন্ধান কূপ খনন করার কথা, এর ৬টি ২০২৩ সালে এবং ১১টি ২০২৪ সালে খনন করা হবে। কেবল এই অনুসন্ধান কূপগুলো বিবেচনায় নিয়ে পরিবর্তনের যৌক্তিকতা বিচার করে দেখা যেতে পারে।

বাংলাদেশের নিজস্ব গ্যাস অনুসন্ধান কোম্পানি বাপেক্স তার বর্তমান লোকবল ও রসদ সামর্থ্য নিয়ে বছরে দুই থেকে তিনটি অনুসন্ধান কূপ খনন করতে পারে। সেই বিবেচনায় ২০২৩ সালে ৬টি অনুসন্ধান কূপ খননের পরিকল্পনাই উচ্চাভিলাষী। আর ২০২৪ সালে ১১টি অনুসন্ধান কূপ খনন করার পরিকল্পনাকে বলতে হয় অতি উচ্চাভিলাষী।

আমাদের মনে আছে, ২০১৬ সালে পেট্রোবাংলা ‘পাঁচ বছরে ১০৮টি কূপ খননের’ পরিকল্পনা ঘোষণা করেছিল। এর মধ্যে ৫৫টি ছিল অনুসন্ধান কূপ। পাঁচ বছরে তা করতে হলে প্রতিবছর ১১টি খনন করা প্রয়োজন। কিন্তু বাপেক্স পরিকল্পনাটি কার্যকর করতে পুরোপুরিভাবে ব্যর্থ হয়েছে।

দেশীয় কোম্পানি বাপেক্স যে তার সীমাবদ্ধতার কারণে পেট্রোবাংলার নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২৩ সালে ৬টি ও ২০২৪ সালে ১১টি অনুসন্ধান কূপ খনন করতে পারবে না, তা সহজেই বোঝা যায়।

এ ক্ষেত্রে কূপ খননের জন্য আউটসোর্সিং ব্যবস্থাপনার পরিকল্পনা করা হয়েছে, যাকে সাধারণভাবে যৌক্তিক হিসেবে বিবেচনা করা যায়। কিন্তু অতীত অভিজ্ঞতা এর সীমাবদ্ধতার দিকটি ও আমাদের সামনে তুলে ধরে। এক বছরে এতগুলো আউটসোর্সিং প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনার সামর্থ্য কি আমাদের আছে?

কূপ খননে আউটসোর্সিং কোম্পানি ও পেট্রোবাংলার বিরোধ অনেক সময় আদালত পর্যন্ত গড়ায়। কয়েক বছর আগে সেমুতাং-৫ ও বেগমগঞ্জ-৪ কূপ দুটি আউটসোর্সিং ব্যবস্থাপনায় আজারবাইজানের রাষ্ট্রীয় তেল–গ্যাস কোম্পানি সোকারকে খনন করতে দেওয়া হয়। কিন্তু পেট্রোবাংলার সঙ্গে ব্যবস্থাপনা ও আর্থিক বিষয়ে বিরোধ হওয়ার কারণে তারা বেগমগঞ্জ কূপটি খনন না করে চলে যায়। এ জন্য আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়া হয়েছে কিন্তু আজ পর্যন্ত বিষয়টির কোনো নিষ্পত্তি হয়নি।

আইনি নিষ্পত্তি না হওয়ায় এখন বেগমগঞ্জ-৪ কূপটি এখন আমাদের বাপেক্সও খনন করতে পারছে না। একইভাবে ছাতক গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাস তোলার জন্য কানাডার অখ্যাত নাইকো কোম্পানিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। নাইকো কূপটিতে দুর্ঘটনা ঘটায় এবং তাতে কূপটি নষ্ট হয়ে যায়। বাংলাদেশ ক্ষতিপূরণের জন্য আন্তর্জাতিক আদালতে গেছে কিন্তু ১৭ বছরেও তার নিষ্পত্তি হয়নি।

ফলে এ গ্যাস-সংকটের দিনেও ছাতক গ্যাসক্ষেত্র থেকেও গ্যাস উত্তোলন সম্ভব হচ্ছে। এদিকে অনেক কূপ বাপেক্সকে দিয়ে খনন না করিয়ে রাশিয়ার গাজপ্রম কোম্পানির মাধ্যমে করানো হচ্ছে, যেখানে গাজপ্রম প্রতিটি কূপ খননে বাপেক্সের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ দাম নিচ্ছে।

বর্তমানে ঘোষিত ৪৬টি কূপ খনন তিন বছরের (২০২৩-২০২৫) পরিবর্তে দুই বছরে (২০২৩-২০২৪) সম্পন্ন করার পরিবর্তিত পরিকল্পনা সুচিন্তিত নয় বলে মনে হয়। মাঠপর্যায়ের অভিজ্ঞতাবিহীন প্রশাসনের উচ্চ মহলের সুপারিশে এ রকম সিদ্ধান্ত হয়ে থাকতে পারে। এত বেশিসংখ্যক কূপ তাড়াহুড়ার মধ্যে করতে যাওয়ার যে ঝুঁকি রয়েছে, তা আমলে না নেওয়া অদূরদর্শিতার সাক্ষ্য বহন করে। একটি বছর তেমন বড় কিছু সময় নয়, যেখানে বাংলাদেশ বছরের পর বছর গ্যাস-সংকটে ভুগে আসছে।

অন্যদিকে ৪৬টি কূপ খননের মাধ্যমে ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদনের যে হিসাব করেছে, তা-ও সুচিন্তিত নয়। পেট্রোবাংলার হিসাবে প্রতিটি অনুসন্ধান কূপে সফলতা ও গ্যাসপ্রাপ্তি ধরে কূপপ্রতি ১৫ থেকে ২০ মিলিয়ন ঘনফুট উৎপাদন হিসাব করা হয়েছে। কিন্তু বিশ্বের কোথাও অনুসন্ধান কূপের প্রতিটি সফল হয় না।

বাংলাদেশে গড় সাফল্যের হার বেশি এবং তা হলো, তিনটি অনুসন্ধান কূপ খনন করলে একটিতে সাফল্য। সেই হিসাবে ১৭টি অনুসন্ধান কূপ খনন করলে তার এক-তৃতীয়াংশ সফল হতে পারে এবং গ্যাস প্রাপ্তির প্রাক্কলন সেভাবেই করা উচিত। সব কটি কূপে সাফল্য ধরে যে পরিমাণ উৎপাদন হিসাব করা হয়েছে, তা বাস্তবসম্মত নয়। এরপরও বলি, নতুন গ্যাস কূপ খননের যে উদ্যোগ পেট্রোবাংলা নিয়েছে, তা সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। গ্যাস অনুসন্ধানে দীর্ঘদিনের স্থবিরতা কাটিয়ে উঠে যথেষ্ট মাত্রায় কূপ খনন করা হলে বর্তমান গ্যাস-সংকট থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে।

ড. বদরূল ইমাম অধ্যাপক, ভূতত্ত্ব বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


img

যুদ্ধ উত্তেজনায় ইরান-ইসরায়েল, কে জিতল, কে হারল?

প্রকাশিত :  ১১:৪৯, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
সর্বশেষ আপডেট: ১১:৫৬, ২৫ এপ্রিল ২০২৪

সিমন টিসডল

ইসফাহানের সামরিক ঘাঁটির কাছে ও অন্যান্য লক্ষ্যবস্তুতে গত শুক্রবার আকাশপথে ইসরায়েল যে হামলা চালায়, ইরান সেটা ততটা পাত্তা দিতে নারাজ। বাইরে থেকে হামলার বিষয়টা তেহরান অস্বীকার করেছে। 

ইসরায়েলি মুখপত্ররা আর সব বিষয়ে অনর্গল বাক্যবর্ষণ করে চললেও এ ঘটনায় অদ্ভুতভাবে নীরব। দেখেশুনে মনে হচ্ছে, ঘটনাকে গুরুত্বহীন করে তুলতে দুই পক্ষের মধ্যে যেন একটা চুক্তি হয়েছে, যাতে ধীরে ধীরে উত্তেজনার পারদ এমনিতেই নিচে নেমে যায়।

এটিকে উনিশ শতকের সেই চোরাগোপ্তা কোনো এক ডুয়েল লড়াইয়ের মতো মনে হচ্ছে; যেন দুই প্রতিদ্বন্দ্বী ইংরেজ ব্রিটেনে কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে তৃণভূমির মধ্যে পরস্পরের দিকে অবৈধভাবে পিস্তল তাক করেছে। ইরান ও ইসরায়েল দুই দেশেরই মানমর্যাদা পরিপূর্ণভাবে রক্ষা করতে হবে, কিন্তু সেটা আবার করতে হবে জনগণের মধ্যে যেন আবার চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু না হয়, সেটা মাথায় রেখে। 

দুই দেশই একে অন্যের দিকে সরাসরি হামলা করেছে। তাতে প্রতীকী ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এখন তারা এবং তাদের সাঙ্গপাঙ্গরা এই ইঙ্গিত দিচ্ছে যে খেলা শেষ, অন্তত এবারের মতো।

এটা যদি সত্যি (যদিও সম্ভাবনাটা সাময়িক সময়ের জন্য) হয়, তাহলে সেটা অনেক বড় স্বস্তির বিষয়। এ ঘটনা এই ইঙ্গিত দেয় যে সংযত হতে ইসরায়েলের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের তীব্র চাপ (যুক্তরাজ্য ও অন্য দেশগুলোও তাতে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে) কাজে এসেছে। 

গত সপ্তাহে ইসরায়েলে ইরানের অভূতপূর্ব ও বড় পরিসরে হামলার পর প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইসরায়েলের প্রতি ‘জয়টাকে ধরে রাখার’ আহ্বান জানিয়ে ছিলেন। বোঝা যাচ্ছে, এই বার্তার মর্মোদ্ধার সফলভাবেই করতে পেরেছে ইসরায়েল। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের নেতৃত্ব কখনোই কোনো বিষয়ে পুরোপুরি ঐকমত্য হতে পারে না।

অবশ্য ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ডিএনএর মধ্যেই সংযমের বালাই নেই। সাবেক এই কমান্ডো ইরানের হামলার পর সহজাতভাবেই পাল্টা শক্তি দেখাতে চেয়েছিলেন। আর তাঁর কট্টর ডানপন্থী মিত্ররা যুদ্ধের উন্মাদনা সৃষ্টি করেছিল। 

এই প্রেক্ষাপটে ইসরায়েল যে মাপা পদক্ষেপ নিয়েছে, তাতে বোঝা যায়, যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে মানাতে পেরেছে। আর ইরানের ড্রোন ও মিসাইল হামলা থেকে ইসরায়েলকে সুরক্ষা দিতে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে, সেটাও নেতানিয়াহুর পক্ষে উপেক্ষা করা সম্ভব হয়নি।

আবার ইসরায়েলের সামান্যতম উদ্‌যাপনের কোনো কারণ নেই। এটা ঠিক যে এবার ইসরায়েল ইরানের হামলা ঠেকিয়ে দিয়েছে। কিন্তু অজেয় বলে ইসরায়েলের যে সুখ্যাতি, সেটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। ইসরায়েল অভেদ্য দুর্গ বলে যে মিথ, সেটা গুঁড়িয়ে গেছে। একইভাবে গাজায় এখনো হামাসের হাতে বন্দী ১৩০ পণবন্দী রয়ে গেছে। হামাস এখনো অপরাজেয়।

অবশ্য এখানেই বিষয়টা মীমাংসা হয়ে গেল এটা ধরে নেওয়াটাও বোকামি হয়ে যাবে। রাজনৈতিক ও মতাদর্শিকভাবে গভীর বৈরিতা ইরান ও ইসরায়েল—এই দুই শত্রুকে পরস্পর থেকে আলাদা করে রেখেছে। 

দুই দেশের সরকারের মধ্যেই অভ্যন্তরীণ বিভাজন রয়েছে, যা চরম অনিশ্চয়তা ও প্ররোচনাময় পরিবেশ সৃষ্টি করছে। তারই একটা ভয়ানক নজির আমরা গত কয়েক দিনে দেখতে পেলাম। একেবারে মুখোমুখি যুদ্ধের প্যান্ডোরার বাক্সটি সরাসরি খুলে গিয়েছিল।

বছরের পর বছর ধরে দুটি দেশ যে ছায়াযুদ্ধ লড়ে যাচ্ছিল, সেই যুদ্ধ তারা সবার চোখের সামনে দিনের আলোয় নিয়ে এসেছিল। ইরান দেখিয়ে দিয়েছে যে তারা ইসরায়েলের যেকোনো জায়গায়, যেকোনো সময়, প্রত্যক্ষভাবে হোক আর পরোক্ষভাবে হোক, হামলা চালাতে সক্ষম। আর ইসরায়েল দেখাল যে তারা যদি চায়, তাহলে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালাতে সক্ষম, পরেরবারের হামলা হবে আরও ভয়াবহ।

ইসরায়েল-ইরানের এ অচলাবস্থা ফিলিস্তিন সংঘাতের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। কিন্তু ফিলিস্তিন সংকট নিরসনে কোনো ভূমিকা রাখছে না। আর ফিলিস্তিন সংকটে পশ্চিমাদের দোটানা অবস্থান আগের চেয়ে তীব্র হলো। 

যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন একপেশে, দ্বিমুখী নীতির প্রতীক হয়ে উঠলেন। গাজায় মানবিক সহায়তা পৌঁছতে তিনি প্রাণান্ত চেষ্টা করে চলেছেন, কিন্তু যুদ্ধবিরতির চেষ্টায় সমানভাবে ঢিলেমি করে যাচ্ছেন। ফলে তাঁর নীতি খুব সামান্যই সফলতার মুখ দেখছে।

এর একটা কারণ হতে পারে, ঋষি সুনাকের সরকার ইসরায়েলের কাছে অস্ত্র বিক্রির সুযোগ হাতছাড়া করতে চায় না। আরেকটি কারণ হলো, ১ এপ্রিল দামেস্কে ইরানি কনস্যুলেটে ইসরায়েলের বিমান হামলার (এই হামলায় ইরানের জ্যেষ্ঠ কয়েকজন কমান্ডার নিহত হন, ইসরায়েলে প্রতিশোধমূলক হামলা চালায় ইরান) নিন্দা জানাতে ক্যামেরন অস্বীকৃতি জানান।

জাতিসংঘ–বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইরানের কনস্যুলেটে ইসরায়েলের হামলা ছিল আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। গত সপ্তাহে ক্যামেরন অবশ্য স্বীকার করেছেন, যুক্তরাজ্যের কোনো দূতাবাসে এ ধরনের হামলা হলে তারা কঠোর ব্যবস্থা নিত। 

কিন্তু তিনি কখনোই বলবেন না, ইসরায়েল অন্যায় করেছে। এ ধরনের ইসরায়েলপন্থী অবস্থান বেশির ভাগ পশ্চিমা দেশের সরকারগুলোর চারিত্রিক অবস্থান।

হারজিতের প্রশ্নটি বড় পরিসর থেকে বিবেচনা করা হলে এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে গত সপ্তাহের ঘটনাপ্রবাহে ইউক্রেনীয়রাও সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তারা আরেকটি পশ্চিমা ভণ্ডামির শিকার। 

দুই বছরের বেশি সময় ধরে কিয়েভ ন্যাটোর কাছে আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ও মিসাইল প্রতিরক্ষাব্যবস্থা চেয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তাদের সেই চাওয়া বৃথা পর্যবসিত হয়েছে।

অথচ ইরান যখন ইসরায়েলে ড্রোন ও মিসাইল হামলা করল, তখন পশ্চিমা দেশগুলো তেল আবিবের সুরক্ষা দিতে কী না করেছে। ইরান ৩০০ ড্রোন ও মিসাইল ছুড়লেও প্রায় অক্ষত থাকে ইসরায়েল। অথচ প্রতি সপ্তাহে রাশিয়া সমানসংখ্যক ড্রোন ও মিসাইল হামলা করে ইউক্রেনে।  

একইভাবে অবরুদ্ধ গাজাবাসীর হতাশা আরও প্রলম্বিত হলো এ–ই দেখে যে নেতানিয়াহুর প্রতি পশ্চিমা সমালোচনা রাতারাতি পাল্টে গেছে। পশ্চিমাদের এই সংহতির ঐকতানের জন্য ইরান অবশ্যই নেতানিয়াহুর ধন্যবাদ পেতে পারে। 

দাতা সংস্থাগুলো ফিলিস্তিন নিয়ে অব্যাহতভাবে সতর্ক করে যাচ্ছে যে সেখানে দুর্ভিক্ষ আসন্ন। ইসরায়েলের হাতে ৬ মাসে ৩৪ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। রাফায় ভয়াবহ আগ্রাসন চোখরাঙানি দিচ্ছে। গাজা ও পশ্চিম তীরে কোনো বিজয়ী নেই, কেবল পরাজিত রয়েছেন।

ইরান দাবি করেছে, তারা খুব সফলভাবে দামেস্কে ইরানি কনস্যুলেটে বোমাবর্ষণের শাস্তি দিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ইরানের এই হামলাকে একটা পরাজয়ই বলা যায়। কেননা, এতে তাদের সামরিক সীমাবদ্ধতা প্রকাশ হয়ে গেছে। 

এ হামলার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ইরান আরও একঘরে হয়ে গেছে, তেহরানের ঘাড়ে নতুন নিষেধাজ্ঞার বোঝা চেপেছে এবং ফিলিস্তিনিদের সুবিধা হয়—এমন কোনো কিছু করতে পারেনি ইরান। অবশ্য সেটা তাদের নেতারা তোয়াক্কা করেন না।

আবার ইসরায়েলের সামান্যতম উদ্‌যাপনের কোনো কারণ নেই। এটা ঠিক যে এবার ইসরায়েল ইরানের হামলা ঠেকিয়ে দিয়েছে। কিন্তু অজেয় বলে ইসরায়েলের যে সুখ্যাতি, সেটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। ইসরায়েল অভেদ্য দুর্গ বলে যে মিথ, সেটা গুঁড়িয়ে গেছে। একইভাবে গাজায় এখনো হামাসের হাতে বন্দী ১৩০ পণবন্দী রয়ে গেছে। হামাস এখনো অপরাজেয়।

অনেকের কাছেই শক্তিশালী যুক্তি হলো, মধ্যপ্রাচ্যের মূল সংকট সমাধান করতে হলে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের অবসান করতে হবে। এর জন্য অনেক বেশি কূটনৈতিক সময়, শক্তি ও সম্পদ ব্যয় করা প্রয়োজন। 

এই সংঘাত আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় বিষ ছড়াচ্ছে। এই সংঘাত পশ্চিমা নীতিকে ভারসাম্যহীন করে তুলছে। ইরানের মতো দুর্বৃত্ত খেলোয়াড়ের ক্ষমতা বাড়াচ্ছে।


সিমন টিসডল: বৈদেশিক সম্পর্কবিষয়ক ভাষ্যকার ও কলাম লেখক;
(গার্ডিয়ান থেকেঅনূদিত)

মতামত এর আরও খবর