ব্রেক্সিটে বরিস হলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী, করোনায় হলেন শুধুই ইংল্যান্ডের নেতা
মুহাম্মদ আব্দুস সাত্তার
ব্রেক্সিট তাঁকে করেছিলো ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রি, আর করোনা তাঁকে করলো ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রি। কম বেশি চার বছরের মধ্যে বরিস জনসনের এই উত্তুঙ্গ প্রমোশন এবং কার্যকর ডিমোশন।
ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বের করে এনে ব্রিটেনকে ‘স্বাধীন‘ করার ধূয়া তুলেছিলেন বরিস জনসন, এই স্বপ্নে মাতিয়ে তুলেছিলেন ব্রিটিশ ভোটারদের। ব্রেক্সিটের পক্ষে প্রথমে গণভোটে পেলেন বিপুল রায়, এর ধারাবাহিকতায় তাঁর কনসারভেটিভ দলের মেজরিটি অংশের মধ্যে তাঁর জনপ্রিয়তা হয়ে দাঁড়ালো আকাশচুম্বি, পার্টির এমপিদের মাঝে তিনি তখন রীতিমতো অপ্রতিদ্বন্দ্বি নায়ক, প্রধানমন্ত্রি তেরেসো মে পদত্যাগে বাধ্য হওয়ার পর দলের নেতা নির্বাচিত হতে বরিসকে মোটেই বেগ পেতে হয়নি এবং সবশেষে গত বছরের ১২ ডিসেম্বরের পার্লামেন্ট নির্বাচনে বিরোধী লেবার পার্টিকে ভূপাতিত করে পেলেন বরিস বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা, ঐতিহাসিক বিজয়। হলেন ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড আর ওয়েলসের সমন্বয়ে গঠিত যুক্তরাজ্যের (ব্রিটেনের) প্রধানমন্ত্রি।
ডিসেম্বরে বিপুল নির্বাচনী বিজয়ের পর চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে বরিস ও তাঁর সরকারের মূল টার্গেট ছিলো ব্রেক্সিটের সফল বাস্তবায়নের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়া। কিন্তু বাগড়া বাধালো চীন দেশ থেকে ভেসে আসা এক অদৃশ্য ‘শত্রু‘। বেক্সিট নিয়ে তাঁর সব পরিকল্পনা আপাতত লন্ডভন্ড করে দিলো করোনাভাইরাস, অর্থনীতি দিলো ছত্রখান করে, লকডাউন জারী হলো, জনজীবন বাধ্য হলো ঘরে খিল এঁটে বসে থাকতে, তারপরও হাজারে হাজার মানুষের মৃত্যুর মিছিল ঠেকানো সম্ভব হলো না।
লকডাউনের শেষ ঘটাবার জন্যে বরিস প্রবল চাপের মধ্যে ছিলেন। ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছিলো তিনি লকডাউন পর্যায়ক্রমে শিথিল করে আনার পক্ষে সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছেন। আর সেখানেই তিনি রীতিমতো একা হয়ে গেলেন। স্কটল্যান্ড, নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড আর ওয়েলস-এর জাতিগত অঞ্চলসমূহের সরকারগুলো ঘোষনা করলো, তারা মনে করে না লকডাউন তুলে নেবার মতো পরিস্থিতির উন্নতি এখনো ততোটা হয়েছে।
বরিস তাদের নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করলেও কাজ হয়নি। ওই আঞ্চলিক সরকারগুলো বরং আগ বাড়িয়ে বরিসের তরফে কোন সিদ্ধান্ত আসার আগেই নিজ নিজ অঞ্চলে লকডাউনের সময় সীমা ২৮ মে পর্যন্ত তিন সপ্তাহের জন্যে বাড়িয়ে দিলো। ২৩ মার্চ লকডাউন জারি করার সাত সপ্তাহের মাথায় করোনাভাইরাস মহামারীটি নির্মূল বা নিদেনপক্ষে নিয়ন্ত্রিত না হওয়া সত্ত্বেও মূলত অর্থনীতি আবার চাঙ্গা করার স্বার্থে রোববার ১০ মে প্রধানমন্ত্রি বরিস জনসন সেটি পর্যায়ক্রমে শিথিল করে আনার ঘোষণা দিলেন। ঘোষণাটি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রির পক্ষ থেকে এলেও আদতে তা কার্যকর হলো শুধুমাত্র ইংল্যান্ডে, অর্থাৎ, চার জাতির সমন্বয়ে গঠিত যুক্তরাজ্যের শুধুমাত্র একটি জাতির অঞ্চলে। এখানেই বরিস জনসনের ডিমোশন ঘটে গেলো অনিবার্যভাবে।
স্কটল্যান্ড, নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড আর ওয়েলস-এ পৃথক পৃথক আঞ্চলিক সরকার থাকলেও ইংল্যান্ডে তা নেই। এখানে ওয়েস্টমিন্সটারে যে সরকার গঠিত হয় তার ক্ষমতার আওতায় রয়েছে পুরো যুক্তরাজ্য। কিন্তু এই কেন্দ্রীয় সরকারের অবস্থা এখন এমনই অবস্থায় পৌঁছেছে যে, মহামারীর মতো একটি পরিস্থিতি মোকাবেলায় তার কর্তৃত্ব এখন দেশের বাকি তিনটি অঞ্চলে একইভাবে প্রযোজ্য হচ্ছে না। অর্থাৎ, দেশের অন্য তিনটি জাতিসত্ত্বার জনপ্রতিনিধিরা কেন্দ্রীয় সরকারের উইজডম আর কম্পিটেন্সির ওপর ভরসা রাখতে পারছেন না।
ওয়েস্টমিন্সটারে হাউস অব পার্লামেন্টের বদৌলতে যে ব্রিটিশ সরকার গঠিত হয়, তার বিরুদ্ধে স্কটল্যান্ড, নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড আর ওয়েলস এখনই স্বাধীনতা ঘোষণা করছে না, যদিও আমরা জানি স্কটল্যান্ড এরই মধ্যে এক দফা স্বাধীনতার পক্ষে গণভোট করেছিলো, সেটাতে স্বাধীনতার পক্ষের দলগুলো জিততে পারেনি বটে, কিন্তু বর্তমান স্কটিশ সরকার আবারও সেখানে স্বাধীনতার প্রশ্নে দ্বিতীয় দফা গণভোটের দাবিতে সোচ্চার রয়েছে।
বরিসের সরকার শিথিল লকডাউন বিধান অনুযায়ি ইংল্যান্ডের মানুষজন গাড়ি চালিয়ে দূরবর্তী সাগর সৈকত, পার্ক এগুলোতে যেতে পারবেন, কিন্তু তাদের স্পষ্ট করে বলে দেয়া হয়েছে, এ সময় তারা যেন স্কটল্যান্ড, নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড আর ওয়েলস এলাকায় প্রবেশ না করেন, কারণ, সেখানে লকডাউনের আগের সব বিধিনিষেধ বলবৎ রয়েছে।
অলিখিত সংবিধানের আওতায় যুক্তরাজ্যের রাজনৈতিক ভবিষ্যত আগামিতে কেমন দাঁড়াবে সে সম্পর্কে সুনিশ্চিত মন্তব্য করার সময় এখনো হয়নি। তবে যুক্তরাজ্যের বর্তমান রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রাজ্যগুলো আর কদ্দিন এই কাঠামোর ভেতওে ঐক্যবদ্ধ থাকছে সে প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ সম্ভবত আর নেই।
লন্ডন, ১৪ মে, ২০২০
[লেখাটি সাপ্তাহিক জনমত এর চলতি সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে। জনমত এর ই-পেপার পড়তে হলে হোম পেজে গিয়ে সাপ্তাহিক জনমত এর প্রচ্ছদে ক্লিক করুন।]