করোনাভাইরাসের ক্রান্তিকাল

img

‘যে শক্তির কাছে তুচ্ছ হয়ে যায় জাগতিক শক্তিমত্তা’

প্রকাশিত :  ১০:০০, ২৩ জুলাই ২০২০
সর্বশেষ আপডেট: ১০:০৯, ২৩ জুলাই ২০২০

‘যে শক্তির কাছে তুচ্ছ হয়ে যায় জাগতিক শক্তিমত্তা’

।। মুহাম্মদ আব্দুস সাত্তার।।

নি:শব্দ এক ঘাতকের আঙ্গুলের ইশারায় বিশ্বের দেশে দেশে এখনও একের পর এক মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন অসহ্য, অবর্ণনীয় যাতনার মধ্য দিয়ে। এমন এক শত্রুর সাথে এখন প্রাণ বাঁচানোর যুদ্ধ, যাকে দেখা যায় না, রোখাও যায় না। যাকে ইচ্ছা তাকে সে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করছে। যাকে ইচ্ছা তাকে মৃত্যুর যাঁতাকল থেকে ফিরিয়েও দিচ্ছে। 

ব্রাডফোর্ডের বাসিন্দা ৩৫ বছর বয়সী মোহাম্মদ আজিম ব্যাপক শ্বাসকষ্টে ভুগতে শুরু করলেন, কিন্তু তিনি হাসপাতালে যেতে রাজি না। তাঁর করোনাভাইরাকের উপসর্গ দেখা দিয়েছে, সেটা তিনি বুঝতে পারছিলেন। কিন্তু হাসপাতালে যাবেন না, কারণ, তাঁর এবং তাঁর মতো আরও অনেকেরই একটা ধারণা জন্মে গিয়েছিলো যে, করোনার কারণে কেউ হাসপাতালে ভর্তি হলে আর বেঁচে ফিরে আসে না। 

আজিমের অবস্থা যখন খুবই গুরুতর হয়ে উঠলো তখন তাঁর এক বন্ধু কারও কথা না শুনে এম্বুলেন্স ডেকে তাঁকে ব্রাডফোর্ড রয়্যাল ইনফারমারি হাসপাতালে পাঠালেন। রক্তে তখন তাঁর অক্সিজেনের মাত্রা খুবই কম, ডাক্তাররা বলেছেন, জীবন ধারণের জন্যে যতোটুকু অক্সিজেন তাঁর রক্তে প্রয়োজন সে সময় সেটা তাঁর ছিলো না। হাসপাতালের ইমার্জেন্সি থেকে তাঁকে সরাসরি দ্রুত নিয়ে যাওয়া হলো ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ)। সেদিন রাতে আজিমের পরিবার হাসপাতাল থেকে একটা ফোন পেলেন, তাঁদের বলা হলো, অজিম হয়তো আর ঘন্টাখানেক বাঁচবেন। 

কিন্তু হাসপাতালের ডাক্তাররা হাল ছাড়ছিলেন না। জীবন-মরণের মাঝামাঝি এক অদ্ভুত আঁধারে আজিম ছিলেন ৪৮টি দিন। এ সময়টায় তাঁকে কোমাতে নিয়ে রাখা হয়। হাসপাতালে তাঁকে থাকতে হয় সব মিলিয়ে ৬৮ দিন। 

আজিমের অক্সিজেন মাত্রা চিকিৎসকরা কোন অবস্থাতেই কাংখিত মাত্রায় নিয়ে তুলতে পারছিলেন না। এর ফলে তাঁর হার্ট ও ব্রেইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যাওয়ার প্রবল শঙ্কা দেখা দিয়েছিলো। আজিম ক্রমশ যেন জীবন থেকে দূরে সরে যাচ্ছিলেন। ভেন্টিলেটরের সাহায্যে তাঁর শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যবস্থা করা হয়। হাসপাতালে পক্ষ থেকে আজিমের পরিবারকে তাঁর চিকিৎসার ব্যাপারে যেমন খবরাখবর দেয়া হচ্ছিলো, তেমনি সম্ভাব্য শোকের জন্যেও মানসিকভাবে প্রস্তুত করা হচ্ছিলো। 

এরই এক পর্যায়ে আজমের শরীর অক্সিজেন গ্রহণে একটু একটু করে সাড়া দিতে শুরু করেেলা। ডাক্তাররা বললেন, এটা মিরাকল। বিস্ময়ে তাঁরা অভিভূত হয়ে পড়লেন। কোমা থেকে তাঁকে আবার জাগিয়ে তোলার পর আজিম নতুনভাবে পৃথিবীতে ফিরে এসে কি রকম করে সাড়া দেবেন, সে নিয়ে ডাক্তাররা অনিশ্চয়তায় ছিলেন।  

কিন্তু সবাইকে আশাতীতভাবে আনন্দ-ধারায় অবগাহিত করে আজিম পৃথিবীর ‘নতুন‘ জীবনের প্রতি সাড়া দিলেন ভালোভাবে। এক পর্যায়ে ফিজিও শুরু হলে তাঁর আরও উন্নতি লক্ষ্য করা যায়। এরই এক পর্যায়ে আজিম যেন সুস্থতার পথে ছুটতে শুরু করে দিলেন। 

আজিমের অস্তিত্ব যখন অদ্ভুত অন্ধকার জগতে দোলায়মান তখন তিনি এক ভয়ঙ্কর দু:স্বপ্ন দেখেছেন। দেখেছেন, তাঁকে কেউ গুলি করছে এবং পরপর তিনটি গুলি করা হয়েছে তাঁকে। এটুকুই তিনি চিকিৎসকদের বলতে পারলেন ওই সময়টা বর্ণনার চেষ্টা করতে গিয়ে। 

মোহাম্মদ হোসেইন নামের আরও এক যুবক চিকিৎসকদের কাছে কোমায় থাকাকালে তাঁর দেখা স্বপ্নের কথা জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, তাঁর কাছে মনে হয়েছে, তাঁর পরিবার এক সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়েছেন। 

আজিম এবং হোসেইন নিশ্চিতভাবেই ভাগ্যবান। প্রায় হাল ছেড়ে দেয়ার মতো পরিস্থিতিতে গিয়ে পৌঁছার পরও তাঁরা আবারও ফিরতে পেরেছেন তাঁদের চেনা এই পৃথিবীতে। করোনায় আক্রান্ত সবার পক্ষে এই সৌভাগ্যের অংশীদার সুযোগ হয়নি। 

কিন্তু তার মানে এই নয় যে, করোনায় আক্রান্তদের সিংহভাগ প্রাণ হারিয়েছেন। 

২২ জুলাই ২০২০। করোনাভাইরাস সম্পর্কিত সর্বশেষ হিসেব হলো: গোটা বিশ্বে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ১ কোটি ৫১ লাখ ২২ হাজার ৯৪২ জন। এ পর্যন্ত এই প্রাণঘাতি ভাইরাসে প্রাণ হারিয়েছেন ৬ লাখ ২০ হাজার ৩০৬ জন। রোগ থেকে সেরে উঠেছেন ৯১ লাখ ৩৮ হাজার ৭৪০ জন। 

এই হিসেব থেকে দেখা যাচ্ছে আক্রান্তদের মধ্যে সেরে উঠেছেন শতকরা ৯৪ ভাগ। মারা গেছেন শতকরা ৬ ভাগ। শতকরা হিসেবে প্রাণহাণির সংখ্যা কম থাকলেও করোনা নিয়ে বিশ্ব জুড়ে যে ভীতি ও শঙ্কা তার মুলে রয়েছে এখনও রোগটির প্রতিষেধক বা চিকিৎসা না থাকা আর সেই সুবাদে ভাইরাসটির দ্রুত সংক্রমণ আর প্রাণ সংহারের ভয় জাগানিয়া ক্ষমতা। । 

নতুন এই ভাইরাসের প্রকোপে প্রাণহাণির সংখ্য শতকরা হিসেবে যতোই কম দেখা যাক না কেন, এই নতুন জীবাণু মানুষকে এরই মধ্যে এই দুনিয়ার জীবনে নজির ছাড়া পরিবর্তন আনতে বাধ্য করেছে। এটি একটা সময়ে দুর্বল হয়ে পড়লেও স্থায়িভাবে নতুন আকার দিতে পারে পৃথিবীর রাষ্ট্র ও সমাজ জীবনের নানা স্তর ।  

প্রকৃতপক্ষেই ব্যক্তিগত সম্পর্ক থেকে শুরু করে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনা, সামাজিক আচরণ থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা এবং অর্থনীতির চাকা সচল করা থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক- সর্বত্রই করোনার প্রভাব পড়েছে ব্যাপকভাবে। মেন্টাল হেলথ পরিস্থিতি, ডিজএবল মানুষের কেয়ার, ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি নানা বিষয় রয়েছে, যেগুলোতে করোনাজনিত পরিস্থিতির প্রভাব লক্ষ্যণীয়ভাবেই পড়ছে।  

সাধারণ মানুষ এবং সরকার- কেউই চাইবে না দেশ আবারও করোনার ছোবলে আক্রান্ত হোক। তাই করোনার কারণে আমাদের হাইজিন কালচারে স্থায়ি পরিবর্তন আসতে পারে। মাস্ক, গ্লাভস, হ্যান্ড স্যানিটাইজার এবং হাত ধোয়া-এগুলো আমাদের নিত্যদিনের অপরিহার্য বিষয় হয়ে উঠতে পারে। সোশ্যাল ডিসটেন্সিং এখনকার পর্যায়ে না থাকলেও হ্যান্ডশেইক হয়তো বিদায় নিলো চিরতরে। 

লেখার শুরুতে যে আজিম এবং হোসেইনের কথা বলা হয়েছিলো, তারা আক্ষরিক অর্থেই মৃত্যুর শীতল হাত ছুঁয়ে আবার ফিরে এসেছিলেন এই পৃথিবীতে। ৯৪ শতাংশ মানুষই সামান্য, মাঝারি এবং গুরুতর ভাবে করোনায় আক্রান্ত হয়েও আরোগ্য লাভ করেছেন। কিন্তু অবশিষ্ট যে ৬ শতাংশ মানুষ বিদায় নিয়েছেন এই পৃথিবী থেকে, তাঁদের মৃত্যুর সাথে করোনার যে ভয়াবহ যোগস্পর্শ সেটা আমাদের এই গ্রহের মানবকূলের জীবনে বিশাল ঝাঁকুনি দিয়ে খুলে দিয়েছে নতুন ভাবনার জগত। 

এ যেন মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত হয়ে মৃত্যুর অন্ধ কোপের কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ। 

এই অন্ধ কোপ থেকে প্রাণ বাঁচাতে আমরা এখন যেসব বাহ্যিক আচরণে পরিবর্তন আনছি, সেগুলো সামাজিক এবং পারিপার্শ্বিক। কিন্তু আমাদের মনোজগতে কিছু  গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনার সময় কি এখনো হয়নি? আমরা দারিদ্র বিমোচনের কথা বলি, যুদ্ধমুক্ত বিশ্বের কথা বলি, মানবাধিকারের কথা বলি, সাম্যের কথাও বলে থাকি আমরা। 

অনেক ক্ষেত্রেই আগের তুলনায় ইতিবাচক অনেক পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু আমরা জানি, বিশ্ব এখনো সংঘাতে বিষাক্ত, দারিদ্রে জর্জরিত কোটি কোটি মানুষ, মানবাধিকার অহর্নিশ পদদলিত হয়ে চলেছে ক্ষমতাবানের নির্লজ্জ দম্ভে আর সাম্যকথা যেন আজও দুর্বল মানুষের জীর্ণ বর্ম। 

বিশ্ব জুড়ে নি:শব্দ ঘাতকের যে অপ্রতিরোধ্য ধ্বংসলীলায় বিশ্ব পর্যদুস্ত হয়ে চলেছে, তার অনুচ্চারিত মর্মার্থ বুঝে নেয়ার সময় কি এখনো হয়নি? জাগতিক ক্ষমতা-শক্তির বাইরেও একটি শক্তি এই পৃথিবীর সব শক্তিকে তুচ্ছ করে দেয়, দিতে পারে, করোনাভাইরাসের এই উপাখ্যান থেকে সেই শিক্ষা নিতে পারলেই আমাদের জ্ঞান-গরিমার বড়াই যথার্থ হতে পারতো। 

লন্ডন, ২৩/০৭/২০

মতামত এর আরও খবর

img

গাজা যুদ্ধ বন্ধে বাইডেন কেন এতটা মরিয়া

প্রকাশিত :  ১১:৪১, ১২ মে ২০২৪
সর্বশেষ আপডেট: ১১:৪৮, ১২ মে ২০২৪

জনাথন ফ্রিডল্যান্ড

দ্বিতীয় দফায় নির্বাচিত হবেন কি না তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের উদ্বেগ একেবারে প্রান্তে এসে পৌঁছেছে। জো বাইডেনের পরামর্শ বারবার উপেক্ষা করে আসছিলেন বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। এই উপেক্ষার মূল্য কী হতে পারে, এই সপ্তাহে ইসরায়েল সেটা দেখতে পেল।

ইসরায়েলের ৩ হাজার ৫০০ বোমার চালান আটকে দিয়েছে বাইডেন প্রশাসন। এই অস্ত্র ইসরায়েল গাজার দক্ষিণের শহর রাফা আক্রমণে ব্যবহার করবে, সেই বিবেচনায় অস্ত্রের চালানটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। রাফায় এখন ১০ লাখের বেশি শরণার্থীর আশ্রয়শিবির।

ইসরায়েলের প্রতি জো বাইডেন তাঁর ‘লৌহদৃঢ়’ সমর্থন থেকে সরে আসছেন না। কিন্তু ইসরায়েল রাফা হামলার জন্য যে হুমকি দিয়ে চলেছে, সেটা সফল করতে অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করবেন না। সিএনএনকে বাইডেন বলেছেন, ‘ইসরায়েলের নিরাপত্তা দেওয়া থেকে আমরা সরে আসছি না। অন্যখানে যুদ্ধ করার সক্ষমতা তৈরির পথ থেকে সরে আসছি আমরা।’

ইসরায়েলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিত্র যুক্তরাষ্ট্র। ইসরায়েলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী আইজাক রবিন বলতেন, তাঁর দেশের ১ নম্বর কৌশলগত সম্পদ এই সব অস্ত্র, এমনকি পারমাণবিক অস্ত্র নয়; বরং ওয়াশিংটনের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক। দশকের পর দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় অস্ত্রের জোগানদাতা ও কূটনৈতিক অভিভাবক। 

কিন্তু মাত্র ছয় সপ্তাহের ব্যবধানে ওয়াশিংটন এমন দুটি পদক্ষেপ নিল, যা পুরোপুরি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গেল। গত মার্চ মাসে নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ভেটো দেওয়া থেকে বিরত থাকে যুক্তরাষ্ট্র। ফলে ইসরায়েল প্রস্তাবটি আটকে দিতে চাইলেও ব্যর্থ হয়। আর এখন তো ওয়াশিংটন অস্ত্রের চালান আটকে দিল।

এর থেকেও বড় বিষয় হলো, এই সিদ্ধান্তগুলো এমন একজন রাজনীতিবিদ নিয়েছেন, যিনি ব্যক্তিগতভাবে ইসরায়েলের খুব নিবেদিতপ্রাণ সমর্থক। বাইডেন সেই যুগের একজন ডেমোক্র্যাট, যখন দুই সহস্রাব্দের নির্বাসন ও শাস্তির পর মধ্যপ্রাচ্যে ইহুদিদের আদি বাড়ি প্রতিষ্ঠার বিষয়টি গতি পেতে শুরু করেছে। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের উদারপন্থীদের চোখ তখন রহস্যজনকভাবে বন্ধ ছিল।  

গোল্ডা মেয়ার থেকে শুরু করে ইসরায়েলের প্রত্যেক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বাইডেন দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে। ইসরায়েলের প্রতি বাইডেনের টান বাড়ার ক্ষেত্রে এর একটার ভূমিকা আছে। পূর্বতন প্রেসিডেন্টদের মতো বাইডেনের ইসরায়েলের প্রতি ভ্রাতৃত্ববোধ শুধু নির্বাচনী হিসাব-নিকাশের বিষয় নয়।  

গাজা নিয়ে কোনো চুক্তি হচ্ছে না। কেননা, নেতানিয়াহু কিংবা সিনাওয়ারা কেউই বিশ্বাস করেন না, চুক্তি করলে তাঁদের স্বার্থ রক্ষিত হয়। যেমনটা যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক কর্মকর্তা অ্যারন ডেভিড মিলার বলেছেন, ‘এই সংঘাত বন্ধে একটি পক্ষেরই কেবল সত্যিকারের তাড়া আছে, সেই পক্ষটি হলেন জো বাইডেন।’

অন্যদিকে ১৯৮০-এর দশকে নেতানিয়াহু প্রথম আলোচনার পাদপ্রদীপে উঠে আসেন। তিনি এমন একজন কূটনীতিক, যিনি আমেরিকানদের সঙ্গে সাবলীলভাবে কথা বলতেন। সে সময় থেকেই তিনি নিজেকে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে দাঁড় করান। ইসরায়েলের একজন হবু নেতার জন্য এই দক্ষতা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। 

কয়েক দশক ধরে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তাঁর ভোটারদের এই বার্তা দিয়ে আসছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের মধ্যকার সব ধরনের গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ক্ষেত্রে তিনিই একমাত্র বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তি।

কিন্তু বাস্তব অবস্থাটা এখন কী দাঁড়াল?  চার দশকের বেশি সময়ের মধ্যে বাইডেনই প্রথম প্রেসিডেন্ট যিনি ইসরায়েলকে সামরিক সহায়তা দেওয়া বন্ধ করলেন। (১৯৮২ সালে ইসরায়েলের লেবানন অভিযানের সময় রোনাল্ড রিগ্যান যুদ্ধবিমান দিতে বিলম্ব করেছিলেন।) বাইডেন কেন এটা করলেন? কারণ, নেতানিয়াহু যুক্তরাষ্ট্রের একটি অংশের জনগোষ্ঠীর মধ্যে এমন তিক্ততা তৈরি করেছেন, যেটা আগে দেখা যায়নি।

ইসরায়েলের প্রতি যে যুক্তরাষ্ট্রের সমাজের নিরেট সমর্থন, তাতে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যেভাবে ছাত্র আন্দোলন আছড়ে পড়েছে, সেটা বিস্ময়করই। আন্তর্জাতিক জরিপ সংস্থা গ্যালাপের মার্চ মাসের জরিপ বলছে, ৫১ শতাংশ ইসরায়েলের পক্ষে সমর্থন দিয়েছে, ২৭ শতাংশ সমর্থন দিয়েছে ফিলিস্তিনের পক্ষে। কিন্তু ডেমোক্র্যাট ও তরুণ জনগোষ্ঠী—দুই ক্ষেত্রেই ফিলিস্তিনিদের পক্ষে সমর্থন অনেকটাই বেড়েছে।

জরিপের এই তথ্য বাইডেন ও তাঁর নির্বাচনী প্রচারণা দলকে চিন্তার মধ্যে ফেলেছে। এই অংশের দ্ব্যর্থহীন সমর্থনই ২০২০ সালের নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে পরাজিত করতে ভূমিকা রেখেছিল। গাজাবাসীর দুর্ভোগ সেই ভোটারদের সমর্থন অনিশ্চিত করে তুলেছে। হোয়াইট হাউস নেতানিয়াহুর কাছে পরিকল্পনা চেয়েছিলেন, বেসামরিক জনসাধারণকে হতাহত না করে কীভাবে রাফায় অভিযান করতে পারে ইসরায়েল। 

কিন্তু নেতানিয়াহু সেই পরিকল্পনা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। সেই কারণে ইসরায়েলকে থামানোর জন্য অস্ত্রের চালান আটকে দেওয়ার সরাসরি পথ বেছে নিয়েছে ওয়াশিংটন।

রাফা বাইডেনের জন্য শক্তি পরীক্ষার জায়গাও হয়ে উঠেছে। বাইডেন রাফাকে বিপদরেখা হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন। নেতানিয়াহু যদি সেই বিপদরেখা অতিক্রম করেন, তাহলে বাইডেন দুর্বল হিসেবে চিহ্নিত হবেন।

কিন্তু নেতানিয়াহু এখন পর্যন্ত রণেভঙ্গ দিতে অস্বীকার করেছেন। ইসরায়েলের স্বাধীনতা আন্দোলনকে সামনে রেখে জনগণের উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র ছাড়া আমরা একাই লড়ে যাব। প্রয়োজনে আমরা আমাদের নখ দিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাব।’ 

নেতানিয়াহু চার্চিলের মতো আওয়াজ তুলতে চাইছেন। কিন্তু তাঁর কথাগুলো দুর্বলের কণ্ঠস্বর, সবলের নয়। ওয়াশিংটন চায়, নেতানিয়াহু যেন রাফা অভিযান থেকে সরে আসেন। কিন্তু জোট সরকারের অতি ডানপন্থী মিত্ররা তাঁকে আরও কঠোর হতে বলছেন, রাফা অভিযানের মাধ্যমে হামাসের বিরুদ্ধে পুরোপুরি বিজয়ের জন্য বলছেন।

এই নিরানন্দ নাটকে বাইডেন ও নেতানিয়াহুই কেবল কুশীলব নন; হামাস নেতা ইয়াহিয়া সিনাওয়ারেরও নিজস্ব হিসাব-নিকাশ আছে, নেতা হিসেবে টিকে থাকার সংকল্প রয়েছে। খুব ঘনিষ্ঠভাবে যাঁরা সিনাওয়ারকেও পাঠ করেছেন তাঁরা বিশ্বাস করেন, নির্দোষ মানুষের জীবন রক্ষা করা তাঁর অগ্রাধিকার নয়; বরং যত বেশি গাজাবাসী নিহত হবেন, আন্তর্জাতিক পরিসরে তাঁর শত্রু ইসরায়েলে অবস্থান ততই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সেই পরিস্থিতি তাঁকে বিজয়ী দাবি করতে সহায়তা করবে। সম্প্রতি হামাস যুদ্ধবিরতি চুক্তি মেনে নেওয়ার ঘোষণার পেছনে সিনাওয়ারের এই ভাবনায় কাজ করেছে। 

সিনাওয়ারা সাময়িক কোনো যুদ্ধবিরতি (তাতে অনেক মানুষের প্রাণরক্ষা হয়, দুর্ভোগ কমে) চান না, তিনি চান স্থায়ী যুদ্ধবিরতি। আর তার জন্য সিনাওয়ারা অপেক্ষা করতেও রাজি।

গাজা নিয়ে কোনো চুক্তি হচ্ছে না। কেননা, নেতানিয়াহু কিংবা সিনাওয়ারা কেউই বিশ্বাস করেন না, চুক্তি করলে তাঁদের স্বার্থ রক্ষিত হয়। যেমনটা যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক কর্মকর্তা অ্যারন ডেভিড মিলার বলেছেন, ‘এই সংঘাত বন্ধে একটি পক্ষেরই কেবল সত্যিকারের তাড়া আছে, সেই পক্ষটি হলেন জো বাইডেন।’


জনাথন ফ্রিডল্যান্ড, ব্রিটিশ গণমাধ্যম গার্ডিয়ানের খ্যাতিমান কলামিস্ট

মতামত এর আরও খবর