‘যে শক্তির কাছে তুচ্ছ হয়ে যায় জাগতিক শক্তিমত্তা’
।। মুহাম্মদ আব্দুস সাত্তার।।
নি:শব্দ এক ঘাতকের আঙ্গুলের ইশারায় বিশ্বের দেশে দেশে এখনও একের পর এক মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন অসহ্য, অবর্ণনীয় যাতনার মধ্য দিয়ে। এমন এক শত্রুর সাথে এখন প্রাণ বাঁচানোর যুদ্ধ, যাকে দেখা যায় না, রোখাও যায় না। যাকে ইচ্ছা তাকে সে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করছে। যাকে ইচ্ছা তাকে মৃত্যুর যাঁতাকল থেকে ফিরিয়েও দিচ্ছে।
ব্রাডফোর্ডের বাসিন্দা ৩৫ বছর বয়সী মোহাম্মদ আজিম ব্যাপক শ্বাসকষ্টে ভুগতে শুরু করলেন, কিন্তু তিনি হাসপাতালে যেতে রাজি না। তাঁর করোনাভাইরাকের উপসর্গ দেখা দিয়েছে, সেটা তিনি বুঝতে পারছিলেন। কিন্তু হাসপাতালে যাবেন না, কারণ, তাঁর এবং তাঁর মতো আরও অনেকেরই একটা ধারণা জন্মে গিয়েছিলো যে, করোনার কারণে কেউ হাসপাতালে ভর্তি হলে আর বেঁচে ফিরে আসে না।
আজিমের অবস্থা যখন খুবই গুরুতর হয়ে উঠলো তখন তাঁর এক বন্ধু কারও কথা না শুনে এম্বুলেন্স ডেকে তাঁকে ব্রাডফোর্ড রয়্যাল ইনফারমারি হাসপাতালে পাঠালেন। রক্তে তখন তাঁর অক্সিজেনের মাত্রা খুবই কম, ডাক্তাররা বলেছেন, জীবন ধারণের জন্যে যতোটুকু অক্সিজেন তাঁর রক্তে প্রয়োজন সে সময় সেটা তাঁর ছিলো না। হাসপাতালের ইমার্জেন্সি থেকে তাঁকে সরাসরি দ্রুত নিয়ে যাওয়া হলো ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ)। সেদিন রাতে আজিমের পরিবার হাসপাতাল থেকে একটা ফোন পেলেন, তাঁদের বলা হলো, অজিম হয়তো আর ঘন্টাখানেক বাঁচবেন।
কিন্তু হাসপাতালের ডাক্তাররা হাল ছাড়ছিলেন না। জীবন-মরণের মাঝামাঝি এক অদ্ভুত আঁধারে আজিম ছিলেন ৪৮টি দিন। এ সময়টায় তাঁকে কোমাতে নিয়ে রাখা হয়। হাসপাতালে তাঁকে থাকতে হয় সব মিলিয়ে ৬৮ দিন।
আজিমের অক্সিজেন মাত্রা চিকিৎসকরা কোন অবস্থাতেই কাংখিত মাত্রায় নিয়ে তুলতে পারছিলেন না। এর ফলে তাঁর হার্ট ও ব্রেইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যাওয়ার প্রবল শঙ্কা দেখা দিয়েছিলো। আজিম ক্রমশ যেন জীবন থেকে দূরে সরে যাচ্ছিলেন। ভেন্টিলেটরের সাহায্যে তাঁর শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যবস্থা করা হয়। হাসপাতালে পক্ষ থেকে আজিমের পরিবারকে তাঁর চিকিৎসার ব্যাপারে যেমন খবরাখবর দেয়া হচ্ছিলো, তেমনি সম্ভাব্য শোকের জন্যেও মানসিকভাবে প্রস্তুত করা হচ্ছিলো।
এরই এক পর্যায়ে আজমের শরীর অক্সিজেন গ্রহণে একটু একটু করে সাড়া দিতে শুরু করেেলা। ডাক্তাররা বললেন, এটা মিরাকল। বিস্ময়ে তাঁরা অভিভূত হয়ে পড়লেন। কোমা থেকে তাঁকে আবার জাগিয়ে তোলার পর আজিম নতুনভাবে পৃথিবীতে ফিরে এসে কি রকম করে সাড়া দেবেন, সে নিয়ে ডাক্তাররা অনিশ্চয়তায় ছিলেন।
কিন্তু সবাইকে আশাতীতভাবে আনন্দ-ধারায় অবগাহিত করে আজিম পৃথিবীর ‘নতুন‘ জীবনের প্রতি সাড়া দিলেন ভালোভাবে। এক পর্যায়ে ফিজিও শুরু হলে তাঁর আরও উন্নতি লক্ষ্য করা যায়। এরই এক পর্যায়ে আজিম যেন সুস্থতার পথে ছুটতে শুরু করে দিলেন।
আজিমের অস্তিত্ব যখন অদ্ভুত অন্ধকার জগতে দোলায়মান তখন তিনি এক ভয়ঙ্কর দু:স্বপ্ন দেখেছেন। দেখেছেন, তাঁকে কেউ গুলি করছে এবং পরপর তিনটি গুলি করা হয়েছে তাঁকে। এটুকুই তিনি চিকিৎসকদের বলতে পারলেন ওই সময়টা বর্ণনার চেষ্টা করতে গিয়ে।
মোহাম্মদ হোসেইন নামের আরও এক যুবক চিকিৎসকদের কাছে কোমায় থাকাকালে তাঁর দেখা স্বপ্নের কথা জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, তাঁর কাছে মনে হয়েছে, তাঁর পরিবার এক সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়েছেন।
আজিম এবং হোসেইন নিশ্চিতভাবেই ভাগ্যবান। প্রায় হাল ছেড়ে দেয়ার মতো পরিস্থিতিতে গিয়ে পৌঁছার পরও তাঁরা আবারও ফিরতে পেরেছেন তাঁদের চেনা এই পৃথিবীতে। করোনায় আক্রান্ত সবার পক্ষে এই সৌভাগ্যের অংশীদার সুযোগ হয়নি।
কিন্তু তার মানে এই নয় যে, করোনায় আক্রান্তদের সিংহভাগ প্রাণ হারিয়েছেন।
২২ জুলাই ২০২০। করোনাভাইরাস সম্পর্কিত সর্বশেষ হিসেব হলো: গোটা বিশ্বে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ১ কোটি ৫১ লাখ ২২ হাজার ৯৪২ জন। এ পর্যন্ত এই প্রাণঘাতি ভাইরাসে প্রাণ হারিয়েছেন ৬ লাখ ২০ হাজার ৩০৬ জন। রোগ থেকে সেরে উঠেছেন ৯১ লাখ ৩৮ হাজার ৭৪০ জন।
এই হিসেব থেকে দেখা যাচ্ছে আক্রান্তদের মধ্যে সেরে উঠেছেন শতকরা ৯৪ ভাগ। মারা গেছেন শতকরা ৬ ভাগ। শতকরা হিসেবে প্রাণহাণির সংখ্যা কম থাকলেও করোনা নিয়ে বিশ্ব জুড়ে যে ভীতি ও শঙ্কা তার মুলে রয়েছে এখনও রোগটির প্রতিষেধক বা চিকিৎসা না থাকা আর সেই সুবাদে ভাইরাসটির দ্রুত সংক্রমণ আর প্রাণ সংহারের ভয় জাগানিয়া ক্ষমতা। ।
নতুন এই ভাইরাসের প্রকোপে প্রাণহাণির সংখ্য শতকরা হিসেবে যতোই কম দেখা যাক না কেন, এই নতুন জীবাণু মানুষকে এরই মধ্যে এই দুনিয়ার জীবনে নজির ছাড়া পরিবর্তন আনতে বাধ্য করেছে। এটি একটা সময়ে দুর্বল হয়ে পড়লেও স্থায়িভাবে নতুন আকার দিতে পারে পৃথিবীর রাষ্ট্র ও সমাজ জীবনের নানা স্তর ।
প্রকৃতপক্ষেই ব্যক্তিগত সম্পর্ক থেকে শুরু করে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনা, সামাজিক আচরণ থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা এবং অর্থনীতির চাকা সচল করা থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক- সর্বত্রই করোনার প্রভাব পড়েছে ব্যাপকভাবে। মেন্টাল হেলথ পরিস্থিতি, ডিজএবল মানুষের কেয়ার, ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি নানা বিষয় রয়েছে, যেগুলোতে করোনাজনিত পরিস্থিতির প্রভাব লক্ষ্যণীয়ভাবেই পড়ছে।
সাধারণ মানুষ এবং সরকার- কেউই চাইবে না দেশ আবারও করোনার ছোবলে আক্রান্ত হোক। তাই করোনার কারণে আমাদের হাইজিন কালচারে স্থায়ি পরিবর্তন আসতে পারে। মাস্ক, গ্লাভস, হ্যান্ড স্যানিটাইজার এবং হাত ধোয়া-এগুলো আমাদের নিত্যদিনের অপরিহার্য বিষয় হয়ে উঠতে পারে। সোশ্যাল ডিসটেন্সিং এখনকার পর্যায়ে না থাকলেও হ্যান্ডশেইক হয়তো বিদায় নিলো চিরতরে।
লেখার শুরুতে যে আজিম এবং হোসেইনের কথা বলা হয়েছিলো, তারা আক্ষরিক অর্থেই মৃত্যুর শীতল হাত ছুঁয়ে আবার ফিরে এসেছিলেন এই পৃথিবীতে। ৯৪ শতাংশ মানুষই সামান্য, মাঝারি এবং গুরুতর ভাবে করোনায় আক্রান্ত হয়েও আরোগ্য লাভ করেছেন। কিন্তু অবশিষ্ট যে ৬ শতাংশ মানুষ বিদায় নিয়েছেন এই পৃথিবী থেকে, তাঁদের মৃত্যুর সাথে করোনার যে ভয়াবহ যোগস্পর্শ সেটা আমাদের এই গ্রহের মানবকূলের জীবনে বিশাল ঝাঁকুনি দিয়ে খুলে দিয়েছে নতুন ভাবনার জগত।
এ যেন মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত হয়ে মৃত্যুর অন্ধ কোপের কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ।
এই অন্ধ কোপ থেকে প্রাণ বাঁচাতে আমরা এখন যেসব বাহ্যিক আচরণে পরিবর্তন আনছি, সেগুলো সামাজিক এবং পারিপার্শ্বিক। কিন্তু আমাদের মনোজগতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনার সময় কি এখনো হয়নি? আমরা দারিদ্র বিমোচনের কথা বলি, যুদ্ধমুক্ত বিশ্বের কথা বলি, মানবাধিকারের কথা বলি, সাম্যের কথাও বলে থাকি আমরা।
অনেক ক্ষেত্রেই আগের তুলনায় ইতিবাচক অনেক পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু আমরা জানি, বিশ্ব এখনো সংঘাতে বিষাক্ত, দারিদ্রে জর্জরিত কোটি কোটি মানুষ, মানবাধিকার অহর্নিশ পদদলিত হয়ে চলেছে ক্ষমতাবানের নির্লজ্জ দম্ভে আর সাম্যকথা যেন আজও দুর্বল মানুষের জীর্ণ বর্ম।
বিশ্ব জুড়ে নি:শব্দ ঘাতকের যে অপ্রতিরোধ্য ধ্বংসলীলায় বিশ্ব পর্যদুস্ত হয়ে চলেছে, তার অনুচ্চারিত মর্মার্থ বুঝে নেয়ার সময় কি এখনো হয়নি? জাগতিক ক্ষমতা-শক্তির বাইরেও একটি শক্তি এই পৃথিবীর সব শক্তিকে তুচ্ছ করে দেয়, দিতে পারে, করোনাভাইরাসের এই উপাখ্যান থেকে সেই শিক্ষা নিতে পারলেই আমাদের জ্ঞান-গরিমার বড়াই যথার্থ হতে পারতো।
লন্ডন, ২৩/০৭/২০