মন্তব্য কলাম

img

শেখ হাসিনা কতোখানি চ্যালেঞ্জিং এখনো?

প্রকাশিত :  ১৩:৪১, ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২০
সর্বশেষ আপডেট: ১৫:৫০, ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২০

টক্ অব দ্যা টাইমস

শেখ হাসিনা কতোখানি চ্যালেঞ্জিং এখনো?

মুহাম্মদ আব্দুস সাত্তার

প্রধানমন্ত্রি শেখ হাসিনা বাংলাদেশের ইতিহাসে এ যাবতকালের দীর্ঘকালীন প্রধানমন্ত্রি। এখন তিনি সরকার পরিচালনায় করছেন চতুর্থ মেয়াদে। প্রথম দফার পর মাঝখানে সাত বছরের কিছু বেশি সময়ের ছেদ পড়েছিলো। কিন্তু ২০০৯ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে এ যাবত তিনি ক্ষমতায় রয়েছেন পর পর তিন দফা। 

বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকান্ডের পর দীর্ঘ ছ‘ বছরের মতো নির্বসিত জীবন যাপনে বাধ্য হওয়ার পর ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে আসা, তখনকার নবিশ রাজনীতিক শেখ হাসিনা আর ২০২০ সালের পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ শেখ হাসিনার মধ্যেকার পার্থক্য বোঝা কঠিন নয়। 

রাজনীতিতে হাতে খড়ির পর থেকেই শেখ হাসিনা রাজনীতির টেক্সট বুকের দিকে নজর রেখেছেন ঠিক মতো, সেটা ফলো করতে যা যা কিছু করা দরকার ছিলো তা তিনি করে গিয়েছেন। 

উর্দি-ভিত্তিক রাজনীতিক জিয়াউর রহমানের শাসনামলের শেষ দু‘টি সপ্তাহ তাঁকে দেখতে হয়েছে। এরপর দেখেছেন আরেক উর্দি পরা রাজনীতিক এরশাদের নয় বছরের শাসনামল। রাজনীতির টেক্সট বুক ভালো করে পড়ে ও বুঝে নিতে এরশাদের শাসনামলকে শেখ হাসিনা ঠিক মতো কাজে লাগিয়েছেন। সে সময় তাঁকে সামরিক শাসক এরশাদের পাশাপাশি পূর্ববর্তী সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের স্ত্রী, রাজনীতিতে তাঁরই মতো আরেক নবাগত এবং তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী, বেগম খালেদা জিয়াকেও মোকাবেলা করতে হয়েছে। 

খুব টালমাটাল সময় ছিলো সেটি, কিন্তু সেই সময়টিই অন্যতম সহায়ক ছিলো সেদিনের শেখ হাসিনা আজকের শেখ হাসিনা হয়ে গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে। সে সময় তাঁকে শাসকচক্রের হাতে বন্দীত্বের স্বাদ পেতে হয়েছে। চট্টগামে তাঁর জনসভা লক্ষ্য করে অবিরাম গুলিবৃষ্টির মধ্যেও শেখ হাসিনা মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গেছেন। আবার প্রথম দফা প্রধানমন্ত্রীত্বের দায়িত্ব পালনের পর তিনি যখন ফের বিরোধীদলীয় নেত্রী, সে সময় তাঁকে হত্যার লক্ষ্যে ঢাকায় ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট চালানো নৃশংস গ্রেনেড হামলা থেকেও বেঁচে ফিরেছেন তিনি। 

২০০৭-০৮এ সেনা সমর্থিত তত্বাবধায়ক সরকারের সময়েও শেখ হাসিনাকে রাজনীতির কঠিন পাঠ গ্রহণ করতে হয়েছে। সে সময়েও তাঁকে পেতে হয়েছে কারাবন্দীত্বের স্বাদ।

এসব কিছু ছিলো রাজনীতির পাঠশালায় তাঁর জন্যে গুরুত্বপূর্ণ সব পাঠক্রম। আজকের শেখ হাসিনার রাষ্ট্র পরিচালনার দিকে মনোযোগ দিলে বুঝতে অসুবিধা হয় না, রাজনীতির সব পাঠ তিনি আত্মস্থ করতে পেরেছেন যথার্থ ভাবেই।  

পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ শেখ হাসিনা সরকার প্রধান হিসেবে কেমন করছেন আসলে? 

যে কোন বিবেচনায় নিশ্চিতভাবে তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দু‘টি সাফল্য হচ্ছে: বঙ্গবন্ধুর ঘাতক এবং একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করা ও সে বিচারের রায় কার্যকর করতে সক্ষম হওয়া।

জাতির জনককে সপরিবারে হত্যার পরবর্তীতে দু‘ দুটো সামরিক শাসনে দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া বাংলাদেশের প্রেক্ষিত বিবেচনায় নিলে এ দুটো কাজ ছিলো অসম্ভবের কিনারায়। বিশেষ করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং আদালতে ফাঁসির দন্ডে দন্ডিতদের রায় কার্যকর হবে, শেখ হাসিনার অন্ধ ভক্তদের কাছেও তা ছিলো এক রকম অবিশ্বাস্য একটি স্বপ্ন। কিন্তু অটল শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সে স্বপ্নের সফল বাস্তবায়ন সম্ভব হলো । 

পিতার মতোই দু:সাহসী, যা বিশ্বাস করেন তার পক্ষে লড়াইয়ে নামতে তাঁর কোন দ্বিধা নেই, লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেন প্রথম সারিতে থেকেই ।

মোটা দাগে শেখ হাসিনার বড় ধরণের সাফল্যের তালিকায় আরও আছে: দেশে ধারাবাহিক অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার সূচনা ও তা অব্যাহত রাখা; বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করতে সক্ষম হওয়া; রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন; কঠোর হাতে জঙ্গী তৎপরতা নিয়ন্ত্রণ; রাজনৈতিক ব্যানারে সহিংসতা-সন্ত্রাসী তৎপরতা প্রায় নির্মূল করা; বিশ্ব ব্যাঙ্ক আর্থিক সহায়তা প্রত্যাহার করে নেয়ার পর তাদের চ্যালেঞ্জ করেই দেশের বৃহত্তম পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শুরু ও সাফল্যের সাথে তা অব্যাহত রাখা এবং দশ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থিকে বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণের সুযোগ দেয়া।

এ সব কিছু শেখ হাসিনার পক্ষে করা সম্ভব হয়েছে তাঁর দু:সাহসী চ্যালেঞ্জিং মনোভাবের কারণে। ৭৫-পরবর্তী জীবনটাই হয়তো তাঁর কাছে একটা চ্যালেঞ্জ। ১৫ আগস্টের ঘাতকদের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া, এরপরও নির্মম এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকা, এক সময় রাজনীতির ঘূর্ণি-আবর্তে নিজেকে সঁপে দেয়া এবং অবশেষে দেশের মানুষকে সাথে নিয়ে ঘুরে দাঁড়ানো। 

২০২০ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর তিনি পা রাখছেন ৭৩ বছর বয়সে। শেখ হাসিনা কি এখনো চ্যালেঞ্জিং? হলে কতোখানি?

যে চ্যালেঞ্জ এখন তাঁর সামনে তা হচ্ছে আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন জন-আকাংখার ভিত্তিতে সুবিচার আর সুশাসন-ভিত্তিক বাংলাদেশ গড়া আর দুর্নীতির মূলোৎপাটন। 

আজকের বাস্তবতায় (ক্ষেত্রবিশেষ ছাড়া) রাষ্ট্রের একজন নাগরিক তাঁর আইনসম্মত প্রয়োজনেও (ব্যতিক্রমী ঘটনা বাদে) সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রীয় সংস্থার লোকজনদের কাছ থেকে ততক্ষণ পর্যন্ত প্রকৃত কোন সহযোগিতা পান না, যতক্ষণ পর্যন্ত না তিনি তাদের সাথে ব্যক্তিগত লেনদেনে সম্মত হয়েছেন। অর্থাৎ, সোজাসাপ্টা ভাষায়, বাংলাদেশে ঘুষ ছাড়া  কোন কাজ করাতে পারা এখন সুকঠিন, প্রায় অসম্ভব। ঘুষ লেনদেন ছাড়া দেশে কি কি কাজ করা সম্ভব সেটি নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে একটি গবেষণা চালানো যেতে পারে। ঘুষ না নিয়ে কেউ যদি কারও কাজ সমাধা করে দেন, তাহলে তিনি নির্ঘাত জাতীয় সংবাদে পরিণত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে ফেলেন। 

এ কেমন রাষ্ট্র? শেখ হাসিনা এ কোন্্ রাষ্ট্রের কান্ডারী?

বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি পুলিশ ও বিচার বিভাগসহ রাষ্ট্রীয় সব সংস্থাকে যে দায়িত্ব পালনের জন্যে সবেতনে নিয়োজিত রেখেছে, নেহায়েত ব্যতিক্রম ছাড়া সেই দায়িত্ব পালনে ওই সংস্থাগুলোতে কর্মরতদের যখন সক্রিয়তা থাকে না, তখন তার দায় কি শেখ হাসিনার ওপর বর্তায় না? শেখ হাসিনাকে কেন সে দায় নিতে হবে?

করোনাভাইরাসের মতো দুনিয়া-জোড়া একটি মহামারীতে মানুষের ভয়ঙ্কর মৃত্যুর বিষয়টিকেও পূঁজি করে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতির মোচ্ছবের সংবাদ জানা গেলো। মানুষের জীবন-মরণ নিয়ে এ রকম খেলা যেন না হয়, সেটা নিশ্চিত করার জন্যে যারা ছিলেন, তাদের পাশে নিয়েই এই কান্ডগুলো ঘটে গেলো। ওরা সবাই এখনো বহাল তবিয়তেই আছেন। মানুষ কিন্তু শেখ হাসিনাকে দুষতে ছাড়ছে না। শেখ হাসিনা কি তা শুনতে পাচ্ছেন? 

গুমের ঘটনা বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের পর যখন তার নিষ্করুণ গৎবাঁধা ব্যাখ্যা ছুঁড়ে দিয়ে চ্যাপ্টার ক্লোজ করে দেয়া হয়, তখন কি শেখ হাসিনার মনে পড়ে না ‘বিচারের বাণি নীরবে নিভৃতে কাঁদার‘ সেই হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া বাণিটির কথা? 

ক্ষমতা আর অর্থলিপ্সা এখন যেন বাংলাদেশে একে অপরের পরিপূরক। এমন পরিস্থিতি এক দিনে হয়নি। বহু দিনে, বহু কালে এই ধারা গড়ে উঠেছে। সামরিক অপশাসকরা ইচ্ছাকৃতভাবে এই ধারায় পুষ্টি ও সার যুগিয়েছেন। পঞ্চাশ বছরের এতা জঞ্জাল সাফের দায়িত্ব একা শেখ হাসিনাকেই নিতে হবে কেন? প্রশ্নটি সঙ্গত। কিন্তু বহু কাল ধরে জমে ওঠা অনেক জঞ্জাল পরিষ্কারের দায়িত্ব শেখ হাসিনাই গ্রহণ করেছেন, এর অনেকগুলোতে তিনি সফলও হয়েছেন। মানুষের প্রত্যাশা তাঁর কাছে থাকবেই। আর ক্ষমতায় যিনি আছেন, মানুষ তাঁর কাছেই আশা করবে, কারণ, আশা পূরণে কিছু করবার সক্ষমতা তো ক্ষমতাসীনের হাতেই থাকে। 

মানুষ শেখ হাসিনাকে সব করতে বলে না। সব করা তাঁর পক্ষে সম্ভবও না। রাতারাতি সব কিছু করে ফেলাও সম্ভব নয়, মানুষ সে দাবিটি করেও না। 

কিন্তু মানুষ চায়, অনেকগুলো সফল কাজের পর এবার তিনি একটি সফল রাষ্ট্রের ভিত্তি গড়বার কাজে হাত দিন। ন্যায় বিচার-ভিত্তিক সুশাসন আর দুর্নীতির মূলোৎপাটন ছাড়া সফল রাষ্ট্র গঠন সম্ভব নয়। আর সফল রাষ্ট্র গড়ে তোলা না গেলে আগের সফল কাজগুলোর সুফল ধরে রাখা কঠিন হয়ে যায়। শেখ হাসিনার পক্ষেও যেমন তা সহজ হবে না, তেমনি যিনি তাঁর স্থলাভিষিক্ত হবেন, তাঁর পক্ষেও সেটি কঠিন হয়েই থাকবে।  

বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় ন্যায় বিচার আর সুশাসন ফিরিয়ে আনা এবং দুর্নীতি নিরোধ Ñ  কঠিনতম কাগুলোর মধ্যেও কঠিনতম। সরকার প্রধান বাঁশি বাজাবেন আর সুশাসন প্রষ্ফূটিত হবে এবং হল্ট হয়ে যাবে দুর্নীতির মার্চ, তা হবে না।

অন্যায়, অবিচার ও অপশাসন আর দুর্নীতির সাথে জড়িয়ে আছে গোষ্ঠিভিত্তিক স্বার্থ, দেশি-বিদেশি কোটারী চক্রের সুগভীর স্বার্থও জড়িত এর সাথে। এগুলোর মূলোৎপাটন ‘শেখ হাসিনা ইচ্ছে করলেন আর হয়ে গেলো‘ সে রকম নয়। অনেক কিছু বিবেচনায় নিয়েই এই কাজটিতে হাত দিতে হবে। অনেক বাধা আসবে, ষড়যন্ত্র হবে, হবে কূটকৌশলের খেলা। অন্যায়ের রাজত্বে বেঈমানী অন্যতম শক্তিশালী স্তম্ভ, সে বিষয়েও গভীরভাবে সতর্ক থাকতে হবে। 

অপশাসন বদলে দেয়া? দুর্নীতির মূল উপড়ে ফেলা? মনে রাখবেন, এটা যুদ্ধ, ছেলেখেলা নয়। পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের প্রস্ততি নিয়েই এ কাজে নামতে হবে। বঙ্গবন্ধু তাঁর পঞ্চান্ন বছরের জীবনটাকে বাজি রেখেছিলেন পঞ্চান্ন হাজার বর্গমাইলের এই গাঙ্গেয় বদ্বীপকে বাঙালির সুখের আবাস বানানোর লক্ষ্যে, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের সাথে বেঈমানী করা দুর্নীতিবাজ অসুরদের তান্ডব নৃত্যের জন্যে নয়। বঙ্গবন্ধু  যুদ্ধ করে দেশটি স্বাধীন করে দিয়ে গেছেন। এখন যুদ্ধ শেখ হাসিনার, দেশটি গড়ে তুলবার। 

তবে যুদ্ধই হোক। এজন্যে কি প্রস্তুত শেখ হাসিনা? কতোখানি চ্যালেঞ্জিং তিনি এখনো? 


(মুহাম্মদ আব্দুস সাত্তার: স্পেশাল কন্ট্রিবিউটর, জনমত ডটকম, সাবেক নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক সিলেটের ডাক, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাব, ও সিলেট প্রেস ক্লাব)

লন্ডন ৩ সেপ্টেম্বর ২০২০

মতামত এর আরও খবর

img

গাজা যুদ্ধ বন্ধে বাইডেন কেন এতটা মরিয়া

প্রকাশিত :  ১১:৪১, ১২ মে ২০২৪
সর্বশেষ আপডেট: ১১:৪৮, ১২ মে ২০২৪

জনাথন ফ্রিডল্যান্ড

দ্বিতীয় দফায় নির্বাচিত হবেন কি না তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের উদ্বেগ একেবারে প্রান্তে এসে পৌঁছেছে। জো বাইডেনের পরামর্শ বারবার উপেক্ষা করে আসছিলেন বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। এই উপেক্ষার মূল্য কী হতে পারে, এই সপ্তাহে ইসরায়েল সেটা দেখতে পেল।

ইসরায়েলের ৩ হাজার ৫০০ বোমার চালান আটকে দিয়েছে বাইডেন প্রশাসন। এই অস্ত্র ইসরায়েল গাজার দক্ষিণের শহর রাফা আক্রমণে ব্যবহার করবে, সেই বিবেচনায় অস্ত্রের চালানটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। রাফায় এখন ১০ লাখের বেশি শরণার্থীর আশ্রয়শিবির।

ইসরায়েলের প্রতি জো বাইডেন তাঁর ‘লৌহদৃঢ়’ সমর্থন থেকে সরে আসছেন না। কিন্তু ইসরায়েল রাফা হামলার জন্য যে হুমকি দিয়ে চলেছে, সেটা সফল করতে অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করবেন না। সিএনএনকে বাইডেন বলেছেন, ‘ইসরায়েলের নিরাপত্তা দেওয়া থেকে আমরা সরে আসছি না। অন্যখানে যুদ্ধ করার সক্ষমতা তৈরির পথ থেকে সরে আসছি আমরা।’

ইসরায়েলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিত্র যুক্তরাষ্ট্র। ইসরায়েলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী আইজাক রবিন বলতেন, তাঁর দেশের ১ নম্বর কৌশলগত সম্পদ এই সব অস্ত্র, এমনকি পারমাণবিক অস্ত্র নয়; বরং ওয়াশিংটনের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক। দশকের পর দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় অস্ত্রের জোগানদাতা ও কূটনৈতিক অভিভাবক। 

কিন্তু মাত্র ছয় সপ্তাহের ব্যবধানে ওয়াশিংটন এমন দুটি পদক্ষেপ নিল, যা পুরোপুরি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গেল। গত মার্চ মাসে নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ভেটো দেওয়া থেকে বিরত থাকে যুক্তরাষ্ট্র। ফলে ইসরায়েল প্রস্তাবটি আটকে দিতে চাইলেও ব্যর্থ হয়। আর এখন তো ওয়াশিংটন অস্ত্রের চালান আটকে দিল।

এর থেকেও বড় বিষয় হলো, এই সিদ্ধান্তগুলো এমন একজন রাজনীতিবিদ নিয়েছেন, যিনি ব্যক্তিগতভাবে ইসরায়েলের খুব নিবেদিতপ্রাণ সমর্থক। বাইডেন সেই যুগের একজন ডেমোক্র্যাট, যখন দুই সহস্রাব্দের নির্বাসন ও শাস্তির পর মধ্যপ্রাচ্যে ইহুদিদের আদি বাড়ি প্রতিষ্ঠার বিষয়টি গতি পেতে শুরু করেছে। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের উদারপন্থীদের চোখ তখন রহস্যজনকভাবে বন্ধ ছিল।  

গোল্ডা মেয়ার থেকে শুরু করে ইসরায়েলের প্রত্যেক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বাইডেন দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে। ইসরায়েলের প্রতি বাইডেনের টান বাড়ার ক্ষেত্রে এর একটার ভূমিকা আছে। পূর্বতন প্রেসিডেন্টদের মতো বাইডেনের ইসরায়েলের প্রতি ভ্রাতৃত্ববোধ শুধু নির্বাচনী হিসাব-নিকাশের বিষয় নয়।  

গাজা নিয়ে কোনো চুক্তি হচ্ছে না। কেননা, নেতানিয়াহু কিংবা সিনাওয়ারা কেউই বিশ্বাস করেন না, চুক্তি করলে তাঁদের স্বার্থ রক্ষিত হয়। যেমনটা যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক কর্মকর্তা অ্যারন ডেভিড মিলার বলেছেন, ‘এই সংঘাত বন্ধে একটি পক্ষেরই কেবল সত্যিকারের তাড়া আছে, সেই পক্ষটি হলেন জো বাইডেন।’

অন্যদিকে ১৯৮০-এর দশকে নেতানিয়াহু প্রথম আলোচনার পাদপ্রদীপে উঠে আসেন। তিনি এমন একজন কূটনীতিক, যিনি আমেরিকানদের সঙ্গে সাবলীলভাবে কথা বলতেন। সে সময় থেকেই তিনি নিজেকে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে দাঁড় করান। ইসরায়েলের একজন হবু নেতার জন্য এই দক্ষতা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। 

কয়েক দশক ধরে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তাঁর ভোটারদের এই বার্তা দিয়ে আসছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের মধ্যকার সব ধরনের গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ক্ষেত্রে তিনিই একমাত্র বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তি।

কিন্তু বাস্তব অবস্থাটা এখন কী দাঁড়াল?  চার দশকের বেশি সময়ের মধ্যে বাইডেনই প্রথম প্রেসিডেন্ট যিনি ইসরায়েলকে সামরিক সহায়তা দেওয়া বন্ধ করলেন। (১৯৮২ সালে ইসরায়েলের লেবানন অভিযানের সময় রোনাল্ড রিগ্যান যুদ্ধবিমান দিতে বিলম্ব করেছিলেন।) বাইডেন কেন এটা করলেন? কারণ, নেতানিয়াহু যুক্তরাষ্ট্রের একটি অংশের জনগোষ্ঠীর মধ্যে এমন তিক্ততা তৈরি করেছেন, যেটা আগে দেখা যায়নি।

ইসরায়েলের প্রতি যে যুক্তরাষ্ট্রের সমাজের নিরেট সমর্থন, তাতে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যেভাবে ছাত্র আন্দোলন আছড়ে পড়েছে, সেটা বিস্ময়করই। আন্তর্জাতিক জরিপ সংস্থা গ্যালাপের মার্চ মাসের জরিপ বলছে, ৫১ শতাংশ ইসরায়েলের পক্ষে সমর্থন দিয়েছে, ২৭ শতাংশ সমর্থন দিয়েছে ফিলিস্তিনের পক্ষে। কিন্তু ডেমোক্র্যাট ও তরুণ জনগোষ্ঠী—দুই ক্ষেত্রেই ফিলিস্তিনিদের পক্ষে সমর্থন অনেকটাই বেড়েছে।

জরিপের এই তথ্য বাইডেন ও তাঁর নির্বাচনী প্রচারণা দলকে চিন্তার মধ্যে ফেলেছে। এই অংশের দ্ব্যর্থহীন সমর্থনই ২০২০ সালের নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে পরাজিত করতে ভূমিকা রেখেছিল। গাজাবাসীর দুর্ভোগ সেই ভোটারদের সমর্থন অনিশ্চিত করে তুলেছে। হোয়াইট হাউস নেতানিয়াহুর কাছে পরিকল্পনা চেয়েছিলেন, বেসামরিক জনসাধারণকে হতাহত না করে কীভাবে রাফায় অভিযান করতে পারে ইসরায়েল। 

কিন্তু নেতানিয়াহু সেই পরিকল্পনা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। সেই কারণে ইসরায়েলকে থামানোর জন্য অস্ত্রের চালান আটকে দেওয়ার সরাসরি পথ বেছে নিয়েছে ওয়াশিংটন।

রাফা বাইডেনের জন্য শক্তি পরীক্ষার জায়গাও হয়ে উঠেছে। বাইডেন রাফাকে বিপদরেখা হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন। নেতানিয়াহু যদি সেই বিপদরেখা অতিক্রম করেন, তাহলে বাইডেন দুর্বল হিসেবে চিহ্নিত হবেন।

কিন্তু নেতানিয়াহু এখন পর্যন্ত রণেভঙ্গ দিতে অস্বীকার করেছেন। ইসরায়েলের স্বাধীনতা আন্দোলনকে সামনে রেখে জনগণের উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র ছাড়া আমরা একাই লড়ে যাব। প্রয়োজনে আমরা আমাদের নখ দিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাব।’ 

নেতানিয়াহু চার্চিলের মতো আওয়াজ তুলতে চাইছেন। কিন্তু তাঁর কথাগুলো দুর্বলের কণ্ঠস্বর, সবলের নয়। ওয়াশিংটন চায়, নেতানিয়াহু যেন রাফা অভিযান থেকে সরে আসেন। কিন্তু জোট সরকারের অতি ডানপন্থী মিত্ররা তাঁকে আরও কঠোর হতে বলছেন, রাফা অভিযানের মাধ্যমে হামাসের বিরুদ্ধে পুরোপুরি বিজয়ের জন্য বলছেন।

এই নিরানন্দ নাটকে বাইডেন ও নেতানিয়াহুই কেবল কুশীলব নন; হামাস নেতা ইয়াহিয়া সিনাওয়ারেরও নিজস্ব হিসাব-নিকাশ আছে, নেতা হিসেবে টিকে থাকার সংকল্প রয়েছে। খুব ঘনিষ্ঠভাবে যাঁরা সিনাওয়ারকেও পাঠ করেছেন তাঁরা বিশ্বাস করেন, নির্দোষ মানুষের জীবন রক্ষা করা তাঁর অগ্রাধিকার নয়; বরং যত বেশি গাজাবাসী নিহত হবেন, আন্তর্জাতিক পরিসরে তাঁর শত্রু ইসরায়েলে অবস্থান ততই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সেই পরিস্থিতি তাঁকে বিজয়ী দাবি করতে সহায়তা করবে। সম্প্রতি হামাস যুদ্ধবিরতি চুক্তি মেনে নেওয়ার ঘোষণার পেছনে সিনাওয়ারের এই ভাবনায় কাজ করেছে। 

সিনাওয়ারা সাময়িক কোনো যুদ্ধবিরতি (তাতে অনেক মানুষের প্রাণরক্ষা হয়, দুর্ভোগ কমে) চান না, তিনি চান স্থায়ী যুদ্ধবিরতি। আর তার জন্য সিনাওয়ারা অপেক্ষা করতেও রাজি।

গাজা নিয়ে কোনো চুক্তি হচ্ছে না। কেননা, নেতানিয়াহু কিংবা সিনাওয়ারা কেউই বিশ্বাস করেন না, চুক্তি করলে তাঁদের স্বার্থ রক্ষিত হয়। যেমনটা যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক কর্মকর্তা অ্যারন ডেভিড মিলার বলেছেন, ‘এই সংঘাত বন্ধে একটি পক্ষেরই কেবল সত্যিকারের তাড়া আছে, সেই পক্ষটি হলেন জো বাইডেন।’


জনাথন ফ্রিডল্যান্ড, ব্রিটিশ গণমাধ্যম গার্ডিয়ানের খ্যাতিমান কলামিস্ট

মতামত এর আরও খবর