ওহ বরিস! বাহ বরিস!!
টক্ অব দ্যা টাইমস
।। মুহাম্মদ আব্দুস সাত্তার।।
করোনাভীতির দ্বিতীয় পর্বে এখন আমাদের অবস্থান। করোনা যায়নি, আমরা জানি। জানি করোনার সঠিক প্রতিষেধক এখনও অবিষ্কার হয়নি। ফলে স্বস্তি নেই করোনা নিয়ে, স্বস্তি নেই জীবনের ধারাপাতে।
তবে যেহেতু এবার করোনার দ্বিতীয় হানা, সে কারণে লোকজন ঠিক আগের মতো ভয়ে জবু-থবু হয়ে পড়েননি। প্রথম দফার অভিজ্ঞতা অনেককে কিছুটা সাহস এনে দিয়েছে, কাউকে কাউকে দু:সাহসী করে তুলেছে আবার কাউকে কাউকে করে তুলেছে অবিশ্বাসীও।
সত্যি কথা হলো, এখন করোনার নাম শুনেই সবাই মুষড়ে পড়ছেন না। বরং, কি করে এর সাথে নিরাপদে সহাবস্থানের একটা তরিকা বের করে ফেলা যায়, এরকম চেষ্টা আম জনতার মাঝে লক্ষ্য করা যায়। সে চেষ্টা করতেই হবে। করোনার কারণে দেশের সব মানুষকেই কম বেশি ছ‘ মাসের মতো সময় মহাবিপদের কালো ছায়ার নিচে বসবাস করতে হয়েছে। এর মধ্যে আমরা অসহায়-করুণ মৃত্যু দেখেছি, মরণাপন্ন মানুষের ভয়ানক যন্ত্রণার বর্ণনা জেনেছি, শুনেছি আয়-রোজগারের তলানীর পথে যাত্রার ধ্বনি, সব মিলিয়ে মানুষকে সহযাত্রি হতে হয়েছে এক নিদারুণ নিদান কালের, শুধুমাত্রএই দেশ নয়, শুধুমাত্র এই মহাদেশ নয়, শুধুমাত্র পশ্চিম গোলার্ধ নয়, গোটা বিশ্ব জুড়ে বিরাজমান এই মহাসঙ্কটকাল।
করোনার প্রথম হানার সময় সবাই ছিলেন অনেকটাই অপ্রস্তুত। সাধারণ মানুষ তো বটেই, খোদ্্ সরকারকেও দেখা গেলো খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলতে। প্রধানমন্ত্রি বরিস জনসন তো প্রথম দিকে করোনা নিয়ে খেলাধূলা করবার মতো একটা মানসিকতা নিয়ে করোনা ‘মোকাবেলায়‘ হাত দিলেন। বললেন, দু‘বার ‘হ্যাপি বার্থ ডে‘ গাইতে যতোটা সময় লাগে ততোটা সময় নিয়ে সবাইকে দু‘হাত ভালো করে ধুয়ে নিতে হবে। ব্যস, তাহলেই করোনা কূপোকাত। কোন্্ এক হাসপাতাল পরিদর্শনে গিয়ে তিনি করোনা পরোয়া না করে উপস্থিতদের সাথে হাত মিলিয়েছিলেন-বীরদর্পে সে কথাও জানালেন তিনি। পরে এই তাঁকেই ২৩ মার্চ ঘোষণা দিতে হলো ন্যাশনাল লকডাউনের।
এর পর তো অনেক কাহিনী। অনেক বিতন্ডা। এর মাঝে করোনায় আক্রান্ত হয়ে বরিসকে হাসপাতালের আইসইউতে গিয়েও থাকতে হলো কয়েকটা দিন। কথা উঠলো, করোনার ভয়াবহতা চোখের সামনে ইটালিতে প্রকট হয়ে উঠতে থাকার পরও ব্রিটিশ সরকার এদেশে রোগটি মোকাবেলায় কার্যকর প্রস্ততি নেয়নি বা নেয়ার জন্যে প্রয়োজনীয় দক্ষতা তাদের ছিলো না।
এই প্রেক্ষাপটে এবারে করোনার দ্বিতীয় হানা প্রকট হয়ে উঠতে থাকার সময় এর মোকাবেলায় বরিস জনসনের নেতৃত্বাধীন ব্রিটিশ সরকারের প্রস্ততি কতোখানি-সে প্রশ্নটি এড়িয়ে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই।
পর্যায়ক্রমে লকডাউন তুলতে শুরু করার এক পর্যায়ে বরিস বলেছিলেন, তিনি খুবই আশাবাদি যে, ক্রিসমাসের আগেই করোনার আতঙ্ক দূরে সরে যাবে, সবাই ক্রিসমাস উদযাপন করতে সক্ষম হবেন আতঙ্কমুক্ত পরিবেশে। আগস্ট থেকে বলা শুরু হলো, ‘গো ব্যাক টু ওয়ার্ক‘, যার যার কাজে ফিরে যান। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি থেকেই আবার সুর বদলাতে শুরু করলো। প্রধানমন্ত্রি এবার বলতে শুরু করলেন ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম-ইফ ইউ ক্যান‘ অর্থাৎ, সম্ভব হলে ঘর থেকেই কাজ করুন। এবারে ছ‘ মাসের একটা মেয়াদ ছুঁড়ে দিলেন তিনি, বললেন, নতুন যেসব বিধিনিষেধ জারি হলো, সেগুলো আগামি ছ‘ মাস পর্যন্ত বলবৎ থাকবে এবং এরপরও ‘আমরা যে বিপদমুক্ত হয়ে যাবো, সেই তুষ্টিতে ভুগবার কোন সুযোগ নেই‘।
‘হ্যাপি বার্থডে‘ গাইবার আমন্ত্রণ জানিয়ে বরিসের করোনা-বিরোধী অভিযানের প্রথম পর্বের শুরু, এর শেষ দিকে তিনি ‘হ্যাপি ক্রিসমাসের‘ আগাম বার্তা দিয়ে রেখেছিলেন। এখন দেখা যাচ্ছে ক্রিসমাস-নিউ ইয়ার পেরিয়ে আগামি মার্চে, ব্রিটেনে ন্যাশনাল লকডাউনের প্রথম বর্ষপূর্তিও সময় পর্যন্ত চলবে তাঁর করোনা-বিরোধী দ্বিতীয় পর্বের যুদ্ধ এবং তারপরও আত্মতুষ্টিতে না ভুগতে তিনি সতর্কবাণি দিয়ে রাখছেন।
নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রি হিসেবে বরিস জনসন দায়িত্বভার নিয়েছেন নয় মাস আগে। তাঁর প্রথম যুদ্ধ ছিলো ব্রেক্সিট বাস্তবায়ন। সে নিয়ে বিশেষ কিছু করতে পারার আগেই করোনার হানা। করোনায় তাঁর সরকারের টালমাটাল পরিস্থিতি তেমন ভাবে সামলে তিনি উঠতে পারেননি। এর মধ্যেই আবারও ব্রেক্সিট যুদ্ধের দামামা। তার কোন দিক করতে পারার আগেই আবার তাঁর ঘাড়ে এসে নি:শ্বাস ফেলছে করোনার দ্বিতীয় অভিযান।
প্রধানমন্ত্রি বরিসের প্রথম বছরটিতে তাঁর সবচেয়ে প্রধান গুরুত্বপূর্ণ দু‘টি ফ্রন্ট হচ্ছে ব্রেক্সিট এবং করোনা। কিন্তু এই দুই ফ্রন্টেই তাঁর লেজেগোবরে দশা তাঁর সমর্থকদের যেমন হতাশ করেছে, তেমনি বিরোধী শিবিরে নিয়ে এসেছে উল্লাস আর সাধারণ মানুষের মধ্যে জন্ম দিয়েছে অবিশ্বাসের।
মঙ্গলবার ২৯ সেপ্টেম্বর বরিস তাঁর ভুলভাল একটি বক্তব্যের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করতে বাধ্য হয়েছেন। মঙ্গলবার দিনগত রাত থেকে নর্থ-ইস্ট ইংল্যান্ডে চালু হতে যাওয়া কোভিড-১৯ নিষেধ্জ্ঞা সম্পর্কে তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিলো। প্রথমে প্রধানমন্ত্রি বললেন, যে সব এলাকায় বাড়তি নিষেধাজ্ঞা নেই, সেসব এলাকার মানুষজন ইনডোর ও আউটডোর- দুই স্থানেই ৬ জন পর্যন্ত পরষ্পর একত্রিত হতে পারবেন। কথাটি সঠিক নয়। নতুন বিধান অনুযায়ি আউটডোরে এভাবে মিলিত হবার ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
বরিসের এই বক্তব্যটি লোকজনদের বিভ্রান্ত করেছে চরমভাবে। নর্থ-ইস্টের জন্যে সরকারের নতুন বিধান হচ্ছে: সেখানকার বাসিন্দারা পাব, রেস্টুরেন্ট ও নিজের ঘরসহ ইনডোর কোন সেটিংয়ে অন্য ঘরের বাসিন্দা কারও সাথে মিলিত হতে পারবেন না।
মঙ্গলবার সকালে স্কিলস মিনিস্টার গিলিয়ান কিগানও বিবিসির সাথে এক সাক্ষাৎকারে একই রকম অজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিলো: নর্থ-ইস্টের লোকজন কি পাবের গার্ডেন অংশে বা কোন রেস্টুরেন্টের বাইরের বসার অংশে অন্য কোন ঘরের কোন বাসিন্দার সাথে মিলিত হতে পারবেন? মিনিস্টারের অকপট জবাব ছিলো: এ প্রশ্নের জবাব আমার জানা নেই।
প্রধানমন্ত্রি বরিসের কান্ডটির পর লেবার পার্টির ডেপুটি লীডার এঞ্জেলা রেইনার বলেছেন: প্রধানমন্ত্রির ‘অযোগ্যতা মাত্রাছাড়া‘। শ্যাডো কেবিনেট অফিস মিনিস্টার র্যাচেল রীভস বলেছেন: প্রধানমন্ত্রি এমনকি বিধি-বিধান সম্পর্কেও কোন জ্ঞান রাখেন না।
ব্রেক্সিট বরিস প্রধামন্ত্রিত্বের প্রথম বছরেই যেভাবে খুবই জরুরী বিভিন্ন ইস্যুতে ঢিলেমি, দোদুল্যমানতা, সিদ্ধান্তহীনতা, সিদ্ধান্ত নিয়েও পিছিয়ে যাওয়া-ইত্যাদি কান্ড করে চলেছেন, তাতে তাঁর যোগ্যতা নিয়ে এরই মধ্যে প্রশ্ন উঠে গেছে। এটা শুধু বিরোধী পক্ষে নয়, বলতে গেলে, সব সেক্টরের গুরুত্বপর্ণ ব্যক্তিদের মধ্য থেকেই উঠেছে। সরকার পরিচালনায় ভুল হতে পারে, সেই ভুল সংশোধন কওে নেয়ার দৃষ্টান্তও একদমই যে নেই, তা নয়। কিন্তু মাত্রছাড়া ভুল করতে থাকা; ভুল যেন না হয়, সে বিষয়ে কার্যকর মনোযোগ না থাকা; ভুল স্বীকারের সৎসাহস না থাকা ইত্যাদি যখন এক সাথে যোগ হয় এবং ঘনঘন যখন এসবের পুনরাবৃত্তি হতে থাকে তখন শুধু উদ্বিগ্ন হওয়া নয়, আতঙ্কিত হয়ে পড়তে হয়।
করোনাভাইরাসের মতো একটি গুরুত্ব ইস্যু মোকাবেলায় বরিস জনসনের সরকার এ পর্যন্ত আশ্বস্ত হওয়ার মতো বিশেষ কোন দৃষ্টান্ত রাখতে পারেনি। আমরা জানি, করোনার প্রথম হানার সময় সরকারের দোদুল্যমান ও অনিশ্চিত ব্যবস্থার কারণে বিভিন্ন কেয়ার হোমে ২০ হাজারের মতো বয়ষ্ক মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। সরকার লকডাউন দিয়েছে দেরীতে, সেটা তুলেও নিয়েছে কিছুটা আগে-এসব অভিযোগ রয়েছে। আরো আছে, করোনা সম্পর্কিত অপর্যাপ্ত টেস্ট এন্ড ট্রেসিংয়ের অভিযোগ। এদিকে, করোনা সংক্রমণের হার আবারও ক্রমেই বাড়ছে। সরকার এখনও যদি দক্ষতার সাথে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার বিষয়ে বিশেষ মনোযোগী না হয়, তাহলে অনেক-অনেক মানুষের প্রাণ ঝুঁকির মধ্যে নিশ্চয় পড়ে যাবে। প্রথম দফার পর, এবারও যদি ঠেকানো যাওয়ার মতো মৃত্যু ঠেকানো না যায়, তাহলে বরিসের সরকারকে সেজন্যে বিপুল খেসারত দিতে হবে-নিশ্চিত করে বলা যায়।
বরিস জনসন পররাষ্ট্র মন্ত্রি থাকার সময় ইরানে আটক ব্রিটিশ-ইরানী নাগরিক নাজনীন সম্পর্কে ভুলভাল বক্তব্য দেয়ার কারণে ইরান সরকার নাজনীনের সাজা বাড়ানোর মওকা পেয়ে গিয়েছিলো। বরিস এ বিষয়ে তাঁর ভুল আজও স্বীকার করেননি। নাজনীন আজও বন্দী জেলের অন্ধ প্রকোষ্ঠে।
বরিস বলেছেন, করোনার প্রথম দফা মোকাবেলায় তাঁর সরকার ‘বিপুল সাফল্য‘ পেয়েছে। সেটা কি মৃতের সংখ্যার দিক থেকে গোটা বিশ্বের মধ্য পঞ্চম স্থান পাওয়ার সুবাদে? বরিসের কাছে যদি এটা বিপুল সাফল্যের নমুনা হয়ে থাকে তাহলে বলতেই হয়: ওহ বরিস! বাহ বরিস!!
লন্ডন ০১ অক্টোবর ২০২০
[লেখকঃ মুহাম্মদ আব্দুস সাত্তার, স্পেশাল কন্ট্রিবিউটর, জনমত ডটকম ও সাপ্তাহিক জনমত, সাবেক নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক সিলেটের ডাক, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, সিলেট প্রেস ক্লাব এবং প্রেস ক্লাব।]