img

সুপারম্যান‘ ট্রাম্প করোনাভাইরাসের ‘সুপারপাওয়ার‘ বুঝতে ভুল করেছেন

প্রকাশিত :  ১৫:৫৬, ০৪ অক্টোবর ২০২০
সর্বশেষ আপডেট: ১৬:২৩, ০৪ অক্টোবর ২০২০

সুপারম্যান‘ ট্রাম্প করোনাভাইরাসের ‘সুপারপাওয়ার‘ বুঝতে ভুল করেছেন

মুহাম্মদ আব্দুস সাত্তার

করোনাভাইরাস টেস্টিংয়ের সর্ব্বোচ্চ সুযোগ ছিলো তাঁর হাতের নাগালে, দেশের সেরা চিকিৎসা ব্যবস্থা ছিলো তাঁর সার্বক্ষণিক সঙ্গী, এদিক থেকে দেশের সবচেয়ে নিরাপদ মানুষ হওয়ার সর্ব্বোচ্চ সুযোগ ছিলো তাঁর। এর কোন কিছুর তোয়াক্কা তিনি করেননি। নিজেকে ‘সুপারম্যান‘ ভেবেছেন এবং চলেছেন সেরকম করে। এমন এক ধারণা তিনি তৈরী করে রেখেছিলেন যে, হোয়াইট হাউসে তাঁর আস্তানায় করোনা হানা দিতে সক্ষম হবে না।

কিন্তু ‘সুপারপাওয়ার‘ করোনা শেষ পর্যন্ত তাঁর দুর্গে আঘাত হনেছে এবং তাঁকে, তাঁর স্ত্রীকে এবং তাঁর সঙ্গী-সাথী অনেককেই কুপোকাত করেছে।

এ লেখার সময়ে পাওয়া শেষ খবর অনুযায়ি, হোয়াইট হাউসের চীফ অব স্টাফ মার্ক মীডোজ জানিয়েছেন, গত ২৪ ঘন্টায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অবস্থা খুবই উদ্বেগজনক ছিলো এবং আগামি ৪৮ ঘন্টা তাঁর অবস্থা খুব স্কংটাপন্ন থাকবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার আগে শুক্রবার সকালে ট্রাম্পকে সাপ্লিমেন্টাল অক্সিজেন দিতে হয়েছে বলেও জানা গেছে।

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের প্রায় শুরুর সময় থেকেই ডোনাল্ড ট্রাম্প চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের তুচ্ছ করে চলেছিলেন, করোনা পরিস্থিতিতে সকলের করণীয় সম্পর্কে তাঁর নিজের সরকারের বেঁধে দেয়া বিধি-বিধান ইচ্ছেমতো ভঙ্গ করে যাচ্ছিলেন এবং পরিস্থিতিকে যাঁরা যথাযথ গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় নিয়েছিলেন, শিষ্টাচারের কোন বালাই না রেখেই তিনি তাঁদের নিয়ে উৎকট উপহাস পর্যন্ত করতে কখনো কুন্ঠিত হননি।

ট্রাম্প একেবারে এই সেদিন পর্যন্তও বলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন যে, করোনা তেমন মারাত্মক কোন ব্যাধি নয় এবং এর সবচেয়ে খারাপ সময়টা পেরিয়ে গেছে। এমনকি তিনি নিজেও নিছক মৌলিক স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতেও গরজ দেখাননি। মাস্ক পরা বা সোশ্যাল ডিসটেন্সিং বজায় রাখা- এগুলোকে তিনি পাত্তা দেননি কখনো। করোনার দ্বিতীয় হানা এসেছে, এরপরও তিনি মার্কিন রাজ্যগুলোতে কড়াকড়ি ব্যবস্থা তুলে নিতে এবং শাটডাউন রুলগুলো বাতিল করা বা নিদেনপক্ষে কমিয়ে আনার জন্যে বিভিন্ন রাজ্যের গভর্ণরদের ওপর চাপ দিয়ে আসছিলেন।

মাস্ক পরা নিয়ে ট্রাম্প তাঁর নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বি জো বাইডেনকে নিয়ে রুচিহীন উপহাস করতেও ছাড়েননি। বলেছেন, সব সময় বাইডেন মাস্ক পরে থাকেন। আমার থেকে তিনি যদি ২০০ ফুট দূরেও থাকেন তাহলেও আমার দেখা সবচেয়ে বড় একটি মাস্ক পরেই তাঁকে হাজির হতে দেখা যাবে।

ট্রাম্প বারবার বলেছেন, করোনা ‘চলে যাবে‘। করোনার হানা যখন যুক্তরাষ্ট্রে তুঙ্গে উঠেছিলো, তার মাসখানেকের মধ্যেই তিনি মহামারীর প্রবল ভয়ঙ্কর দিকটি উপেক্ষা করে অর্থনীতির স্বার্থে সব কিছু আবার স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে আসার উদ্যোগ নিয়েছেন।

যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন একেবারে আসন্ন, যাতে ট্রাম্প আবারও প্রার্থি। এ উপলক্ষে আয়োজিত নির্বাচনী সমাবেশগুলোতে ট্রাম্প যেমন মাস্ক পরাকে পাত্তাই দেননি, তেমনি ওই সব সমাবেশে আসা তাঁর সমর্থকেরাও মাস্ক পরা বা সোশ্যাল ডিসটেন্সিংয়ের থোড়াই পরোয়া করেছেন।

শেষ পর্যন্ত বৃহষ্পতিবার দিনগত গভীর রাতে খবর এলো ‘সুপারম্যান‘ ডেনাল্ড ট্রাম্প ‘সুপারপাওয়ার‘ করোনার হাতে কব্জা হয়েছেন।

শুক্রবার তাঁকে স্থানান্তর করা হয় ওয়াশিংটনের অদূরে ওয়াল্টার রীড ন্যাশনাল মিলিটারি মেডিক্যাল সেন্টারে। শনিবার ওই মেডিক্যাল সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের চিকিৎসক ড. সীন কনলী বলেছেন, ‘৭২ ঘন্টা আগে‘ ট্রাম্পের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার কথা নিশ্চিত হওয়া গেছে। হিসেব কষে দেখা যাচ্ছে, এর অর্থ, বুধবার সকাল নাগাদ বিষয়টি জানতে পারা যায় । কিন্তু কি আশ্চর্য, ট্রাম্প বুধবার রাতে মিনেসোটায় যান তাঁর এক নির্বাচনী সমাবেশে। পরদিন বৃহষ্পতিবার তিনি যান নিউ জার্সিতে ফান্ডরেইজিং অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। এর ৩৬ ঘন্টা পর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বৃহষ্পতিবার দিনগত রাত ১টায় টুইট করে বিশ্ববাসিকে জানান তাঁর করোনা পজিটিভ হওয়ার কথা। ট্রাম্পের টুইট-বার্তার আগেই বৃহষ্পতিবার তাঁকে হোয়াইট হাউসে এন্টিভাইরাল চিকিৎসা দেয়া হয়েছে বলে সরকারীভাবেই স্বীকার করা হয়েছে।

ড. কনলী ‘প্রেসিডেন্ট অনেক ভালো রয়েছেন এবং তাঁর মনোবলও খুব শক্ত‘ এসব বলে ট্রাম্পের শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা জাগিয়ে রাখতে চেয়েছেন। কিন্তু হোয়াইট হাউসের চীফ অব স্টাফের বক্তব্য তো আসল গোমর ফাঁস করে দিলো।

যা কিছুই হোক না কেন, এই সত্য কিন্তু চাপা দেয়া যাচ্ছে না যে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন জেনেও বুধ ও বৃহষ্পতিবার বিভিন্ন কর্মসূচিতে যোগ দিয়ে তাঁর সঙ্গী-সাথিসহ আরো অনেক মানুষকে প্রাণঘাতি ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছেন।

ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি শিগগীরই ভালো ভালোয় সেরে ওঠেন এবং তাঁর স্বাভাবিক কাজকর্মে আবার আগের মতো ঝাঁপিয়ে পড়তে সক্ষম হন, তাহলে নিশ্চিত করেই বলা যায় ট্রাম্প তাঁর প্রিয় হাতিয়ার টুইটারে, তাঁর প্রিয় ফক্স নিউজে এবং আরও নানা উপায়ে সগর্জনে একথা বলে বেড়াতে লাগবেন যে, করোনা নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই, তাঁর এই বয়সেও তো তিনি সেটা মোকাবেলা করে সেরে উঠেছেন। সেই সাথে তিনি করোনার বিষয়টিকে বিশাল করে ‘দেখানোর‘ অভিযোগ তুলে সেজন্যে মিডিয়াকে আবারও এক হাত নেবেন তাঁর যাবতীয় শিষ্টাচার বিরোধী ভাষা ব্যবহার করে।

এই মানুষটি সকল সময় শারীরিক অসুস্থতাকে রাজনৈতিক দুর্বলতা বলে উপহাস করে এসেছেন। আজ তাঁর করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে শয্যাশায়ি হওয়া নিশ্চয় বড়ই অবমাননাকর ঠেকছে তাঁর কাছে। আমাদের মনে আছে, চার বছর আগে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্প তাঁর তৎকালীন ডেমোক্র্যাটিক প্রতিদ্বন্দ্বি হিলারী ক্লিনটনের নিউমোনিয়া হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে উপহাস করতে ছাড়েননি।

আসন্ন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ঠিক ৩১ দিন আগে তাঁকেই হাসপাতাল যাত্রা করতে হলো। নির্বাচনী ক্যাম্পেইনে কখন তিনি ফিরে আসতে পারবেন অথবা আদৌ আসা সম্ভব হবে কিনা, সে নিয়ে অনিশ্চয়তা এখন পুরো মাত্রায়।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের স্বাস্থ্য বিষয়ক জটিলতা জাতীয় নিরাপত্তার ইস্যু, কারণ, তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনীর কমান্ডার-ইন-চীফও। তাঁর শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি হলে এবং তিনি দায়িত্ব পালনে অপারগ হয়ে পড়লে সংবিধানের ২৫তম সংশোধনীর ৩য় সেকশন অনুযায়ি ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হবেন।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আচমকা রোগশয্যায় গমন যুক্তরাষ্ট্রে একই সাথে বেশ কয়েকটি জটিলতার সৃষ্টি করেছে। এগুলোর মধ্যে আছে, নির্বাচনের তারিখটির আগে পর্যন্ত ট্রাম্প সুস্থ হয়ে কাজে ফিরতে না পারলে প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার হস্তান্তর প্রসঙ্গ, সেক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থিতা প্রসঙ্গ, সুপ্রীম কোর্টে বিচারপতির শূণ্য আসনে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের দেয়া মনোনয়নের পরিণতি, নির্বাচনের তারিখ যদি পরিবর্তনের দরকার পড়ে, তাহলে কিভাবে তা করতে হবে ইত্যাদি। একই সাথে কোন কোন ইস্যুতে যে সিদ্ধান্তই নেয়া হোক, সেগুলো আবার কোর্ট পর্যন্ত গড়াতে পারে, সে আশঙ্কাও থাকছে।

সুতরাং, মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পূর্ববর্তী এই একটা মাস সেখানকার রাজনীতি চরম নাটকীয়তা ও উত্তেজনায় ভরপুর থাকবে, অনায়াসেই বলা যায়।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি তাঁর ভক্ত-সমর্থকদের জন্যে একটা ওয়েক আপ কল হিসেবেই বিবেচিত হওয় উচিত। ট্রাম্পের মতোই তারাও মনে করেন বা করতেন, করোনাভাইরাস একটি ভূয়া বিষয়, ভূয়া প্রচারণা। তা যে ঠিক নয়, মিলিটারি হাসপাতালের রোগশয্যায় শুয়ে কমান্ডার-ইন-চীফ ট্রাম্প এখন নিশ্চয় হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। ট্রাম্পের ভক্ত-সমর্থকদেরও সেটা বুঝে নেয়ার সময় হয়েছে।

মুহাম্মদ আব্দুস সাত্তার, লন্ডন, যুক্তরাজ্য।

মতামত এর আরও খবর

img

গাজা যুদ্ধ বন্ধে বাইডেন কেন এতটা মরিয়া

প্রকাশিত :  ১১:৪১, ১২ মে ২০২৪
সর্বশেষ আপডেট: ১১:৪৮, ১২ মে ২০২৪

জনাথন ফ্রিডল্যান্ড

দ্বিতীয় দফায় নির্বাচিত হবেন কি না তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের উদ্বেগ একেবারে প্রান্তে এসে পৌঁছেছে। জো বাইডেনের পরামর্শ বারবার উপেক্ষা করে আসছিলেন বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। এই উপেক্ষার মূল্য কী হতে পারে, এই সপ্তাহে ইসরায়েল সেটা দেখতে পেল।

ইসরায়েলের ৩ হাজার ৫০০ বোমার চালান আটকে দিয়েছে বাইডেন প্রশাসন। এই অস্ত্র ইসরায়েল গাজার দক্ষিণের শহর রাফা আক্রমণে ব্যবহার করবে, সেই বিবেচনায় অস্ত্রের চালানটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। রাফায় এখন ১০ লাখের বেশি শরণার্থীর আশ্রয়শিবির।

ইসরায়েলের প্রতি জো বাইডেন তাঁর ‘লৌহদৃঢ়’ সমর্থন থেকে সরে আসছেন না। কিন্তু ইসরায়েল রাফা হামলার জন্য যে হুমকি দিয়ে চলেছে, সেটা সফল করতে অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করবেন না। সিএনএনকে বাইডেন বলেছেন, ‘ইসরায়েলের নিরাপত্তা দেওয়া থেকে আমরা সরে আসছি না। অন্যখানে যুদ্ধ করার সক্ষমতা তৈরির পথ থেকে সরে আসছি আমরা।’

ইসরায়েলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিত্র যুক্তরাষ্ট্র। ইসরায়েলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী আইজাক রবিন বলতেন, তাঁর দেশের ১ নম্বর কৌশলগত সম্পদ এই সব অস্ত্র, এমনকি পারমাণবিক অস্ত্র নয়; বরং ওয়াশিংটনের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক। দশকের পর দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় অস্ত্রের জোগানদাতা ও কূটনৈতিক অভিভাবক। 

কিন্তু মাত্র ছয় সপ্তাহের ব্যবধানে ওয়াশিংটন এমন দুটি পদক্ষেপ নিল, যা পুরোপুরি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গেল। গত মার্চ মাসে নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ভেটো দেওয়া থেকে বিরত থাকে যুক্তরাষ্ট্র। ফলে ইসরায়েল প্রস্তাবটি আটকে দিতে চাইলেও ব্যর্থ হয়। আর এখন তো ওয়াশিংটন অস্ত্রের চালান আটকে দিল।

এর থেকেও বড় বিষয় হলো, এই সিদ্ধান্তগুলো এমন একজন রাজনীতিবিদ নিয়েছেন, যিনি ব্যক্তিগতভাবে ইসরায়েলের খুব নিবেদিতপ্রাণ সমর্থক। বাইডেন সেই যুগের একজন ডেমোক্র্যাট, যখন দুই সহস্রাব্দের নির্বাসন ও শাস্তির পর মধ্যপ্রাচ্যে ইহুদিদের আদি বাড়ি প্রতিষ্ঠার বিষয়টি গতি পেতে শুরু করেছে। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের উদারপন্থীদের চোখ তখন রহস্যজনকভাবে বন্ধ ছিল।  

গোল্ডা মেয়ার থেকে শুরু করে ইসরায়েলের প্রত্যেক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বাইডেন দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে। ইসরায়েলের প্রতি বাইডেনের টান বাড়ার ক্ষেত্রে এর একটার ভূমিকা আছে। পূর্বতন প্রেসিডেন্টদের মতো বাইডেনের ইসরায়েলের প্রতি ভ্রাতৃত্ববোধ শুধু নির্বাচনী হিসাব-নিকাশের বিষয় নয়।  

গাজা নিয়ে কোনো চুক্তি হচ্ছে না। কেননা, নেতানিয়াহু কিংবা সিনাওয়ারা কেউই বিশ্বাস করেন না, চুক্তি করলে তাঁদের স্বার্থ রক্ষিত হয়। যেমনটা যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক কর্মকর্তা অ্যারন ডেভিড মিলার বলেছেন, ‘এই সংঘাত বন্ধে একটি পক্ষেরই কেবল সত্যিকারের তাড়া আছে, সেই পক্ষটি হলেন জো বাইডেন।’

অন্যদিকে ১৯৮০-এর দশকে নেতানিয়াহু প্রথম আলোচনার পাদপ্রদীপে উঠে আসেন। তিনি এমন একজন কূটনীতিক, যিনি আমেরিকানদের সঙ্গে সাবলীলভাবে কথা বলতেন। সে সময় থেকেই তিনি নিজেকে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে দাঁড় করান। ইসরায়েলের একজন হবু নেতার জন্য এই দক্ষতা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। 

কয়েক দশক ধরে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তাঁর ভোটারদের এই বার্তা দিয়ে আসছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের মধ্যকার সব ধরনের গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ক্ষেত্রে তিনিই একমাত্র বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তি।

কিন্তু বাস্তব অবস্থাটা এখন কী দাঁড়াল?  চার দশকের বেশি সময়ের মধ্যে বাইডেনই প্রথম প্রেসিডেন্ট যিনি ইসরায়েলকে সামরিক সহায়তা দেওয়া বন্ধ করলেন। (১৯৮২ সালে ইসরায়েলের লেবানন অভিযানের সময় রোনাল্ড রিগ্যান যুদ্ধবিমান দিতে বিলম্ব করেছিলেন।) বাইডেন কেন এটা করলেন? কারণ, নেতানিয়াহু যুক্তরাষ্ট্রের একটি অংশের জনগোষ্ঠীর মধ্যে এমন তিক্ততা তৈরি করেছেন, যেটা আগে দেখা যায়নি।

ইসরায়েলের প্রতি যে যুক্তরাষ্ট্রের সমাজের নিরেট সমর্থন, তাতে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যেভাবে ছাত্র আন্দোলন আছড়ে পড়েছে, সেটা বিস্ময়করই। আন্তর্জাতিক জরিপ সংস্থা গ্যালাপের মার্চ মাসের জরিপ বলছে, ৫১ শতাংশ ইসরায়েলের পক্ষে সমর্থন দিয়েছে, ২৭ শতাংশ সমর্থন দিয়েছে ফিলিস্তিনের পক্ষে। কিন্তু ডেমোক্র্যাট ও তরুণ জনগোষ্ঠী—দুই ক্ষেত্রেই ফিলিস্তিনিদের পক্ষে সমর্থন অনেকটাই বেড়েছে।

জরিপের এই তথ্য বাইডেন ও তাঁর নির্বাচনী প্রচারণা দলকে চিন্তার মধ্যে ফেলেছে। এই অংশের দ্ব্যর্থহীন সমর্থনই ২০২০ সালের নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে পরাজিত করতে ভূমিকা রেখেছিল। গাজাবাসীর দুর্ভোগ সেই ভোটারদের সমর্থন অনিশ্চিত করে তুলেছে। হোয়াইট হাউস নেতানিয়াহুর কাছে পরিকল্পনা চেয়েছিলেন, বেসামরিক জনসাধারণকে হতাহত না করে কীভাবে রাফায় অভিযান করতে পারে ইসরায়েল। 

কিন্তু নেতানিয়াহু সেই পরিকল্পনা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। সেই কারণে ইসরায়েলকে থামানোর জন্য অস্ত্রের চালান আটকে দেওয়ার সরাসরি পথ বেছে নিয়েছে ওয়াশিংটন।

রাফা বাইডেনের জন্য শক্তি পরীক্ষার জায়গাও হয়ে উঠেছে। বাইডেন রাফাকে বিপদরেখা হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন। নেতানিয়াহু যদি সেই বিপদরেখা অতিক্রম করেন, তাহলে বাইডেন দুর্বল হিসেবে চিহ্নিত হবেন।

কিন্তু নেতানিয়াহু এখন পর্যন্ত রণেভঙ্গ দিতে অস্বীকার করেছেন। ইসরায়েলের স্বাধীনতা আন্দোলনকে সামনে রেখে জনগণের উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র ছাড়া আমরা একাই লড়ে যাব। প্রয়োজনে আমরা আমাদের নখ দিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাব।’ 

নেতানিয়াহু চার্চিলের মতো আওয়াজ তুলতে চাইছেন। কিন্তু তাঁর কথাগুলো দুর্বলের কণ্ঠস্বর, সবলের নয়। ওয়াশিংটন চায়, নেতানিয়াহু যেন রাফা অভিযান থেকে সরে আসেন। কিন্তু জোট সরকারের অতি ডানপন্থী মিত্ররা তাঁকে আরও কঠোর হতে বলছেন, রাফা অভিযানের মাধ্যমে হামাসের বিরুদ্ধে পুরোপুরি বিজয়ের জন্য বলছেন।

এই নিরানন্দ নাটকে বাইডেন ও নেতানিয়াহুই কেবল কুশীলব নন; হামাস নেতা ইয়াহিয়া সিনাওয়ারেরও নিজস্ব হিসাব-নিকাশ আছে, নেতা হিসেবে টিকে থাকার সংকল্প রয়েছে। খুব ঘনিষ্ঠভাবে যাঁরা সিনাওয়ারকেও পাঠ করেছেন তাঁরা বিশ্বাস করেন, নির্দোষ মানুষের জীবন রক্ষা করা তাঁর অগ্রাধিকার নয়; বরং যত বেশি গাজাবাসী নিহত হবেন, আন্তর্জাতিক পরিসরে তাঁর শত্রু ইসরায়েলে অবস্থান ততই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সেই পরিস্থিতি তাঁকে বিজয়ী দাবি করতে সহায়তা করবে। সম্প্রতি হামাস যুদ্ধবিরতি চুক্তি মেনে নেওয়ার ঘোষণার পেছনে সিনাওয়ারের এই ভাবনায় কাজ করেছে। 

সিনাওয়ারা সাময়িক কোনো যুদ্ধবিরতি (তাতে অনেক মানুষের প্রাণরক্ষা হয়, দুর্ভোগ কমে) চান না, তিনি চান স্থায়ী যুদ্ধবিরতি। আর তার জন্য সিনাওয়ারা অপেক্ষা করতেও রাজি।

গাজা নিয়ে কোনো চুক্তি হচ্ছে না। কেননা, নেতানিয়াহু কিংবা সিনাওয়ারা কেউই বিশ্বাস করেন না, চুক্তি করলে তাঁদের স্বার্থ রক্ষিত হয়। যেমনটা যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক কর্মকর্তা অ্যারন ডেভিড মিলার বলেছেন, ‘এই সংঘাত বন্ধে একটি পক্ষেরই কেবল সত্যিকারের তাড়া আছে, সেই পক্ষটি হলেন জো বাইডেন।’


জনাথন ফ্রিডল্যান্ড, ব্রিটিশ গণমাধ্যম গার্ডিয়ানের খ্যাতিমান কলামিস্ট

মতামত এর আরও খবর