সুপারম্যান‘ ট্রাম্প করোনাভাইরাসের ‘সুপারপাওয়ার‘ বুঝতে ভুল করেছেন
মুহাম্মদ আব্দুস সাত্তার
করোনাভাইরাস টেস্টিংয়ের সর্ব্বোচ্চ সুযোগ ছিলো তাঁর হাতের নাগালে, দেশের সেরা চিকিৎসা ব্যবস্থা ছিলো তাঁর সার্বক্ষণিক সঙ্গী, এদিক থেকে দেশের সবচেয়ে নিরাপদ মানুষ হওয়ার সর্ব্বোচ্চ সুযোগ ছিলো তাঁর। এর কোন কিছুর তোয়াক্কা তিনি করেননি। নিজেকে ‘সুপারম্যান‘ ভেবেছেন এবং চলেছেন সেরকম করে। এমন এক ধারণা তিনি তৈরী করে রেখেছিলেন যে, হোয়াইট হাউসে তাঁর আস্তানায় করোনা হানা দিতে সক্ষম হবে না।
কিন্তু ‘সুপারপাওয়ার‘ করোনা শেষ পর্যন্ত তাঁর দুর্গে আঘাত হনেছে এবং তাঁকে, তাঁর স্ত্রীকে এবং তাঁর সঙ্গী-সাথী অনেককেই কুপোকাত করেছে।
এ লেখার সময়ে পাওয়া শেষ খবর অনুযায়ি, হোয়াইট হাউসের চীফ অব স্টাফ মার্ক মীডোজ জানিয়েছেন, গত ২৪ ঘন্টায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অবস্থা খুবই উদ্বেগজনক ছিলো এবং আগামি ৪৮ ঘন্টা তাঁর অবস্থা খুব স্কংটাপন্ন থাকবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার আগে শুক্রবার সকালে ট্রাম্পকে সাপ্লিমেন্টাল অক্সিজেন দিতে হয়েছে বলেও জানা গেছে।
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের প্রায় শুরুর সময় থেকেই ডোনাল্ড ট্রাম্প চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের তুচ্ছ করে চলেছিলেন, করোনা পরিস্থিতিতে সকলের করণীয় সম্পর্কে তাঁর নিজের সরকারের বেঁধে দেয়া বিধি-বিধান ইচ্ছেমতো ভঙ্গ করে যাচ্ছিলেন এবং পরিস্থিতিকে যাঁরা যথাযথ গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় নিয়েছিলেন, শিষ্টাচারের কোন বালাই না রেখেই তিনি তাঁদের নিয়ে উৎকট উপহাস পর্যন্ত করতে কখনো কুন্ঠিত হননি।
ট্রাম্প একেবারে এই সেদিন পর্যন্তও বলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন যে, করোনা তেমন মারাত্মক কোন ব্যাধি নয় এবং এর সবচেয়ে খারাপ সময়টা পেরিয়ে গেছে। এমনকি তিনি নিজেও নিছক মৌলিক স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতেও গরজ দেখাননি। মাস্ক পরা বা সোশ্যাল ডিসটেন্সিং বজায় রাখা- এগুলোকে তিনি পাত্তা দেননি কখনো। করোনার দ্বিতীয় হানা এসেছে, এরপরও তিনি মার্কিন রাজ্যগুলোতে কড়াকড়ি ব্যবস্থা তুলে নিতে এবং শাটডাউন রুলগুলো বাতিল করা বা নিদেনপক্ষে কমিয়ে আনার জন্যে বিভিন্ন রাজ্যের গভর্ণরদের ওপর চাপ দিয়ে আসছিলেন।
মাস্ক পরা নিয়ে ট্রাম্প তাঁর নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বি জো বাইডেনকে নিয়ে রুচিহীন উপহাস করতেও ছাড়েননি। বলেছেন, সব সময় বাইডেন মাস্ক পরে থাকেন। আমার থেকে তিনি যদি ২০০ ফুট দূরেও থাকেন তাহলেও আমার দেখা সবচেয়ে বড় একটি মাস্ক পরেই তাঁকে হাজির হতে দেখা যাবে।
ট্রাম্প বারবার বলেছেন, করোনা ‘চলে যাবে‘। করোনার হানা যখন যুক্তরাষ্ট্রে তুঙ্গে উঠেছিলো, তার মাসখানেকের মধ্যেই তিনি মহামারীর প্রবল ভয়ঙ্কর দিকটি উপেক্ষা করে অর্থনীতির স্বার্থে সব কিছু আবার স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে আসার উদ্যোগ নিয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন একেবারে আসন্ন, যাতে ট্রাম্প আবারও প্রার্থি। এ উপলক্ষে আয়োজিত নির্বাচনী সমাবেশগুলোতে ট্রাম্প যেমন মাস্ক পরাকে পাত্তাই দেননি, তেমনি ওই সব সমাবেশে আসা তাঁর সমর্থকেরাও মাস্ক পরা বা সোশ্যাল ডিসটেন্সিংয়ের থোড়াই পরোয়া করেছেন।
শেষ পর্যন্ত বৃহষ্পতিবার দিনগত গভীর রাতে খবর এলো ‘সুপারম্যান‘ ডেনাল্ড ট্রাম্প ‘সুপারপাওয়ার‘ করোনার হাতে কব্জা হয়েছেন।
শুক্রবার তাঁকে স্থানান্তর করা হয় ওয়াশিংটনের অদূরে ওয়াল্টার রীড ন্যাশনাল মিলিটারি মেডিক্যাল সেন্টারে। শনিবার ওই মেডিক্যাল সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের চিকিৎসক ড. সীন কনলী বলেছেন, ‘৭২ ঘন্টা আগে‘ ট্রাম্পের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার কথা নিশ্চিত হওয়া গেছে। হিসেব কষে দেখা যাচ্ছে, এর অর্থ, বুধবার সকাল নাগাদ বিষয়টি জানতে পারা যায় । কিন্তু কি আশ্চর্য, ট্রাম্প বুধবার রাতে মিনেসোটায় যান তাঁর এক নির্বাচনী সমাবেশে। পরদিন বৃহষ্পতিবার তিনি যান নিউ জার্সিতে ফান্ডরেইজিং অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। এর ৩৬ ঘন্টা পর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বৃহষ্পতিবার দিনগত রাত ১টায় টুইট করে বিশ্ববাসিকে জানান তাঁর করোনা পজিটিভ হওয়ার কথা। ট্রাম্পের টুইট-বার্তার আগেই বৃহষ্পতিবার তাঁকে হোয়াইট হাউসে এন্টিভাইরাল চিকিৎসা দেয়া হয়েছে বলে সরকারীভাবেই স্বীকার করা হয়েছে।
ড. কনলী ‘প্রেসিডেন্ট অনেক ভালো রয়েছেন এবং তাঁর মনোবলও খুব শক্ত‘ এসব বলে ট্রাম্পের শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা জাগিয়ে রাখতে চেয়েছেন। কিন্তু হোয়াইট হাউসের চীফ অব স্টাফের বক্তব্য তো আসল গোমর ফাঁস করে দিলো।
যা কিছুই হোক না কেন, এই সত্য কিন্তু চাপা দেয়া যাচ্ছে না যে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন জেনেও বুধ ও বৃহষ্পতিবার বিভিন্ন কর্মসূচিতে যোগ দিয়ে তাঁর সঙ্গী-সাথিসহ আরো অনেক মানুষকে প্রাণঘাতি ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছেন।
ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি শিগগীরই ভালো ভালোয় সেরে ওঠেন এবং তাঁর স্বাভাবিক কাজকর্মে আবার আগের মতো ঝাঁপিয়ে পড়তে সক্ষম হন, তাহলে নিশ্চিত করেই বলা যায় ট্রাম্প তাঁর প্রিয় হাতিয়ার টুইটারে, তাঁর প্রিয় ফক্স নিউজে এবং আরও নানা উপায়ে সগর্জনে একথা বলে বেড়াতে লাগবেন যে, করোনা নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই, তাঁর এই বয়সেও তো তিনি সেটা মোকাবেলা করে সেরে উঠেছেন। সেই সাথে তিনি করোনার বিষয়টিকে বিশাল করে ‘দেখানোর‘ অভিযোগ তুলে সেজন্যে মিডিয়াকে আবারও এক হাত নেবেন তাঁর যাবতীয় শিষ্টাচার বিরোধী ভাষা ব্যবহার করে।
এই মানুষটি সকল সময় শারীরিক অসুস্থতাকে রাজনৈতিক দুর্বলতা বলে উপহাস করে এসেছেন। আজ তাঁর করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে শয্যাশায়ি হওয়া নিশ্চয় বড়ই অবমাননাকর ঠেকছে তাঁর কাছে। আমাদের মনে আছে, চার বছর আগে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্প তাঁর তৎকালীন ডেমোক্র্যাটিক প্রতিদ্বন্দ্বি হিলারী ক্লিনটনের নিউমোনিয়া হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে উপহাস করতে ছাড়েননি।
আসন্ন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ঠিক ৩১ দিন আগে তাঁকেই হাসপাতাল যাত্রা করতে হলো। নির্বাচনী ক্যাম্পেইনে কখন তিনি ফিরে আসতে পারবেন অথবা আদৌ আসা সম্ভব হবে কিনা, সে নিয়ে অনিশ্চয়তা এখন পুরো মাত্রায়।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের স্বাস্থ্য বিষয়ক জটিলতা জাতীয় নিরাপত্তার ইস্যু, কারণ, তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনীর কমান্ডার-ইন-চীফও। তাঁর শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি হলে এবং তিনি দায়িত্ব পালনে অপারগ হয়ে পড়লে সংবিধানের ২৫তম সংশোধনীর ৩য় সেকশন অনুযায়ি ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হবেন।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আচমকা রোগশয্যায় গমন যুক্তরাষ্ট্রে একই সাথে বেশ কয়েকটি জটিলতার সৃষ্টি করেছে। এগুলোর মধ্যে আছে, নির্বাচনের তারিখটির আগে পর্যন্ত ট্রাম্প সুস্থ হয়ে কাজে ফিরতে না পারলে প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার হস্তান্তর প্রসঙ্গ, সেক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থিতা প্রসঙ্গ, সুপ্রীম কোর্টে বিচারপতির শূণ্য আসনে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের দেয়া মনোনয়নের পরিণতি, নির্বাচনের তারিখ যদি পরিবর্তনের দরকার পড়ে, তাহলে কিভাবে তা করতে হবে ইত্যাদি। একই সাথে কোন কোন ইস্যুতে যে সিদ্ধান্তই নেয়া হোক, সেগুলো আবার কোর্ট পর্যন্ত গড়াতে পারে, সে আশঙ্কাও থাকছে।
সুতরাং, মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পূর্ববর্তী এই একটা মাস সেখানকার রাজনীতি চরম নাটকীয়তা ও উত্তেজনায় ভরপুর থাকবে, অনায়াসেই বলা যায়।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি তাঁর ভক্ত-সমর্থকদের জন্যে একটা ওয়েক আপ কল হিসেবেই বিবেচিত হওয় উচিত। ট্রাম্পের মতোই তারাও মনে করেন বা করতেন, করোনাভাইরাস একটি ভূয়া বিষয়, ভূয়া প্রচারণা। তা যে ঠিক নয়, মিলিটারি হাসপাতালের রোগশয্যায় শুয়ে কমান্ডার-ইন-চীফ ট্রাম্প এখন নিশ্চয় হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। ট্রাম্পের ভক্ত-সমর্থকদেরও সেটা বুঝে নেয়ার সময় হয়েছে।
মুহাম্মদ আব্দুস সাত্তার, লন্ডন, যুক্তরাজ্য।