img

ওয়েলসে করোনার ভয়ঙ্কর থাবা: কেমন আছেন বাংলাদেশীরা

প্রকাশিত :  ০০:৫৫, ০৩ নভেম্বর ২০২০

ওয়েলসে করোনার ভয়ঙ্কর থাবা: কেমন আছেন বাংলাদেশীরা

সারা বৃটেন জুড়ে চলছে করোনার দ্বিতীয় দফার ভয়াবহ ছোবল। আক্রান্তের সংখ্যা সেই সাথে মৃত্যুর সংখ্যাও দিন দিন শুধু বেড়েই চলেছে। ভীষণ আতঙ্কের মধ্যে ঘরবন্দী হয়ে দিন কাটাচ্ছে এ দেশের মানুষ। কখন যে কার মৃত্যু পরওয়ানা এসে হাজির হবে কেউই জানেনা, এই ভয়ে কেউই বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হচ্ছেনা। ছাত্রদের লেখা পড়া, মানুষের কাজকর্ম সবকিছুই যেন থমকে গেছে। বিপর্য্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন। কিন্তু করার কিছুই নেই, যখন যে অবস্থা আসে, তার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হবে এটাই নিয়ম। এই বেসামল করোনার কাছে সাধারণ মানুষ যেমন অসহায় পড়েছে ঠিক তেমনি দেশের সরকারও দেশ চালাতে গিয়ে হিমসিম খাচ্ছে। ব্যবসা- বাণিজ্য নেই বললেই চলে, আর ব্যবসা যদি না চলে তাহলে তহবিলে টাকা আসবে কেমন করে, আর দেশই বা চলাবে কিভাবে? বেসামাল করোনার বিস্তারলাভ ঠেকাতে গিয়ে দেশে কঠোর আইন  প্রযোগ করতে হয়েছে। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে যাওয়া নিষিদ্ধ, অন্যের ঘরে যাওয়া নিষিদ্ধ, ঘরের বাইরে ৬ জনের বেশী একত্রিত হওয়া নিষিদ্ধ, সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে এবং মুখে মাস্ক লাগিয়ে চলাফেরা এবং শপিং করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। বর্তমানে সরকার এমন এক অবস্থায় পড়েছে যে, দেশের ইকোনমি চাঙ্গা করতে হলে ব্যবসা-বানিজ্য, অফিস আদালত সবকিছু খুলে দিতে হবে, আর তা করতে গেলেই করোনার ছোবলে একদিকে যেমন বাড়বে সংক্রমনের সংখ্যা অন্যদিকে শুরু হবে মৃত্যুর মিছিল। আবার সবকিছু বন্ধ থাকায় সরকারের তহবিল হয়ে যাচ্ছে শূণ্য। তাই সরকারও এখন বেসামাল। এই অবস্থা শুধু বৃটেনেই নয়, সারা বিশ্বব্যাপী। 

যদিও ওয়েলসে প্রথম ধাপের করোনার ছোবল একমাত্র সোয়ানসী এবং নিউপোর্ট ছাড়া আর কোন জায়গায় এমন প্রভাব বিস্তার করেনি, যেখানে ছিল তা-ও সামান্য। এ সময় নিউপোর্ট ও সোয়ানীতে করোনার আক্রমন ছিল বেশ মারাত্মক। সে সময় করোনায় ওয়েলসবাসী হারিয়েছেন তাদের দু’জন প্রিয় মানুষকে, একজন হচ্ছেন সোয়ানসী আওয়ামী লীগের সাধারণ স€úাদক আবু সালেহ সোয়েব এবং নিউপোর্ট আওয়ামী লীগের সহ স€úাদক, সাবেক কাউন্সিলার মাজেদুর রহমান নুনু’কে। তারা দুজনই ছিলেন তাদের এলাকায় সর্বজন শ্রদ্ধেয়, সবার পরিচিত, অত্যন্ত কাছের মানুষ। তাদের মৃত্যুতে এলাকাবাসী সে সময় শোকে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল্।ো তাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি, আল্লাহ পাক তাদেরকে বেহেশত নসীব করুন এই হোক সকলের প্রার্থনা। 

অন্যান্য জায়গায় সংক্রমন যাতে বিস্তার লাভ না করতে পারে সেজন্য ওয়েলস সরকার সে সময় লকডাউন দিয়ে রেখেছিলো, তা এমন কড়াকড়ি ছিলনা। সে সময় ছিলো সামার টাইম। যার ফলে যেখানে সেখানে বেড়াতে খুব একটা অসুবিধা হয়নি, যান চলাচল যদিও কম ছিলো। এ সময় ওয়েলস এর বাংলাদেশী কমিউনিটির মানুষ ঘরের বাইরে বেশি বের না হলেও যাদের ঘরে শাকশব্জি ফলানোর জায়গা আছে, তারা তখন ঐদিকেই নজর দিয়েছিলেন বেশি। কাজ কর্মের অবসরে যে সময়টুকু পেয়েছেন তা ব্যয় করেছেন শাক - শব্জি, তরিতরকারী ফলাতে। প্রচুর ফলনও পেয়েছেন। মোটামুটি এসব কাজ কর্ম করে করোনা মহামারির এই দু:সময়ের মধ্যেও মনের মাঝে আনন্দের ছোয়া পেয়েছেন। তাছাড়া রেষ্টুরেন্ট এবং টেকওয়ে ব্যবসাগুলোও মোটামুটি চলছিলো, কোন রকমে। কিন্তু দ্বিতীয় দফায় করোনার আক্রমণ যাক্তরাজ্যের অন্যান্য এলাকার মতো ওয়েলসেও মারাত্মক ভাবে বিস্তার লাভ করেছে। ওয়েলস এর প্রতিটি শহরেই ‘‘উচ্চতর সাবধাণতা” (হাই এলার্ট) জারী হয়েছে। ওয়েলস সরকার লোকজন চলাচলে, শপিং সেন্টার, আসদা, টেসকো ইত্যাদিতে বাজার করতে গেলে মাস্ক পরা এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলাচল বাধ্যতামূলক করেছে। রাত ১০টায় রেষ্টুরেন্ট টেকওয়ে, পাব সহ সব ধরণের খাবারের দোকান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। রাত ১০টার পর থেকে কারফিউ জারী করা হয়েছে। 

দ্বিতীয় ধাপে করোনা কেন এত প্রবল ভাবে বিস্তার লাভ করেছে ওয়েলসে তা নিয়ে জল্পনা কল্পনার শেষ নেই। ওয়েলস সরকার বলছে, করোনার প্রথম ধাপ যখন শেষের দিকে, তখন সামারও শেষ হওয়ার পথে। তখন দিনগুলো ছিলো বৌদ্রোজ্বল এবং কিছুটা গরমও ছিলো, সে সময় ওয়েলস এর বর্ডার দিয়ে ইংল্যান্ড থেকে প্রচুর লোক বেড়াতে আসে ওয়েলসে। যেহেতু ওয়েলস বেড়ানোর জন্য এক মনোরম জায়গা, সে জন্য লোকজন চলে আসে এখানে। সে সময় যারা ইংল্যান্ড থেকে বেড়াতে এসেছে তাদের অধিকাংশই এসেছে ইংল্যান্ড্রে যেখানে করোনার বিস্তার ছিলো বেশি। তাদের অনেকেই ছিলো করোনায় আক্রান্ত এবং এদের কাছ থেকেই সংক্রমন ছড়িয়ে পড়েছে ওয়েলসে।  সে সময় ওয়েলস সরকার প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনকে ওয়েলস এর বর্ডার বন্ধ করার জন্য অনেক দেনদরবার করেন কিন্তু প্রধানমন্ত্রী তাতে কোন কর্ণপাত করেননি। এ নিয়ে শুধু ওয়েলস নয়, স্কটল্যান্ড সরকারও প্রধানমন্ত্রীর উপর ভীষণ ক্ষেপে যায়। শেষ পর্য্যন্ত করোনার দ্বিতীয় ধাপ শুরু হওয়ার পর পরই তাদের রাজ্যগুলোকে করোনার হাত থেকে রক্ষার জন্য ওয়েলস এবং স্কটল্যান্ড এক হয়ে ইংল্যান্ডের সাথে তাদের বর্ডার নিজেরাই বন্ধ করে দিয়েছে, যদিও এখন ইংল্যান্ডে যাওয়া আসার ব্যাপারে দু’ সপ্তাহের জন্য বন্ধ রাখা হয়েছে তবে দু’সপ্তাহ পর অর্থাৎ ৯ই নভে€^র আবার তারা রিভিউ করবে। 

বর্তমানে ওয়েলস এর অবস্থা খুবই খারাপ। আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে যদিও মৃত্যুর সংখ্যা খুব বেশি একটা নয়। আজ মঙ্গলবার ২৭ অক্টোবর পাবলিক হেলথ ওয়েলস  এর খবরে বলা হয়েছে, সারা ওয়েলসে গত ২৪ ঘন্টায় ১২শতের ও বেশী নতুন আক্রান্ত এবং ৭ জন মারা গেছেন। গত ২৪ ঘন্টার বিভিন্ন এলাকার পজিটিভ কেইসগুলো হচ্ছেÑকার্ডিফ ২০৩, সোয়ানসী ১৩৪, নীথ পোর্টটালবট ৮৫, কারফিলি ৬২ এবং রেক্সহাম ৬০ জন। অন্যান্য অথরিটিগুলোর মধ্যে ব্রিজেন্ড ৫৮, ফ্লিন্টশায়ার ৪৮, কারমারদান শায়ার ৪৪, মার্থার টেডফিল হেড ৪০, নিউপোর্ট ৩১ জন। 

এবার আসি বাংলাদেশী কমিউিনিটির রোজগারের কথায়। ওয়েলসে প্রচুর বাংলাদেশীর বসবাস। তাদের প্রধান  ব্যবসা-ই হচ্ছে রেষ্টুরেন্ট টেকওয়ে। দ্বিতীয় ধাপের করোনা সংক্রমনের আঘাতে এই ব্যবসাগুলো একেবারেই বিপর্য্যস্ত হয়ে পড়েছে। যদিও প্রথম দিকে রেষ্টুরেন্টগুলো খোলা ছিলো কিন্তু গত ২৩ অক্টোবর শুক্রবার থেকে শুধুমাত্র টেকওয়ে চালু রয়েছে। রেষ্টুরেন্টে এসে কাষ্টমারদের খাওয়া বন্ধ করা হয়েছে যার ফলে যারা রেষ্টুরেন্ট ব্যবসায়ী তারা ভেতরে খাবার এবং টেকওয়ে দিয়ে কোন রকমে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছিলেন, এখন শুধু টেকওয়ে নির্ভরশীল। যাদের রেষ্টুরেন্টে আয়ের প্রধান উৎসই ছিলো ভেতরে কাস্টমার খাওয়ানো, টেকওয়ে সামান্য কিছু যেতো, তাদের অবস্থা এখন খুবই খারাপ। নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা। এছাড়াও এখানকার মানুষ এখন আগের মতো টেকওয়েও নেয় না। সবাই যেন একটা ভীত সন্ত্রস্থতার মধ্যে আছে।  এসব ব্যবসায়ীরা এখন ব্যবসা চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। এ রকম অবস্থা চলতে থাকলে আগামী কয়েক মাসের মধ্যে অনেক রেষ্টুরেন্ট এবং টেকওয়ে বন্ধ করা ছাড়া তাদের আর কোন উপায় থাকবেনা। ব্যবসায়ের জিনিস পত্রের দাম যে ভাবে বেড়েছে এবং রেস্টুরেন্ট ও টেকওয়ের রেন্ট, রেইট, ইলেকট্রিক বিল , গ্যাস বিল, টেলিফোন বিল, ট্যাক্স ইত্যাদি দিয়ে তাদের হাতে  বিক্রির যে টাকা আসবে তা দিয়ে কোন মতেই ব্যবসা  চালিয়ে যাওয়া স€¢ব হবে ন্ বলে জানিয়েছেন অনেক ব্যবাসয়ী। এজন্য ব্যবসায়ীরা যেন দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। 

বাংলাদেশী গ্রোসারী দোকানগুলোরও একই অবস্থা। এই গ্রোসারী দোকানগুলো শুধুমাত্র কার্ডিফ, সোয়ানসী এবং নিউপোর্টে অবস্থিত। লকডাউনের কারণে এলাকার লোকজনই এখন তাদের একমাত্র কাষ্টমার, কারণ বাইরের এলাকার লোকজন আর যেতে পারেনা। সুতরাং তাদের বিক্রিও অর্ধেকে নেমে এসেছে। 

এছাড়াও যারা ট্রাক্সি চালিয়ে মোটামুটি ভাল রুজি রোজগার করেছেন, আরামে সংসার চালিয়েছেন তাদের অবস্থা আরও খারাপ। দিনের বেলায় এখন লোকজন কম বের হয় এবং যারা বের হয় তারা এলাকারই লোকজন। কেউবা হেঁটে, কেউবা বাসে চড়ে আবার অনেকেরতো গাড়ি আছে, কাজেই ট্যাক্সি চড়ার দরকারই পড়েনা। যারা  ভাড়া করা ট্যাক্সি চড়ে তাদের সংখ্যা হাতে গোনা। রাত ১০টায় কারফিউ। সুতরাং তারা যে কি অবস্থায় আছেন তা সহজেই অনুমেয়।  

যাক, এত সব দু:খের খবরের পরেও একটা সুসংবাদও আছে। ওয়েলস এর বাংলাদেশী কমিউনিটির বিভিন্ন বিষয়াদি জনগণকে অবহিত করার লক্ষ্যে কার্ডিফ এর বিশিষ্ট সাংবাদিক মকিস মনসুর আহমদ এবং বৃষ্টল এর এটিএন বাংলা টিভি এবং বাংলাদেশ প্রতিদিন এর রিপোর্টার খায়রুল আলম লিংকন মিলে “ইউকে বিডি টিভি’ নামে একটি ফেইসবুক টিভি চালু করেছেন। এই টিভি’তে বিভিন্ন ধরণের অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়ে থাকে, যেমন বিভিন্ন আইন সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে এদেশের অভিজ্ঞ সলিসিটারদের সাথে আলাপ আলোচনা, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে দেশের বর্তমান রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে মতবিনিময়, ইসলামের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে বিজ্ঞ আলেমদের সাথে  আলাপ আলোচনা সহ বিভিন্ন ধরণের বিনোদন মূলক অনুষ্ঠান। তাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এই টিভি চালু করার উদ্দেশ্য হচ্ছে, বর্তমান সময়ে এখানকার মানুষ খুবই দু:শ্চিন্তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন সুতরাং তাদের অবসর সময়টা যদি এই টিভির দিকে একটু চোখ রাখেন, তাহলে ওয়েলস সহ দেশের বিভিন্ন বিষয় যেমন জানতে পারবেন এবং বিভিন্ন সময়ে প্রচারিত বিনোদন মূলক অনুষ্ঠানগুলো দেখে মনের চিন্তাটা মন থেকে সরিয়ে কিছু সময়ের জন্য হলেও মনকে প্রফুল্ল রাখতে পারবেন। 


img

যুদ্ধ উত্তেজনায় ইরান-ইসরায়েল, কে জিতল, কে হারল?

প্রকাশিত :  ১১:৪৯, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
সর্বশেষ আপডেট: ১১:৫৬, ২৫ এপ্রিল ২০২৪

সিমন টিসডল

ইসফাহানের সামরিক ঘাঁটির কাছে ও অন্যান্য লক্ষ্যবস্তুতে গত শুক্রবার আকাশপথে ইসরায়েল যে হামলা চালায়, ইরান সেটা ততটা পাত্তা দিতে নারাজ। বাইরে থেকে হামলার বিষয়টা তেহরান অস্বীকার করেছে। 

ইসরায়েলি মুখপত্ররা আর সব বিষয়ে অনর্গল বাক্যবর্ষণ করে চললেও এ ঘটনায় অদ্ভুতভাবে নীরব। দেখেশুনে মনে হচ্ছে, ঘটনাকে গুরুত্বহীন করে তুলতে দুই পক্ষের মধ্যে যেন একটা চুক্তি হয়েছে, যাতে ধীরে ধীরে উত্তেজনার পারদ এমনিতেই নিচে নেমে যায়।

এটিকে উনিশ শতকের সেই চোরাগোপ্তা কোনো এক ডুয়েল লড়াইয়ের মতো মনে হচ্ছে; যেন দুই প্রতিদ্বন্দ্বী ইংরেজ ব্রিটেনে কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে তৃণভূমির মধ্যে পরস্পরের দিকে অবৈধভাবে পিস্তল তাক করেছে। ইরান ও ইসরায়েল দুই দেশেরই মানমর্যাদা পরিপূর্ণভাবে রক্ষা করতে হবে, কিন্তু সেটা আবার করতে হবে জনগণের মধ্যে যেন আবার চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু না হয়, সেটা মাথায় রেখে। 

দুই দেশই একে অন্যের দিকে সরাসরি হামলা করেছে। তাতে প্রতীকী ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এখন তারা এবং তাদের সাঙ্গপাঙ্গরা এই ইঙ্গিত দিচ্ছে যে খেলা শেষ, অন্তত এবারের মতো।

এটা যদি সত্যি (যদিও সম্ভাবনাটা সাময়িক সময়ের জন্য) হয়, তাহলে সেটা অনেক বড় স্বস্তির বিষয়। এ ঘটনা এই ইঙ্গিত দেয় যে সংযত হতে ইসরায়েলের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের তীব্র চাপ (যুক্তরাজ্য ও অন্য দেশগুলোও তাতে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে) কাজে এসেছে। 

গত সপ্তাহে ইসরায়েলে ইরানের অভূতপূর্ব ও বড় পরিসরে হামলার পর প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইসরায়েলের প্রতি ‘জয়টাকে ধরে রাখার’ আহ্বান জানিয়ে ছিলেন। বোঝা যাচ্ছে, এই বার্তার মর্মোদ্ধার সফলভাবেই করতে পেরেছে ইসরায়েল। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের নেতৃত্ব কখনোই কোনো বিষয়ে পুরোপুরি ঐকমত্য হতে পারে না।

অবশ্য ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ডিএনএর মধ্যেই সংযমের বালাই নেই। সাবেক এই কমান্ডো ইরানের হামলার পর সহজাতভাবেই পাল্টা শক্তি দেখাতে চেয়েছিলেন। আর তাঁর কট্টর ডানপন্থী মিত্ররা যুদ্ধের উন্মাদনা সৃষ্টি করেছিল। 

এই প্রেক্ষাপটে ইসরায়েল যে মাপা পদক্ষেপ নিয়েছে, তাতে বোঝা যায়, যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে মানাতে পেরেছে। আর ইরানের ড্রোন ও মিসাইল হামলা থেকে ইসরায়েলকে সুরক্ষা দিতে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে, সেটাও নেতানিয়াহুর পক্ষে উপেক্ষা করা সম্ভব হয়নি।

আবার ইসরায়েলের সামান্যতম উদ্‌যাপনের কোনো কারণ নেই। এটা ঠিক যে এবার ইসরায়েল ইরানের হামলা ঠেকিয়ে দিয়েছে। কিন্তু অজেয় বলে ইসরায়েলের যে সুখ্যাতি, সেটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। ইসরায়েল অভেদ্য দুর্গ বলে যে মিথ, সেটা গুঁড়িয়ে গেছে। একইভাবে গাজায় এখনো হামাসের হাতে বন্দী ১৩০ পণবন্দী রয়ে গেছে। হামাস এখনো অপরাজেয়।

অবশ্য এখানেই বিষয়টা মীমাংসা হয়ে গেল এটা ধরে নেওয়াটাও বোকামি হয়ে যাবে। রাজনৈতিক ও মতাদর্শিকভাবে গভীর বৈরিতা ইরান ও ইসরায়েল—এই দুই শত্রুকে পরস্পর থেকে আলাদা করে রেখেছে। 

দুই দেশের সরকারের মধ্যেই অভ্যন্তরীণ বিভাজন রয়েছে, যা চরম অনিশ্চয়তা ও প্ররোচনাময় পরিবেশ সৃষ্টি করছে। তারই একটা ভয়ানক নজির আমরা গত কয়েক দিনে দেখতে পেলাম। একেবারে মুখোমুখি যুদ্ধের প্যান্ডোরার বাক্সটি সরাসরি খুলে গিয়েছিল।

বছরের পর বছর ধরে দুটি দেশ যে ছায়াযুদ্ধ লড়ে যাচ্ছিল, সেই যুদ্ধ তারা সবার চোখের সামনে দিনের আলোয় নিয়ে এসেছিল। ইরান দেখিয়ে দিয়েছে যে তারা ইসরায়েলের যেকোনো জায়গায়, যেকোনো সময়, প্রত্যক্ষভাবে হোক আর পরোক্ষভাবে হোক, হামলা চালাতে সক্ষম। আর ইসরায়েল দেখাল যে তারা যদি চায়, তাহলে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালাতে সক্ষম, পরেরবারের হামলা হবে আরও ভয়াবহ।

ইসরায়েল-ইরানের এ অচলাবস্থা ফিলিস্তিন সংঘাতের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। কিন্তু ফিলিস্তিন সংকট নিরসনে কোনো ভূমিকা রাখছে না। আর ফিলিস্তিন সংকটে পশ্চিমাদের দোটানা অবস্থান আগের চেয়ে তীব্র হলো। 

যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন একপেশে, দ্বিমুখী নীতির প্রতীক হয়ে উঠলেন। গাজায় মানবিক সহায়তা পৌঁছতে তিনি প্রাণান্ত চেষ্টা করে চলেছেন, কিন্তু যুদ্ধবিরতির চেষ্টায় সমানভাবে ঢিলেমি করে যাচ্ছেন। ফলে তাঁর নীতি খুব সামান্যই সফলতার মুখ দেখছে।

এর একটা কারণ হতে পারে, ঋষি সুনাকের সরকার ইসরায়েলের কাছে অস্ত্র বিক্রির সুযোগ হাতছাড়া করতে চায় না। আরেকটি কারণ হলো, ১ এপ্রিল দামেস্কে ইরানি কনস্যুলেটে ইসরায়েলের বিমান হামলার (এই হামলায় ইরানের জ্যেষ্ঠ কয়েকজন কমান্ডার নিহত হন, ইসরায়েলে প্রতিশোধমূলক হামলা চালায় ইরান) নিন্দা জানাতে ক্যামেরন অস্বীকৃতি জানান।

জাতিসংঘ–বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইরানের কনস্যুলেটে ইসরায়েলের হামলা ছিল আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। গত সপ্তাহে ক্যামেরন অবশ্য স্বীকার করেছেন, যুক্তরাজ্যের কোনো দূতাবাসে এ ধরনের হামলা হলে তারা কঠোর ব্যবস্থা নিত। 

কিন্তু তিনি কখনোই বলবেন না, ইসরায়েল অন্যায় করেছে। এ ধরনের ইসরায়েলপন্থী অবস্থান বেশির ভাগ পশ্চিমা দেশের সরকারগুলোর চারিত্রিক অবস্থান।

হারজিতের প্রশ্নটি বড় পরিসর থেকে বিবেচনা করা হলে এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে গত সপ্তাহের ঘটনাপ্রবাহে ইউক্রেনীয়রাও সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তারা আরেকটি পশ্চিমা ভণ্ডামির শিকার। 

দুই বছরের বেশি সময় ধরে কিয়েভ ন্যাটোর কাছে আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ও মিসাইল প্রতিরক্ষাব্যবস্থা চেয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তাদের সেই চাওয়া বৃথা পর্যবসিত হয়েছে।

অথচ ইরান যখন ইসরায়েলে ড্রোন ও মিসাইল হামলা করল, তখন পশ্চিমা দেশগুলো তেল আবিবের সুরক্ষা দিতে কী না করেছে। ইরান ৩০০ ড্রোন ও মিসাইল ছুড়লেও প্রায় অক্ষত থাকে ইসরায়েল। অথচ প্রতি সপ্তাহে রাশিয়া সমানসংখ্যক ড্রোন ও মিসাইল হামলা করে ইউক্রেনে।  

একইভাবে অবরুদ্ধ গাজাবাসীর হতাশা আরও প্রলম্বিত হলো এ–ই দেখে যে নেতানিয়াহুর প্রতি পশ্চিমা সমালোচনা রাতারাতি পাল্টে গেছে। পশ্চিমাদের এই সংহতির ঐকতানের জন্য ইরান অবশ্যই নেতানিয়াহুর ধন্যবাদ পেতে পারে। 

দাতা সংস্থাগুলো ফিলিস্তিন নিয়ে অব্যাহতভাবে সতর্ক করে যাচ্ছে যে সেখানে দুর্ভিক্ষ আসন্ন। ইসরায়েলের হাতে ৬ মাসে ৩৪ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। রাফায় ভয়াবহ আগ্রাসন চোখরাঙানি দিচ্ছে। গাজা ও পশ্চিম তীরে কোনো বিজয়ী নেই, কেবল পরাজিত রয়েছেন।

ইরান দাবি করেছে, তারা খুব সফলভাবে দামেস্কে ইরানি কনস্যুলেটে বোমাবর্ষণের শাস্তি দিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ইরানের এই হামলাকে একটা পরাজয়ই বলা যায়। কেননা, এতে তাদের সামরিক সীমাবদ্ধতা প্রকাশ হয়ে গেছে। 

এ হামলার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ইরান আরও একঘরে হয়ে গেছে, তেহরানের ঘাড়ে নতুন নিষেধাজ্ঞার বোঝা চেপেছে এবং ফিলিস্তিনিদের সুবিধা হয়—এমন কোনো কিছু করতে পারেনি ইরান। অবশ্য সেটা তাদের নেতারা তোয়াক্কা করেন না।

আবার ইসরায়েলের সামান্যতম উদ্‌যাপনের কোনো কারণ নেই। এটা ঠিক যে এবার ইসরায়েল ইরানের হামলা ঠেকিয়ে দিয়েছে। কিন্তু অজেয় বলে ইসরায়েলের যে সুখ্যাতি, সেটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। ইসরায়েল অভেদ্য দুর্গ বলে যে মিথ, সেটা গুঁড়িয়ে গেছে। একইভাবে গাজায় এখনো হামাসের হাতে বন্দী ১৩০ পণবন্দী রয়ে গেছে। হামাস এখনো অপরাজেয়।

অনেকের কাছেই শক্তিশালী যুক্তি হলো, মধ্যপ্রাচ্যের মূল সংকট সমাধান করতে হলে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের অবসান করতে হবে। এর জন্য অনেক বেশি কূটনৈতিক সময়, শক্তি ও সম্পদ ব্যয় করা প্রয়োজন। 

এই সংঘাত আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় বিষ ছড়াচ্ছে। এই সংঘাত পশ্চিমা নীতিকে ভারসাম্যহীন করে তুলছে। ইরানের মতো দুর্বৃত্ত খেলোয়াড়ের ক্ষমতা বাড়াচ্ছে।


সিমন টিসডল: বৈদেশিক সম্পর্কবিষয়ক ভাষ্যকার ও কলাম লেখক;
(গার্ডিয়ান থেকেঅনূদিত)

মতামত এর আরও খবর