img

ট্রাম্প সাসপেন্সের চূড়ান্ত পর্ব কী সংসদীয় অভ্যুত্থান?

প্রকাশিত :  ১৬:২৮, ১৯ নভেম্বর ২০২০
সর্বশেষ আপডেট: ১৬:৫২, ১৯ নভেম্বর ২০২০

ট্রাম্প সাসপেন্সের চূড়ান্ত পর্ব কী সংসদীয় অভ্যুত্থান?

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ৩ নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বি ডেমোক্র্যটিক প্রার্থি জো বাইডেনের কাছে হেরে যাওয়ার পর থেকেই নির্বাচনে ‘ভোট ডাকাতির’ অভিযোগ নিয়ে তীব্র শোরগোল করে চলেছেন। প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালনকালে অথবা তারও আগে প্রেসিডেন্টের গদি টার্গেট করে তিনি যেভাবে দেশ জুড়ে বিভাজন সৃষ্টির কাজ করে গেছেন, ঠিক একই কায়দায় এখন নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পরও একই কায়দায় বিভাজন সৃষ্টির কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। ট্রাম্প যেসব অভিযোগ তুলে গদি রক্ষার শেষ চেষ্টা কওে চলেছেন, তার মূল লক্ষ্য যে কোন পন্থায় ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা, কোনভাবেই ক্ষমতা হাতছাড়া হতে না দেয়া। তাঁর অভিযোগের কোন ইয়ত্তা নেই। অভিযোগের তীরে তিনি বিদ্ধ করছেন নিজ দলের লোকজনদের, নিজের প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের, পলক না ফেলে বরখাস্ত করে চলেছেন শীর্ষস্থানয়ি কর্মকর্তাদের। তাঁর অভিযোগগুলোর মধ্যে রয়েছে: প্রচন্ড রকমের ভোট জালিয়াতি, ব্যালট পেপার হাতসাফাই, ভোট গণনার সময় তাঁর দলের প্রতিনিধিদের উপস্থিত থাকতে না দেয়া, যাঁরা উপস্থিত ছিলেন তাঁদের জোর করে বের করে দেয়া ইত্যাদি এবং ইত্যাদি।

ডোনাল্ড ট্রাম্প চার বছর আগে অনেক অঘটনের জন্ম দিয়ে মার্কিন মুল্লুকের প্রেসিডেন্টের পদ বাগিয়ে নিয়েছিলেন। চার বছর পর সেই তিনিই সম্ভবত নানা অঘটনের জন্ম দিয়ে বিদায় নিতে যাচ্ছেন। বিদায় না হওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে তাঁর তরফে। এক সময়ের দর্শকপ্রিয় রিয়েলিটি টিভি শো‘র ক্যারিশম্যাটিক হোস্ট ট্রাম্প তাঁর এই বিদায় হওয়া না হওয়া নিয়ে নানা সাসপেন্স ঘনীভূত করে তুলছেন। কখনো মনে হচ্ছে, ট্রাম্প হাল ছেড়ে দিলেও দিতে পারেন, কখনো মনে হচ্ছে, একটা নাটক না করে তিনি হাল ছাড়ছেন না। আবার কখনো মনে হচ্ছে, তিনি নিজেকে ‘ষড়যন্ত্রের ভিক্টিম’ এমন একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি করে হলেও ক্ষমতায় লটকে থাকতে চান। 

ভুললে চলবে না যে, এই ট্রাম্পই বেশ আগে বলেছিলেন, মার্কিন সংবিধানে কোন একক ব্যক্তির দুই মেয়াদের বেশি প্রেসিডেন্ট না থাকার যে বিধান যুক্ত আছে, সেটা সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হলে তাঁর আপত্তি থাকবে না। অর্থাৎ, দ্বিতীয় মেয়াদ তাঁর হাত থেকে কেউ কেড়ে নিতে পারবে না, সে বিষয়ে ট্রাম্প গভীর নিশ্চিত ছিলেন। তাঁর চোখ ছিলো, তৃতীয় মেয়াদের দিকে। অর্থাৎ, বয়স পঁচাত্তর ছুঁই ছুঁই ট্রাম্প এক রকম আমৃত্যু প্রেসিডেন্ট থেকে যাওয়ার একটা ছক মনে মনে বেশ আগে থেকেই কষে রেখেছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয় মেয়াদের স্বপ্নও যে তাঁর জন্যে মরিচীকা হয়ে দেখা দেবে, তুখোড় ‘বাক ও ভঙ্গিমা শিল্পী’ ট্রাম্পের ধারণায় সেটা সম্ভবত ছিলোই না। 

অতএব কী করা? উত্তর: যে করেই হোক ক্ষমতার সূতো যেন হাত ফস্কে না যায়, তার ব্যবস্থা করা। 

অবিরাম মিথ্যার পূজারি; অবিরাম অসত্যের অনুসারি; প্রতিপক্ষের প্রতি সীমাহীন কটুকাটব্যের বল্গাহীন কথাশিল্পী; ট্যাক্স না দিয়ে মিলিওনেয়ার বনার কারিগর ডোনাল্ড ট্রাম্প শ্রদ্ধা, বিবেচনাবোধ, পরিমিতি, সংযম, দয়ার্দ্রতা - এসব মানবীয় গুণাবলীর সাথে একেবারেই অপরিচিত। 

পছন্দ হয় না-এমন যে কোন মানুষের প্রকাশ্যে পিন্ডি চটকাতে তাঁর জুড়ি নেই। সোশ্যাল মিডিয়া-প্ল্যাটফরম টুইটার দিয়ে প্রেসিডেন্সি চালিয়েছেন তিনি। রাত দুপুরে কাউকে ফায়ার করেছেন, কাউকে হায়ার করেছেন-সবই টুইটার ফিডের মাধ্যমে।

কথায় কথায় সেক্রেটারি অব স্টেটের মতো পদাধিকারীদেরকে বিদায়ের দরোজা দেখিয়েছেন, ওয়াশিংটনের রাস্তায় সামরিক কুচকাওয়াজের ব্যবস্থা করে স্যালুট গ্রহণের অভিলাষ ছিলো তাঁর, অতি সম্প্রতিকালে বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনকারীদের সড়ক থেকে হটাতে সামরিক বাহিনী মোতায়েনের জোর প্রচেষ্টাও ছিলো তাঁর। আর মেইনস্ট্রিম মিডিয়ার সাথে তাঁর বৈরিতা অনেক স্বৈরশাসকের রেকর্ডও ম্লান করে ছেড়েছে।

স্মরণকালের মধ্যে ট্রাম্প হচ্ছেন এমন একজন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিজ দেশে যাঁর দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া যায় না। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে তাঁর জুড়ি একেবারেই নেই, সেটা বলা যাবে না। উত্তর কোরিয়ায় তাঁর দোসর পাওয়া যায়, রাশিয়াতেও পাওয়া যায়, পাওয়া যায় চীনেও। এমন কি মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশেও কি পাওয়া যায় না? অথবা দক্ষিণ এশিয়ায়? আফ্রিকায়? দূরপ্রাচ্যে? নিশ্চয় পাওয়া যায়। 

উপরে উল্লেখিত ওই সব অঞ্চলে ট্রাম্পের সাথে মিল রয়েছে, এমন তথাকথিত নেতারা ষড়যন্ত্র করে ক্ষমতা দখল করেন আবার ষড়যন্ত্র করেই তা ধরে রাখারও কোশেশ করেন। কেউ কেউ ষড়যন্ত্র না করেও ক্ষমতায় আসেন, পরে আর ক্ষমতা ছাড়তে চান না বলে ষড়যন্ত্রই তাঁদের ক্ষমতা ধরে রাখার হাতিয়ার হয়ে পড়ে। কেউ কেউ ক্ষমতার মসনদে সমাসীন হতে জনতাকে উস্কে দেন, কেউ মসনদে বসেও জনতাকে উস্কে দিয়ে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার চেষ্টা চালান। 

রেজিমেন্টেড সমাজ ও দেশে এতোসব কারিকুরির খেল দেখা যায়। কিন্তু তাই বলে যুক্তরাষ্ট্রে? আড়াইশ’ বছর ধরে যে দেশটিতে তাদের একটি নিজস্ব গণতান্ত্রিক পদ্ধতি বিকশিত হয়ে এসেছে?

এমন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের দেশটি যে বিশ্ব জুড়ে হরহামেশা তান্ডবলীলা চালিয়ে আসছে, আমরা সেটি ভুলে যাইনি। আমরা ভুলে যাইনি ভিয়েতনামের ইতিহাস, এমনকি আমাদের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে সে সময়ের ‘গণতান্ত্রিক’ মার্কিন নেতৃবৃন্দের কুৎসিত বাঙালি জনগণবিরোধী চক্রান্তের কথাও ভোলেনি বাংলাদেশের মানুষ।

একেবারে সম্প্রতিকালে ইরাকে মার্কিনীদের ধ্বংসলীলার কথা ভুলে যাওয়ার নয়। ভুলে যাওয়ার নয় আফগানিস্তানে অস্ত্রবলে তাদের নতুন ইতিহাস রচনার চেষ্টার কথা। আমাদের মনে আছে লিবিয়ার কথা, মনে আছে পৌণে এক শতাব্দী ধরে ঘরহারা ভাসমান ফিলিস্তিনী জনগোষ্ঠির করুণ ইতিহাসের কথাও। 

সভ্যতার আলখাল্লা গায়ে চাপিয়ে মার্কিনীরা বিশ্বের নানা প্রান্তে তাদের পছন্দমাফিক ওলট-পালট চালিয়ে আসছে বহু বহু যুগ ধরে। কিন্তু দেশের ভেতরে তাদের সে মূর্তি কখনো দেখা যায়নি। সেখানে তারা সর্বদাই একান্ত গণতান্ত্রিক, একান্ত মানবিক এবং কখনো একান্ত ‘ধার্মিকও’ বটে। এমন একটা ধারায় প্রথম অদ্ভুত ব্যতিক্রম হলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। যেমন করেই হোক, যেভাবেই হোক, ট্রাম্প ক্ষমতায় এসে গিয়েছিলেন। এখন তৃতীয় দফায় নয়, দ্বিতীয় দফাতেই গলা ধাক্কা দেয়া হবে তাঁকে-এতোটা তিনি কেমন করে মেনে নেবেন?

ফলে প্রথমবারের মতো আমরা একজন ক্ষমতাসীন মার্কিন প্রেসিডেন্টকে দেখলাম নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তুলে ক্রুদ্ধ আর্তনাদ ছাড়তে। সাধারণত এমনটা দেখা যায়, অন্য কোন দেশে বিরোধী দলীয় নেতার তরফে। প্রেসিডেন্ট পদে সমাসীন ট্রাম্প বললেন, তাঁর কাছ থেকে বিজয় ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে; ভোট জালিয়াতি হয়েছে; তাঁকে দেয়া ভোট বদলে প্রতিপক্ষ জো বাইডেনকে দিয়ে দেয়া হয়েছে; জো বাইডেনের পক্ষে অবৈধ ভোটও বৈধ ঘোষণা করা হয়েছে ইত্যাকার নানা কাহিনী। 

২০২১ সালের ২০ জানুয়ারি নতুন প্রেসিডেন্টের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট পুনর্নিাচিত হিসেবে নতুন প্রেসিডেন্ট হতে পারেন অথবা যিনি সদ্য নতুন নির্বাচিত হলেন, তিনিও হতে পারেন। ধড়িবাজ ট্রাম্প কাউকেই বুঝতেও দিচ্ছেন না, ২০ জানুয়ারি শেষ পর্যন্ত তিনি কি করতে যাচ্ছেন। 

কখনো তিনি একজন ‘ভিক্টিমের’ ভাব ধারণ করে করুণ কন্ঠে কাতরাচ্ছেন, কখনো ‘নির্বাচনী ফলাফল মানি না’ বলে গর্জে উঠছেন আর নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে টুইটারে তাঁর অবিরাম ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ তো অব্যাহতই রয়েছে। 

রোববার (১৫ নভেম্বর) রাতে বিদায়ি ট্রাম্প আটটি টুইট-ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছেন। সার কথা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি ‘জিতেছেন’ এবং সে ‘বিজয় ছিনিয়ে‘ নেয়া হচ্ছে। 

এর কয়েক ঘন্টা আগে তিনি হয়তো মনের অজান্তে এক টুইট-বোমায় পেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী ঘোষিত জো বাইডেনের নাম উল্লেখ না করে লিখে ফেলেছিলেন: ‘‘...‘তিনি‘ জিতেছেন, কারণ নির্বাচনে কারচুপি করা হয়েছে”। পর্যবেক্ষকরা আশাবাদি হয়ে উঠেছিলেন যে, শেষ পর্যন্ত ট্রাম্পের বোধহয় বোধাদয় হতে চলেছে, নির্বাচনী ফলাফল তিনি শেষ পর্যন্ত বোধহয় মানতে চলেছেন। কিন্তু, না, এর পরপরই বেশ কয়েকটি টুইট-বার্তায় রিয়েলিটি টিভির স্টার উপস্থাপক সেসব আশার গুড়ে বালি ঢেলে দিয়েছেন। পরিষ্কার করে বলেছেন, না, তিনি পরাজয় স্বীকার করছেন না। 

মজার ব্যাপার, ট্রাম্প শুধু অভিযোগ তুলেই যাচ্ছেন, ভোটে কারচুপির কোন প্রমাণ দেখাচ্ছেন না। তাঁর নিজের সরকারের সাইবার সিকিউরিটি ও ইনফ্রাস্ট্রাকচার সিকিউরিটি এজেন্সি স্পষ্ট করে বলে দিয়েছে, এবারের নির্বাচন আমেরিকান ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি নিরাপত্তার সাথে ও সুষ্ঠু পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত হয়েছে। ফলে সে এজেন্সির পরিচালককে তাৎক্ষণিকভাবে বিদায় হতে হয়েছে, ট্রাম্প তাঁকে টুইট ফিডে বরখাস্ত করে দিয়েছেন। 

শঙ্কিত পর্যবেক্ষকদের এখন ভয়: নানা ডামাডোলের আড়ালে ট্রাম্পের আসল উদ্দেশ্য একটি অভ্যুত্থান ঘটানো। 

নির্বাচনের পরপরই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রি মার্ক এসপারকে বরখাস্ত করেছেন। প্রতিরক্ষা দফতর এবং নিরাপত্তা বিষয়ক আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শীর্ষপদেও তিনি পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। নির্বাচনে তাঁর প্রায় সর্বত্র স্বীকৃত পরাজয়ের পর বিদায় বেলায় এ ধরণের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে রদবদল করা, এমন কি ট্রাম্পের তোঘলকী মানদন্ডেও বড় রকমের কান্ড বলে দেখা হচ্ছে। 

তবে কি ট্রাম্প প্রতিরক্ষা দফতর তথা মার্কিন সশস্ত্র বাহিনীকে ব্যবহার করে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন? ঠিক এতোটা হয়তো ট্রাম্পের রাজত্বেও সম্ভব হবে না। কিন্তু ট্রাম্প একটা অভ্যুত্থান ঘটাবার প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছেন, সে নিয়ে আশঙ্কা ক্রমেই জোরদার হয়ে উঠছে। মার্কিন রাজনীতির সর্বশেষ হালচালের দিকে নজর রাখা পর্যবেক্ষদের ধারণা, এই অভ্যুত্থান হবে বিচার বিভাগীয়-কাম-সংসদীয় অভ্যুত্থান। 

ওয়াশিংটনের খবরগুলো থেকে জানা যাচ্ছে, ট্রাম্পের রিপাবলিকান পার্টি যে একের পর এক নানা মামলা নিয়ে কোর্টে যাচ্ছেন তার একটি উদ্দেশ্য রয়েছে। অনেক কোর্টেই তাঁরা ব্যর্থ হয়েছেন। কিন্তু ট্রাম্প থেমে নেই। তিনি নির্বাচনে প্রদত্ত ব্যালটের বৈধতা নিয়ে নানা কোর্টে নানা প্রশ্ন তুলেই চলেছেন।

তাঁর লক্ষ্য হচ্ছে, মামলাবাজির অতিবর্ষণের কারণে অঙ্গরাজ্যগুলোর পক্ষ থেকে যেন ওই রাজ্যে ভোটের ফলাফল সার্টিফাই করার সুযোগ না মেলে। এই সার্টিফিকেশনের কাজ ঠেকিয়ে রাখা গেলে তাঁর যে ফায়দা হবে, তা হলো, তাঁর দল রিপাবলিকান পার্টির সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে যেসব রাজ্যে, সেগুলোর আইনসভাগুলো জনসাধারণের দেয়া (পপুলার) ভোটের রায় আমলে না নিয়ে ইলেক্টোরাল কলেজে তাদের নিজেদের পছন্দমতো প্রতিনিধিদের মনোনীত করতে পারবে। এর ফলে এই ইলেক্টোরাল কলেজের ভোটাভুটিতে ট্রাম্প সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট পেয়ে যাবেন, অর্থাৎ, থেকে যাবেন প্রেসিডেন্টের গদিতে।  

দিবাস্বপ্ন? ভুলে গেলে চলবে না: ট্রাম্পের ডিকশনারিতে ‘অসম্ভব‘ বলে কোন শব্দ নেই। 

চলতি নভেম্বরের মধ্যেই অনেকগুলো রাজ্যের ফলাফল সার্টিফায়েড হয়ে যাওয়ার কথা। দেশজুড়ে বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে এর সর্বশেষ সময়সীমা ৮ ডিসেম্বর। ট্রাম্পের পরিকল্পনা হচ্ছে, মামলা-মোকদ্দমার অতিবর্ষণে বিচার বিভাগকে পর্যদুস্ত করার কাজ অব্যাহত রেখে এসব ডেডলাইন পার করে দেয়া। 

ইলেক্টোরাল কলেজের সভা বসবে ১৪ ডিসেম্বর। এর আগেই যেসব অঙ্গরাজ্যের আইনসভায় রিপাবলিকান পার্টি সংখ্যাগরিষ্ঠ, সেগুলোতে ওই আইনসভাগুলোর মাধ্যমে ট্রাম্প নিজের পক্ষের প্রতিনিধিদের ইলেক্টোরাল কলেজে মনোনীত করার কাজটি শেষ করে ফেলতে পারবেন। ফলে ইলেকটোরাল কলেজের সভায় তাঁর পক্ষে বেশি ভোট পড়বে, ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট পদে থেকে যেতে পারবেন।

ট্রাম্পের এই অনুমিত অভ্যুত্থান-ষড়যন্ত্র শেষ পর্যন্ত কোন্্ পরিণতির দিকে এগিয়ে যায় সেটা সামনের দিনগুলোই বলে দেবে। কিন্তু ট্রাম্পের হাতে মার্কিন নির্বাচনী ব্যবস্থা তথা দেশটির গণতান্ত্রিক ধারাটি ভয়ানকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে চলেছে, সে নিয়ে সন্দেহ করার সুযোগ থাকছে না। নির্বাচনী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তাঁর প্রমাণবিহীন লাগাতার অভিযোগ ও হামলা মিলিয়িন মিলিয়ন মার্কিনী দেখেছেন। নানা জরীপে দেখা যাচ্ছে, নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থে নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা ধ্বংসের লক্ষ্যে ট্রাম্পের পরিকল্পিত এই আক্রমণ কাজে আসছে। ট্রাম্পের দল রিপাবলিকান পার্টির বেশির ভাগ কর্মী-সমর্থক বিশ্বাস করছেন, নির্বাচনে বড় রকমের প্রতারণা হয়েছে।

ট্রাম্পের যাবতীয় হৈচৈয়ের পেছনে আসলেই কোন ‘অভ্যুত্থান-ষড়যন্ত্র‘ রয়েছে কি-না, তা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়, কিন্তু একনায়কদের সাথে তাঁর আচরণে যে কোন তফাৎ নেই, সেটা নিশ্চিত। তাই ট্রাম্পের ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার যাবতীয় প্রচেষ্টার একটি অংশরূপে ‘অভ্যুত্থান-ষড়যন্ত্রের‘ অস্তিত্ব বোধহয় উড়িয়ে দেয়ার মতো নয়।। 

কিন্তু তেমন একটি সম্ভাবনা/আশঙ্কার কথা বলাবলি হওয়াটাও কি একটি ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে না?  

[মুহাম্মদ আব্দুস সাত্তারঃ সাংবাদিক - কলামিস্ট। স্পেশাল কন্ট্রিবিউটর, সাপ্তাহিক জনমত এবং জনমত ডটকম, সাবেক নির্বাহি সম্পাদক, দৈনিক সিলেটের ডাক, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, সিলেট প্রেস ক্লাব এবং লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাব]

লন্ডন ১৮ নভেম্বর ২০২০

মতামত এর আরও খবর

img

গাজা যুদ্ধ বন্ধে বাইডেন কেন এতটা মরিয়া

প্রকাশিত :  ১১:৪১, ১২ মে ২০২৪
সর্বশেষ আপডেট: ১১:৪৮, ১২ মে ২০২৪

জনাথন ফ্রিডল্যান্ড

দ্বিতীয় দফায় নির্বাচিত হবেন কি না তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের উদ্বেগ একেবারে প্রান্তে এসে পৌঁছেছে। জো বাইডেনের পরামর্শ বারবার উপেক্ষা করে আসছিলেন বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। এই উপেক্ষার মূল্য কী হতে পারে, এই সপ্তাহে ইসরায়েল সেটা দেখতে পেল।

ইসরায়েলের ৩ হাজার ৫০০ বোমার চালান আটকে দিয়েছে বাইডেন প্রশাসন। এই অস্ত্র ইসরায়েল গাজার দক্ষিণের শহর রাফা আক্রমণে ব্যবহার করবে, সেই বিবেচনায় অস্ত্রের চালানটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। রাফায় এখন ১০ লাখের বেশি শরণার্থীর আশ্রয়শিবির।

ইসরায়েলের প্রতি জো বাইডেন তাঁর ‘লৌহদৃঢ়’ সমর্থন থেকে সরে আসছেন না। কিন্তু ইসরায়েল রাফা হামলার জন্য যে হুমকি দিয়ে চলেছে, সেটা সফল করতে অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করবেন না। সিএনএনকে বাইডেন বলেছেন, ‘ইসরায়েলের নিরাপত্তা দেওয়া থেকে আমরা সরে আসছি না। অন্যখানে যুদ্ধ করার সক্ষমতা তৈরির পথ থেকে সরে আসছি আমরা।’

ইসরায়েলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিত্র যুক্তরাষ্ট্র। ইসরায়েলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী আইজাক রবিন বলতেন, তাঁর দেশের ১ নম্বর কৌশলগত সম্পদ এই সব অস্ত্র, এমনকি পারমাণবিক অস্ত্র নয়; বরং ওয়াশিংটনের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক। দশকের পর দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় অস্ত্রের জোগানদাতা ও কূটনৈতিক অভিভাবক। 

কিন্তু মাত্র ছয় সপ্তাহের ব্যবধানে ওয়াশিংটন এমন দুটি পদক্ষেপ নিল, যা পুরোপুরি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গেল। গত মার্চ মাসে নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ভেটো দেওয়া থেকে বিরত থাকে যুক্তরাষ্ট্র। ফলে ইসরায়েল প্রস্তাবটি আটকে দিতে চাইলেও ব্যর্থ হয়। আর এখন তো ওয়াশিংটন অস্ত্রের চালান আটকে দিল।

এর থেকেও বড় বিষয় হলো, এই সিদ্ধান্তগুলো এমন একজন রাজনীতিবিদ নিয়েছেন, যিনি ব্যক্তিগতভাবে ইসরায়েলের খুব নিবেদিতপ্রাণ সমর্থক। বাইডেন সেই যুগের একজন ডেমোক্র্যাট, যখন দুই সহস্রাব্দের নির্বাসন ও শাস্তির পর মধ্যপ্রাচ্যে ইহুদিদের আদি বাড়ি প্রতিষ্ঠার বিষয়টি গতি পেতে শুরু করেছে। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের উদারপন্থীদের চোখ তখন রহস্যজনকভাবে বন্ধ ছিল।  

গোল্ডা মেয়ার থেকে শুরু করে ইসরায়েলের প্রত্যেক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বাইডেন দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে। ইসরায়েলের প্রতি বাইডেনের টান বাড়ার ক্ষেত্রে এর একটার ভূমিকা আছে। পূর্বতন প্রেসিডেন্টদের মতো বাইডেনের ইসরায়েলের প্রতি ভ্রাতৃত্ববোধ শুধু নির্বাচনী হিসাব-নিকাশের বিষয় নয়।  

গাজা নিয়ে কোনো চুক্তি হচ্ছে না। কেননা, নেতানিয়াহু কিংবা সিনাওয়ারা কেউই বিশ্বাস করেন না, চুক্তি করলে তাঁদের স্বার্থ রক্ষিত হয়। যেমনটা যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক কর্মকর্তা অ্যারন ডেভিড মিলার বলেছেন, ‘এই সংঘাত বন্ধে একটি পক্ষেরই কেবল সত্যিকারের তাড়া আছে, সেই পক্ষটি হলেন জো বাইডেন।’

অন্যদিকে ১৯৮০-এর দশকে নেতানিয়াহু প্রথম আলোচনার পাদপ্রদীপে উঠে আসেন। তিনি এমন একজন কূটনীতিক, যিনি আমেরিকানদের সঙ্গে সাবলীলভাবে কথা বলতেন। সে সময় থেকেই তিনি নিজেকে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে দাঁড় করান। ইসরায়েলের একজন হবু নেতার জন্য এই দক্ষতা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। 

কয়েক দশক ধরে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তাঁর ভোটারদের এই বার্তা দিয়ে আসছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের মধ্যকার সব ধরনের গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ক্ষেত্রে তিনিই একমাত্র বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তি।

কিন্তু বাস্তব অবস্থাটা এখন কী দাঁড়াল?  চার দশকের বেশি সময়ের মধ্যে বাইডেনই প্রথম প্রেসিডেন্ট যিনি ইসরায়েলকে সামরিক সহায়তা দেওয়া বন্ধ করলেন। (১৯৮২ সালে ইসরায়েলের লেবানন অভিযানের সময় রোনাল্ড রিগ্যান যুদ্ধবিমান দিতে বিলম্ব করেছিলেন।) বাইডেন কেন এটা করলেন? কারণ, নেতানিয়াহু যুক্তরাষ্ট্রের একটি অংশের জনগোষ্ঠীর মধ্যে এমন তিক্ততা তৈরি করেছেন, যেটা আগে দেখা যায়নি।

ইসরায়েলের প্রতি যে যুক্তরাষ্ট্রের সমাজের নিরেট সমর্থন, তাতে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যেভাবে ছাত্র আন্দোলন আছড়ে পড়েছে, সেটা বিস্ময়করই। আন্তর্জাতিক জরিপ সংস্থা গ্যালাপের মার্চ মাসের জরিপ বলছে, ৫১ শতাংশ ইসরায়েলের পক্ষে সমর্থন দিয়েছে, ২৭ শতাংশ সমর্থন দিয়েছে ফিলিস্তিনের পক্ষে। কিন্তু ডেমোক্র্যাট ও তরুণ জনগোষ্ঠী—দুই ক্ষেত্রেই ফিলিস্তিনিদের পক্ষে সমর্থন অনেকটাই বেড়েছে।

জরিপের এই তথ্য বাইডেন ও তাঁর নির্বাচনী প্রচারণা দলকে চিন্তার মধ্যে ফেলেছে। এই অংশের দ্ব্যর্থহীন সমর্থনই ২০২০ সালের নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে পরাজিত করতে ভূমিকা রেখেছিল। গাজাবাসীর দুর্ভোগ সেই ভোটারদের সমর্থন অনিশ্চিত করে তুলেছে। হোয়াইট হাউস নেতানিয়াহুর কাছে পরিকল্পনা চেয়েছিলেন, বেসামরিক জনসাধারণকে হতাহত না করে কীভাবে রাফায় অভিযান করতে পারে ইসরায়েল। 

কিন্তু নেতানিয়াহু সেই পরিকল্পনা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। সেই কারণে ইসরায়েলকে থামানোর জন্য অস্ত্রের চালান আটকে দেওয়ার সরাসরি পথ বেছে নিয়েছে ওয়াশিংটন।

রাফা বাইডেনের জন্য শক্তি পরীক্ষার জায়গাও হয়ে উঠেছে। বাইডেন রাফাকে বিপদরেখা হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন। নেতানিয়াহু যদি সেই বিপদরেখা অতিক্রম করেন, তাহলে বাইডেন দুর্বল হিসেবে চিহ্নিত হবেন।

কিন্তু নেতানিয়াহু এখন পর্যন্ত রণেভঙ্গ দিতে অস্বীকার করেছেন। ইসরায়েলের স্বাধীনতা আন্দোলনকে সামনে রেখে জনগণের উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র ছাড়া আমরা একাই লড়ে যাব। প্রয়োজনে আমরা আমাদের নখ দিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাব।’ 

নেতানিয়াহু চার্চিলের মতো আওয়াজ তুলতে চাইছেন। কিন্তু তাঁর কথাগুলো দুর্বলের কণ্ঠস্বর, সবলের নয়। ওয়াশিংটন চায়, নেতানিয়াহু যেন রাফা অভিযান থেকে সরে আসেন। কিন্তু জোট সরকারের অতি ডানপন্থী মিত্ররা তাঁকে আরও কঠোর হতে বলছেন, রাফা অভিযানের মাধ্যমে হামাসের বিরুদ্ধে পুরোপুরি বিজয়ের জন্য বলছেন।

এই নিরানন্দ নাটকে বাইডেন ও নেতানিয়াহুই কেবল কুশীলব নন; হামাস নেতা ইয়াহিয়া সিনাওয়ারেরও নিজস্ব হিসাব-নিকাশ আছে, নেতা হিসেবে টিকে থাকার সংকল্প রয়েছে। খুব ঘনিষ্ঠভাবে যাঁরা সিনাওয়ারকেও পাঠ করেছেন তাঁরা বিশ্বাস করেন, নির্দোষ মানুষের জীবন রক্ষা করা তাঁর অগ্রাধিকার নয়; বরং যত বেশি গাজাবাসী নিহত হবেন, আন্তর্জাতিক পরিসরে তাঁর শত্রু ইসরায়েলে অবস্থান ততই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সেই পরিস্থিতি তাঁকে বিজয়ী দাবি করতে সহায়তা করবে। সম্প্রতি হামাস যুদ্ধবিরতি চুক্তি মেনে নেওয়ার ঘোষণার পেছনে সিনাওয়ারের এই ভাবনায় কাজ করেছে। 

সিনাওয়ারা সাময়িক কোনো যুদ্ধবিরতি (তাতে অনেক মানুষের প্রাণরক্ষা হয়, দুর্ভোগ কমে) চান না, তিনি চান স্থায়ী যুদ্ধবিরতি। আর তার জন্য সিনাওয়ারা অপেক্ষা করতেও রাজি।

গাজা নিয়ে কোনো চুক্তি হচ্ছে না। কেননা, নেতানিয়াহু কিংবা সিনাওয়ারা কেউই বিশ্বাস করেন না, চুক্তি করলে তাঁদের স্বার্থ রক্ষিত হয়। যেমনটা যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক কর্মকর্তা অ্যারন ডেভিড মিলার বলেছেন, ‘এই সংঘাত বন্ধে একটি পক্ষেরই কেবল সত্যিকারের তাড়া আছে, সেই পক্ষটি হলেন জো বাইডেন।’


জনাথন ফ্রিডল্যান্ড, ব্রিটিশ গণমাধ্যম গার্ডিয়ানের খ্যাতিমান কলামিস্ট

মতামত এর আরও খবর