পুরুষদের বীরত্ব তুলে ধরা, সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা
নারীদের চেয়ে ৩ গুণ বেশি পুরুষ আত্মহত্যা করে, পুরুষ মারা যায় নারীদের চেয়ে ৪ থেকে ৫ বছর আগে। পুরুষেরা হৃদরোগে ভুগে বেশি।
আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবস কবে? উত্তর দিতে গিয়ে থমকে যাবেন অনেকেই। উত্তরটা হলো ১৯ নভেম্বর।
নারী দিবস আর পুরুষ দিবসের পার্থক্য হলো - নারী দিবস প্রতিষ্ঠার পেছনে রয়েছে নারীর অধিকার আদায়ের সংগ্রাম। অনেক অত্যাচার সহ্য করে, জেল জুলুম খেটে আত্মত্যাগ এর বিনিময়ে অর্জন করতে হয়েছে নারী দিবস। আর পুরুষের বীরত্বকে তুলে ধরা এবং সমাজে ও পরিবারে পুরুষের অবদানকে উদযাপন করতেই পুরুষ দিবসের সূচনা হয়। এ বছরের আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবসের থিম হলো ‘বেটার হেলথ ফর ম্যান এন্ড বয়েজ’।
নারী-পুরুষ আদতে সমাজের দুটি স্তম্ভ। যার উপর ভিত্তি করেই দাঁড়িয়ে থাকে একটা সুস্থ, স্বাভাবিক সমাজ।
আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবস প্রতি বছর ১৯ নভেম্বর তারিখে পালিত হয়। সারা বিশ্বব্যাপী পুরুষদের মধ্যে লিঙ্গ ভিত্তিক সমতা, পুরুষদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা এবং ইতিবাচক ভাবমূর্তি তুলে ধরার প্রধান উপলক্ষ হিসেবে এই দিবসটি উদযাপন করা হয়ে থাকে।
পুরুষ দিবসের ইতিকথা:
কথিত আছে, ১৯২৩ সালে, অগণিত পুরুষ ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসের মতো আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবস পালনের দাবি তুলে। প্রথমে ঠিক হয়েছিল ২৩ ফেব্রুয়ারী পুরুষ দিবস পালন করা হবে। ঠিক ৮ মার্চ নারী দিবসের আগেই হবে পুরুষ দিবস। কিন্তু তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নে আগে থেকেই ২৩ ফেব্রুয়ারী বিশ্বযুদ্ধে মৃত সৈনিকদের শ্রদ্ধা জানাতে এবং পুরুষজাতিকে উদ্বুদ্ধ করতে রেড আর্মি ও নেভি ডে পালন করা হতো। ফলে ফেব্রুয়ারীর পরিবর্তে নভেম্বর মাসে পুরুষ দিবস পালনের জন্য ঠিক হয়।
ষাটের দশক থেকেই পুরুষ দিবস পালনের জন্য লেখালেখি চলছে। ১৯৬৮ সালে আমেরিকান সাংবাদিক জন পি হ্যারিস নিজের লেখায় এ দিবসটি পালনের গুরুত্ব তুলে ধরেন। নব্বই দশকের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও মাল্টায় কয়কেটি প্রতিষ্ঠান পুরুষ দিবস পালনের জন্য বেশ কয়কেটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। যদিও অনুষ্ঠানগুলো খুব একটা প্রচার পায়নি। অংশগ্রহণও ছিল কম।
দিনটিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বীকৃতি আনার পেছনে যার সবচেয়ে বেশি অবদান রয়েছে তিনি ত্রিনিদাদ ও টোবাগোর বাসিন্দা জেরোমি টিলুকসিংহ। তিনি দিবসটির স্বীকৃতির জন্য তার পিতার জন্মদিন ১৯ নভেম্বরকে বেছে নেন। আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবসের পেছনে ইউনেসকোরও পৃষ্ঠপোষকতা রয়েছে।
অবশেষে ১৯৯৯ সালের ১৯ নভেম্বর ত্রিনিদাদ ও টোবাগোতে প্রথম আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবস উদযাপিত হয়েছিল। বর্তমানে প্রতি বছর ১৯ নভেম্বর বিশ্বের ৮০টিরও বেশি দেশে পালন করা হয় দিবসটি। এই দেশগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো - যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রিয়া, চীন, কানাডা, বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, ক্রোয়েশিয়া, জ্যামাইকা, কিউবা, স্কটল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, মাল্টা, কানাডা, ডেনমার্ক, নরওয়ে ও ইউক্রেন।
আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবসেকে গুরুত্ব দেবার আরো কারণ হলো:
ইন্টারন্যাশনাল মেনসডে ওয়বেসাইট অনুসারে, বিশ্বের নারীদের চেয়ে ৩ গুণ বেশি পুরুষ আত্মহত্যা করে, পুরুষ মারা যায় নারীদের চেয়ে ৪ থেকে ৫ বছর আগে। পুরুষেরা হৃদরোগে ভুগেন বেশি। এর থেকে পরিত্রাণ পেতে এবং সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবস পালনের লক্ষ্য।
শিশু, কিশোর ও পুরুষের স্বাস্থ্যের বিষয়ে বিশেষ যতœ ও মনোযোগ দেয়া। বিভিন্ন সংস্কার ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে এবং সমাজ, পরিবার, বিবাহ ও শিশু যতেœর ক্ষেত্রে পুরুষদের সচেতনতা তৈরী করা। নারী-পুরুষের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়ন, সমান অধিকার বিষয়ক প্রচারণা করা এবং পুরুষদের অর্জন ও অবদানকে তুলে ধরাও এ্ দিবসের উদ্দেশ্য।
বিশ্বজুড়ে পুরুষ দিবসে নানা ভাবে পালনের রেওয়াজ রয়েছে। শোভাযাত্রা এবং মহিলা ও পুরুষদের সাম্যতা রক্ষার্থে বিভিন্ন দাবী-দাওয়া সম্পর্কিত আলোচনা সভা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে উদযাপন করা হয়। লিঙ্গ সমতা, কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষের একই সুযোগ দেওয়ার মত সামাজিক বিষয়গুলিও প্রাসঙ্গিকভাবে আসে।
নারীর অধিকারগুলো পুরোপুরি অর্জিত না হলে যেমন মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করা যাবে না, তেমনি পুরুষের অধিকার বাদ দিয়েও সেটা হবে না। নারীর অধিকার ও পুরুষের অধিকার তাই একে অপরের পরিপূরক।
নারী-পুরুষ একই মানবসমাজের সহযোদ্ধা। উভয়ের লড়াইটা মূলত বৈষম্য ও সকল প্রকার নির্যাতকের বিরুদ্ধে, অন্যায়কারীর বিরুদ্ধে। অন্যায় ও বৈষম্যমূলক রীতিনীতিকে ধারণ করে যে সমাজ সেই সামাজিক বৈষম্য ও রীতিনীতির বিরুদ্ধে। এ লড়াইতে সচেতন পুরুষ ও নারী দুজনকেই এগোতে হবে পাশাপাশি।
অনেকে ‘দিবস’ পালনের মর্মার্থ বুঝতে পারেননা। আসলে প্রতি বছর একটি দিনকে দিবস’ হিসেবে পালনের উদ্দেশ্য হলো অসংগতি দূর করা, উত্তরণের উপায় উদ্ভাবন ও পালন। আগামীদিনের জন্য কিছু কর্মসূচী গ্রহণ করা এবং বিগত বছরের প্রতিবাদ্য বিষয় কতটুকু কার্যকর হলো তার মূল্যায়ণ করা।
অপরদিকে, ১৯ নভেম্বর আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবসের পরদিন ২০ নভেম্বর ছিলো বিশ্ব শিশু দিবস। দেশের ভবিষ্যৎ গঠনে শিশুদের গুরুত্বকে মনে করেই এই দিনটি পালিত হয়। এছাড়াও,এই দিনে শিশুদের অধিকার সম্পর্কে সব মানুষকে আরও সচেতন করার চেষ্টা করা হয়। শিশুরা যাতে সঠিক শিক্ষা পায়, দেশের সংস্কৃতি সম্পর্কে শিক্ষা পায় সে ব্যাপারেও প্রচার করা হয় এই দিনটিকে উপলক্ষ করে। পাশাপাশি শিশুদের সঠিক পুষ্টির প্রয়োজনীয়তার কথাও তুলে ধরা হয়।
*নিলুফা ইয়াসমীন হাসান: সাংবাদিক ও কলাম লেখক*
লন্ডন ২৫ নভেম্বর ২০২০