প্রকাশিত : ১৪:১৭, ২৬ নভেম্বর ২০২০
ক্রিং... ক্রিং... টেলিফোনের অপর প্রান্তটি একটানা সুরেলা শব্দে বেজে উঠার আগেই এ মূহুর্তে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তিটি ফোনের অপর প্রান্ত হতে তাঁর প্রাপ্ত বিজয় অভিনন্দনটি শুনতে পেলেন। অভিনন্দন গ্রহীতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম সদ্য নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন এবং সম্মানিত দাতাটি আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন।
যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র সর্ম্পকটি ঐতিহাসিকভাবেই কূটনৈতিক বন্ধুত্বে আপাদমস্তক মোড়ানো। তবে, গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধা হতেই নিয়মতান্ত্রিকভাবে আগত রাষ্ট্রপতির সাথে চলমান সর্ম্পককে ঝালিয়ে নেওয়া অন্য রাষ্ট্রটির পদস্থ রাষ্ট্রপ্রধানের কাজ। ক্ষমতাসীন দল রিপাবলিকান পরাজিত, পরাজিত দাম্ভিক রাষ্ট্রপতি ট্রাম্প তবে, কিছুটা পাগলাটে স্বভাবের এ মানুষটি সে পরাজয় মেনে নিতে আদৌ রাজি নন। ক্ষমতার স্বাদ যে বড্ড মধুর, তাই তাঁর মার্কিন সিংহাসনটির মেয়াদ শেষ হবার নির্ধারিত দু’টি মাস আগ হতেই অদ্ভুত সব আইন প্রয়োগ করে তাঁর শিশুসুলভ চরিত্রটিকে জনসম্মুখে আর ও স্পষ্ট করে তুলছেন। বৈশ্বিক মহামারি, অর্থনৈতিক মন্দা,বর্ণ বৈষম্যের এক অদৃশ্য তবে সুস্পষ্ট বিদ্যমান স্পর্শকাতর বিষয় সহ নানা অনস্বীকার্য ব্যাপারগুলোকে পাশ কাটিয়ে যে বিষয়টি আবার ও মার্কিন জনতা বিশ্ববাসীর কাছে উপস্থাপন করল,তা গণতন্ত্রের বিজয়! তারা চমৎকারভাবে বুঝিয়ে দিল কেন তারা বিশ্বসেরা।
দীর্ঘসময় ধরে মিডিয়ার বদৌলতে ট্রাম্পের আক্রমনাতœক ও হাস্যকর প্রেস কনফারেন্স এ দু:সময়ে অনেকের কাছেই নির্মল বিনোদনের খোরাক ছিল। এ নির্মল বিনোদনের খোরাকে বহুদিন পর নতুনত্ব নিয়ে হাজির হলেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাম ওবামার উত্তরসুরি পুরোদস্তুর রাজনীতিবিদ জো বাইডেন, বিশ্ব আবার ও একটি চমৎকার স্বাগত ভাষণ শুনল। তবে, পরীক্ষিত জো বাইডেনকে ছাঁপিয়ে অষ্টম বিস্ময়টি আমাদের উপহার দিলেন সদ্য নির্বাচিত ভাইস প্রেসিডেন্ট কমালা হ্যারিস। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের প্রথম কৃষ্টতাঙ্গ মহিলা ভাইস-প্রেসিডেন্ট! নারীর ক্ষমতায়নের কি অসাধারণ বহি:প্রকাশ। ২০২০ সালের সাধারণ নির্বাচনে দৃশ্যত ফুঁটে উঠা দ্বিধাবিভক্ত মার্কিনীদের তোপের মুখে পড়া ট্রাম্পের ভোট ব্যাংকটি কিন্তু নানা প্রশ্নবিদ্ধ সিদ্ধান্ত আর অযাচিত হস্তক্ষেপের পর ও স্তুপাকার। অন্যতম কারণ একটাই, পাক্কা ব্যবসায়ীটি মার্কিন বাণিজ্য লক্ষীটিকে তাঁর শাসনামলে বিস্তৃত করেছেন,যদি ও চলতি অশুভ সময়ের থাবা তাতে চিড় ধরিয়েছে। অবশ্য , প্রকৃতির স্বাভাবিক শক্তির কাছে কল্পনার সুপারম্যান ও পরাজিত বাস্তবের শাহেনশাহ তো কোন ছাড়!
এ অশুভ সময়ে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ শক্তি হিসেবে পরিচিত ব্রিটেনের সাথে চলমান অর্থনৈতিক সর্ম্পক আর ও জোরদার হবে না ব্রেক্সিট বিবেচনায় তা অন্যদিকে মোড় নেবে তা অনেকখানি বর্তমান ডেমোক্রেট প্রধান জো বাইডেনের উপর নির্ভর করছে। পারিবারিক জীবনে অসংখ্য ঘাত-প্রতিঘাতের মুখোমুখি হওয়া এ বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের অধিকারি মানুষটির আদি বসতিটি সুদূর আয়ারল্যান্ডে। জন্মসূত্রে আইরিশ এ নাগরিকটি তাঁর উত্তরসুরি স্কটিশ ট্রাম্পের পদাংক অনুসরণ করবেন তা বলাই বাহুল্য। তবে, বর্তমান বাস্তবতা বিবেচনায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে ‘গুড ফ্রাইডে এগ্রিমেন্টের’ মুখোমুখি সরকার প্রধান বরিস নিদির্¦ধায় স্বীকার করেছেন, তাদের এখন ও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে।
কনজারভেটিভ পার্টির অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্র ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী জন মেজর সম্প্রতি গণমাধ্যমে আক্ষেপ করে বলেছেন ইংল্যান্ডের বিশ্বব্যপী সুনাম যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এটা দুঃখজনক, কর্মরত কৌসুলীরা সরকারের পরিকল্পনাটিকে অতিরিক্ত চুল-চেরা বিশ্লেষণের মাধ্যমে ব্রিটেনের ব্রেক্সিট চুক্তিটি বাজারে অযৌক্তিক করে তুলেছেন যা ব্রিটিশ পার্লামেন্টে দায়িত্বরত মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরা আর্ন্তজাতিক আইনের অবমাননা বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি জোরালো দাবি করেছেন;
ব্রিটেন এখন আর কোন ১ম সারির বৈশ্বিক শক্তি নয়, ব্রিটেন পরিণত হয়েছে ২য় সারির রাষ্ট্রে ব্রেক্সিট নামক বারুদটি বিস্ফোরণের পর যা বিক্রিত হতে চলেছে পুরোপুরি মিথ্যার উপর।
তাঁর দল ক্ষমতাসীন, তথাপি ব্রেক্সিটের নিয়মিত গঠনমূলক সমালোচনাকারি জন মেজর এ হুঁশিয়ারিই প্রদান করেছেন, এ প্রক্রিয়াটির সাথে জড়িতদের কাউকে ক্ষমা করা হবে না। ১ম সারির বৈশ্বিক শক্তিটির পক্ষে পূর্বের অবস্থান ফিরে পাওয়া কষ্টসাধ্য হবে।
তবে, আগামী অর্ধ শতক জুঁড়ে আমাদের অল্প জনসংখ্যা আর ইচ্ছেশক্তিকে পুঁজি করে আমাদের সামনে এগোনোর উপরই নির্ভর করবে আমরা আমাদের সমসাময়িক বৈশ্বিক শক্তিগুলোকে অতিক্রম করতে সক্ষম হব কি না?
সাম্প্রতিক দশক গুলোতে এটাই প্রমাণিত হয়েছে, আর্ন্তজাতিক বিষয়গুলোতে আমরা আমাদের সাধ্যের সীমা অতিক্রম করেছি।
আর্ন্তজাতিক প্রভাবের পুরোটাই নির্ভর করছে ব্রিটেনের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস আর সুনামের উপর। অথচ, পরিস্থিতি বলছে ভিন্ন কথা-দ্বিধাবিভক্ত ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন আর দীর্ঘসূত্রিতা বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর ইউরোপের সাথে এক নড়বড়ে সর্ম্পকের সেতু ধরে রেখেছে ব্রিটেন। যে সেতুটি সময়ের সাথে সাথে হয়তবা পাকাপোক্ত হতে পারে নতুবা আর ও নড়বড়ে।
এ ক্রান্তিকালে বরিস সরকার যথেষ্ট সাহসের সাথে তার প্রধান সেনাপতি আমাদের দয়ালু অর্থমন্ত্রী রিশি সুনাককে সঙ্গে নিয়ে বিপর্যস্ত অর্থনীতি মোকাবেলা করে চলেছেন। চলতি লকডাউনকে সামনে রেখে আগামী ২০২১ সালের মার্চ মাস নাগাদ চাকরীজীবীদের জন্য ফারলো স্কীম চালু রেখেছেন।
সময়ের সাহসী অর্থমন্ত্রীটি ব্রিটিশ জনতাকে এই বলে আশ্বাস দিয়েছেন ব্রেক্সিট পরবর্তী ব্রিটেন হবে ইউরোপের অন্যতম আর্থিক লেনদেনের কেন্দ্রবিন্দু। চর্তুদিক সমুদ্র পরিবেস্টিত ব্রিটেন নিঃসন্দেহে পুরো ইউরোপজুড়ে যোগাযোগের মূল পথ। তবে, জনবিচ্ছিন্ন রাজা যেমন সঠিক পথের সন্ধানে দিগবিদিক জ্ঞান শূন্য হয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে অপারগ হন। ঠিক তেমনি ব্রেক্সিট সূত্রটির মূল পরিকল্পনাকারিদের অন্যতম বরিস চলতি ২০২০ সালের ৩১শে ডিসেম্বর নাগাদ ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে চুক্তির মেয়াদ শেষে কিসের মুখোমুখি হবেন তা আসলেই নিরীহ ব্রিটিশবাসীর বোধগম্য নয়।
সময় দোরগোড়ায় কড়া নাড়ছে, তুরুপের তাসের মত বরিসের হাতে এখন একটিই অব্যর্থ ওষুধ আশা করা যায়- ফাইজার এর প্রতিষেধক। কভিজ ১৯ এর সংক্রমণ ঠেকাতে ফাইজারের আবিষ্কৃত টিকা। বিজ্ঞানীদের মতে, শতকরা ৯৫ ভাগ রোগ প্রতিরোধকারি এ ভ্যাকসিনটি কভিড-১৯ এ আক্রান্ত কোটি কোটি মানুষকে সুরক্ষিত রাখবে। বিজ্ঞানীদের এ আশাবাদ সত্যি হোক, এ আকাঙ্খা সকলের সেই সাথে, ব্রিটেন এ ভ্যাকসিন সরবাহের মাধ্যমে যেমন বিপর্যস্ত অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে তুলতে সক্ষম হবে ঠিক তেমনি যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ সহ বিশ্বের অন্যান্য ১ম সারির বৈশ্বিক শক্তিগুলোকে আবার একসুতোয় গেঁথে নিতে পারবে।
অন্যথায়, স্বাধীনচেতা স্কটল্যান্ড হয়ত প্রতিবেশীর সম্মানের প্রতি খেয়াল না রেখে তার প্রাচীর ভেঙ্গে তার সীমানাটুকু আর ও বিস্তৃত করতে ক্রমশ মরিয়া হয়ে উঠবে। শুভস্য শিঘ্রম বরিস জনসন।
*নুজহাত নূর সাদিয়া, বিশেষ প্রদায়ক, সাপ্তাহিক জনমত, সদস্য লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাব।
১০ই নভেম্বর, ২০২০*