img

ডিশি রিশি: করোনাকালীন এক সফল অর্থমন্ত্রী

প্রকাশিত :  ১০:১৪, ০৩ ডিসেম্বর ২০২০

ডিশি রিশি: করোনাকালীন এক সফল অর্থমন্ত্রী

ধারাল নাক আর কিছুটা চৌকোণা মুখের মানুষটির তীক্ষ‘ চোখের দৃষ্টি আর বুদ্ধিদীপ্ত হাসিটি সহ সহস্র মানুষের ভিড়েও নজর কাড়ে। তবে, সুদর্শন মানুষটির নজরকাড়া চেহারাটি সাধারণের আলোচনার মূখ্য বিষয় নয়, যে বিষয়টি ব্রিটিশ জনতা ও সেই সাথে বর্তমানে তাবত পৃথিবীর বোদ্ধা রাষ্ট্রপ্রধানদের বারে বারে বিস্মিত করছে এ করোনাকালীন সময়ে রাষ্ট্র পরিচালনায় তাঁর অভিনব সব পরিকল্পনার বাস্তব সম্মত প্রয়োগ।

অভিবাসীর পরিচয়টি পৈতৃক সূত্রে রক্তে বহমান,তবে জন্মসূত্রে ব্রিটিশ মানুষটি তার ঐতিহ্যগত ধর্ম বিশ্বাসের উপর আজ ও দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করে আছেন । তাই ব্রিটিশ পার্লামেন্টে শপথ নেওয়ার অনুষ্ঠানে চটপটে মানুষটি ‘ভগবত গীতা’ পাঠের মাধ্যমেই তাঁর রাজনৈতিক জীবনের শুভ সূচনা করেন। বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক ক্যারিয়ার, শত বছরের পুরনো অভিজাত ‘রিচমন্ড’ এলাকার আসনটি কনজারভেটিভ পার্টির শক্ত ঘাটি বলে পরিচিত, সে আসনটিতে প্রথমবার নির্বাচনে অংশ নিয়ে বাজিমাত করতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি এ ভারতীয় বংশোদ্ভূত জিনিয়াসের। 

২০১৫ সালে প্রায় ৩৬.২% মেজরিটি নিয়ে এ পাঞ্জাব বাজিকরটি জীবনের প্রথম রাজনৈতিক বাজিটি জিতেছিলেন। সময় তার ক্ষণজন্মা পুরুষটির দিকে দু‘হাত বাড়িয়ে আলিঙ্গন করেছিল, তবে ধীমান রিশি অনাবাসীদের ভিনদেশে শেকড় খুঁজে ফেরার সংগ্রামটি সেই শৈশবেই অনুভব করতে পেরেছিলেন।  হয়তবা, চিকিৎসক বাবার সূত্রে কেনিয়া আর ফার্মাসিস্ট মা’র সূত্রে তানজানিয়ায় আবাস গাড়া কৃষ্টতবর্ণের মানুষদের দু:খগাঁথা তাঁকে ছুঁয়েছিল। আর তাই, সংসদ সদস্য নির্বাচিত হবার সাথে সাথে কালো এবং অনাবাসীদের গবেষণা প্রকল্পের অন্যতম প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নিলেন। 

পথচলা শুরু, সংসদে গৌরবময় অভিষেক ঘটল পরিবেশ, খাদ্য ও রাজধানীর বাইরের শহরগুলোর নানা সমস্যার উপর আলোকপাতের মাধ্যমে। আগেই বলেছি, সৌভাগ্যের বরপুত্র আর সে সৌভাগ্যের সাথে যদি পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্ত মেধার যর্থাথ সম্মিলন ঘটে, তবে সে উদীয়মানের অগ্রযাত্রা ঠেকায় কে? ২০১৭, ২০১৯ সাল নির্বাচনে জয়ী তরুণটির রাজনৈতিক পথচলা যথেষ্ট মসৃণ, পুরোপুরি মন দিলেন নিজ দলের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের ব্রেক্সিট সমর্থনে জোর প্রচারণায়। উত্তর সুরি বির্তকিত সাজিদ জাভেদের সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন ট্রেজারিতে। কোষাগারের স্পর্শকাতর রক্ষণাবেক্ষণ, সাজিদ জাভেদের সমালোচিত সিদ্ধান্ত সমূহ অপরদিকে, বরিসের একান্ত অনুগত ডমিনিকের নি:শর্ত সমর্থন, কোষাগারের প্রধান সচিবের পদোন্নতি ছিল সময়ের ব্যাপার মাত্র। 

চলতি ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে যাত্রা শুরু হল নতুন অর্থমন্ত্রীটির। সপ্তাহ না ঘুরতেই, সময়ের সবচেয়ে বড় অগ্নিপরীক্ষাটির সম্মুখীন সুনাক, করোনা নামক সে ক্রান্তিকালে বীরের মতই ঘুরে দাঁড়ালেন এই সাহসী যুবাপুরুষটি। অধিবাসীদের ক্ষমতাসীন টোরি দল প্রকৃত মূল্যায়ন করে না, নিন্দুকদের এই আপ্ত বাক্যকে ভুল প্রমাণিত করে সম্পূর্ণ নিজ মেধা আর ইচ্ছেশক্তিকে পুঁজি করে এটাই প্রমাণ করলেন প্রকৃত গুণীর কদর পাগলাটে প্রধানমন্ত্রী বরিস ও করতে জানেন। বরিস ও ডমিনিকের সময়োচিত সিদ্ধান্ত যে ভুল ছিল না, তা প্রমাণার্থে সুনাক ১ম বারের মত ৩০ বিলিয়ন পাউন্ডের এক  বাজেট পেশ করলেন যার মধ্যে  অতিরিক্ত ১২ বিলিয়ন পাউন্ড বরাদ্দ ছিল যা করোনা কালে বিপর্যস্ত অর্থনীতির ভারসাম্য বজায় রাখতে রিশি বরাদ্দ করেছিলেন। অর্থনীতির চুলচেরা বিশ্লেষণ নয়, ঐতিহাসিকভাবেই সমাদৃত ইংল্যান্ডের জনকল্যাণ সিস্টেমকে সম¥ান জানিয়ে ৩৩০ বিলিয়ন পাউন্ডের এক বিশাল বাজেট পেশ করলেন যা পুরো বিশ্বের বিস্ময়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানেই শেষ নয়, বিগত অক্টোবর মাস পর্যন্ত এ চরম চাকরি সংকটের বাজারে প্রায় ৯.৬ মিলিয়ন চাকরিজীবীকে ‘ফারলো স্কীমের’ আওতায় এনে আর্থিক সংকটে পড়া বহু পরিবারকে এখন ও বেঁচে থাকার আশ্বাস যুগিয়ে চলেছেন প্রতিনিয়ত। ব্রিটেন ২য় জাতীয় লকডাউনের অবরুদ্ধ সময়টিতে ইতিমধ্যে ঢুকে পড়েছে, আসন্ন ২০২১ সালের এপ্রিল মাস নাগাদ পুরো ইউরোপ জুঁড়ে কনকনে শীতের সে হাঁড় কাঁপানো অনুভব আর মহামারির তীব্রতা পাল্লা দিয়ে বেঁড়েই যাবে, এ বাস্তবভিক্তিক আশংকাই প্রকাশ করেছেন দায়িত্বরত বিজ্ঞানীরা। আর এ কঠিন সময়ের সাথে  এক দারুণ সন্ধি স্থাপন করেছেন দয়ালু হৃদয়ের রিশি। মন্থর অর্থনীতি আর স্থবির জীবনযাত্রাকে সচল রাখার অভিপ্রায়, বাড়িয়ে দিয়েছেন ‘ফারলো স্কীমের’ সময় সীমা আগামী ২০২১ সালের মার্চ মাসের শেষ নাগাদ।

স্টানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুলব্রাইট স্কলারটি কর্মজীবনের শুরতে ‘ইনভেস্টম্যান্ট ব্যাংকে’ একজন এনালিস্ট হিসেবে তাঁর পেশাগত জীবন শুরু করেছিলেন। পরবর্তীতে ব্যবস্থাপনার নানা খাতে তাঁর পেশাগত দক্ষতার হাতটি ক্রমশ প্রসারিত হতে লাগল। ব্যক্তিগত জীবনে বিয়ের প্রজাপতিটি ও তার বর্ণিল রঙে তাঁর জীবনকে রাঙিয়ে দিয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সহপাঠি ভারতীয় ধনকুবের নারায়ন মিত্রের কন্যা অশ্বেতা মিত্রকে ভালবেসে বিয়ে করে সুখী সংসারে দু‘টি সন্তানের জনক রিশি। সংসার জীবনে দায়িত্বশীল পিতা, বাস্তব জীবনে প্রেমময় স্বামীটি শ্বশুরের মালিকানাধীন ‘ক্যাটামারান’ কোম্পানির একজন ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বটে।

ব্যবসায়িক বোদ্ধা না রাজনীতির নব্য গুরু কোন পরিচয়ে রিশি অলঙ্কৃত হবেন তা ইতিহাসই নির্ধারণ করবে। তবে, বর্তমানে ‘ডিশি রিশি’ পরিচয়ে দারুণ ভাবে জনপ্রিয় মানুষটির ইট আউট হেল্প আউট স্কীমটি 

(অর্থাৎ, শতকরা ৫০ ভাগ দামে রেস্তোরাগুলোতে খাবার সরবরাহ করা) নির্দিষ্ট সময় শেষে ব্যক্তি মালিকানাধীন রেস্তোরাগুলোতে প্রবল প্রতাপেই রাজত্ব করছে।

পাকা রাঁধুনির মতই হেশেল সামাল দিয়ে চলেছেন রিশি, তবে সুদূরপ্রসারী মানুষটি বেশ ভালভাবেই অনুভব করছেন এ বিপর্যস্ত অর্থনীতিকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে কমপক্ষে দু হতে আড়াই বছর সময় লাগবে। আর তাই, তাঁর উপদেষ্টা কমিটিকে সাথে নিয়ে প্রণয়ন করেছেন নতুন কর্মসংস্থানের একটি রুপরেখা যাতে শতকরা ৭৭ ভাগ আবাসন ও খাদ্য সরবরাহে নতুন চাকরির সুযোগ তৈরি করা, শতকরা ৬০ ভাগ বিনির্মাণে, বিক্রয় ক্ষেত্রে ৪২ ভাগ সহ পর্যটন ও শিল্পে নতুন বিনিয়োগের দ্বার খুলে দেওয়ার উপর জোর দিয়েছেন তিনি।

তবে, সব ছাঁপিয়ে আমজনতার দৃষ্টি কেড়েছে ১৬ হতে ২৪ বছর বয়সীদের জন্য করা তাঁর ‘কিক র্স্টাট’ স্কিমটি। ২ বিলিয়ন পাউন্ডের এই প্রণোদনাটি তরুণ গ্রাজুয়েটদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির একটি উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা যা বিগত আগস্ট মাস হতে শুরু হয়েছে। বিগত জুলাই মাস হতে অতিরিক্ত ৩০ বিলিয়ন পাউন্ড বরাদ্দ করা হয়েছে যাতে অর্ন্তভুক্ত আছে পর্যটন খাতে ভ্যাট প্রত্যাহারের প্রস্তাব, মোট ৩,০০,০০০ মানুষকে কর্মপ্রণোদনা দেওয়া, ট্যাক্স বাতিল বেশ কিছু খাতে,  কাজের পাশাপাশি বোনাসের মাধ্যমে উৎসাহ প্রদান সহ নানা সৃষ্টিশীল প্রকল্পের এক আশ্চর্য সুন্দর প্রয়োগ। শক্তিশালী প্রতিবেশী জার্মানী, তাদের সৃষ্ট স্বল্প সময়ে কাজ করার পরিকল্পনাটি বন্ধুপ্রতিম ব্রিটেন ও অনুসরণের অপেক্ষায়। ১২ হতে ২৪ মাস স্থায়ী ‘কুরজারবেত’ নামক সিস্টেমটি চলমান সংকট সমাধানের পথ কিছুটা হলে ও বাতলে দেয় বৈকি! অপর দু’ রাষ্ট্র অস্ট্রিয়া ও ফ্রান্স যা ইতিমধ্যে অনুসরণ করছে।

সরকারের উচ্চ পর্যায়ের পরিকল্পনা বিভাগ ইতিমধ্যে স্থানীয় সরকার, স্বাস্থ্য আর শিক্ষা খাতে নতুন ৬,০০,০০০ কর্মসংস্থান তৈরিতে নিরলস কাজ করে চলেছেন। ৭.৬ বিলিয়ন পাউন্ডের একটি প্রণোদনা বাজেট ও অনুমোদনের অপেক্ষায়।

ইউরোপে শীত দোরগোড়ায়, চলতি নভেম্বর মাস হতে কভিড-১৯ সংক্রমণের রেখাটি আবার উর্ধ্বমুখি মূত্যু হার তুলনামূলক ভাবে কম বিবেচিত রেখেই। ব্রিটেন এখন অভিনন্দনের জোয়ারে ভাসছে, অতি আকাঙ্খিত ‘পিফাইজার’  প্রতিষেধকটি বাজারে। শতকরা ৯০ ভাগ আক্রান্তের সেরে উঠার কার্যকারিতা সময়ের ব্যাপার!   অনিশ্চয়তায় মোড়া সময়, খুঁড়িয়ে চলা অর্থনীতি, কোণঠাসা যোগাযোগ ব্যবস্থা, সাবেক প্রধান উপদেষ্টা ডমিনিকের আকস্মিক পদত্যাগ এসব ছাঁপিয়ে  বিচক্ষণ রিশি কি পারবেন  নবাব সিরাজউদ্দোলার বিশ্বস্ত মোহনলাল, বঙ্গবন্ধুর সোচ্চার কন্ঠস্বর তাজউদ্দিন আহমেদ, কিংবা মনমোহন সিং-এর মত এক অসাধারণ কূটনীতিবিদ বনাম রাজনীতিবিদ অথবা শিক্ষাবিদ যেই নামে ডাকি না কেন বরিস সরকারের সাফল্যের মেয়াদ কে দীর্ঘস্থায়ী করতে? না, আপাত সুস্থ বিশ্ববাসী উপভোগ করবে এক বিশ্বস্ত সেনাপতির একক নৈপুন্যের নিপুণ বিনির্মাণ। ইতিহাস তার অব্যর্থ কলম নিয়ে প্রস্তুত!!


*নুজহাত নূর সাদিয়া, বিশেষ প্রদায়ক, সাপ্তাহিক জনমত, সদস্য লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাব।*

০৪ ডিসেম্বর, ২০২০

মতামত এর আরও খবর

img

গাজা যুদ্ধ বন্ধে বাইডেন কেন এতটা মরিয়া

প্রকাশিত :  ১১:৪১, ১২ মে ২০২৪
সর্বশেষ আপডেট: ১১:৪৮, ১২ মে ২০২৪

জনাথন ফ্রিডল্যান্ড

দ্বিতীয় দফায় নির্বাচিত হবেন কি না তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের উদ্বেগ একেবারে প্রান্তে এসে পৌঁছেছে। জো বাইডেনের পরামর্শ বারবার উপেক্ষা করে আসছিলেন বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। এই উপেক্ষার মূল্য কী হতে পারে, এই সপ্তাহে ইসরায়েল সেটা দেখতে পেল।

ইসরায়েলের ৩ হাজার ৫০০ বোমার চালান আটকে দিয়েছে বাইডেন প্রশাসন। এই অস্ত্র ইসরায়েল গাজার দক্ষিণের শহর রাফা আক্রমণে ব্যবহার করবে, সেই বিবেচনায় অস্ত্রের চালানটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। রাফায় এখন ১০ লাখের বেশি শরণার্থীর আশ্রয়শিবির।

ইসরায়েলের প্রতি জো বাইডেন তাঁর ‘লৌহদৃঢ়’ সমর্থন থেকে সরে আসছেন না। কিন্তু ইসরায়েল রাফা হামলার জন্য যে হুমকি দিয়ে চলেছে, সেটা সফল করতে অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করবেন না। সিএনএনকে বাইডেন বলেছেন, ‘ইসরায়েলের নিরাপত্তা দেওয়া থেকে আমরা সরে আসছি না। অন্যখানে যুদ্ধ করার সক্ষমতা তৈরির পথ থেকে সরে আসছি আমরা।’

ইসরায়েলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিত্র যুক্তরাষ্ট্র। ইসরায়েলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী আইজাক রবিন বলতেন, তাঁর দেশের ১ নম্বর কৌশলগত সম্পদ এই সব অস্ত্র, এমনকি পারমাণবিক অস্ত্র নয়; বরং ওয়াশিংটনের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক। দশকের পর দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় অস্ত্রের জোগানদাতা ও কূটনৈতিক অভিভাবক। 

কিন্তু মাত্র ছয় সপ্তাহের ব্যবধানে ওয়াশিংটন এমন দুটি পদক্ষেপ নিল, যা পুরোপুরি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গেল। গত মার্চ মাসে নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ভেটো দেওয়া থেকে বিরত থাকে যুক্তরাষ্ট্র। ফলে ইসরায়েল প্রস্তাবটি আটকে দিতে চাইলেও ব্যর্থ হয়। আর এখন তো ওয়াশিংটন অস্ত্রের চালান আটকে দিল।

এর থেকেও বড় বিষয় হলো, এই সিদ্ধান্তগুলো এমন একজন রাজনীতিবিদ নিয়েছেন, যিনি ব্যক্তিগতভাবে ইসরায়েলের খুব নিবেদিতপ্রাণ সমর্থক। বাইডেন সেই যুগের একজন ডেমোক্র্যাট, যখন দুই সহস্রাব্দের নির্বাসন ও শাস্তির পর মধ্যপ্রাচ্যে ইহুদিদের আদি বাড়ি প্রতিষ্ঠার বিষয়টি গতি পেতে শুরু করেছে। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের উদারপন্থীদের চোখ তখন রহস্যজনকভাবে বন্ধ ছিল।  

গোল্ডা মেয়ার থেকে শুরু করে ইসরায়েলের প্রত্যেক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বাইডেন দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে। ইসরায়েলের প্রতি বাইডেনের টান বাড়ার ক্ষেত্রে এর একটার ভূমিকা আছে। পূর্বতন প্রেসিডেন্টদের মতো বাইডেনের ইসরায়েলের প্রতি ভ্রাতৃত্ববোধ শুধু নির্বাচনী হিসাব-নিকাশের বিষয় নয়।  

গাজা নিয়ে কোনো চুক্তি হচ্ছে না। কেননা, নেতানিয়াহু কিংবা সিনাওয়ারা কেউই বিশ্বাস করেন না, চুক্তি করলে তাঁদের স্বার্থ রক্ষিত হয়। যেমনটা যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক কর্মকর্তা অ্যারন ডেভিড মিলার বলেছেন, ‘এই সংঘাত বন্ধে একটি পক্ষেরই কেবল সত্যিকারের তাড়া আছে, সেই পক্ষটি হলেন জো বাইডেন।’

অন্যদিকে ১৯৮০-এর দশকে নেতানিয়াহু প্রথম আলোচনার পাদপ্রদীপে উঠে আসেন। তিনি এমন একজন কূটনীতিক, যিনি আমেরিকানদের সঙ্গে সাবলীলভাবে কথা বলতেন। সে সময় থেকেই তিনি নিজেকে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে দাঁড় করান। ইসরায়েলের একজন হবু নেতার জন্য এই দক্ষতা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। 

কয়েক দশক ধরে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তাঁর ভোটারদের এই বার্তা দিয়ে আসছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের মধ্যকার সব ধরনের গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ক্ষেত্রে তিনিই একমাত্র বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তি।

কিন্তু বাস্তব অবস্থাটা এখন কী দাঁড়াল?  চার দশকের বেশি সময়ের মধ্যে বাইডেনই প্রথম প্রেসিডেন্ট যিনি ইসরায়েলকে সামরিক সহায়তা দেওয়া বন্ধ করলেন। (১৯৮২ সালে ইসরায়েলের লেবানন অভিযানের সময় রোনাল্ড রিগ্যান যুদ্ধবিমান দিতে বিলম্ব করেছিলেন।) বাইডেন কেন এটা করলেন? কারণ, নেতানিয়াহু যুক্তরাষ্ট্রের একটি অংশের জনগোষ্ঠীর মধ্যে এমন তিক্ততা তৈরি করেছেন, যেটা আগে দেখা যায়নি।

ইসরায়েলের প্রতি যে যুক্তরাষ্ট্রের সমাজের নিরেট সমর্থন, তাতে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যেভাবে ছাত্র আন্দোলন আছড়ে পড়েছে, সেটা বিস্ময়করই। আন্তর্জাতিক জরিপ সংস্থা গ্যালাপের মার্চ মাসের জরিপ বলছে, ৫১ শতাংশ ইসরায়েলের পক্ষে সমর্থন দিয়েছে, ২৭ শতাংশ সমর্থন দিয়েছে ফিলিস্তিনের পক্ষে। কিন্তু ডেমোক্র্যাট ও তরুণ জনগোষ্ঠী—দুই ক্ষেত্রেই ফিলিস্তিনিদের পক্ষে সমর্থন অনেকটাই বেড়েছে।

জরিপের এই তথ্য বাইডেন ও তাঁর নির্বাচনী প্রচারণা দলকে চিন্তার মধ্যে ফেলেছে। এই অংশের দ্ব্যর্থহীন সমর্থনই ২০২০ সালের নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে পরাজিত করতে ভূমিকা রেখেছিল। গাজাবাসীর দুর্ভোগ সেই ভোটারদের সমর্থন অনিশ্চিত করে তুলেছে। হোয়াইট হাউস নেতানিয়াহুর কাছে পরিকল্পনা চেয়েছিলেন, বেসামরিক জনসাধারণকে হতাহত না করে কীভাবে রাফায় অভিযান করতে পারে ইসরায়েল। 

কিন্তু নেতানিয়াহু সেই পরিকল্পনা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। সেই কারণে ইসরায়েলকে থামানোর জন্য অস্ত্রের চালান আটকে দেওয়ার সরাসরি পথ বেছে নিয়েছে ওয়াশিংটন।

রাফা বাইডেনের জন্য শক্তি পরীক্ষার জায়গাও হয়ে উঠেছে। বাইডেন রাফাকে বিপদরেখা হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন। নেতানিয়াহু যদি সেই বিপদরেখা অতিক্রম করেন, তাহলে বাইডেন দুর্বল হিসেবে চিহ্নিত হবেন।

কিন্তু নেতানিয়াহু এখন পর্যন্ত রণেভঙ্গ দিতে অস্বীকার করেছেন। ইসরায়েলের স্বাধীনতা আন্দোলনকে সামনে রেখে জনগণের উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র ছাড়া আমরা একাই লড়ে যাব। প্রয়োজনে আমরা আমাদের নখ দিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাব।’ 

নেতানিয়াহু চার্চিলের মতো আওয়াজ তুলতে চাইছেন। কিন্তু তাঁর কথাগুলো দুর্বলের কণ্ঠস্বর, সবলের নয়। ওয়াশিংটন চায়, নেতানিয়াহু যেন রাফা অভিযান থেকে সরে আসেন। কিন্তু জোট সরকারের অতি ডানপন্থী মিত্ররা তাঁকে আরও কঠোর হতে বলছেন, রাফা অভিযানের মাধ্যমে হামাসের বিরুদ্ধে পুরোপুরি বিজয়ের জন্য বলছেন।

এই নিরানন্দ নাটকে বাইডেন ও নেতানিয়াহুই কেবল কুশীলব নন; হামাস নেতা ইয়াহিয়া সিনাওয়ারেরও নিজস্ব হিসাব-নিকাশ আছে, নেতা হিসেবে টিকে থাকার সংকল্প রয়েছে। খুব ঘনিষ্ঠভাবে যাঁরা সিনাওয়ারকেও পাঠ করেছেন তাঁরা বিশ্বাস করেন, নির্দোষ মানুষের জীবন রক্ষা করা তাঁর অগ্রাধিকার নয়; বরং যত বেশি গাজাবাসী নিহত হবেন, আন্তর্জাতিক পরিসরে তাঁর শত্রু ইসরায়েলে অবস্থান ততই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সেই পরিস্থিতি তাঁকে বিজয়ী দাবি করতে সহায়তা করবে। সম্প্রতি হামাস যুদ্ধবিরতি চুক্তি মেনে নেওয়ার ঘোষণার পেছনে সিনাওয়ারের এই ভাবনায় কাজ করেছে। 

সিনাওয়ারা সাময়িক কোনো যুদ্ধবিরতি (তাতে অনেক মানুষের প্রাণরক্ষা হয়, দুর্ভোগ কমে) চান না, তিনি চান স্থায়ী যুদ্ধবিরতি। আর তার জন্য সিনাওয়ারা অপেক্ষা করতেও রাজি।

গাজা নিয়ে কোনো চুক্তি হচ্ছে না। কেননা, নেতানিয়াহু কিংবা সিনাওয়ারা কেউই বিশ্বাস করেন না, চুক্তি করলে তাঁদের স্বার্থ রক্ষিত হয়। যেমনটা যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক কর্মকর্তা অ্যারন ডেভিড মিলার বলেছেন, ‘এই সংঘাত বন্ধে একটি পক্ষেরই কেবল সত্যিকারের তাড়া আছে, সেই পক্ষটি হলেন জো বাইডেন।’


জনাথন ফ্রিডল্যান্ড, ব্রিটিশ গণমাধ্যম গার্ডিয়ানের খ্যাতিমান কলামিস্ট

মতামত এর আরও খবর