অকুতোভয় দুই মুক্তিযোদ্ধার সাহসের গল্প
অজয় পাল
।। অজয় পাল ।।
গল্পটি তেরো ডিসেম্বর একাত্তর সালের। ছয় ডিসেম্বর বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার পর ভারতীয় মিত্রবাহিনী সিলেট শহর ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় প্রচন্ড বিমান হামলা শুরু করে। এসময় গেরিলা তৎপরতা এবং বীর মুক্তিযোদ্ধাদের চোরাগুপ্তা হামলাও সমান্তরালভাবে চলতে থাকায় পাকসেনা ও তাদের দোসররা প্রায় দিশেহারা হয়ে পড়ে এবং পাকি-দের কয়েকটি ঘাঁটিরও পতন ঘটে। এরই মধ্যে তেরো ডিসেম্বর পাকবাহিনী হঠাৎ করে পাল্টা বিমান হামলা শুরু করলে মুক্তি ও মিত্রবাহিনী সড়ক পথে বিনা যুদ্ধে সিলেট দখলের প্রস্তুতি নেয়।
এর আগে বারো ডিসেম্বর জৈন্তাপুরের দরবস্ত এলাকায় অবস্থান নেয়া মুক্তিযুদ্ধের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের তথা ৪ ও ৫ নম্বর সেক্টরের বেসামরিক প্রধান, তৎকালীন জাতীয় পরিষদ সদস্য দেওয়ান ফরিদ গাজী, মিত্র বাহিনীর অধিনায়ক কর্নেল বাগচী এবং ৪ নম্বর সেক্টর কমান্ডার সি আর দত্ত সিলেটের মানচিত্র নিয়ে বসে উল্লেখিত সিদ্ধান্তের ছক কষেন। সে অনুযায়ী তেরো ডিসেম্বর পাকসেনাদের বিমান হামলা উপেক্ষা করে মুক্তিবাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্যকে সাথে নিয়ে এগিয়ে এসে তাঁরা অবস্থান নেন সিলেট শহরের পূর্ব দিকে খাদিমনগরে। একই সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের আরো দুটি দল অবস্থান নেয় দক্ষিণ-পশ্চিমে জালালপুর এবং লামাকাজী এলাকায়। একমাত্র উত্তর দিক ছিলো উন্মুক্ত। বিস্তীর্ণ সীমান্ত ও পাহাড়ি এলাকা থাকায় সেদিকে পাকবাহিনীর পালানোর সকল পথ ছিলো রুদ্ধ।
ইতোমধ্যে এমসি কলেজ থেকে পাক বাহিনী তাদের ক্যাম্পটি গুটিয়ে নেয়নি, এমন খবর চলে আসলে এদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করার প্রস্তুতি নেয়া হয় দুপুরের দিকে। হরিপুর গ্যাস ফিল্ড, টিলাগড়স্থ বেতার কেন্দ্র ও এমসি কলেজ সহ অন্যান্য স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে আশঙ্কায় যুদ্ধ অর্থাৎ লড়াইয়ের পরিকল্পনা বাদ দেয়া হয়। সে অনুযায়ী দু’জন অসীম সাহসী মুক্তিযোদ্ধার প্রয়োজন অপরিহার্য হয়ে ওঠে, যারা গাড়িতে মাইক বেঁধে পাকবাহিনীর ক্যাম্পে পৌঁছে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানাবে। হাত উঁচিয়ে স্বেচ্ছায় এগিয়ে এলেন দুই মুক্তিযোদ্ধা। জীবনের উপর মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে এগিয়ে আসা এই দুই মুক্তিযোদ্ধার একজন দেওয়ান ফরিদ গাজীর দীর্ঘদিনের ছায়াসঙ্গী ফোরকান আলী (কুটু মিয়া), অপরজন টগবগে যুবক আনোয়ার হোসেন গোরা।
অল্পক্ষণের মধ্যেই গাড়িতে মাইক বেঁধে তাঁরা পৌঁছে গেলেন এমসি কলেজে পাক সেনাদের ক্যাম্পে। মাইকে উপর্যুপরি আত্মসমর্পণের আহ্বান জানানোর এক পর্যায়ে কয়েকজন পাকসেনা এগিয়ে এসে তাঁদের আটক করে জীপসহ ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে অমানুষিক নির্যাতন চালাতে থাকে। তাঁরা তখন পাকসেনাদের জানিয়ে দেন যে, মুক্তি ও মিত্রবাহিনী তোমাদের কাছাকাছি অবস্থানে। আমাদের হত্যা করলে পরিণতি ভয়াবহ হবে, বরং তোমরা আত্মসমর্পণ করো । তখন হঠাৎ কি ভেবে যেনো দুজনকেই তারা প্রায় দু’ঘন্টা পর গাড়ি নিয়ে চলে যেতে বলে। জবাবে তাঁরা বলেন, তোমরা কি পেছন থেকে আমাদের গুলি করতে চাচ্ছো? ক্যাম্প ইনচার্জ বলে, নাহ্, তোমরা নির্ভয়ে যাও। মিত্রবাহিনীকে বলে দিও, আমরা আপার লেভেলে যোগাযোগ করে আমাদের সিদ্ধান্ত জানাব।
প্রাণ নিয়ে ফিরে এসে দুই মুক্তিযোদ্ধা আদ্যপান্ত জানালে পরদিন চৌদ্দ ডিসেম্বর বিকেলের দিকে মুক্তি ও মিত্রবাহিনীকে সাথে নিয়ে দেওয়ান ফরিদ গাজী, সি আর দত্ত ও কর্নেল বাগচী শহর অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন। এদিকে অবস্থা বেগতিক দেখে আগের রাতেই পাকবাহিনী এমসি কলেজের ক্যাম্প গুটিয়ে নিয়ে সালুটিকর বিমানঘাঁটিতে চলে যায়। যাবার আগে তারা ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দিয়ে যায় সিলেটের ঐতিহ্যবাহী কীনব্রিজটি । এদিকে সিলেট অভিমুখী যাত্রার অংশ হিসেবে আনোয়ার হোসেন গোরা ও ফোরকান আলীর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের আরো দুটি দল সালুটিকর বিমান ঘাঁটি পর্যন্ত ঘুরে আসে। মিত্র বাহিনীর একটি দল অবস্থান নেয় আলুরতলে সরকারী দুগ্ধ খামারের কাছে । এরই মাঝে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে । চারদিক থেকে স্রোতের মতো সিলেট শহর অভিমুখে মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর আগমন ঘটতে থাকে । এদের সাথে যুক্ত হন মুক্তিকামী আপামর জনগণ। জয়বাংলা শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে সিলেট নগরী। হানাদার মুক্ত সিলেটের জনগণ আনন্দে সেদিন রাতে দুচোখের পাতা আর এক করতে পারেননি। পরদিন পনেরো ডিসেম্বর সিলেটকে মুক্তাঞ্চল হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়। ইতোমধ্যে পাকবাহিনীর দোসর আলবদর , রাজাকার, আল-সামশ ও শান্তি বাহিনীর সাথে সংশ্লিষ্টরা আত্মগোপনে চলে যায়।
সিলেটকে মুক্ত করার সেদিনের অভিযাত্রায় অগণন মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর অবদান আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে সন্দেহাতীতভাবে সমৃদ্ধ করলেও সেই দুজন মুক্তিযোদ্ধা, ফোরকান আলী ও আনোয়ার হোসেন গোরা’র কীর্তিকে আমি একটু এগিয়েই রাখছি। কতটুকু সাহসী হলে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে হানাদারদের ডেরায় চলে যেতে পারেন দুই বীর, ভাবতেই আজো আমি অবাক হই । অথচ এই দুই বীরকে আজ আমরা ভুলতে বসেছি। সাম্প্রতিক সময়ে অনেক সংবাদকর্মীকে সিলেট মুক্ত দিবস সম্পর্কে লিখতে দেখেছি। তারা নিজেদের প্রতিবেদনে এই দুই মুক্তিযোদ্ধার নাম উল্লেখ না করে “অজ্ঞাতনামা দুই মুক্তিযোদ্ধা” শব্দটি ব্যবহার করেছেন, যা কিনা নিতান্তই দুঃখজনক।
সিলেট নগরীর সুবিদবাজার নিবাসী ফোরকান আলী প্রয়াত হয়ে ছেন ’৯৫ সালের ২৩ অক্টোবর আর জালালাবাদ আবাসিক এলাকা নিবাসী আনোয়ার হোসেন গোরা লোকান্তরিত হয়েছেন ২০০৬ সালের ১২ মে। ব্যক্তিজীবনে দুজনই ছিলেন খুবই সমাজ-বান্ধব এবং নগরীর পরিচিত মুখ। গোরা ছিলেন সংস্কৃতিমনস্ক মানুষ । গানের কন্ঠ ছিলো অপূর্ব। চমৎকার করে গাইতেন: “তোমরা ভুলে গেছো মল্লিকাদির নাম” গানটি। প্রয়াত চিত্রনায়ক জাফর ইকবালের খুব নিকটজন ছিলেন এই আনোয়ার হোসেন গোরা।
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের গর্বিত ইতিহাসের সাথে সম্পৃক্ত এই দুই বীর সর্বমহলে যথাযথ সম্মানিত হবেন, এ আমার প্রত্যাশা ।
অজয় পাল, প্রবীণ সাংবাদিক।
লণ্ডন ১৬ ডিসেম্বর ২০২০