বর্ণাঢ্য এক অধ্যায়ের সমাপ্তি

প্রকাশিত :  ১৫:৪৩, ২৮ জানুয়ারী ২০২১

বর্ণাঢ্য এক অধ্যায়ের সমাপ্তি

এক.

নিজামউদ্দিন লস্কর। আমাদের সবার প্রিয় ‘ময়না ভাই’। লেখক, অনুবাদক, নাট্যকার, অভিনেতা - সর্বোপরি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। ময়না ভাই আর নেই। চলে গেছেন না-ফেরার দেশে। কেন জানি - চলে গেছেন শব্দটি লিখতে গিয়ে আঙুল এগুচ্ছে না। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু এটাই নির্মম সত্য। ময়না ভাই সংস্কৃতির মুক্তমঞ্চে আর আসবেন না। অডিটোরিয়ামে নাটকের মহড়ায় আসবেন না। শহীদ মিনারে চেতনার সম্মিলনে তিনি থাকবেন অনুপস্থিত। এটা এমনই এক সত্য - যে সত্য অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।

নিজামউদ্দিন লস্করের মৃত্যু সিলেটবাসী তথা দেশের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। এটা শুধু প্রথাগত কথার কথা নয়। এমন মানুষ যুগে যুগে জন্মায় না। তাঁর মতো মেধাবী আরেকজন পেতে হলে সিলেটবাসীকে আরও কতদিন অপেক্ষা করতে হবে কে জানে! ঈর্ষণীয় পান্ডিত্বের অধিকারী ছিলেন ময়না ভাই। যেকোনো বিষয় নিয়ে ঘণ্টার পর ঘন্টা কথা বলার যোগ্যতা রাখতেন। আমরা তাঁকে ‘এনসাইক্লোপিডিয়া’ বলতাম। সিলেটের সাহিত্য-সংস্কৃতি, প্রগতিশীল আন্দোলনের পুরোধা পুরুষ ছিলেন ময়না ভাই। তাঁর গোটা জীবনটাই যেন নানা বৈচিত্র্যে ভরপুর ছিল। তাঁর এই অকাল প্রস্থান বড় বেশি ক্ষতি হয়ে গেল আমাদের। একই সঙ্গে বর্ণাঢ্য এক অধ্যায়েরও যে সমাপ্তি ঘটল। যার অনেকটুকু হয়ত আমরা জেনেছি কিন্তু অনেক কিছুই অজানা থেকে গেছে।

দুই.

ময়না ভাইয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্কের সমীকরণ বুঝানো কঠিন। কতটা প্রহর আমরা একসঙ্গে কাটিয়েছি। কত বিষয়ে আলোচনা করেছি। মত-দ্বিমত হয়েছে। তারপর আমরা যেকোনো বিষয়ের উপসংহারে পৌঁছেছি। এসব করতে করতে কখন যে আমরা একে অপরের আপনজন হয়ে উঠেছি তা টেরই পাইনি। এক সময় তাকিয়ে দেখি আমরা পরস্পরের বন্ধু হয়ে গেছি। হ্যাঁ, আমাদের বয়সের ব্যবধান থাকা সত্ত্বেও তিনি ছিলেন আমার বন্ধু। সম্পর্ককে এ পর্যায়ে তিনিই নিয়ে গিয়েছিলেন। এখানেই ময়না ভাই আলাদা এবং অনন্য। যে কারণে ময়না ভাইয়ের নিজস্ব ভুবনে আমার উপস্থিতি আমি অনুভব করতে থাকি। এই যে দীর্ঘ পথচলা—অনেক কিছু শিখেছি তাঁর কাছ থেকে। অনেক কিছু জেনেছি, নিজেকে সমৃদ্ধ করেছি। পাশাপাশি এই মানুষটাকে গভীরভাবে জানার চেষ্টা করেছি। শেষ পর্যন্ত যেটুকু বুঝেছি, এই মানুষটা অন্য ধাতের। সম্পূর্ণ আলাদা। সহজ-সরল। শিশুর মতো কোমল হৃদয়ের অধিকারী। সিনেমা কিংবা নাটকে কষ্টের দৃশ্য দেখে অঝোরে তাঁর চোখ দিয়ে অশ্রু গড়াতে আমি দেখেছি। আনন্দের আতিশয্যে প্রাণখোলা হাসতে দেখেছি। কর্তব্যে অবিচল থাকা, বিষয়বস্তুর গভীর থেকে গভীরে গিয়ে আলোকপাত করা - এটা ছিল তাঁর জীবনদর্শন। কোনো ধরনের কুটিলতা, পঙ্কিলতা তাঁর মাঝে কোনোদিন দেখিনি। একজন মানুষ কতটা সমৃদ্ধ হলে, কতটা মানবিক হলে, কতটা নিষ্ঠাবান ও দায়বদ্ধ হলে এমনটি হতে পারে - তা আমি নিজেও ধারণা করতে পারি না। অসুস্থ হওয়ার আগের দিন পর্যন্ত প্রায়ই মুঠোফোনে তাঁর সঙ্গে কথা হয়েছে। যেদিন অসুস্থ হলেন সেদিন আমার অফিসে আসার কথা ছিল। কেন এলেন না, নিজের ব্যস্ততার কারণে সেটা খোঁজ নিতে পারিনি। 

কিন্তু গভীর রাতে সংস্কৃতিকর্মী নীলাঞ্জন দাশ টুকু জানালেন, ময়না ভাই অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। চিকিৎসকরা নাকি বলেছেন, ‘টু লেট’। যার সারাংশ অনেক দেরি হয়ে গেছে। শব্দটা শুনেই বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। অজানা শঙ্কা ভর করলো মনে। সেই শঙ্কা আর কাটল না। আশা-নিরাশার দোলাচলে দুলতেই থাকল। আর শেষ পর্যন্ত চলেই গেলেন ময়না ভাই!


বীর মুক্তিযোদ্ধা নিজামুদ্দিন লস্কর ময়না\'র কফিনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে শেষ শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন  

তিন.

আমাদের বেশির ভাগ সময়ই কেটেছে লেখালেখি নিয়ে। সারাক্ষণ যেন তাঁর মাথায় নতুন নতুন চিন্তা-ভাবনা খেলা করত। নাটক-গল্প এমনকি প্রবন্ধ-নিবন্ধেও তিনি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশের চেষ্টা করতেন। সামাজিক ত্রুটি-বিচ্যুতি, স্খলন, অবক্ষয়ের পাশাপাশি ইতিবাচক দিকগুলো ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করতেন প্রতিটি লেখায়। অনুবাদের ক্ষেত্রেও একই চিন্তা-ভাবনা লালন করতেন। 

বিশ্বের খ্যাতিমান লেখকদের বহুল পঠিত এবং পাঠক সমাদৃত বইগুলো তিনি অনুবাদ করেছেন। অন্য অর্থে বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে এ দেশের পাঠকদের একটা যোগসূত্র তৈরি করে দিয়েছেন। তাঁর অনুবাদ করা গ্রন্থগুলো পাঠককে উজ্জীবিত করে, উদ্বুদ্ধ করে এবং একজন সফল মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে সাহস জোগায়। 

পাঠককে আত্মোন্নয়নের আলোকিত পথের সন্ধান দেওয়াই ছিল তাঁর অভিষ্ট লক্ষ্য। বেছে বেছে তিনি অনুবাদ করতেন। হাতেগোনা কয়েকটি মাত্র গ্রন্থ তিনি অনুবাদ করেছেন। তাঁর অনুবাদ গ্রন্থগুলো দেখলেই সহজে এটি টের পাবেন পাঠকরা। তিনি তো অনুবাদ জানেন, তাহলে তাঁর অনুবাদকৃত গ্রন্থের সংখ্যা কেন কুড়িটি নয়! এখানেই অন্যদের সঙ্গে অনুবাদক নিজামউদ্দিন লস্করের মূল তফাৎ। শুধু একটি গ্রন্থের কথা বলি। কানাডিয়ান লেখক রবিন এস শর্মার ‘দ্য মঙ্ক হু সোল্ড হিজ ফেরারি’। এ গ্রন্থটি বিশ্বব্যাপী সর্বাধিক বিক্রিত একটি গ্রন্থ। পৃথিবীর ৫০টি দেশে ৭০টি ভাষায় গ্রন্থটি অনূদিত হয়েছে। ময়না ভাই সেটিকেই বেছে নিলেন এবং ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি সেটি অনুবাদ করে পাঠকের হাতে তুলে দেন।

সম্ভবত বছর দুয়েক আগে তিনি একটি নাটক রচনা করেছিলেন। নাম ছিল ‘ঝুঁকি’। নাটকটি মঞ্চায়িতও হয়েছিল। এ নাটকেও সমসাময়িক বিষয় প্রাধান্য পেয়েছে। এই যে, জীবন থেকে নেওয়া কিংবা জীবনের গল্প - এটার স্বার্থক রূপ দিতে পারতেন ময়না ভাই। 

স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে আছে নানা বিকৃতি-বিভ্রান্তি। নিজামউদ্দিন লস্করের ‘একাত্তরে রণাঙ্গনে’ গ্রন্থটি মুক্তিযুদ্ধের একটি নির্মোহ দলিল। সম্মুখসমরে যুদ্ধ করেছেন তিনি। গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো কেমন ছিল, তা তাঁর বই পড়লেই সহজে অনুধাবন করা যায়। নানা বিকৃতি, বিভ্রান্তি, অসত্য-ভুল তথ্যের মধ্যে এটাই তৃণমূল থেকে উঠে আসা যুদ্ধদিনের প্রকৃত ইতিহাস। 


সিলেটের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বীর মুক্তিযোদ্ধা নিজাম উদ্দিন লস্করকে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে গার্ড অফ অনার করা হয়।

চার.

আগেই বলেছি ময়না ভাইয়ের জীবনটা খুবই বর্ণাঢ্য। কোথায় নেই তিনি? সাহিত্যে, সংস্কৃতিতে, সামাজিক আন্দোলনে, রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির জায়গায় কিংবা দেশপ্রেম। জীবনের সব শাখা-প্রশাখায় যার বিচরণ—তাঁকে কিভাবে, কোন অভিধায় ভূষিত করা যায়? এসবের বাইরেও কি তাঁর বিচরণ ছিল না? যদি বলি ‘ইকরামুদ্দিনের বিলেত যাত্রা’র কথা? এক রোমাঞ্চকর বাস্তব উপাখ্যান। সিলেট মিরর-এর ঈদ সংখ্যায় এটি ছাপা হয়েছিল। এটা কি কল্পনা? মোটেই না। এটি বাস্তব। এবং এখানে ময়না ভাই যে কাজটি করেছেন, সেটি একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিকের। একজন ইকরামুদ্দিন কিভাবে সিলেটের হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ থেকে পায়ে হেঁটে নানা প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে লন্ডন গিয়েছিলেন, এর বাস্তব চিত্র। তিনি রীতিমতো ইকরামুদ্দিনের বক্তব্য রেকর্ড করেছেন। তাঁর মুখ থেকে শোনা কাহিনি রেকর্ড করে রেখেছেন। তারপর সেটি নিয়েই রচনা করেছেন উপাখ্যান। এটা কি একজন লেখকের কাজ? নাকি একজন সাংবাদিকের? তাঁর এ লেখাটি বিপুলভাবে প্রশংসিত হয়েছে। ঢাকা থেকে মামুন ভাই (নাট্যজন মামুনুর রশীদ) আমাকে ফোন করে যখন বিস্ময় প্রকাশ করেন, তখন ময়না ভাইয়ের সাফল্যে আমার বুকটা গর্বে ফুলে উঠে। শুধু কী তাই? মামুন ভাই ঢাকার প্রতিষ্ঠিত প্রকাশনাসংস্থা উৎস প্রকাশনের প্রকাশক মোস্তফা সেলিমকে ফোন করে বলেন, যেন ময়না ভাইয়ের এ উপাখ্যানটি তাঁরা বই আকারে প্রকাশ করেন। সেই প্রকাশক আমারও অত্যন্ত স্বজন। বইটি প্রকাশের উদ্যোগ নিই আমরা। ময়না ভাই সেই উপাখ্যানের পরবর্তী অংশ লিখতে শুরু করেন। এক সময় শেষও করেন। লিখেই আমার কাছে পাঠিয়ে দেন। ফোন করে বলেন, ‘আমি যা লিখার লিখে দিয়েছি, বাকিটা আপনি ঠিক করবেন।’ বইটির নাম কী দেওয়া যায়? এ-ও জানালেন Ñ নাম ঠিক করতে পারেননি। যেগুলো মনে এসেছে সেগুলো তাঁর নিজের মনপুত হচ্ছে না। বললেন, ‘আপনিই দেন। আর মামুন ভাই ভূমিকা লিখে দেবেন। তাঁকে পান্ডুলিপি পাঠিয়ে দিয়েছি।’ 

এ পান্ডুলিপি নিয়ে আমাদের বসার কথা ছিল ঠিক ওইদিনই। যেদিন তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন। এখন তো তিনি আর নেই। ভাবি (ময়না ভাইয়ের স্ত্রী) সেদিন হাসপাতালে বললেন, ‘নূর ভাই, এ বইটি নিয়ে উনার এত আগ্রহ, এটি প্রকাশ করতেই হবে।’ আমি বললাম, ‘অবশ্যই হবে।’ কী হবে এখন এ বইটির? প্রকাশক মোস্তফা সেলিম বললেন, ‘বইটি প্রকাশ করবই।’ মামুন ভাই বললেন, ‘ময়না তো আমাকে পান্ডুলিপি পাঠিয়েছে, আমি তো ভূমিকা লিখবই। কিন্তু সে যে চলে গেল।’ হাউমাউ করে কাঁদছেন মামুন ভাই। তাঁর একটাই প্রশ্ন, ‘নূর আমি সিলেট গেলে এখন কার কাছে যাব? তুমি আছো, অন্যরা আছে, কিন্তু ময়না যে ছিল আমার বড় নির্ভরতা।’ 


নিজামউদ্দিন লস্করের বাসায় নাট্যজন মামুনুর রশীদের সঙ্গে। 

এ বইয়ের পুরো পান্ডুলিপি এখন আমার কাছে। আমি পড়েছি। সত্যি বলতে কী, এমন উপাখ্যান আমি এর আগে পড়িনি। এটা ময়না ভাইয়ের মুনশিয়ানা। এমনভাবে সত্য ঘটনাটির যোগসূত্র তৈরি করেছেন, হঠাৎ করে যেকোনো পাঠক এটিকে লেখকের কল্পিত গল্প-উপন্যাস বলে ভ্রম করতে পারেন। ময়না ভাই, আপনার এই অসাধারণ সৃষ্টি আপনি পুস্তকরূপে দেখে যেতে পারলেন না - এটাই যে বড় দুঃখ। 

পাঁচ.

ময়না ভাই আর আমার কত পরিকল্পনা ছিল। আজ থেকে তিন বছর আগে ২০১৭ সালে ১৯ ফেব্রুয়ারি তাঁকে একটি কাজ দিয়েছিলাম আমি। কাজটি হচ্ছে নিজের আত্মস্মৃতি লেখা। বেশ কয়েকটি অনুচ্ছেদে ভাগ করে দিয়েছিলাম। আমার সঙ্গে তিনি একমতও হয়েছিলেন। কিন্তু শুরু করেও তিনি থমকে যেতেন। মাঝখানে ঢুকে পড়তেন গল্প কিংবা নাটকে। এ নিয়ে অনেকদিন রাগও করেছি তাঁর ওপর। কঠোরভাবে শাসনের সুরেও বলেছি। সবকিছু মেনেও নিতেন। কিন্তু তারপরও অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়তেন। শেষ পর্যন্ত সে কাজটি আর হলো না। অথচ এ কাজটি হলে ইতিহাসের অনেক সত্য উন্মোচিত হতো। 

মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি এম এ জি ওসমানীর সঙ্গে দু বছর ঘনিষ্ঠভাবে ছিলেন তিনি। অনেক ঘটনা প্রত্যক্ষভাবে দেখেছেন। অনেক সত্য জেনেছেন। অনেক অম্লÑমধুর অভিজ্ঞতাও আছে। অনেক সময় আমাকে বলেছেন। আমি বলেছিলাম, ‘এগুলো লেখেন।’ বলেছিলেন, ‘এটা লেখা সম্ভব না!’ বলেছিলাম, ‘লিখে রাখেন, এমন যদি হয় তাহলে আপনার মৃত্যর পর প্রকাশ করব।’ বলেছিলেন, সে চেষ্টা করবেন। কিন্তু কিছুই হলো না। সব অব্যক্ত কথা অজানাই থেকে গেল। অথচ ময়না ভাই আপনি সে ইতিহাস লিখে গেলে সেটি হতো আমাদের জানার বাইরের এক অজানা অধ্যায়। এখন কী হবে ময়না ভাই?


২৩ জানুয়ারী সিলেটের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অনুষ্ঠিত হয় নাগরিক শোক সভায একটি স্মারক মরহুমের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করছেন আয়োজকরা।

ছয়.

আমার রক্তে-মাংসে সাংবাদিকতা। সাংবাদিকতা আমার ধ্যান-জ্ঞান। সিলেটের সাংবাদিকতাকে অন্যরকম উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার স্বপ্নে ২০০৬ সালে সিলেট প্রতিদিন নামে একটি দৈনিক বের করেছিলাম। কিন্তু বৈরি পরিবেশে আমাকে হোঁচট খেতে হয়। পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়। এক যুগ পর আবারও নতুন স্বপ্ন, নতুন উদ্যম নিয়ে যুক্ত হলাম দৈনিক সিলেট মিরর-এ। দেশের প্রতিষ্ঠিত শিল্পগ্রুপ বারাকা গ্রুপ আমার স্বপ্নের সারথি হয়। 

প্রকাশিত হয় দৈনিক সিলেট মিরর। নতুন কিছু করার স্বপ্ন। নানা সীমাবদ্ধতা, তবুও এরই মধ্যে অনেকগুলো সাহসী উদ্যোগ নিয়েছে সিলেট মিরর। সিলেট থেকে গুণীজনদের সম্মাননা জানাতে প্রথমবারের মতো কোনো সংবাদপত্র হিসেবে সিলেট মিরর উদ্যোগ নেয়। বিভিন্ন ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখা ব্যক্তিদের সম্মাননা প্রদানের জন্য সিলেট মিরর পুরস্কার প্রবর্তন করে। 

সাহিত্য, সাংবাদিকতা, সংস্কৃতি, শিক্ষা এই চার ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রাখা ব্যক্তিত্বদের সম্মানিত করে সিলেট মিরর। প্রথমবারের মতো প্রবর্তিত এ সম্মাননা পেয়েছিলেন নিজামউদ্দিন লস্কর ময়না। সংষ্কৃতি ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্য তাঁকেই মনোনীত করে জুরি বোর্ড। আজ এই সময়ে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছে - আমরা সিলেট মিরর পরিবার সত্যিই সৌভাগ্যবান। কারণ তাঁর মতো কীর্তিমানকে সম্মাননা জানিয়ে সিলেট মিরর পরিবারই সম্মানিত বোধ করছে। 


সংস্কৃতিক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে সিলেট মিরর পুরস্কার গ্রহণ করছেন নিজামউদ্দিন লস্কর। 

সাত.

আমাদের কত কথা হতো। কত বিষয়। এটা কেউ আন্দাজই করতে পারবেন না। কারণ কই ময়না ভাই, আর কই আমি? অথচ আমরা যে কী ছিলাম-সেটা কী করে বুঝাই? ময়না ভাইয়ের একটা আকাঙ্ক্ষা ছিল, আমাকে নিয়ে শান্তিনিকেতনে যাবেন। কত চিন্তা-ভাবনা। কী করবেন, কোথায় যাবেন। কারা সঙ্গ দেবে Ñ কতকিছু। বলেছিলেন ওখানে শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার আছে। সব্যসাচী (ফেলুদাখ্যাত জনপ্রিয় অভিনেতা সব্যসাচী চক্রবর্তী) আছেন।  আমাদের আর শান্তি নিকেতনে যাওয়া হলো না।

এখন কী হবে ময়না ভাই? হুট করেই আপনি চলে গেলেন। একটি কথা মনে রাখবেন, চলে যাওয়া মানেই প্রস্থান নয়। যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন - এটাই আমার শেষ প্রার্থনা।

আহমেদ নুর, সম্পাদক দৈনিক সিলেট মিরর

(লেখাটি সিলেট মিরর এর সৌাজন্যে প্রকাশিত হলো।)


মতামত এর আরও খবর

ফের মধ্যপ্রাচ্য সফরে অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন, যুদ্ধ কি থামবে?

প্রকাশিত :  ১৪:০৮, ২১ মার্চ ২০২৪

 ইসরায়েল-হামাসের মধ্যে একটি যুদ্ধবিরতি নিশ্চিত করার জন্য ফের মধ্যপ্রাচ্য সফরে গেছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন। প্রথমে সৌদি আরব ও তারপর মিসরে আরব নেতাদের সাথে পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন আলোচনা করবেন। যাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বলছে ‘অ্যান আর্কিটেকচার ফর লাস্টিং পিস’, অর্থাৎ সেখানে দীর্ঘস্থায়ী শান্তির লক্ষ্যে একটি কাঠামো তৈরির চেষ্টা করা হবে। এবারের আলোচনার মূল বিষয়বস্তুও এটি।

এই উদ্যোগ এমন সময়ে নেয়া হলো, যখন প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন ইসরাইলি বাহিনী গাজা শহরের আল-শিফা হাসপাতালের চারপাশে অভিযান বাড়িয়েছে, এমনকি তারা বেশ কয়েকটি বিমান হামলাও চালিয়েছে।

এর আগে ইসরাইলের সেনাবাহিনী বলেছিল যে তারা সোমবার থেকে সেখানে ৯০ জন বন্দুকধারীকে হত্যা করেছে।

একইসাথে, যুদ্ধবিরতি ও জিম্মিদের মুক্তির জন্য কাতারে ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে পরোক্ষ আলোচনা চলছে। তবে কিছু বিষয় দেখে বোঝা যাচ্ছে যে একটা অগ্রগতি আসন্ন।

গাজায় যুদ্ধ শুরুর পর থেকে এই অঞ্চলে এটি মি ব্লিঙ্কেনের ষষ্ঠ সফর। সৌদি নেতাদের সাথে দেখা করতে বুধবার বিকেলে তিনি জেদ্দায় অবতরণ করেন।

সূর্যাস্তের কিছুক্ষণ আগে বিমান থেকে নামার পর সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাজিন আল-হিমালি সহ অপেক্ষমান কর্মকর্তারা তাকে অভ্যর্থনা জানান এবং আলিঙ্গন করেন।

বুধবার রাতে রাজপ্রাসাদে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সাথে তার দেখা করার কথা।

যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার বলেছেন যে তারা একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তির সিদ্ধান্তে পৌঁছানো ও গাজায় চলমান মানবিক সংকটের মাঝে সেখানে ত্রাণ বিতরণ বাড়ানোর বিষয়ে আলোচনা করবেন।

এই সপ্তাহে জাতিসঙ্ঘ-সমর্থিত ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্লাসিফিকেশন (আইপিসি)-এর একটি খাদ্য নিরাপত্তা জরিপ বলছে যে গাজার এক দশমিক এক মিলিয়ন, অর্থাৎ ১১ লাখ মানুষ ভয়ানক ক্ষুধা ও অনাহারের সাথে লড়াই করছে।

সংস্থাটি আরো বলেছে যে আগামী মে মাসের মাঝে গাজার উত্তরাঞ্চলেও একটি মানবসৃষ্ট দুর্ভিক্ষ আসতে চলেছে।

এছাড়াও মিলার যোগ করেন, ‘পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আলোচ্যসূচিতে আরো থাকবে গাজার জন্য সঙ্ঘাত পরবর্তী পরিকল্পনার সমন্বয়, এটি নিশ্চিত করা যে হামাস আর গাজাকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে বা ৭ অক্টোবরের হামলার আর পুনরাবৃত্তি ঘটাতে পারবে না, ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য একটি রাজনৈতিক সমাধান, দীর্ঘস্থায়ী শান্তি স্থাপন এবং এই অঞ্চলের নিরাপত্তা।’

ব্লিঙ্কেন মিসরের নেতাদের সাথে দেখা করতে বৃহস্পতিবার কায়রো যাবেন।

আজ থেকে ১৭ বছর আগে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত প্যালেস্টেনিয়ান অথরিটিকে (পিএ) গাজা থেকে বিতাড়িত করেছিলো হামাস।

এত বছর পর আবার তাদেরকে গাজায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে আমেরিকানরা।

এখনো কিছুই এগোয়নি। কিন্তু, আন্তর্জাতিক মহল দীর্ঘদিন ধরে যে দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানের কথা বলে আসছে, ইসরাইলসহ সকল পক্ষ যখন সেদিকে অগ্রসর হবে, তখন আরব দেশগুলোর সমর্থন পাওয়া যাবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের উন্নত অস্ত্রশস্ত্র এবং তাদের সমর্থিত বেসামরিক পারমাণবিক শক্তি কর্মসূচিতে প্রবেশের বিনময়ে আরব দেশগুলোর প্রধান পৃষ্ঠপোষক দেশ সৌদি আরব ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে পারে।

এদিকে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বারবার গাজায় পিএ নিয়ন্ত্রণের বিষয়টিকে প্রত্যাখ্যান করেছেন।

এই অবস্থায় গাজায় পিএ-কে ফিরিয়ে আবার চেষ্টার কারণে তার এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সম্পর্কে কিছুটা চিড় ধরাতে পারে।

তবে এই পরিকল্পনার বিষয়ে জানেন, এমন কেউ কেউ স্বীকার করেছেন যে যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে অগ্রগতির অভাব, গাজায় চলমান মানবিক সংকট, ইসরাইলি ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে বিদ্যমান অবশিষ্ট আস্থাটুকুও ভেঙে যাওয়ার কারণে আপাতদৃষ্টিতে এটিকে উচ্চাভিলাষী বলে মনে হচ্ছে।

যদিও মার্কিন প্রশাসন তাদের এই পরিকল্পনার বিষয়ে এখনো আশাবাদী।

ব্লিঙ্কেনও তার বর্তমান সফরের অংশ হিসেবে শুক্রবার ইসরাইলেও যাবেন।

মিলারের মতে, তিনি ইসরাইলি নেতাদের সাথে জিম্মিদের বিষয়ে ও রাফাহ-তে বেসামরিক নাগরিকদের রক্ষা করার জন্য হামাসের পরাজয় সুনিশ্চিত করা নিয়েও আলোচনা করবেন।

প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইসরাইলকে সতর্ক করেছেন যে দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর রাফাহ-তে আক্রমণ শুরু করা ‘ভুল’ হবে। কারণ সেখানে এক মিলিয়নেরও বেশি বাস্তুচ্যুত বেসামরিক লোক আশ্রয় নিয়েছে।

কিন্তু মঙ্গলবার নেতানিয়াহু বলেন, ইসরাইল রাফাহ-তে হামাস ব্যাটালিয়নদের নির্মূল করার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এবং স্থল আক্রমণ ছাড়া এটি করার আর কোনো উপায় নেই।

হামাস পরিচালিত গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতে, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে গাজায় ৩১ হাজার ৯০০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে।

আর ইসরাইল বলছে, সাতই অক্টোবর দক্ষিণ ইসরাইলে হামাসের হামলায় প্রায় এক হাজার ২০০ জন নিহত ও ২৫৩ জন জিম্মি হওয়ার পর থেকে এই সংঘর্ষ শুরু হয়।

বুধবার গাজার মাটিতে, বিশেষত আল-শিফা হাসপাতালের চারপাশে প্রচণ্ড লড়াই হয়েছিল। কারণ সেখানে তৃতীয় দিনের মতো ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর অভিযান অব্যাহত ছিল।

প্রত্যক্ষদর্শীরা বিবিসিকে বলেছেন যে আগে হাসপাতাল কমপ্লেক্সের চারপাশে অবস্থান করা ট্যাঙ্কগুলো এখন আল-ওয়াহদা স্ট্রিট বরাবর পূর্ব দিকে সরে গেছে।

তারা গাজা শহর ও উত্তরাঞ্চলে বিমান হামলার সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধির কথাও জানিয়েছে।

মঙ্গলবার সন্ধ্যায় গাজা শহরে মানবিক সহায়তা বিতরণের সময় ১১ জন নিহত হন। গাজার স্থানীয়রা বলছেন যে তারা শুধু বোমা হামলাই সহ্য করছে না, খাদ্য সংকটেরও সম্মুখীন হচ্ছে।

স্থানীয় বাসিন্দা ওসামা তৌফিক বলেন যে কিছুদিন শান্ত থাকার পর তার এলাকায় পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে।

‘আমরা শুধু বোমা হামলাই সহ্য করছি না, খাদ্য সঙ্কটও মোকাবেলা করছি’, তিনি বলেন।

তিনি জানান, গত রমজানে তারা ইফতারে কিছু একটা খেয়ে রোজা ভাঙতে পারতেন। কিন্তু এখন তারা পানির বাইরে তেমন কিছুই খেতে পান না।

এমনকি যে পানি তারা পান করছেন, সেগুলোও ‘নর্দমার গন্ধযুক্ত ও সুমদ্রের পানির মতো স্বাদযুক্ত’ বলে জানিয়েছেন তিনি।

তৌফিক বলেন যে তারা এখন সামান্য একটু রুটিও খেতে পান না। ‘আমার সন্তানরা ক্ষুধার কষ্টে ভুগছে’, বলছিলেন তিনি।

বুধবার সকালে ইসরাইলের সেনাবাহিনী বলেছে যে প্রায় ৯০ জনকে হত্যা করার পাশাপাশি তারা সেদিন ৩০০ জন সন্দেহভাজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে।

এটিকে তারা আল-শিফা হাসপাতালের চারপাশে ‘নির্দিষ্ট অভিযান’ হিসেবে উল্লেখ করেছে।

এই হাসপাতালে প্রথম অভিযান চালানো হয়েছিল গত নভেম্বরে। তখন ইসরাইলি সেনাবাহিনী এটিকে হামাসের ‘কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সেন্টার’ হিসেবে অভিযুক্ত করেছিল।

যদিও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তা অস্বীকার করেছিল।

ইসরাইলের সামরিক বাহিনী বলছে যে সোমবার ফের অভিযান শুরুর কারণ, ‘জ্যেষ্ঠ হামাস সন্ত্রাসীরা ভেতরে পুনরায় সংগঠিত হয়েছে…এবং তারা এটিকে ব্যবহার করে ইসরাইলের বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনা করছে।’

হামাস স্বীকার করেছে যে সোমবার সেখানে তাদের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বাহিনীর একজন জ্যেষ্ঠ কমান্ডার নিহত হয়েছেন। তবে তারা বলেছেন যে তিনি তখন ত্রাণ বিতরণে সমন্বয় করছিলেন। সূত্র : বিবিসি