img

কোয়াড সিক্যুরিটি ডায়লগঃ বাংলাদেশকে নিয়ে চীনের মাথাব্যাথা? - ইমরান চৌধুরী

প্রকাশিত :  ২০:১৭, ২৯ মে ২০২১

কোয়াড সিক্যুরিটি ডায়লগঃ বাংলাদেশকে নিয়ে চীনের মাথাব্যাথা? - ইমরান চৌধুরী
কোয়াডল্যাট্যারাল (চতুর্ভুজাকার) নিরাপত্তা সংলাপ একটা  নতুন অনানুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইন্ডিয়া, জাপান এবং অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে - এই চারটি দেশের কারণে এই সংলাপটির নামের আবির্ভাব। ২০০৭ সালে জাপানের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী সেঞ্জে আবে’ প্রথমে এই নতুন উদ্যোগটি নিয়ে অগ্রসর হয় তখনকার আমেরিকার ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনি, অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী জন হাওয়ার্ড এবং ভারতের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং প্রমুখদের সহায়তায়। সংলাপটির সাথে সাথে তাঁরা সমান্তরালভাবে শুরু করেন একটি যৌথ সামরিক মহড়া - ইতিহাসের এক অভূতপূর্ব মহড়া - ‘\'মালাবার মহড়া।‘\'
সামরিক মহড়া এবং কূটনৈতিক সংস্থিতির ব্যাপকতা এবং আয়োজনের পরিসর দেখেই বিশেষজ্ঞরা অনুধাবন করেন  যে, এই সকল সংলাপ এবং মহড়ার প্রধান উদ্দেশ্য হল চায়নার সামরিক এবং অর্থনৈতিক পেশী সঞ্চালন রোধ করা। চায়না সরকার  সঙ্গে সঙ্গে তড়িঘড়ি করে সকল সদস্যদেরকে  আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক প্রতিবাদ প্রেরণ করে।
অস্ট্রেলিয়ার জন হাওয়ার্ড এর নেতৃত্ব চলে গেল নতুন সরকার প্রধান কেভিন রুড এই ডায়লগ থেকে দূরে সরে যায় বিভিন্ন কারণে - তারপরেও বাকি তিন দেশ তাদের ডায়লগ চালিয়ে যেতে থাকে এবং ২০১০ সালে রুড সরকার এর পর যখন জুলিয়া গিলার্ড প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পুনরায় পুনরুজ্জীবিত হয় কোয়াড এবং এর ফলশ্রুতিতে ইউ, এস মেরিনরা অস্ট্রেলিয়ার নিকট ডারউইন দ্বীপে অবস্থান গ্রহণ করে যাতে করে মেরিনরা তিমুর সাগর এবং ল্যাম্বক প্রণালিতে নজর রাখতে পারে এবং একই সাথে পুনরায় সেই পুরানো চার দেশে মিলে মালাবার এ নৌ বাহিনীর মহড়া করতে থাকে। 
২০১৭ সালে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আবারও চায়নার হটাৎ বৃদ্ধি প্রাপ্ত সামরিক এবং ব্যাবসায়িক প্রতিপত্তি খর্ব না করলে সামনের দিনগুলোতে অত্র অঞ্চলের সকল ক্ষমতা দখল হয়ে যেতে পারে ভেবে পুনরায় এই সংলাপ আশিয়ান ট্রিটি ভুক্ত দেশ গুলোর সম্মেলনে উৎথাপন করে এবং সংলাপ চালাতে থাকে - যা কিনা চীনকে বেশ ভাবান্বিত করে তুলে - চায়না এই নব্য উদ্যোগ কে ‘\'নতুন কোল্ড ওয়ার‘\' হিসেবে আখ্যায়িত করে। 
চায়না কোন অংশে  কম না সেও সাউথ চায়না সমুদ্র এবং পূর্ব চায়না সমুদ্রে তার পেশি প্রসার করতে থাকে - আশেপাশের দেশগুলোকে সস্তা কিস্তিতে ঋণ দিয়ে ক্রমান্বয়ে ঐ দেশগুলোকে ঋণের ফাঁদে ফেলতে থাকে। আর ঐ ফাঁদের বেড়াজালে আস্তে আস্তে সমুদ্র - ব্যবসা - উন্নয়নের নামে চায়না তার প্রভাব বিস্তার করতে থাকে হাঁটি হাঁটি পা পা করে। এখন সে সম্পূর্ণ ইন্ডিয়ান মহাসাগর - থেকে শুরু করে বে অফ বেঙ্গল রিজিওন কন্ট্রোল নেবার পায়তারা করছে। 
চায়নার এই নব্য সাম্রাজ্যবাদী প্রভাবের ভয়ে দক্ষিণ কোরিয়া, নিউজিল্যান্ড ও ভিয়েতনাম ও কোয়াড প্লাস প্লান এ সংযোজিত হতে থাকে, ক্রমে ক্রমে কোয়াড সংলাপ এর ছত্রতলে আরও অনেক গুলো হুমকি প্রাপ্ত দেশ আশ্রয় নিতে থাকে চায়নার এই  নতুন আগ্রাসী বৈদেশিক নীতির ভয়ে। ইন্ডিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাজ্য সেই ১৯৯১ সালে ইন্ডিয়ার ওপেন হবার সময় থেকেই একে ওপরের সম্পূরক এক বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তুলতে থাকে এবং কোয়াড সংলাপকে আজ অনেক ভূ রাজনীতি বিশেষজ্ঞরা এশিয়ান ন্যাটো হিসেবে দেখতে থাকে। 

অত্র এলাকার নিরাপত্তা এবং অর্থনীতিকে সচল রাখতে হলে চায়নার এই মোড়ল এর পোশাকে আবির্ভূত হওয়া কোন দেশই সহজ ভাবে মেনে নিতে পারছে না। মার্কিন নব্য প্রেশিডেন্ট এই বার কোভিড ১৯ এর দুর্দশা কে ব্যবহার করতঃ অত্র এলাকার দেশ গুলোর সাথে এক সুদৃঢ় সম্পর্ক গড়ে তুলছে যা কিনা আগামীতে এই নতুন সংলাপকে এক নতুন সামরিক - ভূ রাজনৈতিক অ্যালায়েন্সে পর্যবসিত করতে পারে এবং তার জন্য চায়নার সরকার চায়নার আশেপাশের সকল দেশ উপর এক ধরনের স্নায়ু চাপ বৃদ্ধি করতে থাকে বিভিন্ন পন্থার মাধ্যমে। বাংলাদেশের সাথে ইন্ডিয়ার ঐতিহাসিক, সংস্কৃতি, অংশীদারি সামাজিক নীতি রীতি দ্বারা সমৃক্ত সেই ৫০০০ বছর যাবত; বাংলাদেশের সবচে’ নিকটতম প্রতিবেশী- যার দ্বারা বাংলাদেশ তিন দিক থেকে ঘেরা - এবং একই জলরাশি বে অফ বেঙ্গল - এরাবিয়ান সমুদ্র এবং ইন্ডিয়ান ওশান দিয়ে পরিমন্ডলে। স্বভাবত কারণেই বাংলাদেশ ইন্ডিয়ার সাথে এই নতুন স্নায়ুযুদ্ধের অংশীদার হওয়াটাই স্বাভাবিক । বাংলাদেশের নিরাপত্তা নিকটতম দেশের নিকটই সংরক্ষিত দুরের এই নব্য  পেশীশক্তির পেশীর নিষ্পেষণে না যাওয়াটাই শ্রেয়। সেই কারণেই হয়ত বাংলাদেশ ইন্ডিয়ার স্বার্থ এবং বাংলাদেশের ভূমি, সৈকত, জনবলকে নিরাপদ রাখার জন্য এই সংলাপে থাকাটাই সবচে’ বুদ্ধিমান বিবেচনা। 
যদিও এখনও এই ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি - কিন্তু অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে চায়না খুবি উদ্বিগ্ন বাংলাদেশের অবস্থান নিয়ে - গত কয়েক মাস যাবত যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতের সামরিক নেতাদের আগমন এবং বাংলাদেশের সামরিক ব্যক্তিবর্গদের বিদেশ ভ্রমন দেখে চায়না ধরে নিয়েছে যে, বাংলাদেশ হয়ত বা এই দলে যোগ দিয়েই ফেললো বুঝি । বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ এবং ভারত বাংলাদেশের সবচে পরীক্ষিত বন্ধুর সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে থাকাটা শ্রেয় , তাহলে অন্যদের এই ব্যাপারে কোন প্রকার নাক গলানোর অবকাশ নাই। কিন্তু, আশ্চর্য হলেও সত্য যে চায়না বাংলাদেশেকে এই সংলাপে না প্রবেশ করার জন্য বেশ তৎপর হয়ে পরেছে। কয়েকটি অতি উচ্চ শ্রেণীর হর্তা কর্তা ব্যক্তিরা অহরহ বাংলাদেশে কূটনৈতিক ভ্রমণ করছে - যাতে করে বাংলাদেশ ইন্ডিয়ার হাত ধরে - এই উদ্যোগ  এর দিকে পা’  না বাড়ায় । কিন্তু কেন ? কেন এত মাথাব্যথা এবং কেনই বা তাদের এত কুম্ভীরাশ্রু নির্গমন করার দরকার ? যে দেশ ১৯৭১ সালে পাকিস্তানিদের সকল ধরনের সাহায্য করেছিল - এই সেই বাংলা যেই বাংলার মানুষদের নির্মম ভাবে হত্যা করার জন্য চায়নিজ রাইফেল এর গুলি বানানোর ফ্যাক্টরি ১৯৭১ সালের মাঝামাঝি সময়ে তড়িঘড়ি করে চালু করেছে - যাহার  পর্দা উন্মোচন করতে তদানীন্তন চায়নিজ ডিফেন্স মিনিস্টার এসেছিল , আজ সেই দেশের জন্য এত ভালবাসা কেন? 
ব্যাবসায়িক সম্পর্ক, অস্ত্র বিক্রি, অর্থ লগ্নি, তাদের বানানো কাঁচামাল ব্যবহার করে আমাদের রফতানি বাণিজ্যে প্রসার এবং আমাদের অবকাঠামো প্রোজেক্টে সফট হারে সুদ দিয়ে সাহায্য করা -এই সব গুলোই ওরা করেছে ওদের স্বার্থে - যার জন্য বাংলাদেশ হয়তো কৃতজ্ঞ এবং সফলতার অংশীদার মনে করে; তার মানে এই নয় যে, বাংলাদেশ তাদের একটি ভ্যাসাল স্টেট বা তাবেদার রাষ্ট্র। বর্তমান পৃথিবীতে বাংলাদেশ একটি উদাহারন - বাংলাদেশ একটি রোল মডেল - বাংলাদেশকে অনুকরণ করতে সেই ১৯৭১ বর্বররাও উৎসাহী। বাংলাদেশ আজ সারা পৃথিবীতে সমাদরে সম্ভাষিত তাঁর ফেলা আসা অতীত দারিদ্রতাকে উন্নয়নের সোপানে পরিবর্তনের এবং রূপান্তরের জন্য। 
সম্প্রতি চায়নিজ  পদাতিক সামরিক এবং নৌ সেনাদের পায়তারা - হিমালয়ের চূড়ায় সৈন্য সমাবেশ, মায়ানমার এর সাথে সখ্যতা, বে অফ বেঙ্গল এ নৌসেনা জনিত পেশী সঞ্চালন, ঋণ ফাঁদ পেতে পার্শ্ববর্তী দেশের সমুদ্র বন্দর দখলে নিয়ে নেওয়া, ইন্ডিয়ান ওসোন রিজিওন এবং থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া সহ আশেপাশের সকল দেশের দিকে চাতক পাখির মত তাকানোর কারণে বাংলাদেশের ও শঙ্কা হওয়াটা স্বাভাবিক - এবং এই চাইনিজ সামরিক অক্ষের থেকে তাদের চির পরীক্ষিত বন্ধু জাপান, অস্ট্রেলিয়া এবং ভারত এর সাথে হাত  মিলিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক আনিত এই সংলাপ থেকে জোট যোগদান করাটা এক ধরনের নিরাপত্তা বীমা। 
আর এতে চাইনিজ অস্ত্র ও ঋণ কূটনীতি দিয়ে ভয় দেখানো বা অহেতুক বাংলাদেশকে নিয়ে মাথাব্যাথা  একান্তই অহেতুক এবং অনভিপ্রেত। 
একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে তাঁর সামরিক এবং ভূ রাজনৈতিক পার্টনার খোঁজার স্বাধীনতা একান্তই কাম্য। 

[লেখক একজন বিশ্লেষক এবং ভূ রাজনীতি বিশেষজ্ঞ]

মতামত এর আরও খবর

img

গাজা যুদ্ধ বন্ধে বাইডেন কেন এতটা মরিয়া

প্রকাশিত :  ১১:৪১, ১২ মে ২০২৪
সর্বশেষ আপডেট: ১১:৪৮, ১২ মে ২০২৪

জনাথন ফ্রিডল্যান্ড

দ্বিতীয় দফায় নির্বাচিত হবেন কি না তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের উদ্বেগ একেবারে প্রান্তে এসে পৌঁছেছে। জো বাইডেনের পরামর্শ বারবার উপেক্ষা করে আসছিলেন বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। এই উপেক্ষার মূল্য কী হতে পারে, এই সপ্তাহে ইসরায়েল সেটা দেখতে পেল।

ইসরায়েলের ৩ হাজার ৫০০ বোমার চালান আটকে দিয়েছে বাইডেন প্রশাসন। এই অস্ত্র ইসরায়েল গাজার দক্ষিণের শহর রাফা আক্রমণে ব্যবহার করবে, সেই বিবেচনায় অস্ত্রের চালানটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। রাফায় এখন ১০ লাখের বেশি শরণার্থীর আশ্রয়শিবির।

ইসরায়েলের প্রতি জো বাইডেন তাঁর ‘লৌহদৃঢ়’ সমর্থন থেকে সরে আসছেন না। কিন্তু ইসরায়েল রাফা হামলার জন্য যে হুমকি দিয়ে চলেছে, সেটা সফল করতে অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করবেন না। সিএনএনকে বাইডেন বলেছেন, ‘ইসরায়েলের নিরাপত্তা দেওয়া থেকে আমরা সরে আসছি না। অন্যখানে যুদ্ধ করার সক্ষমতা তৈরির পথ থেকে সরে আসছি আমরা।’

ইসরায়েলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিত্র যুক্তরাষ্ট্র। ইসরায়েলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী আইজাক রবিন বলতেন, তাঁর দেশের ১ নম্বর কৌশলগত সম্পদ এই সব অস্ত্র, এমনকি পারমাণবিক অস্ত্র নয়; বরং ওয়াশিংটনের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক। দশকের পর দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় অস্ত্রের জোগানদাতা ও কূটনৈতিক অভিভাবক। 

কিন্তু মাত্র ছয় সপ্তাহের ব্যবধানে ওয়াশিংটন এমন দুটি পদক্ষেপ নিল, যা পুরোপুরি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গেল। গত মার্চ মাসে নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ভেটো দেওয়া থেকে বিরত থাকে যুক্তরাষ্ট্র। ফলে ইসরায়েল প্রস্তাবটি আটকে দিতে চাইলেও ব্যর্থ হয়। আর এখন তো ওয়াশিংটন অস্ত্রের চালান আটকে দিল।

এর থেকেও বড় বিষয় হলো, এই সিদ্ধান্তগুলো এমন একজন রাজনীতিবিদ নিয়েছেন, যিনি ব্যক্তিগতভাবে ইসরায়েলের খুব নিবেদিতপ্রাণ সমর্থক। বাইডেন সেই যুগের একজন ডেমোক্র্যাট, যখন দুই সহস্রাব্দের নির্বাসন ও শাস্তির পর মধ্যপ্রাচ্যে ইহুদিদের আদি বাড়ি প্রতিষ্ঠার বিষয়টি গতি পেতে শুরু করেছে। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের উদারপন্থীদের চোখ তখন রহস্যজনকভাবে বন্ধ ছিল।  

গোল্ডা মেয়ার থেকে শুরু করে ইসরায়েলের প্রত্যেক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বাইডেন দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে। ইসরায়েলের প্রতি বাইডেনের টান বাড়ার ক্ষেত্রে এর একটার ভূমিকা আছে। পূর্বতন প্রেসিডেন্টদের মতো বাইডেনের ইসরায়েলের প্রতি ভ্রাতৃত্ববোধ শুধু নির্বাচনী হিসাব-নিকাশের বিষয় নয়।  

গাজা নিয়ে কোনো চুক্তি হচ্ছে না। কেননা, নেতানিয়াহু কিংবা সিনাওয়ারা কেউই বিশ্বাস করেন না, চুক্তি করলে তাঁদের স্বার্থ রক্ষিত হয়। যেমনটা যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক কর্মকর্তা অ্যারন ডেভিড মিলার বলেছেন, ‘এই সংঘাত বন্ধে একটি পক্ষেরই কেবল সত্যিকারের তাড়া আছে, সেই পক্ষটি হলেন জো বাইডেন।’

অন্যদিকে ১৯৮০-এর দশকে নেতানিয়াহু প্রথম আলোচনার পাদপ্রদীপে উঠে আসেন। তিনি এমন একজন কূটনীতিক, যিনি আমেরিকানদের সঙ্গে সাবলীলভাবে কথা বলতেন। সে সময় থেকেই তিনি নিজেকে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে দাঁড় করান। ইসরায়েলের একজন হবু নেতার জন্য এই দক্ষতা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। 

কয়েক দশক ধরে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তাঁর ভোটারদের এই বার্তা দিয়ে আসছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের মধ্যকার সব ধরনের গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ক্ষেত্রে তিনিই একমাত্র বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তি।

কিন্তু বাস্তব অবস্থাটা এখন কী দাঁড়াল?  চার দশকের বেশি সময়ের মধ্যে বাইডেনই প্রথম প্রেসিডেন্ট যিনি ইসরায়েলকে সামরিক সহায়তা দেওয়া বন্ধ করলেন। (১৯৮২ সালে ইসরায়েলের লেবানন অভিযানের সময় রোনাল্ড রিগ্যান যুদ্ধবিমান দিতে বিলম্ব করেছিলেন।) বাইডেন কেন এটা করলেন? কারণ, নেতানিয়াহু যুক্তরাষ্ট্রের একটি অংশের জনগোষ্ঠীর মধ্যে এমন তিক্ততা তৈরি করেছেন, যেটা আগে দেখা যায়নি।

ইসরায়েলের প্রতি যে যুক্তরাষ্ট্রের সমাজের নিরেট সমর্থন, তাতে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যেভাবে ছাত্র আন্দোলন আছড়ে পড়েছে, সেটা বিস্ময়করই। আন্তর্জাতিক জরিপ সংস্থা গ্যালাপের মার্চ মাসের জরিপ বলছে, ৫১ শতাংশ ইসরায়েলের পক্ষে সমর্থন দিয়েছে, ২৭ শতাংশ সমর্থন দিয়েছে ফিলিস্তিনের পক্ষে। কিন্তু ডেমোক্র্যাট ও তরুণ জনগোষ্ঠী—দুই ক্ষেত্রেই ফিলিস্তিনিদের পক্ষে সমর্থন অনেকটাই বেড়েছে।

জরিপের এই তথ্য বাইডেন ও তাঁর নির্বাচনী প্রচারণা দলকে চিন্তার মধ্যে ফেলেছে। এই অংশের দ্ব্যর্থহীন সমর্থনই ২০২০ সালের নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে পরাজিত করতে ভূমিকা রেখেছিল। গাজাবাসীর দুর্ভোগ সেই ভোটারদের সমর্থন অনিশ্চিত করে তুলেছে। হোয়াইট হাউস নেতানিয়াহুর কাছে পরিকল্পনা চেয়েছিলেন, বেসামরিক জনসাধারণকে হতাহত না করে কীভাবে রাফায় অভিযান করতে পারে ইসরায়েল। 

কিন্তু নেতানিয়াহু সেই পরিকল্পনা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। সেই কারণে ইসরায়েলকে থামানোর জন্য অস্ত্রের চালান আটকে দেওয়ার সরাসরি পথ বেছে নিয়েছে ওয়াশিংটন।

রাফা বাইডেনের জন্য শক্তি পরীক্ষার জায়গাও হয়ে উঠেছে। বাইডেন রাফাকে বিপদরেখা হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন। নেতানিয়াহু যদি সেই বিপদরেখা অতিক্রম করেন, তাহলে বাইডেন দুর্বল হিসেবে চিহ্নিত হবেন।

কিন্তু নেতানিয়াহু এখন পর্যন্ত রণেভঙ্গ দিতে অস্বীকার করেছেন। ইসরায়েলের স্বাধীনতা আন্দোলনকে সামনে রেখে জনগণের উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র ছাড়া আমরা একাই লড়ে যাব। প্রয়োজনে আমরা আমাদের নখ দিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাব।’ 

নেতানিয়াহু চার্চিলের মতো আওয়াজ তুলতে চাইছেন। কিন্তু তাঁর কথাগুলো দুর্বলের কণ্ঠস্বর, সবলের নয়। ওয়াশিংটন চায়, নেতানিয়াহু যেন রাফা অভিযান থেকে সরে আসেন। কিন্তু জোট সরকারের অতি ডানপন্থী মিত্ররা তাঁকে আরও কঠোর হতে বলছেন, রাফা অভিযানের মাধ্যমে হামাসের বিরুদ্ধে পুরোপুরি বিজয়ের জন্য বলছেন।

এই নিরানন্দ নাটকে বাইডেন ও নেতানিয়াহুই কেবল কুশীলব নন; হামাস নেতা ইয়াহিয়া সিনাওয়ারেরও নিজস্ব হিসাব-নিকাশ আছে, নেতা হিসেবে টিকে থাকার সংকল্প রয়েছে। খুব ঘনিষ্ঠভাবে যাঁরা সিনাওয়ারকেও পাঠ করেছেন তাঁরা বিশ্বাস করেন, নির্দোষ মানুষের জীবন রক্ষা করা তাঁর অগ্রাধিকার নয়; বরং যত বেশি গাজাবাসী নিহত হবেন, আন্তর্জাতিক পরিসরে তাঁর শত্রু ইসরায়েলে অবস্থান ততই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সেই পরিস্থিতি তাঁকে বিজয়ী দাবি করতে সহায়তা করবে। সম্প্রতি হামাস যুদ্ধবিরতি চুক্তি মেনে নেওয়ার ঘোষণার পেছনে সিনাওয়ারের এই ভাবনায় কাজ করেছে। 

সিনাওয়ারা সাময়িক কোনো যুদ্ধবিরতি (তাতে অনেক মানুষের প্রাণরক্ষা হয়, দুর্ভোগ কমে) চান না, তিনি চান স্থায়ী যুদ্ধবিরতি। আর তার জন্য সিনাওয়ারা অপেক্ষা করতেও রাজি।

গাজা নিয়ে কোনো চুক্তি হচ্ছে না। কেননা, নেতানিয়াহু কিংবা সিনাওয়ারা কেউই বিশ্বাস করেন না, চুক্তি করলে তাঁদের স্বার্থ রক্ষিত হয়। যেমনটা যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক কর্মকর্তা অ্যারন ডেভিড মিলার বলেছেন, ‘এই সংঘাত বন্ধে একটি পক্ষেরই কেবল সত্যিকারের তাড়া আছে, সেই পক্ষটি হলেন জো বাইডেন।’


জনাথন ফ্রিডল্যান্ড, ব্রিটিশ গণমাধ্যম গার্ডিয়ানের খ্যাতিমান কলামিস্ট

মতামত এর আরও খবর