‘সাগা (saga) অব উন্নয়নশীল বাংলাদেশ’
মু. নূর উদ্দিন।। বছর দুয়েক ধরে বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন দল ও তাদের বিভিন্ন পর্যায়ের সমর্থকদের মধ্য একটি শব্দ বা টাইটেল নিয়ে বেশ আলোচনা এবং গর্ববোধ পোষন চলছে। সর্বশেষ গেল ফেব্রুয়ারিতে খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে সংবাদ সম্মেলন করে কৃতিত্বের(?) ঝুলি জাতির সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করলেন। সেটা হচ্ছে স্বাধীনতার ৫০ বছর পর বাংলাদেশ এখন ‘উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তর। তাই এ ব্যাপারে দুটি কথা।
১৯৯৭ সালে আমার উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষা জীবন শুরু, আর ২০০৯ সালে অর্থনীতি সম্মান শেষ বর্ষের মাধ্যমে বাংলাদেশে একাডেমিক শিক্ষার ইতি। এই প্রায় এক যুগ সময় ধরে বাংলা, ইংরেজী, ইতিহাস, সামাজিক বিজ্ঞান, সাধারণ বিজ্ঞান থেকে শুরু করে রাষ্ট্র বিজ্ঞান, সর্বশেষ অর্থনীতির বিভিন্ন বিষয় যেমন বাংলাদেশ অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক অর্থনীতি, কৃষি অর্থনীতি প্রভৃতি পাঠ্যপুস্তক বাংলাদেশ সম্পর্কে যতটুকু পাঠ গ্রহণ করেছি, জেনেছি, তা হচ্ছে বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। এই উন্নয়নশীল বাংলাদেশ ধারণাটি সম্ভবত এরো বহু আগে থেকেই ছিলো।
মাধ্যমিকে পড়াকালীন আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক যখন উন্নত দেশের উদাহরণ দিচ্ছিলেন যেমন ব্রিটেন, আমেরিকা, জাপান তখন উন্নয়নশীল দেশের উদাহরণে বাংলাদেশের নাম বললেন। আমি জিগ্যেস করেছিলাম, এসব দেশের সাথে আমাদের অনেক ব্যবধান তাহলে কি আমরা অন্ন্নুত দেশ নই? তিনি জবাব দিলেন, আসলে অনুন্নতই। মৃদূ হেসে বললেন, অনুন্নত শুনতে খারাপ দেখায় তাই উন্নয়নশীল বলা হয় একারণে যে এসব দেশ ধীরে ধীরে উন্নতি করছে Ñ করবে।
২০০৫ সালে আমি যখন অর্থনীতি ১ম বর্ষের ছাত্র, সমাজ বিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক প্রিয় আনিস স্যার এ ব্যাপারে উল্লেখ করেন -“আসলে কী জানো, বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ আমার কাছে তা মনে হয়না। আমি মালয়েশিয়া সফর করেছি তাদের উন্নয়ন সত্যিই অসাধারণ, বাংলাদেশ সেই তুলনায় অনেক অনেক পিছিয়ে। সেই মালয়েশিয়াকেও যদি উন্নয়নশীল দেশ বলা হয় তাহলে বাংলাদেশকে কীভাবে উন্নয়নশীল দেশ বলা যায়?”
তবুও কিনা আমরা গদ্যে-কবিতায়, ভাব-সম্প্রসারণে রচনায়, ইংরেজি-বাংলায় বাংলদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ বলে পড়ে পড়ে মুখে ফেনা তুলেছি। লিখে কতো কলমের কালী শেষ করেছি তার হিসেব নেই।
অথচ আজ এতো বছর পর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ঘটা করে জানালেন, বাংলাদেশ এখন একটি উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা অর্জন করেছে। তাহলে কেন বাংলাদেশের লাখ লাখ শিক্ষার্থী এতদিন ভুল শিখলো? এর দায়ভার কার?
বছর তিনেক আগে বাংলাদেশের তৎকালীন পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এবং তার অনুসারী দল বলাবলি করলেন বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে চলেছে। কিন্তু বছর খানেক পর উনি যখন অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব নিলেন তখন সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বললেন, ‘আসলে মধ্যম আয়ের দেশ বলতে কিছু নেই’।
এইভাবে পলিটিশিয়ানরা মনগড়া কথাবার্তা হরহামেশা বলে চলেছেন অবশ্য সেটা নতুন কিছু নয়।
যাহোক এবারে আসি মুল ঘটনায়।
বাংলাদেশের এই উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তর নিয়ে দেশের জাতীয় ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার একটি প্রতিবেদন ছাপিয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে ৪৫ বছর পর স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশের যোগ্যতা অর্জন করলো। ২০২৬ সালে বাংলাদেশ অফিসিয়ালি উন্নয়নশীল দেশ বলে গণ্য হবে। যদিও রূপান্তর সময়কাল তিন বছর কিন্তু করোনা পরিস্থিতির কারনে বাংলাদেশকে আরো ৫ বছর স্বল্পন্নোত দেশের সুবিধা দেয়া হবে। সূত্রঃ ডেইলি স্টার ২৮ফেব্রুয়ারী ২০২১।
অন্যদিকে অধ্যাপক আলী রিয়াজ ও ডঃ সাইমুম পারভেজ তাদের এক নিবন্ধে লিখেছেন অর্থনীতিতে প্রধানত অবদান রাখছে দেশের বাইরে থেকে পাঠানো রেমিট্যান্স এবং তৈরি পোশাক রপ্তানি। অথচ তারা এও লিখেছেন “এই যে এই দুই খাতের যে শ্রমিকগোষ্ঠী এই সাফল্যের নির্মাতা, তাঁদের ব্যাপারে রাষ্ট্র একধরনের নির্লিপ্ততাই অনুসরণ করেছে, তাঁদের নিরাপত্তা এবং অধিকার নিয়ে রাষ্ট্র কিছুই করেনি।একই কথা বলা চলে কৃষি খাত বিষয়েও। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা সত্ত্বেও ১৯৭৪ সালের পর বাংলাদেশ দুর্ভিক্ষে পতিত হয়নি; এই কৃতিত্ব একাদিক্রমে কৃষকের এবং নীতিনির্ধারকদের।” সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো ২১মার্চ ২০২১।
যেকোন দেশের উন্নয়নের পূর্বশর্ত হলো যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন।
তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও জাপানের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় তারা প্রথমে কৃষি নির্ভর অর্থনীতি ছিল।
তাই আগামী দিনে প্রবাসী ও পোশাক খাতের শ্রমিকদের দেখভাল, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, কৃষি ও কৃষকের জীবন মান উন্নয়ন করতে পারলে অর্থনীতিতে বাংলদেশ ঈর্শনীয় সাফল্য অর্জন করে কাংখিত লক্ষ্যে পৌছতে পারবে একথা অনেকটা নিশ্চিত করে বলা যায়।
মু. নূর উদ্দিনঃ সাবেক শিক্ষার্থী, বিএসএস(সম্মান) অর্থনীতি, এমসি কলেজ, সিলেট। বর্তমানে যুক্তরাজ্যে বসবাসরত।