img

আফগানিস্তানের এই পরাজয় আমেরিকার নাকি মুসলমানদের?

প্রকাশিত :  ১৫:১৯, ১৬ আগষ্ট ২০২১

হাসান রহমান

আফগানিস্তানের এই পরাজয় আমেরিকার নাকি মুসলমানদের?

কে সহি মুসলমান, কে না- এই ব্যাখ্যা বড়ই জটিল! এই বিতর্কের কোন সহজ সমাপ্তিও হবেনা।  তবে তালেবানদের বিজয়ে মধ্যপন্থি মুসলমানদের অনেকেই উল্লাস প্রকাশ করছেন কেউ আবার হতাশ। তালেবানদের এই বিজয়ে যারা আমেরিকার পরাজয় দেখছেন তাদের কপালে অচিরেই ভাঁজ পড়বে এমন আশংকাও উড়িয়ে দেয়া যায়না।  আফগানিস্তানে আমেরিকার পরাজয়কে যারা ভিয়েতনাম যুদ্ধের সাথে তুলনা করছেন তারা ইতিহাসের সরু গলিকেই পছন্দ করে নিয়েছেন। গল্পের অন্তমিল ঠিক রাখার জন্য এই দুটি যুদ্ধের উপসংহার মেলানো হয়তো সহজ কিন্তু একটু বিবেচনায় নিলেই বুঝা যায় দুটি যুদ্ধের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ন আলাদা। 

আফগান যুদ্ধে আমেরিকার পরাজয়ের চাইতেও বড় পরাজয় হয়েছে আফগান রাষ্ট্রের। আমাদের খেয়াল রাখতে হবে তালেবানদের যুদ্ধ আফগান সরকারের বিরুদ্ধে নয়। এমনকি আমেরিকার বিরুদ্ধেও নয়। তালেবানদের যুদ্ধ ইসলামী রাষ্ট্র ও ইসলামী খিলাফত প্রতিষ্ঠার। তালিবানরা মনে প্রাণে বিশ্বাস করে সমগ্র বিশ্বে ইসলামের খিলাফত প্রতিষ্ঠা করা প্রতিটি মুসলমানের জন্য ওয়াজিব। আর এই ওয়াজিব পালনে যারা বাধার সৃষ্টি করে তারা সকলেই ইসলামের দুশমন। এখানে কে ভাল মুসলমান কে খারাপ অমুসলমান সেই বিচার করার যথেষ্ট সময় তালেবানদের হাতে নাই। তালেবানদের বিশ্বাস সমগ্র বিশ্বে ইসলামী খিলাফত প্রতিষ্ঠা করা পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। আর এই লড়াইয়ের মাধ্যমে যারা শাহাদাত বরণ করবেন তারা শহিদী মর্যাদা লাভ করবেন। এবং হাসরের ময়দানে তারা সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী হবেন। 

তালেবান মুজাহেদীনরা মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন এই দুনিয়া কিছুই না। এটি একটি সাময়ীক পরীক্ষা কেন্দ্র। আখিরাতই হচ্ছে মুসলমানদের প্রকৃত ঠিকানা। ইসলামের এই আদর্শে যারা বিশ্বাস করেন তালেবানদের দৃষ্টিতে তারাই প্রকৃত মুমিন। আর যারা এই মতাদর্শ মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন না অথবা পালন করেন না তারা মুনাফিক। এ কারনে কয়েক দশক ধরে তালেবানদের হাতে সব থেকে বেশী মৃত্যু বরণ করেছেন আফগান মুসলমানরা। কোরআন ও হাদিসের আলোকে বিশ্লেষণ করলে তালেবানদের এই ধরনের মতাদর্শকে উড়িয়ে দেয়া যায়না। 

ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠিত হলে নারী শিক্ষা ও ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হবে এমন ধারণা যারা পোষণ করেন তালেবানদের দৃষ্টিতে তারা সত্যিকারে মুসলমানই নয়। মুজাহেদীনরা বিশ্বাস করেন সত্যিকারের মুসলমান কখনো কোরআনের শাষনকে উপেক্ষা করতে পারেনা। অর্ধ সত্য যেমন মিথ্যার চাইতেও খারাপ, অনুরূপ ভাবে আধা মুসলিম মুনাফিকের চাইতেও খারাপ। আফগানিস্তানের চলমান পরিস্থিতিতে প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানিসহ শত শত রাজনীতিক এরই মধ্যে দেশ ত্যাগ করেছেন। হাজারো মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন বিভিন্ন দেশে। আর যাদের দেশ ছাড়ার উপায় নেই তারা হয়তো মৃত্যু কিংবা কারাবরণ করবেন অথবা তালেবানদের কাছে আত্মসমর্পণ করে মুজাহেদিনে পরিণত হবেন। 


বিশ বছর ধরে পরাশক্তির ছত্রছায়ায় থেকেও আফগানিস্তানে কেন একটি শক্তিশালী সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়নি? কেন একটি শক্তিশালী প্রতিরক্ষা বাহিনী গড়ে উঠেনি? কেন মানুষের চিন্তা চেতনায় মৌলিক পরিবর্তণের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে আধুনিকিকরণ করা হয়নি? এই সকল প্রশ্নের জবাব অমিমাংশিতই থেকে যাবে। একটি রাষ্ট্রের অধিকাংশ জনগণ কি চায় প্রকৃত পক্ষে সেই ধরণের শাসন ব্যবস্থাই প্রতিষ্ঠিত হয়। আফগানিস্তান এই ভূপৃষ্ঠের বাহিরের কোন জনপদ নয়। তালেবানের শাসনই ছিল অধিকাংশ আফগান জনতার প্রাণের দাবি। সময়ের বিবর্তণে তাই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বা হতে চলেছে। তবে এই ব্যবস্থাপনা কতদিন দীর্ঘস্থায়ী হবে সেই ব্যাপারে নিশ্চয়তা দেয়া যায়না। ইসলামের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায় যে কালের পরিক্রমায় মুসলমানরাই মুসলমানদের সব থেকে বড় দুশমনে পরিনত হয়। ক্ষমতার দ¦ন্দ¦ খালিফায়ে রাশেদীনদের আমল থেকেই প্রচলিত। ক্ষমতার দ¦ন্দে¦ তিন জন খলিফারই অপমৃত্যু হয়েছিল। নিহত হয়েছিলেন সাহাবায়েকরামসহ হাজারো মুসলমান। মধ্যযুগের ইসলামী শাসনতন্ত্রেও উমাইয়া এবং আব্বাসিয় ক্ষমতার দ্বন্দে¦ নিহত হয়েছেন অসংখ্য ধর্মপ্রাণ মুসলমান এবং মুজাহেদীন।    

গত দুই দশকে অফগান সরকারের নেতৃত্বে থাকা হামিদ কার্জাই, আব্দুল্লাহ আব্দুল্লাহ আর আশরাফ ঘানিদের সকলেই ছিল ঠুটো জগন্নাথ। আমেরিকাসহ পশ্চিমা পরাশক্তির হাতের পুতুল। এদেরকেও ইতিহাসের আস্তাকুড়েই থাকতে হবে। দুই দশকের আফগান শাসকরা তালেবান মুজাহেদীনদের দেশের নাগরিক মনে না করে দেশের শত্রু হিসেবেই চিহ্নিত করেছে। তালেবানদের মনস্তাত্ত্বিক অবস্থাকে কখনোই মুল্যায়ণ করার প্রয়োজন মনে করেনি। অথচ এই তালেবান মুজাহেদীনরা আফগানিস্তানেরই সন্তান। এই আফগানরাই একসময় যৌথভাবে বৃটিশ সাম্্রাজ্যকে পরাস্থ করেছিল, এই আফগানরাই রাশিয়ার দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে লড়াই করে নিজেদের ভূখন্ডকে স্বাধীন করেছিল।

আফগান সরকার এবং আমিরিকা গংরা আফগানিস্তানে আসলে কি চেয়েছিল? কি ধরনের সরকার ব্যবস্থার প্রবর্তণ চেয়েছিল। যদি গতানুগতিক গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা কায়েম করতে চেয়ে থাকে তবে আফগান জনগণ কি সেটি চেয়েছিল? এই সকল প্রশ্ন এখন নিতান্তই মূল্যহীন। এখন তালেবানদের নেতৃত্বে ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠিত হবে এটাই একমাত্র সময়ের ব্যাপার। তবে আধুনিক বিশ্বে ইসলামী খেলাফত কেমন হবে সেই বাস্তবতা দেখার জন্যই অধির আগ্রহে অপেক্ষা করবে সমগ্র বিশ্ব। 

যদি তালেবানদের হাতে ইসলামী শাসনের নামে দুঃশ্বাসন প্রতিষ্ঠিত হয়, চরমভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়, নারীদের অধিকার ভুলন্ঠিত হয়, তবে বিশ্ব ব্যাপী ইসলামের অনুসারীদের বিরাট চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। একবিংশ শতাব্দিতে এসে তালেবানরা কি ধরনের খিলাফত প্রতিষ্ঠা করবেন সেই দিকেই তাকিয়ে থাকবে সমগ্র বিশ্ব। তালেবানদের শাসন যদি গতানুগতিক শাসন ব্যবস্থার চাইতে উন্নত না হয় তবে ভবিষ্যতে ধর্ম হিসেবে ইসলামের সংকোচন রোধ করা কঠিন হবে। 

তালেবানদের মাথায় রাখতে হবে আফগান সরকার যেমন এতদিন আমেরিকার অনুগত ছিল তেমনি ভাবে তারাও বর্তমানে রাশিয়া এবং চায়নার অনুগত। ভূ-রাজনীতিতে কোন কিছুই বৃহত্তর স্বার্থ ছাড়া চলেনা। তালেবানদের ইসলামীক রিপাবলিক অব আফগানিস্তান প্রতিষ্ঠায় চায়না এবং রাশিয়ার এই নিঃস্বর্ত সহযোগিতার ফসল কার ঘরে বেশী যায় সেই সত্য দেখা যাবে খুব শীঘ্রই। পরাশক্তির দ¦ন্দে¦ আফগান জনগনকে আরো অনেক মূল্য দিতে হবে এমন আশংকাও উড়িয়ে দেয়ার সুযোগ নেই। তালেবানদের এই উত্থানে মুসলমান বিশ্বের অতি উৎসাহী জঙ্গীদের মধ্যে যদি কোন ধরণের প্রভাব পড়ে তবে সেটা হবে মুসলমানদের জন্য অনেক বড় দুর্ভাগ্যের। 

হাসান রহমান,  সাংবাদিক ও মানব উন্নয়ন কর্মী

১৫ আগস্ট ২০২১ লন্ডন

মতামত এর আরও খবর

img

গাজা যুদ্ধ বন্ধে বাইডেন কেন এতটা মরিয়া

প্রকাশিত :  ১১:৪১, ১২ মে ২০২৪
সর্বশেষ আপডেট: ১১:৪৮, ১২ মে ২০২৪

জনাথন ফ্রিডল্যান্ড

দ্বিতীয় দফায় নির্বাচিত হবেন কি না তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের উদ্বেগ একেবারে প্রান্তে এসে পৌঁছেছে। জো বাইডেনের পরামর্শ বারবার উপেক্ষা করে আসছিলেন বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। এই উপেক্ষার মূল্য কী হতে পারে, এই সপ্তাহে ইসরায়েল সেটা দেখতে পেল।

ইসরায়েলের ৩ হাজার ৫০০ বোমার চালান আটকে দিয়েছে বাইডেন প্রশাসন। এই অস্ত্র ইসরায়েল গাজার দক্ষিণের শহর রাফা আক্রমণে ব্যবহার করবে, সেই বিবেচনায় অস্ত্রের চালানটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। রাফায় এখন ১০ লাখের বেশি শরণার্থীর আশ্রয়শিবির।

ইসরায়েলের প্রতি জো বাইডেন তাঁর ‘লৌহদৃঢ়’ সমর্থন থেকে সরে আসছেন না। কিন্তু ইসরায়েল রাফা হামলার জন্য যে হুমকি দিয়ে চলেছে, সেটা সফল করতে অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করবেন না। সিএনএনকে বাইডেন বলেছেন, ‘ইসরায়েলের নিরাপত্তা দেওয়া থেকে আমরা সরে আসছি না। অন্যখানে যুদ্ধ করার সক্ষমতা তৈরির পথ থেকে সরে আসছি আমরা।’

ইসরায়েলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিত্র যুক্তরাষ্ট্র। ইসরায়েলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী আইজাক রবিন বলতেন, তাঁর দেশের ১ নম্বর কৌশলগত সম্পদ এই সব অস্ত্র, এমনকি পারমাণবিক অস্ত্র নয়; বরং ওয়াশিংটনের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক। দশকের পর দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় অস্ত্রের জোগানদাতা ও কূটনৈতিক অভিভাবক। 

কিন্তু মাত্র ছয় সপ্তাহের ব্যবধানে ওয়াশিংটন এমন দুটি পদক্ষেপ নিল, যা পুরোপুরি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গেল। গত মার্চ মাসে নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ভেটো দেওয়া থেকে বিরত থাকে যুক্তরাষ্ট্র। ফলে ইসরায়েল প্রস্তাবটি আটকে দিতে চাইলেও ব্যর্থ হয়। আর এখন তো ওয়াশিংটন অস্ত্রের চালান আটকে দিল।

এর থেকেও বড় বিষয় হলো, এই সিদ্ধান্তগুলো এমন একজন রাজনীতিবিদ নিয়েছেন, যিনি ব্যক্তিগতভাবে ইসরায়েলের খুব নিবেদিতপ্রাণ সমর্থক। বাইডেন সেই যুগের একজন ডেমোক্র্যাট, যখন দুই সহস্রাব্দের নির্বাসন ও শাস্তির পর মধ্যপ্রাচ্যে ইহুদিদের আদি বাড়ি প্রতিষ্ঠার বিষয়টি গতি পেতে শুরু করেছে। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের উদারপন্থীদের চোখ তখন রহস্যজনকভাবে বন্ধ ছিল।  

গোল্ডা মেয়ার থেকে শুরু করে ইসরায়েলের প্রত্যেক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বাইডেন দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে। ইসরায়েলের প্রতি বাইডেনের টান বাড়ার ক্ষেত্রে এর একটার ভূমিকা আছে। পূর্বতন প্রেসিডেন্টদের মতো বাইডেনের ইসরায়েলের প্রতি ভ্রাতৃত্ববোধ শুধু নির্বাচনী হিসাব-নিকাশের বিষয় নয়।  

গাজা নিয়ে কোনো চুক্তি হচ্ছে না। কেননা, নেতানিয়াহু কিংবা সিনাওয়ারা কেউই বিশ্বাস করেন না, চুক্তি করলে তাঁদের স্বার্থ রক্ষিত হয়। যেমনটা যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক কর্মকর্তা অ্যারন ডেভিড মিলার বলেছেন, ‘এই সংঘাত বন্ধে একটি পক্ষেরই কেবল সত্যিকারের তাড়া আছে, সেই পক্ষটি হলেন জো বাইডেন।’

অন্যদিকে ১৯৮০-এর দশকে নেতানিয়াহু প্রথম আলোচনার পাদপ্রদীপে উঠে আসেন। তিনি এমন একজন কূটনীতিক, যিনি আমেরিকানদের সঙ্গে সাবলীলভাবে কথা বলতেন। সে সময় থেকেই তিনি নিজেকে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে দাঁড় করান। ইসরায়েলের একজন হবু নেতার জন্য এই দক্ষতা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। 

কয়েক দশক ধরে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তাঁর ভোটারদের এই বার্তা দিয়ে আসছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের মধ্যকার সব ধরনের গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ক্ষেত্রে তিনিই একমাত্র বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তি।

কিন্তু বাস্তব অবস্থাটা এখন কী দাঁড়াল?  চার দশকের বেশি সময়ের মধ্যে বাইডেনই প্রথম প্রেসিডেন্ট যিনি ইসরায়েলকে সামরিক সহায়তা দেওয়া বন্ধ করলেন। (১৯৮২ সালে ইসরায়েলের লেবানন অভিযানের সময় রোনাল্ড রিগ্যান যুদ্ধবিমান দিতে বিলম্ব করেছিলেন।) বাইডেন কেন এটা করলেন? কারণ, নেতানিয়াহু যুক্তরাষ্ট্রের একটি অংশের জনগোষ্ঠীর মধ্যে এমন তিক্ততা তৈরি করেছেন, যেটা আগে দেখা যায়নি।

ইসরায়েলের প্রতি যে যুক্তরাষ্ট্রের সমাজের নিরেট সমর্থন, তাতে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যেভাবে ছাত্র আন্দোলন আছড়ে পড়েছে, সেটা বিস্ময়করই। আন্তর্জাতিক জরিপ সংস্থা গ্যালাপের মার্চ মাসের জরিপ বলছে, ৫১ শতাংশ ইসরায়েলের পক্ষে সমর্থন দিয়েছে, ২৭ শতাংশ সমর্থন দিয়েছে ফিলিস্তিনের পক্ষে। কিন্তু ডেমোক্র্যাট ও তরুণ জনগোষ্ঠী—দুই ক্ষেত্রেই ফিলিস্তিনিদের পক্ষে সমর্থন অনেকটাই বেড়েছে।

জরিপের এই তথ্য বাইডেন ও তাঁর নির্বাচনী প্রচারণা দলকে চিন্তার মধ্যে ফেলেছে। এই অংশের দ্ব্যর্থহীন সমর্থনই ২০২০ সালের নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে পরাজিত করতে ভূমিকা রেখেছিল। গাজাবাসীর দুর্ভোগ সেই ভোটারদের সমর্থন অনিশ্চিত করে তুলেছে। হোয়াইট হাউস নেতানিয়াহুর কাছে পরিকল্পনা চেয়েছিলেন, বেসামরিক জনসাধারণকে হতাহত না করে কীভাবে রাফায় অভিযান করতে পারে ইসরায়েল। 

কিন্তু নেতানিয়াহু সেই পরিকল্পনা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। সেই কারণে ইসরায়েলকে থামানোর জন্য অস্ত্রের চালান আটকে দেওয়ার সরাসরি পথ বেছে নিয়েছে ওয়াশিংটন।

রাফা বাইডেনের জন্য শক্তি পরীক্ষার জায়গাও হয়ে উঠেছে। বাইডেন রাফাকে বিপদরেখা হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন। নেতানিয়াহু যদি সেই বিপদরেখা অতিক্রম করেন, তাহলে বাইডেন দুর্বল হিসেবে চিহ্নিত হবেন।

কিন্তু নেতানিয়াহু এখন পর্যন্ত রণেভঙ্গ দিতে অস্বীকার করেছেন। ইসরায়েলের স্বাধীনতা আন্দোলনকে সামনে রেখে জনগণের উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র ছাড়া আমরা একাই লড়ে যাব। প্রয়োজনে আমরা আমাদের নখ দিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাব।’ 

নেতানিয়াহু চার্চিলের মতো আওয়াজ তুলতে চাইছেন। কিন্তু তাঁর কথাগুলো দুর্বলের কণ্ঠস্বর, সবলের নয়। ওয়াশিংটন চায়, নেতানিয়াহু যেন রাফা অভিযান থেকে সরে আসেন। কিন্তু জোট সরকারের অতি ডানপন্থী মিত্ররা তাঁকে আরও কঠোর হতে বলছেন, রাফা অভিযানের মাধ্যমে হামাসের বিরুদ্ধে পুরোপুরি বিজয়ের জন্য বলছেন।

এই নিরানন্দ নাটকে বাইডেন ও নেতানিয়াহুই কেবল কুশীলব নন; হামাস নেতা ইয়াহিয়া সিনাওয়ারেরও নিজস্ব হিসাব-নিকাশ আছে, নেতা হিসেবে টিকে থাকার সংকল্প রয়েছে। খুব ঘনিষ্ঠভাবে যাঁরা সিনাওয়ারকেও পাঠ করেছেন তাঁরা বিশ্বাস করেন, নির্দোষ মানুষের জীবন রক্ষা করা তাঁর অগ্রাধিকার নয়; বরং যত বেশি গাজাবাসী নিহত হবেন, আন্তর্জাতিক পরিসরে তাঁর শত্রু ইসরায়েলে অবস্থান ততই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সেই পরিস্থিতি তাঁকে বিজয়ী দাবি করতে সহায়তা করবে। সম্প্রতি হামাস যুদ্ধবিরতি চুক্তি মেনে নেওয়ার ঘোষণার পেছনে সিনাওয়ারের এই ভাবনায় কাজ করেছে। 

সিনাওয়ারা সাময়িক কোনো যুদ্ধবিরতি (তাতে অনেক মানুষের প্রাণরক্ষা হয়, দুর্ভোগ কমে) চান না, তিনি চান স্থায়ী যুদ্ধবিরতি। আর তার জন্য সিনাওয়ারা অপেক্ষা করতেও রাজি।

গাজা নিয়ে কোনো চুক্তি হচ্ছে না। কেননা, নেতানিয়াহু কিংবা সিনাওয়ারা কেউই বিশ্বাস করেন না, চুক্তি করলে তাঁদের স্বার্থ রক্ষিত হয়। যেমনটা যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক কর্মকর্তা অ্যারন ডেভিড মিলার বলেছেন, ‘এই সংঘাত বন্ধে একটি পক্ষেরই কেবল সত্যিকারের তাড়া আছে, সেই পক্ষটি হলেন জো বাইডেন।’


জনাথন ফ্রিডল্যান্ড, ব্রিটিশ গণমাধ্যম গার্ডিয়ানের খ্যাতিমান কলামিস্ট

মতামত এর আরও খবর