আফগানিস্তানের এই পরাজয় আমেরিকার নাকি মুসলমানদের?
হাসান রহমান
কে সহি মুসলমান, কে না- এই ব্যাখ্যা বড়ই জটিল! এই বিতর্কের কোন সহজ সমাপ্তিও হবেনা। তবে তালেবানদের বিজয়ে মধ্যপন্থি মুসলমানদের অনেকেই উল্লাস প্রকাশ করছেন কেউ আবার হতাশ। তালেবানদের এই বিজয়ে যারা আমেরিকার পরাজয় দেখছেন তাদের কপালে অচিরেই ভাঁজ পড়বে এমন আশংকাও উড়িয়ে দেয়া যায়না। আফগানিস্তানে আমেরিকার পরাজয়কে যারা ভিয়েতনাম যুদ্ধের সাথে তুলনা করছেন তারা ইতিহাসের সরু গলিকেই পছন্দ করে নিয়েছেন। গল্পের অন্তমিল ঠিক রাখার জন্য এই দুটি যুদ্ধের উপসংহার মেলানো হয়তো সহজ কিন্তু একটু বিবেচনায় নিলেই বুঝা যায় দুটি যুদ্ধের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ন আলাদা।
আফগান যুদ্ধে আমেরিকার পরাজয়ের চাইতেও বড় পরাজয় হয়েছে আফগান রাষ্ট্রের। আমাদের খেয়াল রাখতে হবে তালেবানদের যুদ্ধ আফগান সরকারের বিরুদ্ধে নয়। এমনকি আমেরিকার বিরুদ্ধেও নয়। তালেবানদের যুদ্ধ ইসলামী রাষ্ট্র ও ইসলামী খিলাফত প্রতিষ্ঠার। তালিবানরা মনে প্রাণে বিশ্বাস করে সমগ্র বিশ্বে ইসলামের খিলাফত প্রতিষ্ঠা করা প্রতিটি মুসলমানের জন্য ওয়াজিব। আর এই ওয়াজিব পালনে যারা বাধার সৃষ্টি করে তারা সকলেই ইসলামের দুশমন। এখানে কে ভাল মুসলমান কে খারাপ অমুসলমান সেই বিচার করার যথেষ্ট সময় তালেবানদের হাতে নাই। তালেবানদের বিশ্বাস সমগ্র বিশ্বে ইসলামী খিলাফত প্রতিষ্ঠা করা পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। আর এই লড়াইয়ের মাধ্যমে যারা শাহাদাত বরণ করবেন তারা শহিদী মর্যাদা লাভ করবেন। এবং হাসরের ময়দানে তারা সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী হবেন।
তালেবান মুজাহেদীনরা মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন এই দুনিয়া কিছুই না। এটি একটি সাময়ীক পরীক্ষা কেন্দ্র। আখিরাতই হচ্ছে মুসলমানদের প্রকৃত ঠিকানা। ইসলামের এই আদর্শে যারা বিশ্বাস করেন তালেবানদের দৃষ্টিতে তারাই প্রকৃত মুমিন। আর যারা এই মতাদর্শ মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন না অথবা পালন করেন না তারা মুনাফিক। এ কারনে কয়েক দশক ধরে তালেবানদের হাতে সব থেকে বেশী মৃত্যু বরণ করেছেন আফগান মুসলমানরা। কোরআন ও হাদিসের আলোকে বিশ্লেষণ করলে তালেবানদের এই ধরনের মতাদর্শকে উড়িয়ে দেয়া যায়না।
ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠিত হলে নারী শিক্ষা ও ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হবে এমন ধারণা যারা পোষণ করেন তালেবানদের দৃষ্টিতে তারা সত্যিকারে মুসলমানই নয়। মুজাহেদীনরা বিশ্বাস করেন সত্যিকারের মুসলমান কখনো কোরআনের শাষনকে উপেক্ষা করতে পারেনা। অর্ধ সত্য যেমন মিথ্যার চাইতেও খারাপ, অনুরূপ ভাবে আধা মুসলিম মুনাফিকের চাইতেও খারাপ। আফগানিস্তানের চলমান পরিস্থিতিতে প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানিসহ শত শত রাজনীতিক এরই মধ্যে দেশ ত্যাগ করেছেন। হাজারো মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন বিভিন্ন দেশে। আর যাদের দেশ ছাড়ার উপায় নেই তারা হয়তো মৃত্যু কিংবা কারাবরণ করবেন অথবা তালেবানদের কাছে আত্মসমর্পণ করে মুজাহেদিনে পরিণত হবেন।
বিশ বছর ধরে পরাশক্তির ছত্রছায়ায় থেকেও আফগানিস্তানে কেন একটি শক্তিশালী সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়নি? কেন একটি শক্তিশালী প্রতিরক্ষা বাহিনী গড়ে উঠেনি? কেন মানুষের চিন্তা চেতনায় মৌলিক পরিবর্তণের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে আধুনিকিকরণ করা হয়নি? এই সকল প্রশ্নের জবাব অমিমাংশিতই থেকে যাবে। একটি রাষ্ট্রের অধিকাংশ জনগণ কি চায় প্রকৃত পক্ষে সেই ধরণের শাসন ব্যবস্থাই প্রতিষ্ঠিত হয়। আফগানিস্তান এই ভূপৃষ্ঠের বাহিরের কোন জনপদ নয়। তালেবানের শাসনই ছিল অধিকাংশ আফগান জনতার প্রাণের দাবি। সময়ের বিবর্তণে তাই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বা হতে চলেছে। তবে এই ব্যবস্থাপনা কতদিন দীর্ঘস্থায়ী হবে সেই ব্যাপারে নিশ্চয়তা দেয়া যায়না। ইসলামের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায় যে কালের পরিক্রমায় মুসলমানরাই মুসলমানদের সব থেকে বড় দুশমনে পরিনত হয়। ক্ষমতার দ¦ন্দ¦ খালিফায়ে রাশেদীনদের আমল থেকেই প্রচলিত। ক্ষমতার দ¦ন্দে¦ তিন জন খলিফারই অপমৃত্যু হয়েছিল। নিহত হয়েছিলেন সাহাবায়েকরামসহ হাজারো মুসলমান। মধ্যযুগের ইসলামী শাসনতন্ত্রেও উমাইয়া এবং আব্বাসিয় ক্ষমতার দ্বন্দে¦ নিহত হয়েছেন অসংখ্য ধর্মপ্রাণ মুসলমান এবং মুজাহেদীন।
গত দুই দশকে অফগান সরকারের নেতৃত্বে থাকা হামিদ কার্জাই, আব্দুল্লাহ আব্দুল্লাহ আর আশরাফ ঘানিদের সকলেই ছিল ঠুটো জগন্নাথ। আমেরিকাসহ পশ্চিমা পরাশক্তির হাতের পুতুল। এদেরকেও ইতিহাসের আস্তাকুড়েই থাকতে হবে। দুই দশকের আফগান শাসকরা তালেবান মুজাহেদীনদের দেশের নাগরিক মনে না করে দেশের শত্রু হিসেবেই চিহ্নিত করেছে। তালেবানদের মনস্তাত্ত্বিক অবস্থাকে কখনোই মুল্যায়ণ করার প্রয়োজন মনে করেনি। অথচ এই তালেবান মুজাহেদীনরা আফগানিস্তানেরই সন্তান। এই আফগানরাই একসময় যৌথভাবে বৃটিশ সাম্্রাজ্যকে পরাস্থ করেছিল, এই আফগানরাই রাশিয়ার দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে লড়াই করে নিজেদের ভূখন্ডকে স্বাধীন করেছিল।
আফগান সরকার এবং আমিরিকা গংরা আফগানিস্তানে আসলে কি চেয়েছিল? কি ধরনের সরকার ব্যবস্থার প্রবর্তণ চেয়েছিল। যদি গতানুগতিক গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা কায়েম করতে চেয়ে থাকে তবে আফগান জনগণ কি সেটি চেয়েছিল? এই সকল প্রশ্ন এখন নিতান্তই মূল্যহীন। এখন তালেবানদের নেতৃত্বে ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠিত হবে এটাই একমাত্র সময়ের ব্যাপার। তবে আধুনিক বিশ্বে ইসলামী খেলাফত কেমন হবে সেই বাস্তবতা দেখার জন্যই অধির আগ্রহে অপেক্ষা করবে সমগ্র বিশ্ব।
যদি তালেবানদের হাতে ইসলামী শাসনের নামে দুঃশ্বাসন প্রতিষ্ঠিত হয়, চরমভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়, নারীদের অধিকার ভুলন্ঠিত হয়, তবে বিশ্ব ব্যাপী ইসলামের অনুসারীদের বিরাট চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। একবিংশ শতাব্দিতে এসে তালেবানরা কি ধরনের খিলাফত প্রতিষ্ঠা করবেন সেই দিকেই তাকিয়ে থাকবে সমগ্র বিশ্ব। তালেবানদের শাসন যদি গতানুগতিক শাসন ব্যবস্থার চাইতে উন্নত না হয় তবে ভবিষ্যতে ধর্ম হিসেবে ইসলামের সংকোচন রোধ করা কঠিন হবে।
তালেবানদের মাথায় রাখতে হবে আফগান সরকার যেমন এতদিন আমেরিকার অনুগত ছিল তেমনি ভাবে তারাও বর্তমানে রাশিয়া এবং চায়নার অনুগত। ভূ-রাজনীতিতে কোন কিছুই বৃহত্তর স্বার্থ ছাড়া চলেনা। তালেবানদের ইসলামীক রিপাবলিক অব আফগানিস্তান প্রতিষ্ঠায় চায়না এবং রাশিয়ার এই নিঃস্বর্ত সহযোগিতার ফসল কার ঘরে বেশী যায় সেই সত্য দেখা যাবে খুব শীঘ্রই। পরাশক্তির দ¦ন্দে¦ আফগান জনগনকে আরো অনেক মূল্য দিতে হবে এমন আশংকাও উড়িয়ে দেয়ার সুযোগ নেই। তালেবানদের এই উত্থানে মুসলমান বিশ্বের অতি উৎসাহী জঙ্গীদের মধ্যে যদি কোন ধরণের প্রভাব পড়ে তবে সেটা হবে মুসলমানদের জন্য অনেক বড় দুর্ভাগ্যের।
হাসান রহমান, সাংবাদিক ও মানব উন্নয়ন কর্মী
১৫ আগস্ট ২০২১ লন্ডন