img

অং সান সুচিঃ নিঃসঙ্গ এক নোবেল লরিয়েট

প্রকাশিত :  ১৭:৫৩, ২৩ নভেম্বর ২০২১
সর্বশেষ আপডেট: ১৭:৫৫, ২৩ নভেম্বর ২০২১

অং সান সুচিঃ নিঃসঙ্গ এক নোবেল লরিয়েট

|| হাসান রহমান ||

কথা ছিল প্রতি সপ্তাহে গৃহবন্দী সুচির বাসভবনের গেট থেকে অন্তত এক গাড়ি শুকনো ফুল সরিয়ে নেবে নগরের পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা। কথা ছিল প্রতিদিন কোন না কোন আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে তার বাড়ির সামনে থেকে সরাসরি সংবাদ সম্প্রচার করা হবে। কথা ছিল বিশ্বের কোথাও না কোথাও তার মুক্তির দাবিতে প্রতিবাদ কিংবা মানব বন্ধন হবে। অথচ সব জায়গায় এখন শুনশান নিরবতা। 

২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর এখন পর্যন্ত মায়ানমারে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে হাজারো মানুষ প্রাণ দিয়েছে। আহত এবং বন্দি হয়েছে হাজার হাজার গণতন্ত্রকামী জনতা। অথচ সামরিক জান্তা আগেরমত বিষয়টিকে আর আমলে নিচ্ছেনা। সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্ববাসীর আগ্রহও আর আগের মত নেই। তবে মায়ানমারের সাধারণ মানুষের মধ্যে গণতন্ত্রের স্বপ্ন এখনো প্রজ্জ্বলিত। কারণ কয়েক দশক ধরে অধরাই রয়ে গেল তাদের প্রকৃত গণতন্ত্রের শাসন। 

আন্তর্জাতিক চাপের কারণে সামারিক সরকার ২০১৬ সালে আধা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করলেও অং সান সুচির অদক্ষ ও অদূরদর্শী রাজনীতির পরিনতি ভোগ করছেন মায়ানমারের আপামর জনসাধারণ। বর্তমানের সামারিক সরকার আগের চাইতে আরো বেশী কঠোর হস্তে দমন করছে গণতন্ত্রের কন্ঠস্বর। জান্তাবিরোধী সাংবাদিকতা মায়ানমারে অপরাধ। এরই মধ্যে অসংখ্য সাংবাদিক নিহত, নির্জাতিত এবং কারান্তরীত হয়েছেন। এ তালিকায় বিদেশী সাংবাদিকরাও আছেন।

মায়ানমারের গনতন্ত্রের সংগ্রামে সাধারণ মানুষদের সাথে সববময় ঐক্যবদ্ধ হয়ে যোগ দিয়েছেন আরাকানসহ সমগ্র মায়নমারের সংখ্যালঘূ মুসলিম জনগোষ্ঠি। মুসলমানরা মনে প্রাণে বিশ্বাস করতো সুচি সরকার ক্ষমতায় ফিরলে তাদের কেড়ে নেয়া নাগরীক মর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়া হবে। অথচ সেই সুচির ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি ক্ষমতায় আসার পর সমগ্র বিশ্ব বিস্মিত হয়েছে সুচির বর্ণবাদী আচরণ দেখে। একজন নোবেল শান্তিপুরস্কার প্রাপ্ত রাজনীতিক হিসেবে নয়, একজন রাষ্ট্র নায়ক হিসেবেও নয়, একজন সাধারণ মানুষ হিসেবেও মুসলমানদের প্রতি মানবতা বিরোধী আপরাধে তার ভূমিকা এবং সমর্থন ছিল নিষ্ঠুরতায় পরিপূর্ণ। 

আরাকানে হাজার বছরের ঐতিহ্য নিয়ে বসতি গড়ে তোলা লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রতি তার সরকারের আমালে যে পৈশাচিক নির্যাতন, হত্যা, ধর্ষণ এবং দেশান্তর হয়েছে। সেটি বার্মার ইতিহাসে আরেকটি কলঙ্কজনক অধ্যায়ের জন্ম দিয়েছে। মানববতা বিরোধী এই নির্মমতাকে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভাবে সমর্থন দিয়েছেন অং সান সুচি। তার এই বিভৎস মানসিকতায় হতভম্ব হয়ে গিয়েছে সমগ্র বিশ্ব। প্রশ্ন উঠেছে তার নোবেল শান্তি পুরস্কারের বৈধতা নিয়ে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সুচিকে দেওয়া অনেক পুরস্কার প্রত্যাহার করে নিয়েছে এরই মধ্যে। ডক্টর মুহাম্মদ ইউনুসসহ অনেক নোবেল লরিয়েট সুচির এই অবস্থানকে হঠকারিতা বলেও উল্লেখ করেছেন। 

২০১৩ সালে বিবিসির সাংবাদিক মিশেল হোসেন অং সান সুচির একটি  সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। সেই সাক্ষাৎকারের পর সুচি বিস্ময় এবং বিরক্তি প্রকাশ করেছেন এই জন্য যে, তিনি জানতেনইনা একজন মুসলিম সাংবাদিক তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। সুচির সেই আচরনের মাধ্যমেই তার বর্ণবাদী মানসিকতার প্রকাশ পেয়েছিল। তবে মায়ানমারের গণতন্ত্রের স্বার্থে তার সেই আচরণ বিশ্বব্যাপী ততটা গুরুত্ব পায়নি। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় সুচি তার আসল রূপ দেখিয়ে দিলেন নিখিল বিশ্বকে! সুচি ভাল করেই জানেন গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা একে অন্যের পরিপূরক। যে দেশে ধর্মনিরপেক্ষতা নেই সেই দেশে গনতন্ত্র অকার্যকর। তবুও মিশেলের স্বাক্ষাতকারের সময় সুচি অজাচিতভাবে একতরফা বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের পক্ষেই কথা বলে মহামতি বুদ্ধের আদর্শকে আসম্মানিতই করেছেন। আর উপেক্ষা করেছেন তার নিশ্চিত সমর্থক সংখ্যালঘু মুসলিম জনগোষ্ঠীকে। 

সরকারের সর্বোচ্চ উপদেষ্ঠা হয়ে সুচির মুসলিম বিরোধী অবস্থান উগ্রবাদী বৌদ্ধ মৌলবাদীদের আরো বেশী সহিংস করে তুলেছে। সেনাবাহিনী এবং উগ্রবাদীরা রোহিঙ্গা হত্যা এবং নির্যাতনে যে নিষ্ঠুরতার উদাহরণ সৃষ্টি করেছে সেটি পৃথিবীর ইতিহাসে খুব কমই লেখা হবে। কারণ এই অঞ্চলে বিশ্বের কোন মিডিয়াকে প্রবেশ করতে দেয়নি সুচি সমর্থিত সরকারের পেটুয়া বাহিনী। মুসলমানদের বিরুদ্ধে উগ্রবাদসহ নানান অভিযোগ তুলে ধরেছে মায়ানমার প্রশাসন। কিন্তু যুগযুগ ধরে নাগরিক অধিকার বঞ্চিত এক বিশাল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে অশিক্ষার অন্ধকারে রেখে আদিম জনগোষ্ঠীতে রূপান্তরিত করার দায় কি মায়ানমার সরকার এড়াতে পারবে কখনো?

সামরীক সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে প্রাকৃতিক সম্পদে টইটুম্বুর মায়ানমারের মানুষের জীবন-জীবিকার সংবাদ খুব কমই জেনেছে সমগ্র বিশ্ব। অর্থনৈতিক অব্যস্থাপনা, সামাজিক নৈরাজ্য আর সামরিক বাহিনীর নির্যাতনের কারণে মানুষের মানবিক বিকাশ স্তম্ভিত হয়ে আছে কয়েক যুগ ধরে। বিশাল  আয়তনের এই দেশটিতে জনসংখ্যা মাত্র সাড়ে পাঁচ কোটি। আর অপার সম্ভাবনা থাকা স্বত্ত্বেও ক্ষুধা, দারিদ্রতা মায়ানমারের সাধারণ মানুষের নিত্য সঙ্গী। বেঁচে থাকার সংগ্রামে নিয়োজিত জনতা জানেইনা নাগরিক অধিকার কি জিনিস। বিশেষ করে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী মুসলমানরা কয়েক দশক ধরে নির্যাতিত হচ্ছে রাষ্ট্রীয়ভাবে। আর তাদের গণতন্ত্রের মানস কন্যা অক্সফোর্ড গ্র্যাজুয়েট অং সান সুচি ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থেকেও সেই দলিত, নিস্পেষিত জনগোষ্ঠীকে নিঃগৃহিতই করেছেন। সুচির এই আমানবিক অবস্থান বিস্বিত করেছে বিশ্ব বিবেককে। 

রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জনপ্রিয়তা কমেছে অং সান সুচির। দেশে বিদেশে সবখানে বিবেকবান মানুষেরা তার এই নিষ্ঠুর অবস্থানে হতবাক হয়েছেন। সুচি বার বার বলার চেষ্টা করছেন, রাখাইন প্রদেশে তেমন কিছুই হয়নি। অথচ বছরের পর বছর ধরে উপেক্ষিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নিষ্পেষিত করেছে মায়ানমার সরকার। নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী একজন শান্তির দূত অথবা মায়ানমারের সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের একজন অংশিদার হিসেবে নয়, শুধুমাত্র একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে সুচি রোহিঙ্গা নির্যাতনের বিরুদ্ধে সঠিক অবস্থান প্রমান করতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। সরকারে থাকা অবস্থায় রোহিঙ্গা বিষয়ে তার প্রতিটি পদক্ষেপ মানবতা বিরোধী হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। 

সেনাবাহিনী অবশ্য অভ্যুত্থানের জন্য সুচির বিরুদ্ধে স্বর্ণ ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ এনেছে। এ ছাড়া অবৈধ সম্পদ অর্জন, লাইসেন্সবিহীন রেডিও যন্ত্রসামগ্রী রাখা, করোনাভাইরাস সংক্রান্ত বিধিনিষেধ ভঙ্গ, এবং উস্কানিমূলক বক্তব্যের অভিযোগও এনেছে। তবে সেনা বাহিনীর ক্ষমতা দখলের জন্য এটি যে খুবই ঠুনকো যুক্তি এ বিষয়ে কারোরই সন্দেহ নেই। তার পরও সর্বশেষ সেনা অভ্যুত্থানের পর সুচির পক্ষ্যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আগের মত সরব হতে দেখা যায়নি। 

মায়ানমারের সাধারণ মানুষ এখনো গণতন্ত্রের জন্য তাদের সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছে। এখনো রাস্তায়-রাস্তায় জান্তা বিরোধী আন্দোলন সংগ্রাম চলছে। কিন্তু সেই আন্দোলনে সুচির নাম আগের মত উচ্চারিত হয়না। গনতন্ত্র এবং সুচির মুক্তির কথা এখন আর একই সাথে উঠে আসেনা। গত ফেব্রুয়ারীতে সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে আর কখনো সুচিকে জন সম্মুখে দেখা যায়নি। বর্তমানে গৃহবন্দি সুচির এই নিঃসঙ্গ পরিনতির জন্য সে নিজেই দ্বায়ী। তার হঠকারীতাই তাকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে পৃথিবীর বিবেকবান মানুষদের হৃদয় থেকে। 

- হাসান রহমান, সাংবাদিক ও মানব উন্নয়ন কর্মী

লন্ডন, ২২ নভেম্বর ২০২১

img

যুদ্ধ উত্তেজনায় ইরান-ইসরায়েল, কে জিতল, কে হারল?

প্রকাশিত :  ১১:৪৯, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
সর্বশেষ আপডেট: ১১:৫৬, ২৫ এপ্রিল ২০২৪

সিমন টিসডল

ইসফাহানের সামরিক ঘাঁটির কাছে ও অন্যান্য লক্ষ্যবস্তুতে গত শুক্রবার আকাশপথে ইসরায়েল যে হামলা চালায়, ইরান সেটা ততটা পাত্তা দিতে নারাজ। বাইরে থেকে হামলার বিষয়টা তেহরান অস্বীকার করেছে। 

ইসরায়েলি মুখপত্ররা আর সব বিষয়ে অনর্গল বাক্যবর্ষণ করে চললেও এ ঘটনায় অদ্ভুতভাবে নীরব। দেখেশুনে মনে হচ্ছে, ঘটনাকে গুরুত্বহীন করে তুলতে দুই পক্ষের মধ্যে যেন একটা চুক্তি হয়েছে, যাতে ধীরে ধীরে উত্তেজনার পারদ এমনিতেই নিচে নেমে যায়।

এটিকে উনিশ শতকের সেই চোরাগোপ্তা কোনো এক ডুয়েল লড়াইয়ের মতো মনে হচ্ছে; যেন দুই প্রতিদ্বন্দ্বী ইংরেজ ব্রিটেনে কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে তৃণভূমির মধ্যে পরস্পরের দিকে অবৈধভাবে পিস্তল তাক করেছে। ইরান ও ইসরায়েল দুই দেশেরই মানমর্যাদা পরিপূর্ণভাবে রক্ষা করতে হবে, কিন্তু সেটা আবার করতে হবে জনগণের মধ্যে যেন আবার চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু না হয়, সেটা মাথায় রেখে। 

দুই দেশই একে অন্যের দিকে সরাসরি হামলা করেছে। তাতে প্রতীকী ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এখন তারা এবং তাদের সাঙ্গপাঙ্গরা এই ইঙ্গিত দিচ্ছে যে খেলা শেষ, অন্তত এবারের মতো।

এটা যদি সত্যি (যদিও সম্ভাবনাটা সাময়িক সময়ের জন্য) হয়, তাহলে সেটা অনেক বড় স্বস্তির বিষয়। এ ঘটনা এই ইঙ্গিত দেয় যে সংযত হতে ইসরায়েলের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের তীব্র চাপ (যুক্তরাজ্য ও অন্য দেশগুলোও তাতে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে) কাজে এসেছে। 

গত সপ্তাহে ইসরায়েলে ইরানের অভূতপূর্ব ও বড় পরিসরে হামলার পর প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইসরায়েলের প্রতি ‘জয়টাকে ধরে রাখার’ আহ্বান জানিয়ে ছিলেন। বোঝা যাচ্ছে, এই বার্তার মর্মোদ্ধার সফলভাবেই করতে পেরেছে ইসরায়েল। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের নেতৃত্ব কখনোই কোনো বিষয়ে পুরোপুরি ঐকমত্য হতে পারে না।

অবশ্য ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ডিএনএর মধ্যেই সংযমের বালাই নেই। সাবেক এই কমান্ডো ইরানের হামলার পর সহজাতভাবেই পাল্টা শক্তি দেখাতে চেয়েছিলেন। আর তাঁর কট্টর ডানপন্থী মিত্ররা যুদ্ধের উন্মাদনা সৃষ্টি করেছিল। 

এই প্রেক্ষাপটে ইসরায়েল যে মাপা পদক্ষেপ নিয়েছে, তাতে বোঝা যায়, যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে মানাতে পেরেছে। আর ইরানের ড্রোন ও মিসাইল হামলা থেকে ইসরায়েলকে সুরক্ষা দিতে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে, সেটাও নেতানিয়াহুর পক্ষে উপেক্ষা করা সম্ভব হয়নি।

আবার ইসরায়েলের সামান্যতম উদ্‌যাপনের কোনো কারণ নেই। এটা ঠিক যে এবার ইসরায়েল ইরানের হামলা ঠেকিয়ে দিয়েছে। কিন্তু অজেয় বলে ইসরায়েলের যে সুখ্যাতি, সেটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। ইসরায়েল অভেদ্য দুর্গ বলে যে মিথ, সেটা গুঁড়িয়ে গেছে। একইভাবে গাজায় এখনো হামাসের হাতে বন্দী ১৩০ পণবন্দী রয়ে গেছে। হামাস এখনো অপরাজেয়।

অবশ্য এখানেই বিষয়টা মীমাংসা হয়ে গেল এটা ধরে নেওয়াটাও বোকামি হয়ে যাবে। রাজনৈতিক ও মতাদর্শিকভাবে গভীর বৈরিতা ইরান ও ইসরায়েল—এই দুই শত্রুকে পরস্পর থেকে আলাদা করে রেখেছে। 

দুই দেশের সরকারের মধ্যেই অভ্যন্তরীণ বিভাজন রয়েছে, যা চরম অনিশ্চয়তা ও প্ররোচনাময় পরিবেশ সৃষ্টি করছে। তারই একটা ভয়ানক নজির আমরা গত কয়েক দিনে দেখতে পেলাম। একেবারে মুখোমুখি যুদ্ধের প্যান্ডোরার বাক্সটি সরাসরি খুলে গিয়েছিল।

বছরের পর বছর ধরে দুটি দেশ যে ছায়াযুদ্ধ লড়ে যাচ্ছিল, সেই যুদ্ধ তারা সবার চোখের সামনে দিনের আলোয় নিয়ে এসেছিল। ইরান দেখিয়ে দিয়েছে যে তারা ইসরায়েলের যেকোনো জায়গায়, যেকোনো সময়, প্রত্যক্ষভাবে হোক আর পরোক্ষভাবে হোক, হামলা চালাতে সক্ষম। আর ইসরায়েল দেখাল যে তারা যদি চায়, তাহলে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালাতে সক্ষম, পরেরবারের হামলা হবে আরও ভয়াবহ।

ইসরায়েল-ইরানের এ অচলাবস্থা ফিলিস্তিন সংঘাতের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। কিন্তু ফিলিস্তিন সংকট নিরসনে কোনো ভূমিকা রাখছে না। আর ফিলিস্তিন সংকটে পশ্চিমাদের দোটানা অবস্থান আগের চেয়ে তীব্র হলো। 

যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন একপেশে, দ্বিমুখী নীতির প্রতীক হয়ে উঠলেন। গাজায় মানবিক সহায়তা পৌঁছতে তিনি প্রাণান্ত চেষ্টা করে চলেছেন, কিন্তু যুদ্ধবিরতির চেষ্টায় সমানভাবে ঢিলেমি করে যাচ্ছেন। ফলে তাঁর নীতি খুব সামান্যই সফলতার মুখ দেখছে।

এর একটা কারণ হতে পারে, ঋষি সুনাকের সরকার ইসরায়েলের কাছে অস্ত্র বিক্রির সুযোগ হাতছাড়া করতে চায় না। আরেকটি কারণ হলো, ১ এপ্রিল দামেস্কে ইরানি কনস্যুলেটে ইসরায়েলের বিমান হামলার (এই হামলায় ইরানের জ্যেষ্ঠ কয়েকজন কমান্ডার নিহত হন, ইসরায়েলে প্রতিশোধমূলক হামলা চালায় ইরান) নিন্দা জানাতে ক্যামেরন অস্বীকৃতি জানান।

জাতিসংঘ–বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইরানের কনস্যুলেটে ইসরায়েলের হামলা ছিল আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। গত সপ্তাহে ক্যামেরন অবশ্য স্বীকার করেছেন, যুক্তরাজ্যের কোনো দূতাবাসে এ ধরনের হামলা হলে তারা কঠোর ব্যবস্থা নিত। 

কিন্তু তিনি কখনোই বলবেন না, ইসরায়েল অন্যায় করেছে। এ ধরনের ইসরায়েলপন্থী অবস্থান বেশির ভাগ পশ্চিমা দেশের সরকারগুলোর চারিত্রিক অবস্থান।

হারজিতের প্রশ্নটি বড় পরিসর থেকে বিবেচনা করা হলে এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে গত সপ্তাহের ঘটনাপ্রবাহে ইউক্রেনীয়রাও সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তারা আরেকটি পশ্চিমা ভণ্ডামির শিকার। 

দুই বছরের বেশি সময় ধরে কিয়েভ ন্যাটোর কাছে আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ও মিসাইল প্রতিরক্ষাব্যবস্থা চেয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তাদের সেই চাওয়া বৃথা পর্যবসিত হয়েছে।

অথচ ইরান যখন ইসরায়েলে ড্রোন ও মিসাইল হামলা করল, তখন পশ্চিমা দেশগুলো তেল আবিবের সুরক্ষা দিতে কী না করেছে। ইরান ৩০০ ড্রোন ও মিসাইল ছুড়লেও প্রায় অক্ষত থাকে ইসরায়েল। অথচ প্রতি সপ্তাহে রাশিয়া সমানসংখ্যক ড্রোন ও মিসাইল হামলা করে ইউক্রেনে।  

একইভাবে অবরুদ্ধ গাজাবাসীর হতাশা আরও প্রলম্বিত হলো এ–ই দেখে যে নেতানিয়াহুর প্রতি পশ্চিমা সমালোচনা রাতারাতি পাল্টে গেছে। পশ্চিমাদের এই সংহতির ঐকতানের জন্য ইরান অবশ্যই নেতানিয়াহুর ধন্যবাদ পেতে পারে। 

দাতা সংস্থাগুলো ফিলিস্তিন নিয়ে অব্যাহতভাবে সতর্ক করে যাচ্ছে যে সেখানে দুর্ভিক্ষ আসন্ন। ইসরায়েলের হাতে ৬ মাসে ৩৪ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। রাফায় ভয়াবহ আগ্রাসন চোখরাঙানি দিচ্ছে। গাজা ও পশ্চিম তীরে কোনো বিজয়ী নেই, কেবল পরাজিত রয়েছেন।

ইরান দাবি করেছে, তারা খুব সফলভাবে দামেস্কে ইরানি কনস্যুলেটে বোমাবর্ষণের শাস্তি দিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ইরানের এই হামলাকে একটা পরাজয়ই বলা যায়। কেননা, এতে তাদের সামরিক সীমাবদ্ধতা প্রকাশ হয়ে গেছে। 

এ হামলার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ইরান আরও একঘরে হয়ে গেছে, তেহরানের ঘাড়ে নতুন নিষেধাজ্ঞার বোঝা চেপেছে এবং ফিলিস্তিনিদের সুবিধা হয়—এমন কোনো কিছু করতে পারেনি ইরান। অবশ্য সেটা তাদের নেতারা তোয়াক্কা করেন না।

আবার ইসরায়েলের সামান্যতম উদ্‌যাপনের কোনো কারণ নেই। এটা ঠিক যে এবার ইসরায়েল ইরানের হামলা ঠেকিয়ে দিয়েছে। কিন্তু অজেয় বলে ইসরায়েলের যে সুখ্যাতি, সেটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। ইসরায়েল অভেদ্য দুর্গ বলে যে মিথ, সেটা গুঁড়িয়ে গেছে। একইভাবে গাজায় এখনো হামাসের হাতে বন্দী ১৩০ পণবন্দী রয়ে গেছে। হামাস এখনো অপরাজেয়।

অনেকের কাছেই শক্তিশালী যুক্তি হলো, মধ্যপ্রাচ্যের মূল সংকট সমাধান করতে হলে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের অবসান করতে হবে। এর জন্য অনেক বেশি কূটনৈতিক সময়, শক্তি ও সম্পদ ব্যয় করা প্রয়োজন। 

এই সংঘাত আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় বিষ ছড়াচ্ছে। এই সংঘাত পশ্চিমা নীতিকে ভারসাম্যহীন করে তুলছে। ইরানের মতো দুর্বৃত্ত খেলোয়াড়ের ক্ষমতা বাড়াচ্ছে।


সিমন টিসডল: বৈদেশিক সম্পর্কবিষয়ক ভাষ্যকার ও কলাম লেখক;
(গার্ডিয়ান থেকেঅনূদিত)

মতামত এর আরও খবর