অং সান সুচিঃ নিঃসঙ্গ এক নোবেল লরিয়েট
|| হাসান রহমান ||
কথা ছিল প্রতি সপ্তাহে গৃহবন্দী সুচির বাসভবনের গেট থেকে অন্তত এক গাড়ি শুকনো ফুল সরিয়ে নেবে নগরের পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা। কথা ছিল প্রতিদিন কোন না কোন আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে তার বাড়ির সামনে থেকে সরাসরি সংবাদ সম্প্রচার করা হবে। কথা ছিল বিশ্বের কোথাও না কোথাও তার মুক্তির দাবিতে প্রতিবাদ কিংবা মানব বন্ধন হবে। অথচ সব জায়গায় এখন শুনশান নিরবতা।
২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর এখন পর্যন্ত মায়ানমারে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে হাজারো মানুষ প্রাণ দিয়েছে। আহত এবং বন্দি হয়েছে হাজার হাজার গণতন্ত্রকামী জনতা। অথচ সামরিক জান্তা আগেরমত বিষয়টিকে আর আমলে নিচ্ছেনা। সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্ববাসীর আগ্রহও আর আগের মত নেই। তবে মায়ানমারের সাধারণ মানুষের মধ্যে গণতন্ত্রের স্বপ্ন এখনো প্রজ্জ্বলিত। কারণ কয়েক দশক ধরে অধরাই রয়ে গেল তাদের প্রকৃত গণতন্ত্রের শাসন।
আন্তর্জাতিক চাপের কারণে সামারিক সরকার ২০১৬ সালে আধা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করলেও অং সান সুচির অদক্ষ ও অদূরদর্শী রাজনীতির পরিনতি ভোগ করছেন মায়ানমারের আপামর জনসাধারণ। বর্তমানের সামারিক সরকার আগের চাইতে আরো বেশী কঠোর হস্তে দমন করছে গণতন্ত্রের কন্ঠস্বর। জান্তাবিরোধী সাংবাদিকতা মায়ানমারে অপরাধ। এরই মধ্যে অসংখ্য সাংবাদিক নিহত, নির্জাতিত এবং কারান্তরীত হয়েছেন। এ তালিকায় বিদেশী সাংবাদিকরাও আছেন।
মায়ানমারের গনতন্ত্রের সংগ্রামে সাধারণ মানুষদের সাথে সববময় ঐক্যবদ্ধ হয়ে যোগ দিয়েছেন আরাকানসহ সমগ্র মায়নমারের সংখ্যালঘূ মুসলিম জনগোষ্ঠি। মুসলমানরা মনে প্রাণে বিশ্বাস করতো সুচি সরকার ক্ষমতায় ফিরলে তাদের কেড়ে নেয়া নাগরীক মর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়া হবে। অথচ সেই সুচির ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি ক্ষমতায় আসার পর সমগ্র বিশ্ব বিস্মিত হয়েছে সুচির বর্ণবাদী আচরণ দেখে। একজন নোবেল শান্তিপুরস্কার প্রাপ্ত রাজনীতিক হিসেবে নয়, একজন রাষ্ট্র নায়ক হিসেবেও নয়, একজন সাধারণ মানুষ হিসেবেও মুসলমানদের প্রতি মানবতা বিরোধী আপরাধে তার ভূমিকা এবং সমর্থন ছিল নিষ্ঠুরতায় পরিপূর্ণ।
আরাকানে হাজার বছরের ঐতিহ্য নিয়ে বসতি গড়ে তোলা লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রতি তার সরকারের আমালে যে পৈশাচিক নির্যাতন, হত্যা, ধর্ষণ এবং দেশান্তর হয়েছে। সেটি বার্মার ইতিহাসে আরেকটি কলঙ্কজনক অধ্যায়ের জন্ম দিয়েছে। মানববতা বিরোধী এই নির্মমতাকে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভাবে সমর্থন দিয়েছেন অং সান সুচি। তার এই বিভৎস মানসিকতায় হতভম্ব হয়ে গিয়েছে সমগ্র বিশ্ব। প্রশ্ন উঠেছে তার নোবেল শান্তি পুরস্কারের বৈধতা নিয়ে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সুচিকে দেওয়া অনেক পুরস্কার প্রত্যাহার করে নিয়েছে এরই মধ্যে। ডক্টর মুহাম্মদ ইউনুসসহ অনেক নোবেল লরিয়েট সুচির এই অবস্থানকে হঠকারিতা বলেও উল্লেখ করেছেন।
২০১৩ সালে বিবিসির সাংবাদিক মিশেল হোসেন অং সান সুচির একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। সেই সাক্ষাৎকারের পর সুচি বিস্ময় এবং বিরক্তি প্রকাশ করেছেন এই জন্য যে, তিনি জানতেনইনা একজন মুসলিম সাংবাদিক তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। সুচির সেই আচরনের মাধ্যমেই তার বর্ণবাদী মানসিকতার প্রকাশ পেয়েছিল। তবে মায়ানমারের গণতন্ত্রের স্বার্থে তার সেই আচরণ বিশ্বব্যাপী ততটা গুরুত্ব পায়নি। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় সুচি তার আসল রূপ দেখিয়ে দিলেন নিখিল বিশ্বকে! সুচি ভাল করেই জানেন গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা একে অন্যের পরিপূরক। যে দেশে ধর্মনিরপেক্ষতা নেই সেই দেশে গনতন্ত্র অকার্যকর। তবুও মিশেলের স্বাক্ষাতকারের সময় সুচি অজাচিতভাবে একতরফা বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের পক্ষেই কথা বলে মহামতি বুদ্ধের আদর্শকে আসম্মানিতই করেছেন। আর উপেক্ষা করেছেন তার নিশ্চিত সমর্থক সংখ্যালঘু মুসলিম জনগোষ্ঠীকে।
সরকারের সর্বোচ্চ উপদেষ্ঠা হয়ে সুচির মুসলিম বিরোধী অবস্থান উগ্রবাদী বৌদ্ধ মৌলবাদীদের আরো বেশী সহিংস করে তুলেছে। সেনাবাহিনী এবং উগ্রবাদীরা রোহিঙ্গা হত্যা এবং নির্যাতনে যে নিষ্ঠুরতার উদাহরণ সৃষ্টি করেছে সেটি পৃথিবীর ইতিহাসে খুব কমই লেখা হবে। কারণ এই অঞ্চলে বিশ্বের কোন মিডিয়াকে প্রবেশ করতে দেয়নি সুচি সমর্থিত সরকারের পেটুয়া বাহিনী। মুসলমানদের বিরুদ্ধে উগ্রবাদসহ নানান অভিযোগ তুলে ধরেছে মায়ানমার প্রশাসন। কিন্তু যুগযুগ ধরে নাগরিক অধিকার বঞ্চিত এক বিশাল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে অশিক্ষার অন্ধকারে রেখে আদিম জনগোষ্ঠীতে রূপান্তরিত করার দায় কি মায়ানমার সরকার এড়াতে পারবে কখনো?
সামরীক সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে প্রাকৃতিক সম্পদে টইটুম্বুর মায়ানমারের মানুষের জীবন-জীবিকার সংবাদ খুব কমই জেনেছে সমগ্র বিশ্ব। অর্থনৈতিক অব্যস্থাপনা, সামাজিক নৈরাজ্য আর সামরিক বাহিনীর নির্যাতনের কারণে মানুষের মানবিক বিকাশ স্তম্ভিত হয়ে আছে কয়েক যুগ ধরে। বিশাল আয়তনের এই দেশটিতে জনসংখ্যা মাত্র সাড়ে পাঁচ কোটি। আর অপার সম্ভাবনা থাকা স্বত্ত্বেও ক্ষুধা, দারিদ্রতা মায়ানমারের সাধারণ মানুষের নিত্য সঙ্গী। বেঁচে থাকার সংগ্রামে নিয়োজিত জনতা জানেইনা নাগরিক অধিকার কি জিনিস। বিশেষ করে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী মুসলমানরা কয়েক দশক ধরে নির্যাতিত হচ্ছে রাষ্ট্রীয়ভাবে। আর তাদের গণতন্ত্রের মানস কন্যা অক্সফোর্ড গ্র্যাজুয়েট অং সান সুচি ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থেকেও সেই দলিত, নিস্পেষিত জনগোষ্ঠীকে নিঃগৃহিতই করেছেন। সুচির এই আমানবিক অবস্থান বিস্বিত করেছে বিশ্ব বিবেককে।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জনপ্রিয়তা কমেছে অং সান সুচির। দেশে বিদেশে সবখানে বিবেকবান মানুষেরা তার এই নিষ্ঠুর অবস্থানে হতবাক হয়েছেন। সুচি বার বার বলার চেষ্টা করছেন, রাখাইন প্রদেশে তেমন কিছুই হয়নি। অথচ বছরের পর বছর ধরে উপেক্ষিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নিষ্পেষিত করেছে মায়ানমার সরকার। নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী একজন শান্তির দূত অথবা মায়ানমারের সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের একজন অংশিদার হিসেবে নয়, শুধুমাত্র একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে সুচি রোহিঙ্গা নির্যাতনের বিরুদ্ধে সঠিক অবস্থান প্রমান করতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। সরকারে থাকা অবস্থায় রোহিঙ্গা বিষয়ে তার প্রতিটি পদক্ষেপ মানবতা বিরোধী হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
সেনাবাহিনী অবশ্য অভ্যুত্থানের জন্য সুচির বিরুদ্ধে স্বর্ণ ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ এনেছে। এ ছাড়া অবৈধ সম্পদ অর্জন, লাইসেন্সবিহীন রেডিও যন্ত্রসামগ্রী রাখা, করোনাভাইরাস সংক্রান্ত বিধিনিষেধ ভঙ্গ, এবং উস্কানিমূলক বক্তব্যের অভিযোগও এনেছে। তবে সেনা বাহিনীর ক্ষমতা দখলের জন্য এটি যে খুবই ঠুনকো যুক্তি এ বিষয়ে কারোরই সন্দেহ নেই। তার পরও সর্বশেষ সেনা অভ্যুত্থানের পর সুচির পক্ষ্যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আগের মত সরব হতে দেখা যায়নি।
মায়ানমারের সাধারণ মানুষ এখনো গণতন্ত্রের জন্য তাদের সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছে। এখনো রাস্তায়-রাস্তায় জান্তা বিরোধী আন্দোলন সংগ্রাম চলছে। কিন্তু সেই আন্দোলনে সুচির নাম আগের মত উচ্চারিত হয়না। গনতন্ত্র এবং সুচির মুক্তির কথা এখন আর একই সাথে উঠে আসেনা। গত ফেব্রুয়ারীতে সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে আর কখনো সুচিকে জন সম্মুখে দেখা যায়নি। বর্তমানে গৃহবন্দি সুচির এই নিঃসঙ্গ পরিনতির জন্য সে নিজেই দ্বায়ী। তার হঠকারীতাই তাকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে পৃথিবীর বিবেকবান মানুষদের হৃদয় থেকে।
- হাসান রহমান, সাংবাদিক ও মানব উন্নয়ন কর্মী
লন্ডন, ২২ নভেম্বর ২০২১