img

কবি মোহাম্মদ হান্নানের ‘কালের স্রোত’ মহাকালের এক প্রমূর্ত রূপ

প্রকাশিত :  ২৩:২৯, ২৩ এপ্রিল ২০২২
সর্বশেষ আপডেট: ১০:৩৪, ২৪ এপ্রিল ২০২২

কবি মোহাম্মদ হান্নানের ‘কালের স্রোত’ মহাকালের এক প্রমূর্ত রূপ
নাজমুল ইসলাম
‘কালের স্রোত’ কবি মোহাম্মদ হান্নান রচিত এক বহুমাত্রিক ও বিচিত্র বিষয় সম্বলিত কাব্যগ্রন্থ, যার প্রতিটি কবিতার শব্দ, পংক্তি, স্তবকে গীতিময় হয়েছে কবির হীরণ্ময় অতীত, ভবিষ্যতের সুসুপ্ত বাসনা, পরম সত্তায় অগাধ বিশ্বাস, প্রেম-বিরহ, সৌন্দর্যবোধ, হর্ষ-বিষাদ, স্মৃতিকাতরতা, দেশাত্মবোধ, পরপারে বিশ্বাস,, মৃত্যুচিন্তা, প্রকৃতির নিরাবরণ সৌন্দর্য, মানবতাবোধ, পার্থিব জীবনের ক্ষণস্থায়িত্বের স্বরূপ, পরকালীন অনন্ত জীবনের ইঙ্গিত, জন্মভূমির প্রতি সীমাহীন দরদ, স্বজাতির অগ্রসরমানতায় উদ্দীপনা, আবহমান কালের বাঙালি স্বভাব, সংস্কৃতি, আচার-আচরণ, কর্মক্ষমতা, সততা, আলস্য, লোভ, হিংসা, পরশ্রীকাতরতা, পশ্চাদপদতা, দেশাচার প্রভৃতি নানাবিদ অনুষঙ্গ।
অসংখ্য কবিতায় আলোচ্য গ্রন্থটি ঋদ্ধ হয়েছে বটে, তবে এগুলোর ছন্দপ্রকরণে সর্বত্রগামিতা পরিদৃষ্ট হয় না। কবি সুপ্রাচীন অথচ সর্বাধিক জনপ্রিয় ছন্দালঙ্কারে বেশি মনোনিবেশ করেছিলেন বলেই এমনটা হয়েছে। মিত্রাক্ষরে স্বরবৃত্ত ছন্দের মৃদু ঝংকারে বাঙময় হয়েছে কবির তাৎপর্যময় আকুতি:

“কার আকাশে উড়াও ঘুড়ি
কার মনেতে থাকো
যেথায় উড়ে উড়ুক ঘুড়ি
ধরে কেবল রাখো।”
(কবিতা: ঘুড়ি, পৃষ্ঠা ২০৮)

তানপ্রধান হিসেবে পরিচিত অক্ষরবৃত্ত ছন্দেও বিধৃত হয়েছে কবি হৃদয়ের গভীর অনুরাগ। নিরাবরণ শব্দকল্পে তিনি অত্যন্ত নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছেন প্রেমিক হৃদয়ের কথামালা:

“তুমি নাই যেথা আমি গেলে সেথা
লোকে যাহা তাহা বলে,
ভুলে গেলে মোরে বড় নেশা ঘোরে
তবু আছি ভেসে জলে।”
(কবিতা: তুমি ছাড়া আমি হারা, পৃষ্ঠা ১৪)

কালের স্রোত গ্রন্থে এই নশ্বর পৃথিবীর পরিবর্তমানতার পাশাপাশি যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি দৃষ্টিগ্রাহ্য হয় তা হলো কবির দেশপ্রেম। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করা মুক্তিযোদ্ধা এ কবি এখন সুদূর পরবাসে অবস্থান করলেও তাঁর জনমভূমি বাংলাকে যে তিনি কতটা ভালবাসেন তা নিম্নের সনেটে ফুটে উঠেছে। ব্রিটেনের মত সুসভ্য মার্জিত সমাজের আদলে তিনি নিজের দেশকে গড়ার প্রত্যাশা আজও লালন করেন:

“দেখে বড় ভালো লাগে মনে বলি হায়
হতো যদি দেশ মোর এই ভাবে গড়া,
ভাবি তাই ফিরে যাই মনে মোর চায়
কাজ করে গড়ি দেশ ফলে ফুলে ভরা।
পরদেশে লোকে সবে কাজে ব্যস্ত রয়,
হাসি খুশি দেখে লাগে যেনো সহোদর।
ভাল লাগে পরদেশ তবু মনে হয়,
মাতৃভুমি দেশ মোর অতি মনোহর।

দূর দেশে এই বেশ দেখে প্রাণে চায়
সবে যেনো মোর দেশে সুখে বাঁচে তায়।”
(কবিতা: দেশপ্রেম, পৃষ্ঠা ২১)

কবিতার কাছে আশা করা হয় স্নিগ্ধতা, কখনো তেজস্বিতা, কখনো অরূপের লীলাময়তা। কখনো আবার বিলের টলমল পানি, ফোটে থাকা অসংখ্য শাপলা ফুলের মতো শব্দ ও বাক্যের অমিত মূর্চ্ছনা ও সৌন্দর্য। এই বৈশিষ্ট্য কবিতার বিষয় ও মেজাজের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। কবিতাই বলে দেয় তাকে কোন রূপে সাজাতে হবে, নন্দনের কোন কাপড় পড়লে তাকে রূপবতী লাগবে। এই রূপের সঙ্গে রসগত গুণও সমানভাবে প্রয়োজনীয়। তবেই তা একটি কবিতা পদবাচ্য হয়ে উঠে।
কবি মোহাম্মদ হান্নান সম্পূর্ণ প্রতিকূল এক পরিবেশে অবস্থান করলেও তার কবিতাগুলো ঋদ্ধ হয়েছে যথোপযুক্ত অলংকারে।
‘কালের স্রোত’ গ্রন্থে কবি অধুনা মধ্যগতির ছন্দেরও দারুণ প্রকাশ ঘটিয়েছেন। আধ্যাত্মিক আবহে সিক্ত কবিকণ্ঠে মাত্রাবৃত্ত ছন্দে ঝংকৃত হয়েছে বিশ্বাসের অমোঘ বাণী:

“আর নয় দেরি মসজিদে যাই
চলো নামাজ পড়ি
যাহার কৃপায় জীবন পেলাম
তাকে সেজদা করি।”
(কবিতা: নামাজ পড়ো সবে, পৃষ্ঠা ৬৫)

কবি কালের স্রোত বলতে মহাকালের অনন্ত গতিময়তাকে বুঝিয়েছেন, যেই স্রোত সর্বগ্রাসী। সময়ের গতিকে থামিয়ে দেয়ার ক্ষমতা পরম সত্তা ছাড়া আর কারো নেই। সর্ববিনাসী এই স্রোতের একটা অনন্ত লক্ষ্য আছে। রবিঠাকুরের কালজয়ী কাব্যগ্রন্থ বলাকায় এই কালস্রোতের স্বরূপ বিধৃত হয়েছে দার্শনিক অভিব্যক্তিতে। তেমনি কবি মোহাম্মদ হান্নানও এই গতির মধ্য দিয়ে তুলে ধরতে চেয়েছেন মহাকালের স্বরূপ।
‘বলাকা’য় আমরা দেখি, সন্ধ্যার আলো-আঁধারির রহস্যময়তার ভেতরে অবগাহন করতে করতে রবীন্দ্রনাথ প্রবেশ করেছেন অন্য এক রহস্যের মায়াজালে। আর আমাদেরকেও যেন আটকে ফেলেছেন এই জালের জটিল সুতোয়! চারিদিকে যেন কেবল কান্নার রোল; অসীম শূন্যতার সৌন্দর্যকে ধরতে না-পারার বেদনায় বোধহয় বিষণ্ন এই পৃথিবীর আকাশ-বাতাস। যেন কেবল নিজেকে মেলে ধরবার, সুদুরে ছুটে যাবার মহা-আয়োজনের শুভ সূচনা আমাদের দোরগোড়ায়। অজানার এই মহাসমুদ্রের অভিযাত্রী হিসেবে আমরা তো নতুন; অতীতের পাটাতনে নিজেকে দাঁড় করিয়ে ভবিষ্যতের অজানা বিশ্বকে জানবার জন্য দরকার সীমাহীন উদ্যম আর চিন্তার চঞ্চলতা। জগতের সকল সৃষ্টির যাপিত জীবন আর চলাচলের মধ্যে সেই অমিত বাণীই কেবল ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত:

“এই বাসাছাড়া পাখি ধায় আলো-অন্ধকারে
কোন্ পার হতে কোন্ পারে।
ধ্বনিয়া উঠিছে শূন্যে নিখিলের পাখার এ গানে-
“হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোথা, অন্য কোনখানে। ”
(কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠকুরের ‘বলাকা’র স্তবক বিশেষ)

আমরা বোধহয় স্বীকার করবো যে, মানবজীবনের জন্য ক্রম-উন্নতির পাঠ অত্যন্ত জরুরি বিষয়। কিন্তু বিস্ময়করভাবে আমরা প্রায় সকলে এই প্রয়োজনীয় শিক্ষা গ্রহণের পথ থেকে অনেক দূরে অবস্থান করি- সজ্ঞানে অথবা অবচেতনে। কালের স্রোত গ্রন্থে কবি বারবার তাঁর শিল্পের বাতাসে আমাদের এই ঘুমিয়ে থাকা চেতনাকে জাগাতে চেয়েছেন। কবি মোহাম্মদ হান্নানের বেশকিছু কবিতায় রয়েছে সে রকমই সহজ ও দরকারি আহ্বানের উজ্জ্বল ইশারা। কবি বোধকরি তাঁর পাঠককে জানাতে চেয়েছেন যে, থেমে থাকবার জন্য আমাদের হাতে কোনো সময় নেই; কাজের মধ্যে দিয়ে, চলমানতার মধ্য দিয়ে পার করতে হবে জীবনের জন্য বরাদ্দকৃত সামান্যতম পথ। হতাশা আর কষ্ট মনের ভেতরে লুকিয়ে না রেখে আনন্দের মধ্যে দিয়ে যাপন করতে হবে সুখকর জীবন:

“ক্ষান্ত হও কেন জীবনের এই অভিযানে
উদ্যম বিহনে অর্জন হয় কি অভিমানে?
সে তোমার আপন জন থাকে তব ধারে
নিঃস্বার্থ প্রেম দিলে নিশ্চয় পাবে তারে।”
(কবিতা: সুখের তালাশ, পৃষ্ঠা১৮৫)

কবি নিজে একজন প্রবাসী বাংলাদেশি। তাই প্রবাসীদের নিরন্তর পরিশ্রম ও দেশের পোষ্যপালনের বিড়ম্বনার শিকার তিনি নিজেই। হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে দেশ ও বিদেশে পোষ্যদের প্রতিপালনেই তাদের জীবনলীলা সাঙ্গ হয়। এতদসত্ত্বেও তারা তাদের প্রাপ্য সমাদরটুকু কোথায়ও পায় না। নিজ জন্মভূমিতে তাদের পরিচয় প্রবাসী আর প্রবাসে গেলে তো ভিনদেশির তকমা আছেই, তদুপরি নিজ দেশের সরকারি কামলারা যখন তাদেরকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে তখন এই মর্মবেদনা উপশমের কোনো উপায় থাকে না। যাদের ঘামঝরানো শ্রমের বিনিময়ে পাঠানো রেমিট্যান্সে দেশের এত উন্নতি হচ্ছে, আর্থিক দেউলিয়াত্ব থেকে দেশ রক্ষা পাচ্ছে সেই প্রবাসীরা দেশে এলে সরকারি কর্মকর্তা বা চাকরদের কাছে সবদিক থেকে হয়রানির শিকার হয়। রাজনৈতিক নেতাদের তোয়াজ না করলে চতুর্মুখী ঝামেলায় পড়তে হয়। সরকার ও আমলারা মিলে লাখো শহীদের বিনিময়ে অর্জিত এই সবুজ শ্যামল বাংলাকে যেন জাহান্নাম বানিয়ে ফেলেছে। এ অবস্থাদৃষ্টে কবি অপরাপর বাঙালির চেয়ে বেশি সংক্ষুব্ধ। কারণ টগবগে যৌবনে তিনি এ দেশটাকে স্বাধীন করার জন্য অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন। নিজের প্রাণের মায়া ত্যাগ করে যে দেশটাকে তারা স্বাধীন করলেন সেই দেশ আজ এক শ্রেণির দুর্বৃত্তদের কারণে পৃথিবীর অন্যতম দুর্নীতিগ্রস্ত, অসভ্য ও দূষিত দেশে পরিণত হয়েছে। তাইতো কবিকণ্ঠে ঘোষিত হয়েছে:

“নেতায় গেছে সমাজ ভরে
কেউ শোনে না কথা
পালন করে নেতার কথা
যখন চাহে যথা।
জাগো মানুষ দেশের যত
জাতি বাঁচাও সবে
নইলে কারো জাত রবে না
মগের জাতি হবে।”

পরিশেষে বলা যেতে পারে, কবিতাকে প্রকৃত কবিতা করে তুলতে শুধু অবয়বই বিচার্য নয়, কবিতার অন্তর্গত বোধের জায়গাটিতেও পরিবর্তন জরুরি। অস্বীকারের সুযোগ নেই যে, জীবনের সবকিছুর মাঝেই নিয়মতান্ত্রিক স্পন্দন আছে। মানুষের ভাবনা, আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ম মেনেই সর্বদা অগ্রসরমাস। ভবিষ্যতের গর্ভে কি আছে জানা নেই তবু আশা-আকাঙ্ক্ষার মোহে নিরুদ্দেশের উদ্দেশে ছুটে চলে মানুষের মন। মনের এই ছুটে চলাই গতির প্রকৃত রূপ। বীজ থেকে অঙ্কুরে, অঙ্কুর থেকে বৃক্ষে, বৃক্ষ থেকে ফুলে, ফুল থেকে ফলে, আবার ফল থেকে বীজে চক্রাকার এই প্রাণের যাত্রা। জীবন ও মৃত্যুর প্রতিটি ক্ষেত্রেই এই গতির লীলা বিরাজমান, যাকে স্রোতের রূপকে উপস্থাপন করে কবি এক স্বার্থক শিল্পীর পরিচয় দিয়েছেন।

নাজমুল ইসলাম প্রাবন্ধিক, ব্যাকরণবিদ, সাহিত্য সমালোচক; নির্বাহী সম্পাদক, জনমত।










img

কষ্ট তুমি কার! -রেজুয়ান আহম্মেদ

প্রকাশিত :  ২০:৫৭, ১৫ অক্টোবর ২০২৪

কষ্ট তুমি কার?

শূন্য রাতে কাঁদে তারা,

অঝোর বৃষ্টির ক্লান্ত ধারা,

নীরব সুরে ভাঙা স্বর—

তুমি কার? কষ্ট, তুমি কার?


নীল আকাশে মেঘের ছবি,

রোদে পুড়ে সোনালি রবি,

অশ্রু ঝরা অন্ধকার—

তুমি কার? কষ্ট, তুমি কার?


চেনা মুখের অচেনা স্মৃতি,

হৃদয় ভাঙার নিঃশব্দ ইতি,

ভালোবাসায় দগ্ধ প্রান্তর—

তুমি কার? কষ্ট, তুমি কার?


আকাশ কেন থেমে থাকে,

চাঁদ কেন রাত ফেলে ডাকে,

নীরবতার চাপা হাহাকার—

তুমি কার? কষ্ট, তুমি কার?


তবুও তুমি নীরব পথিক,

চলে যাও দূরের দিকে,

বয়ে বেড়াও বোবা ভার—

তুমি কার? কষ্ট, তুমি কার?