img

বেদনার নীলকাব্য

প্রকাশিত :  ১৮:০৬, ০১ জুন ২০২২
সর্বশেষ আপডেট: ১৯:৫৬, ০১ জুন ২০২২

বেদনার নীলকাব্য

মোহাম্মদ গোলাম কিবরিয়া


আমরা হারাই

বারবার হারিয়ে যাই

হারিয়েই খুঁজে পাই

যা কিছু হারাই।


আমরা ঘর ছাড়ি

বহুদূর দেই পাড়ি

বুকের সুখটুকু কাড়ি

ফের পথটাকেই ছাড়ি।


আমরা পথের মায়ায় ভুলি

ঘরের দরোজায় খিল তুলি

অঙ্গে মাখি ধুলি

আবারো পথটাকে ভুলি।


তখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি। আমার দাদাজি এবং দাদিজি বেঁচে আছেন।

বছরের প্রথম থেকেই বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ গ্রহণের পরিকল্পনা নিতে হয়েছে। লেখাপড়ার ফাঁকে ফাঁকে ছেলেবেলার ছেলেমনুষি চলমান। তবে, লেখাপড়ার ব্যাপারে মনযোগ থাকলেও নিয়ামানুগ আইন-কানুনের ঘাটতি ছিল। এখনকার দিনে যেমন জানুয়ারির এক তারিখেই স্কুলগামি ছেলেমেয়েদের হাতে বই তুলে দেয়া হয় এবং পরের দিন থেকেই নিয়মমাফিক শ্রেণিকার্যক্রম শুরু হয়, তখনকার দিনে বিষয়টা তেমন ছিল না। বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হবার পর আমরা বেশ কিছুটা সময় পেতাম। পরীক্ষার ফলাফল জানুযারির মাঝামাঝিতে হত। আমরা বেশ ফুরফুরা মেজাজে ঘুরে বেড়াতাম।

গ্রামের বিষয়টাই এমন ছিল।

দাদাজি বিলেতে ছিলেন। বিলেত, শব্দটা কেমন আদুরে। আমরা ইংল্যান্ড বলতাম না। বলতাম লন্ডন। কেউ ইংল্যান্ডের যে কোনো শহরে থাকলে আমরা সেটাকে লণ্ডন বলতাম। যারা ইংল্যান্ডের বার্মিংহাম বা অন্য কোনো শহরেও বসবাস করতেন, তাদের অনেকেই বলতেন, তারা লন্ডনে থাকেন। আমরাও সেটা শুনে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। দাদাজি দীর্ঘ বাইশটি বছর ইংল্যান্ডের বার্মিংহাম শহরে বসবাস করেছেন। তিনি ব্রিটিশ নাগরিক ছিলেন। কিন্তু, জীবিতাবস্থায় তিনি কখনোই আমার আব্বা, চাচা বা ফুফুদের ইংল্যান্ডে নেবার চেষ্টা করেননি। এমনকি আমার পরমাসুন্দরি দাদিজিকেও তিনি কখনোই ইংল্যান্ড নিতে চাননি। কেন চাননি, এ ব্যাপারে আমাদের স্পষ্ট কোনো ধারনা ছিলো না। তবে, এতে হয়তো আমাদের কোনো কল্যাণ নিহিত ছিল।

শিশুকাল থেকেই আমি আমার দাদিজির কোলে স্থান পেয়েছিলাম। আমার এবং আমার ছোট ভাইয়ের বয়সের ব্যবধান এক বছরের একটু বেশি। আমার মায়ের হালকা পাতলা শরীরে কারণে আমাদের দুই ভাই’র লালন পালন বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। তখন, আমার দাদিজি আমার মায়ের স্থান দখল করেন। আমি তাঁর কোলে আশ্রয় পাবার পর থেকে তাঁর কাছ থেকে মায়ের মতন আদর-যত্ন, লালন-পালন, খেয়াল-নজর পেয়ে এসেছি। এভাবেই এক বছরের শিশু থেকে পায়ে পায়ে এগিয়ে একদিন অষ্টম শ্রেণি পড়ুয়া কিশোরে পরিণত হলাম।

আমার দাদাজি বিলেত থাকার কারণেই এবং আমার পরমাসুন্দরী দাদিজিকে না নেবার কারণেই আমি আমার মায়ের ক্রান্তিকালে একটি নিশ্চিন্ত কোল পেয়েছিলাম, সে কোলের উষ্ণতায় আমি বেড়ে উঠছিলাম।

মানুষের জীবনে মাঝে মাঝে এমন কিছু সময় আসে, যখন তার চারপাশে সাফল্য এসে ধরা দেয়। যে অবস্থায় কিংবা যে অবস্থানেই থাকুক না কেন, সে সময়ে সাফল্যগুলো সুজলা সুফলা হয়ে মানুষের বুকটা ভরিয়ে দেয়। অষ্টম শ্রেণির অবস্থা এবং অবস্থানটাও আমার জন্য সে রকম কিছু ছিল। জানুয়ারিতে পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হলো। আমি ভাল রেজাল্ট করলাম। আমাদের ক্লাসের এক থেকে আট ক্রমিক নম্বর পর্যন্ত সবাইকে বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ গ্রহণের প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য নির্দেশনা দেয়া হলো। ক্রমিক নাম্বারের ব্যাপারে কোনো পরিবর্তন হয়েছিল কি না, সেটা এখন আর স্মরণ করতে পারি না।

আমরা জানুয়ারির ফুরফুরা আমেজ শেষে ধীরে ধীরে লেখাপড়ায় বাড়তি খাটুনি দিতে শুরু করলাম। নিয়ম মতো স্কুলে যাওয়া, বাড়ির পড়া শিখে যাওয়া, সকাল সন্ধ্যা নিয়মিত পড়তে বসা- সব কিছু বেশ স্বাভাবিক এবং বাড়তি মনযোগের সাথে চলতে লাগল।

ভোর হতে না হতেই আমার ঘুম ভেঙ্গে যেত। আমার আম্মা আমাকে এক গ্লাস গরম পানিতে হরলিক্স ঢেলে একটু চিনি মিশিয়ে নেড়ে দিতেন। সেই সাথে এক টুকরো পাউরুটি এবং একটি ডিম থাকত। আমি তৃপ্তি সহকারে সেগুলো খেয়ে দেয়ে প্রাইভেট পড়ার জন্য বের হয়ে যেতাম। তখনও স্কুলের স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়ার বিষয়ে মনযোগি হতে পারিনি। আমাদের গ্রামের এক বাড়িতে খুরশেদ স্যারের কাছে আমরা বেশ কয়েক জন মিলে বিভিন্ন ব্যাচে প্রাইভেট পড়তাম। আমাদের ব্যাচে আমার সাথে একই ক্লাসে এবং একই স্কুলে ‍পড়ুয়া দু‘চারজনও ছিল।

এ ভাবেই দিন যায়, মাস যায়। এক সময় পরীক্ষার দিন ঘনিয়ে আসে। আমি আমার মাতৃতুল্য দাদিজির আদরে, ভালবাসায় এবং গভীর মমতায় লেখাপড়ার পাশাপাশি যা যা করার সবই করে বেড়াচ্ছি। তবে, আমার দাদিজি ঐ সময়ে পক্ষাঘাতগ্রস্ত ছিলেন।

বছর তিনেক আগেই তিনি উচ্চরক্তচাপজনিত কারণে স্ট্রোক করেছিলেন। ঐ সময়ে তাঁর শরীরের একপাশ অবশ হয়ে গিয়েছিল। যেদিন তিনি স্ট্রোক করেন, সেদিন আমার চারপাশ কেমন অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল। আমি বেশ কয়েক দিন স্বাভাবিক ছিলাম না। আমার মনে হচ্ছিল, আমার কিছু একটা হয়ে গেছে। মনে হচ্ছিল আমার জীবনটা আর আগের মতো নেই। তারপর, ধীরে ধীরে সে সময়টা আমি কাটিয়ে ওঠতে সক্ষম হই। সময়ই সবচেয়ে বড় প্রতিষেধক। সময় কাটতে থাকে সময়ের মতো। শুধু বিবর্ণ ও ভুলতে না পারা কিছু কষ্ট মানুষ বুকের গভীরে বপন করে চলতে চলতে অনেক দূর এগিয়ে যায়। আমরা কখনো কখনো সেই কষ্টবীজ থেকে বেড়ে ওঠা যন্ত্রণাবৃক্ষের অস্তিত্ব অনুভব করি আর খুব গোপনে মাঝে মাঝে গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলি।

দাদিজি এ কসময় স্ট্রোকের ধকল কাটিয়ে উঠেন এবং ব্যাপক চিকিৎসা, ঝাঁড়ফুক, কবিরাজ প্রভৃতির কল্যাণে ধীরে ধীরে হাঁটতে শুরু করলেন; তবে, লাঠি ভর দিয়ে। আমি আমার মতো ঘুরে বেড়াই, লুকিয়ে লুকিয়ে বোবার মতো কাঁদি। এ কান্নার কথা কেউ জানে না, কেউ দেখে না। আমার বারবার মনে হতো, আমার জীবনে যে পরিবর্তন এসেছে, তা এক সময় অবহেলা আর অনাদরে পর্যবসিত হবে। কারণ, সেই ছোটকাল থেকেই আমি আমার মতো চলতে ভালবাসতাম। এ কারণে বাড়ির বড়রা অনেকেই শাসন করার চেষ্টা করতেন। এটা সেটা বুঝাতেন। কিন্তু, আমি তাঁদেরকে খুব গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করতে পাতাম না। আমার মনে হতো, আমিতো কারো ক্ষতি করছি না, কারো ক্ষতির কারণ হচ্ছি না। আমি শুধুই আমার মতো করে আমার কাজ করি, আমার খেলাধূলার আয়োজন করি কিংবা, অন্য কারো ধার ধারি না।

আমার্ দাদিজি অসুস্থ হবার পর থেকে মনে হচ্ছিল, আমি যে একান্তই আমার আমি, এখন থেকে তা পাল্টে যেতে শুরু করবে। অনেকটা পাল্টেও গিয়েছিল। আমি তখন আমার ভেতরে অদম্য প্রেরণাকে হারিয়ে ফেলেছিলাম। তবে, শেষ পর্যন্ত আমি আমার নিজেকে সামলে নিতে পেরেছিলাম।

এক সময় অষ্টম শ্রেণির বৃত্তি পরীক্ষার সময় ঘনিয়ে এলো। আমার এক ফুফা আমাকে নিয়ে হবিগঞ্জ গেলেন। হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে বৃত্তি পরীক্ষার আসন বসানো হয়। আমি আমার ফুফার সাথে হবিগঞ্জ গিয়ে হোটেল গুলশানে একটি ডাবল রুম ভাড়া করলাম। পাশের আরেকটি রুমে আমার বন্ধু উজ্জল এবং তার খালু আরেকটি ডাবল রুম ভাড়া নিলেন। পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল বীরেন্দ্র, নুর আলম, সেলিনা, লুৎফা এবং আরো কয়েকজন। অন্যরা কোথায় উঠেছিল তা জানা ছিল না। তবে, লুৎফা আর তার আব্বা হোটেল আলিফে উঠেছিলেন। পরীক্ষার আগের দিন শেষ বিকেলের দিকে লুৎফার আব্বা লুৎফাকে নিয়ে আমাদের হোটেলে এসেছিলেন।

ভালোয় ভালোয় বৃত্তি পরীক্ষা শেষ হলো।

আমরা বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি নিলাম। সেদিনই হঠাৎ শুনতে পেলাম,পরের দিন হরতাল এবং একটানা তিন দিন হরতাল থাকবে। আমরা পরীক্ষা শেষ করে ঐদিন বাড়ি ফিরব বলে মনস্থির করলাম। কিন্তু ঝামেলা হল, বিকেল বেলা কোন যানবাহন হবিগঞ্জ থেকে নবীগঞ্জ আসে না। বাধ্য হয়ে আমি, উজ্জল, আমার ফুফা এবং উজ্জলের খালু সন্ধার পর হবিগঞ্জ থেকে শায়েস্তাগঞ্জ আসব বলে সিদ্ধান্ত নিলাম।

সিদ্ধান্ত মতে, রাতি আটটার দিকে আমরা শায়েস্তাগঞ্জ গিয়ে পৌঁছালাম।

তখন পড়লাম আরেক ঝামেলায়।

ঢাকা থেকে সিলেটের উদ্দেশে ছেড়ে আসা বাসগুলো শায়েস্তাগঞ্জ আসতে আসতে রাত একটা থেকে দুইটা বেজে যায়। তখন বাজে মাত্র রাত আটটা। কি ভাবে আরো পাঁচ ছয় ঘণ্টা কাটানো যায়, সেটা নিয়ে আলোচনা হল। আলোচনা শেষে একটা সিদ্ধান্ত হলো।

পাশেই শায়েস্তাগঞ্জের সিনেমা হল। সিদ্ধান্ত হলো, আমরা সবাই সে হলে রাত নয়টা থেকে বারোটা পর্যন্ত মুভি দেখে সময় কাটাবো। বারোটার সময় মুভি শেষ হেলে বেরিয়ে এসে রাতের বাস ধরে শেরপুর আসব। কথা মতো, আমরা তখনি টিকেট কাটতে গেলাম। চারজন নিজের কাপড়চোপড় ও বই‘র ব্যাগ নিয়ে সিনেমা হলে ঢুকে পড়লাম। মুভির নাম ছিল তিন কন্যা। সুচন্দা, ববিতা আর চম্পা-তিন বোনের ছবি।

রাত বারোটায় মুভি শেষ হলো। আমরা চারজন মিলে শায়েস্তাগঞ্জ সিনেমা হল থেকে হেঁটে হেঁটে যেখানে ঢাকা-সিলেট বাস থামে, সেখানে চলে এলাম। রাত দুইটা পর্যন্ত অপেক্ষার পর সিলেটগামী একটি বাস আসল। আমরা সেই বাসে উঠলাম। বাসে বেশ যাত্রী। পরের তিন দিন হরতাল! সবাই পগলপারা হয়ে যার যার গন্তব্যে ফেরার চেষ্টা করছে। ভোর সাড়ে ছয়টার দিকে বাসটি আমাদের গন্তব্য শেরপুর এসে থামল। আমি আর উজ্জল ঘুমঘুম চোখে বাস থেকে নামলাম। একট চা’র স্টল খোঁজে সেটোতে গিয়ে চোখে মুখে পানি ছিটালাম।

আমাদের অভিভাবক দুইজনের পরামর্শে একটি ডিমপোজ আর ভাজি দিয়ে গরম গরম পরোটা খেলাম। পরোটা খেয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আমরা বাড়ির পথ ধরলাম। তখন পুরোদমে হরতাল।

হরতাল না থাকলেও শেরপুর থেকে সকাল সকাল আমাদের গ্রামে ফিরে আসতে গেলে কোন ধরনের যানবাহন পাওয়া যেত না। দুপুর বারোটার পর কুশিয়ারা দিয়ে শেরপুর থেকে আজমিরিগঞ্জের লঞ্চ চলাচল করে। বারোটা পর্যন্ত অপেক্ষা করার পক্ষে ছিলাম না আমরা কেউই। শেষে মেশ কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে রাস্তায় নেমে বাড়ির পথ ধরলাম। শেরপুর থেকে ফারকুল হয়ে ফাদুল্লা, জামারগাঁও, দীঘলবাঁক ও কসবা হয়ে শেষ পর্যন্ত আমরা ইনাতগঞ্জের সীমানায় প্রবেশ করলাম।

উজ্জলদের বাড়ি আমাদের বাড়ির আগে। সে বাড়ির পথে পা বাড়াল।

এদিকে, উজ্জলের সঙ্গ সমাপ্ত হবার পরই আমার মনে সহসাই আমার দাদিজির কথা ভেসে উঠল! না জানি তিনি কি করছেন! হয়তো আমার কথা ভাবতে ভাবতে কাতর হয়ে পড়েছেন। হরতালের খবর তিনি জানেন কি না তা আমার জানা ছিল না। তবে, পরীক্ষার জন্য বাড়ি থেকে বেরিয়েছি চার দিন হল। এ চার দিন তিনি আমার কথা ভাবতে ভাবতে উথলা হয়ে উঠবেন, এটা আর কেউ না জানলেও আমি জানি।

বাড়িতে পা রাখলাম।

বারান্দায় তিনি বিমর্ষ চেহারা নিয়ে বসে আছেন। আমি ছোট ছোট পদক্ষেপে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। তিনি এক হাত বাড়ালেন। স্ট্রোক করার পর তাঁর ডান হাতটি সে ভাবে কাজ করে না। বাম হাতটি আগের মতই। তাঁর বাড়ানো একটি হাতই যেন আমার সমগ্র পৃথিবী হয়ে ধরা দিল তখন।

তারপর অনেক দিন কেটে গেল। আমার মনে মনে একটি বিশ্বাস ছিল, বৃত্তি পরীক্ষায় উত্তির্ণ হব। কারণ, ঐ যে বললাম, মাঝে মাঝে সময় মানুষকে সফল করে তোলে। হয়ত আমার সময়টা ছিল তখন।

পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হবার দিন এগিয়ে আসছে। এরই মধ্যে হঠাৎ একদিন আমার দাদিজি আমাকে ছেড়ে, সবাইকে ছেড়ে, এই পৃথিবীকে ছেড়ে্ অসীম ওপারের পথে রওনা হলেন।

সেদিনটি আমার জীবনের সব হারানোর দিন ছিল বলে মনে হয়েছিল। আমার দাদিজিকে রীতিমাফিক গোসল করিয়ে জানাজা শেষ করে কবরে নামানো হল। আমি কবরের পাড়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। মৃতদেহটি কবরে নামানোর সাথে সাথে আমার যে কী হল, সেটা আর আমার মনে নেই। হঠাৎ করেই মনে হল, আমার সব কিছু সাড়ে তিন হাত মাটির খুপড়ি ঘরে চাপা দিয়ে দেয়া হচ্ছে এবং এটা আমি আর কোন দিনই দেখতে পাব না!

আমি চিৎকার করে উঠলাম! আমার বুকটা তখন ফেটে যাচ্ছিল। ঐ মুহূর্তের ঐ ঘটনাচক্র আমাকে এ ভাবেই পরিচালিত করেছিল। আমার মনে হচ্ছিল, আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারব না এবং যে কোন মুহূর্তে পড়ে যাব।

এ সময় আমার একজন চাচা এসে আমাকে ঝাপটে ধরে বুকের সাথে আলগে রাখেন। তারপর সেখান থেকে ধরে ধরে বাড়িতে নিয়ে আসেন।

নিস্তরঙ্গ গ্রামিণ শান্ত জীবনে আমার ঐ বছরের বৃত্তিটি বিশেষ কিছু ছিল। আমি আর আমাদের আরেক জন, নাম নুর আলম, বৃত্তি পেয়েছিলাম। আমাদের দু’জনের বৃত্তি পরীক্ষার উত্তির্ণ হবার কাহিনীটি ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল। কারণ, ইতোপূর্বে ঐ স্কুল থেকে আর কেউ বৃত্তি পাননি। আমরাই শুরু করেছিলাম।

প্রকৃতি মনে হয় খুব গোছালো এবং হিসেবি। কোথায় কোন অঘটন ঘটলে কিংবা কোথায় নতুন কিছ সংযোজিত হলে কোন না কোন উপায়ে সে সব কিছুকে বিন্যস্ত করে তোলে। আমার শ্রেষ্ঠ পাওয়ার সময়গুলোতে আমি আমার শ্রেষ্ঠ কিছু হারিয়েছি।

সে তো গেল কিশোর জীবনের কথা।

জীবন যখন সংসারের হাল ধরল, তখন সব কিছু গোছানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করল। গত পাঁচ বছরের বিরামহীন চেষ্টা, অপরিসীম কষ্ট, বুকভাঙ্গা বিরহ, কাছের এবং দূরের যন্ত্রণা- সব কিছু ছাপিয়ে আমি আমার আশপাশকে গুছিয়ে নিয়ে এসেছিলাম।

এ বছরের ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ ছিল সেদিন। পরের দিন বাইশে ফেব্রুয়ারি সাদির অনার্স ভর্তির ইনডাকশন এবং ঐদিনই ভোর সাড়ে সাতটায় ঐশির নতুন ক্লাস শুরু হবে।

সব কিছু সাজানো গোছানো ছিল। কেমন যেন ঐ অবস্থায় এবং অবস্থানে নিজেকে কিছুটা সফল মনে হচ্ছিল, অনেকটা অষ্টমের বৃত্তি পেয়ে যাব পেয়ে যাব- তেমন একটা সুখানুভুতির মত।

রাত আড়াইটার দিকে আলমগীরের বয়েস ম্যাসেজ। পৃথিবীটা কেমন হঠাৎ টালমাটাল হয়ে গেল! শারমিন স্ট্রোক করেছে। শরীরের এক সাইড অবশ হয়ে গেছে! ইয়া আল্লাহ! এমনও হয়! আমার সব কিছু এলোমেলো হয়ে গেল।

তারপর থেকে আজ বিশ দিন গত হল। আমি নিজেও জানি না, কোথায় আছি, কি করছি, কেন করছি!

শুধু পাশের আপন দুয়েকজন মানুষ ওঠে দাঁড়াতে বলছে। কেউ কেউ হাত ধরে টেনে তুলছে, কেই আবার সাহস ও অনুপ্রেরণা দিয়ে বলছে, যা কিছুই হয় কোন না কোন ভালর জন্য হয়। আমি তাদের কথা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি- যা হয় ভালর জন্যই হয়।

আবারো একটি নতুন অভিজ্ঞতা। পাশের মানুষগুলোর প্রতি আমি চিরকৃতজ্ঞ। তোমরা পাশে না থাকলে আমি ভেঙ্গেচুরে গুড়িয়ে যেতাম।

তোমরা ভাল থেক, আমি আরেকটি যুদ্ধে গেলাম। নিজেকে ভাল রাখার চেষ্টা করব শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত। কথা দিলাম, তোমাদের নিয়েই বাঁচব।


মোহাম্মদ গোলাম কিবরিয়া, কবি ও সাংবাদিক
১৩ মার্চ ২০২২, সিলেট।


img

আয়না ঘরের বন্দি: এক ভয়াল নির্যাতনের ইতিহাস!

প্রকাশিত :  ১১:২০, ০৮ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
সর্বশেষ আপডেট: ১১:৫০, ০৮ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

রেজুয়ান আহম্মেদ

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে নিপীড়ন ও দমন-পীড়নের গল্প নতুন নয়। তবে আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে এমন এক নির্যাতনের পদ্ধতি চালু হয়েছিল, যা মানুষের মনে গভীর আতঙ্কের ছাপ ফেলে গিয়েছে— "আয়না ঘর"। এটি ছিল এক ভয়ংকর জায়গা, যেখানে বন্দিদের শুধু শারীরিকভাবেই নয়, মানসিকভাবেও ভেঙে ফেলার জন্য এক বিভীষিকাময় ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছিল।

এই আয়না ঘর ছিল এক ধরনের মানসিক নির্যাতন কেন্দ্র, যেখানে বন্দিদের চারপাশের দেয়ালে শুধু আয়না ছিল। দিনের পর দিন সেখানে বন্দিরা নিজেদের প্রতিবিম্ব দেখতে বাধ্য হতো, নিজের অস্তিত্ব নিয়ে সন্দেহ করতে বাধ্য হতো। সেখানে কাউকে সরাসরি হত্যা করা হতো না, তবে এমন এক মানসিক চাপ সৃষ্টি করা হতো, যা একজন মানুষকে আস্তে আস্তে ভেতর থেকে মেরে ফেলতে পারত।

এই লেখায় আমরা আয়না ঘরের ভয়াবহ বাস্তবতা, সেখানে নির্যাতিত মানুষদের অভিজ্ঞতা এবং এর সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব নিয়ে আলোচনা করব।

আয়না ঘরের উৎপত্তি ও নির্যাতনের ধরন

একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের দায়িত্ব জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কিন্তু যখন কোনো সরকার ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে ভয়ভীতি ও নিপীড়নকে হাতিয়ার বানায়, তখন মানবাধিকারের লঙ্ঘন চরম আকার ধারণ করে।

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিরোধী দলের কর্মী, সাংবাদিক, ছাত্রনেতা কিংবা সাধারণ মানুষ— যেকোনো ব্যক্তিকে রাতের আঁধারে তুলে নিয়ে যাওয়া হতো। যাদের নাম সরকারের ‘কালো তালিকায়’ চলে যেত, তাদের পরিণতি হতো ভয়াবহ। অনেকে গুম হয়ে যেত, আর যারা ফিরে আসত, তারা আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারত না। কারণ, তারা ছিল আয়না ঘরের বন্দি।

আয়না ঘরের অভ্যন্তরীণ নির্মাণ ও নির্যাতন পদ্ধতি

এই নির্যাতনকেন্দ্রটি ছিল একেবারে ভিন্ন। বন্দিদের এমন এক ঘরে রাখা হতো, যার চারপাশের দেয়ালে ছিল শুধু আয়না। কোনো জানালা থাকত না, বাইরের দুনিয়ার কোনো দৃশ্য দেখা যেত না। ঘরটিকে নিয়ন্ত্রণ করা হতো ভয়ংকর আলোর মাধ্যমে— কখনো অত্যন্ত উজ্জ্বল আলো জ্বালিয়ে চোখ ঝলসে দেওয়া হতো, আবার কখনো সম্পূর্ণ অন্ধকার করে ফেলা হতো।

বন্দিদের চোখ বাঁধা অবস্থায় সেখানে আনা হতো। তারপর হঠাৎ চোখ খুলে দেওয়া হতো, যাতে তারা নিজেদের প্রতিচ্ছবি দেখে বিভ্রান্ত হয়ে যায়।

এই কক্ষে বন্দিদের ওপর চালানো হতো অমানবিক নির্যাতন—

১. প্রচণ্ড ঠান্ডা বা অসহনীয় গরমের মধ্যে রাখা হতো,

২. টানা কয়েক দিন না ঘুমোতে দেওয়া হতো,

৩. নোংরা, দুর্গন্ধযুক্ত খাবার দেওয়া হতো,

৪. আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে আত্মসম্মানবোধ ধ্বংস করা হতো,

৫.কানের কাছে উচ্চশব্দ বাজিয়ে রাখা হতো, যাতে মানসিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়,

৬. পরিবারকে হত্যা করার হুমকি দেওয়া হতো,

৭. আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে বন্দিকে নিজেকেই মারতে বাধ্য করা হতো।

এই নির্যাতন এতটাই ভয়ংকর ছিল যে অনেকে কয়েক দিনের মধ্যেই দিশেহারা হয়ে যেত। তারা ভুলে যেত তারা কোথায় আছে, কতদিন ধরে বন্দি, এমনকি নিজের নামও মনে করতে পারত না।

মানসিক ধ্বংসের কৌশল

এই নির্যাতন ছিল সম্পূর্ণ পরিকল্পিত। কাউকে হত্যা না করেও তাকে জীবন্মৃত করে রাখা ছিল এর মূল উদ্দেশ্য।

বন্দিদের মানসিকভাবে ধ্বংস করার জন্য যেসব কৌশল ব্যবহার করা হতো—

 ১. মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করা: বন্দিদের বলা হতো, তাদের পরিবার মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, তাদের বন্ধুরা বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।

 ২. আয়নার মাধ্যমে বিভ্রম সৃষ্টি করা: বিশেষ আলোর সাহায্যে আয়নায় এমন প্রতিচ্ছবি দেখানো হতো, যাতে মনে হতো বন্দির শরীর বিকৃত হয়ে গেছে।

 ৩. সময় ও বাস্তবতার অনুভূতি ধ্বংস করা: বন্দিরা কতদিন ধরে বন্দি, সেটি বোঝার কোনো উপায় রাখত না। কখনো দিনের বেলা রাতের পরিবেশ তৈরি করা হতো, আবার কখনো রাতেও কৃত্রিম আলো জ্বালিয়ে রাখা হতো।

আয়না ঘর থেকে মুক্তি পেলেও মুক্তি নেই

যারা কোনোভাবে মুক্তি পেত, তারা আর কখনো স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারত না। কেউ মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলত, কেউ আত্মহত্যা করত, কেউ সারাজীবন আতঙ্কে কাটাত।

একজন ভুক্তভোগীর বর্ণনায়—

"আমি আয়না ঘর থেকে বের হওয়ার পরও আমার চারপাশের আয়নাগুলো কথা বলে। যখন ঘরে ঢুকি, মনে হয় আবার বন্দি হয়ে গেছি। আয়নায় নিজেকে দেখলে মনে হয়, আমি আর মানুষ নেই, আমি কেবল এক মৃতপ্রায় ছায়া।"

বন্দিদের সমাজও গ্রহণ করতে চাইত না। তারা ছিল ভয়, আতঙ্ক, ও মানসিক অবসাদের জীবন্ত প্রতীক।

রাজনৈতিক প্রভাব ও ভবিষ্যৎ শঙ্কা

এই নির্যাতন শুধু ব্যক্তি পর্যায়ে সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং এটি পুরো জাতির মনোবল ধ্বংসের জন্য ব্যবহৃত হয়েছিল।

 ১. প্রতিবাদের কণ্ঠ স্তব্ধ করা:

মানুষ সরকারের বিরুদ্ধে কিছু বলতে ভয় পেতে শুরু করল, কারণ তারা জানত এর মূল্য কী হতে পারে।

 ২. সাংবাদিকতা ধ্বংস করা:

সত্য প্রকাশ করলেই গুম হওয়ার ভয় ছিল। ফলে মিডিয়া একসময় সরকারের প্রচারযন্ত্রে পরিণত হলো।

 ৩. একটি ভীতসন্ত্রস্ত প্রজন্ম তৈরি করা:

তরুণদের শেখানো হলো— সত্য বললে, প্রতিবাদ করলে, তাদের পরিণতি হবে আয়না ঘরের বন্দিদের মতো।

আয়না ঘরের স্মৃতি মুছবে না

"আয়না ঘর" ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের এক ভয়ঙ্কর নিপীড়নযন্ত্র। এটি শুধু শারীরিক নির্যাতন নয়, ছিল নির্মম মানসিক নিপীড়নের কেন্দ্র।

হয়তো সেই ঘরগুলো আজ আর নেই, হয়তো সময় বদলাবে, কিন্তু সেই আয়নার প্রতিচ্ছবি বন্দিদের মনে চিরদিন থেকে যাবে।

কিন্তু ইতিহাস ভুলে গেলে, সেই আতঙ্ক আবার ফিরে আসতে পারে। তাই আমাদের দায়িত্ব হলো এই নির্মম সত্যের কথা সবাইকে জানানো, যাতে ভবিষ্যতে আর কেউ আয়না ঘরের বন্দি না হয়।

"যে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলাম, সেই আয়না আমি ভেঙে দিতে চাই।"




রেজুয়ান আহম্মেদ: কলামিস্ট, বিশ্লেষক; সম্পাদক অর্থনীতি ডটকম