আশুরার ফজিলত: করণীয় ও বর্জনীয়

প্রকাশিত :  ০১:৫৮, ০৪ আগষ্ট ২০২২

আশুরার ফজিলত: করণীয় ও বর্জনীয়

মুফতী নূরুজ্জামান যশোরী

চন্দ্র প্রথম মাস ‘মহররম’। এ মাসের দশম তারিখকে ইসলামের পরিভাষায় ‘আশুরা’ বলা হয়। এই দিনে একদিকে যেমন রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ফজিলত, অন্যদিকে রয়েছে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট। আর তাই এ দিনটি নানা কারণে পৃথিবীর ইতিহাসে বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ।

হাদিস শরীফের বর্ণনায় আছে, পৃথিবীর অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এ দিনে সংঘটিত হয়েছে। অনেক নবী-রাসূলের জীবনের স্মরণীয় ও উল্লেখযোগ্য ঘটনা আশুরার দিনে সংঘটিত হয়েছে বলে কিতাবে পাওয়া যায়। বিশেষ করে হযরত মূসা (আ.) ও তার দলবল নিরাপদে সমুদ্র পার হওয়ার এবং ফেরাউনের সৈন্য-সামন্তসহ ডুবে মরার ঘটনা যে এ দিনে সংঘটিত হয়েছিল, তা বিশুদ্ধ বর্ণনায় পাওয়া যায়। আশুরার দিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আমল হলো, এ দিনে রোজা রাখা। আর এ রোজা অত্যন্ত ফজিলতময়। আশুরার রোজার উৎপত্তি ও তার তাৎপর্য সম্পর্কে হাদিস শরীফে এসেছে- হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন- রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন মদিনায় হিজরত করেন, তখন ইহুদিদেরকে আশুরার রোজা রাখতে দেখলেন, তখন তিনি জিজ্ঞেস করলেন- ‘এটা কি?’ উত্তরে তারা বলল, এটা একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। এই দিনে আল্লাহ তা’আলা বনী ইসরাইলকে তাদের শত্রু (ফেরাউন) থেকে মুক্তি দিয়েছেন। তাই এ দিনে মুসা (আ.) আল্লাহ তা’আলার শুকরিয়া আদায়কল্পে রোজা রেখেছেন। আর তাই আমরাও আমাদের নবীর অনুসরণে রোজা রাখি। তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, মুসা (আ.) এর সঙ্গে (কোনো নেক আমলের সম্পৃক্ত হওয়ার ব্যাপারে) আমরা তোমাদের চেয়ে বেশি হকদার। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সা.) এদিনে রোজা রাখলেন এবং সাহাবিগণকে রোজা রাখতে নির্দেশ দিলেন। (বুখারী-হাদিস নং-১৮৬৫)

এছাড়া হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেন: ‘আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে এই দিন (আশুরার দিন) এবং এই মাস (রমজান মাস) এর রোজার চেয়ে অন্য কোনো রোজাকে এত গুরুত্ব দিতে দেখিনি।’ (মিশকাত, ১৭৮ পৃষ্ঠা)

অপর এক হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, আমার বিশ্বাস যে, আশুরার রোজার বিনিময়ে আল্লাহ তা’আলা বিগত এক বছরের গুনাহ মাফ করে দেবেন। (তিরমিযী শরীফ) তবে যিনি আশুরার রোজা রাখতে চান তার ব্যাপারে কর্তব্য হলো, তিনি শুধু আশুরার দিন অর্থাৎ মহররমের দশ তারিখে রোজা রাখবেন না, বরং একদিন আগে বা পরে আরও একটি রোজা রাখবেন। কারণ এ রোজা রাখার ব্যাপারে একটি হাদিসে এসেছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমরা আশুরার রোজা রাখো এবং ইহুদিদের সাদৃশ্য পরিত্যাগ করে আশুরার রোজার আগে বা পরে আরও একদিন রোজা রাখো। (তিরমিজি- ৭৫৫, হাদীসটি সহীহ) আশুরার দিনের রোজার সূত্রের ব্যাপারে অপর একটি হাদিসে হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন- তোমরা আশুরার দিন রোজা রাখো। কেননা, এই দিনে আম্বিয়ায়ে কিরামগণ (আ.) রোজা রাখতেন। হযরত আলী (রা.)-কে এক ব্যক্তি প্রশ্ন করলেন, রমজানের পর আর কোন মাস আছে, যাতে আপনি আমাকে রোজা রাখার আদেশ করেন? তিনি বললেন, এই প্রশ্ন রাসূলুল্লাহ (সা.) এর নিকট জনৈক সাহাবি করেছিলেন। তখন আমি তার খেদমতে উপস্থিত ছিলাম। উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, রমজানের পর যদি তুমি রোজা রাখতে চাও, তাহলে তুমি মহররম মাসে রোজা রাখো। কারণ এটি আল্লাহর মাস। এ মাসে এমন একটি দিন রয়েছে, যে দিনে আল্লাহ তা’আলা একটি জাতির তাওবা কবুল করেছেন এবং ভবিষ্যতেও অন্যান্য জাতির তাওবা কবুল করবেন। (তিরমিযী ১ম খণ্ড)

আশুরার দিনের ব্যাপারে একটি প্রসিদ্ধ হাদিস রয়েছে যে, ‘যে ব্যক্তি আশুরার দিনে নিজের পরিবারবর্গের মধ্যে খাদ্যদ্রব্যে প্রশস্ততা করবে অর্থাৎ ভালো খাবারের ব্যবস্থা করবে, আল্লাহপাক তাকে সারা বছর সচ্ছল রাখবেন।’ (মেশকাত শরীফ) উক্ত হাদিসটির ব্যাপারে মুহাদ্দিসগণের মধ্যে মতাদ্বৈধতা রয়েছে। কেউ বলেন, উক্ত হাদিসটি মাউযত (বানানো) হাদিস। আবার অনেকে বলেন, এই হাদিসটির সনদে যদিও কিছুটা দুর্বলতা আছে, কিন্তু বিভিন্ন বর্ণনায় বর্ণিত হওয়াতে এটা হাসান হাদিসের পর্যায়ভুক্ত হয়। আর তাছাড়া ফজিলতের আমলের ক্ষেত্রে দুর্বল হাদিসের আমল করা যায়।

অপরদিকে দেখা যায়, কারবালার ঐতিহাসিক ঘটনাও এদিনে সংঘটিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) এর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র, জান্নাতি যুবকদের সরদার হযরত হুসাইন (রা.) ইয়াযিদ বাহিনী কর্তৃক আক্রান্ত হয়ে শাহাদাত বরণ করেন। এতে করে অনেকেই মনে করে থাকে যে, আশুরার ফজিলত ও রোজার হুকুম হযরত হুসাইন (রা.) এর শাহাদাত বা কারবালার ঘটনার কারণে হয়েছে, বস্তু‘ত এমন ধারণা নিতান্ত ভুল ও ভিত্তিহীন। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে আশুরার ফজিলত পূর্ব থেকেই বিদ্যমান রয়েছে, কারবালার ঘটনার পরে নয়।

বরং আল্লাহ তা’আলা কারবালার ঘটনাকে আশুরার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করে এর তাৎপর্য ও মর্যাদাকে বাড়িয়ে দিয়েছেন। তাই আশুরা উপলক্ষে যা কিছু নেক আমল করা হয়, তা আশুরার ফজিলতের কারণেই করা হয়, কারবালার ঘটনার কারণে নয়। অবশ্য তত্ত্বজ্ঞানীগণ লিখেছেন, সাইয়্যেদুনা হযরত হুসাইন (রা.) এর শাহাদাতের জন্য আল্লাহ তা’আলা আশুরার এই মুবারক ও মহান দিবসকেই পছন্দ করেছেন, যার ফলে তার পবিত্র শাহাদাতের ফজিলত ও মর্যাদা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু মহররম মাসে আশুরাকে কেন্দ্র করে আমাদের সমাজে এমন কিছু কুপ্রথা, বিদআত ও কুসংস্কারের প্রচলন দেখা যায় যা শরীয়তবিরোধী ও নাজায়েজ। অনেক ক্ষেত্রে যা শিরকের পর্যায়েও গিয়ে পৌঁছে। যেমন- রসমী আলোকসজ্জা, আতশবাজি, কালো কাপড় পরিধান করা, তাজিয়া মিছিল করা, মর্সিয়া পাঠ করা, হা-হুতাশ করা, আহাজারি ও শোক প্রকাশ করা, শোক প্রকাশার্থে বক্ষে ও পিঠে ছুরিকাঘাতে রক্তাক্ত করা ইত্যাদি। এ সমস্ত নাজায়েজ কর্মকা- থেকে নিজে বিরত থাকতে হবে এবং অন্যকে বিরত রাখার চেষ্টা করতে হবে। আল্লাহ তা’আলা আমাদের সকলকে তাওফিক দান করেন। আমিন।



ঐতিহাসিক বদর দিবস আজ

প্রকাশিত :  ০৬:৪৮, ২৮ মার্চ ২০২৪
সর্বশেষ আপডেট: ০৬:৫১, ২৮ মার্চ ২০২৪

আজ ১৭ রমজান। আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর পূর্বে ১৭ রমজান মদিনার মুসলিম ও কুরাইশদের একটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ২য় হিজরির এই দিনে মহানবী (সা.)’র নেতৃত্বে সাহাবায়ে কেরামের ৩১৩ জনের একটি মুজাহিদ বাহিনী বদর প্রান্তরে উপস্থিত হন। ইসলামের ইতিহাসে যাকে জঙ্গে বদর বা বদর যুদ্ধ নামে অভিহিত করা হয়েছে।  মুসলমানদের সমৃদ্ধি ও শক্তিবৃদ্ধিতে ঈর্ষা ও শত্রুতা থেকেই পৌত্তলিক মক্কাবাসী রাসুলুল্লাহ (স.) ও তাঁর অনুসারীদের সাথে সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটায়, ইসলামের ইতিহাসে তা ’গাজওয়ায়ে বদর’ বা বদর যুদ্ধ নামে পরিচিত। এই যুদ্ধে আবু জেহেলের এক হাজার সুসজ্জিত বাহিনীর বিপরীতে মুসলমানদের সেনা সংখ্যা ছিল মাত্র ৩১৩। 

যেসব পরোক্ষ কারণে বদরযুদ্ধের সূচনা হয়, তা হলো- হিজরতের পর মদিনায় ইসলামের দৃঢ় প্রতিষ্ঠা ও প্রসারে কুরাইশদের হিংসা, আবদুল্লাহ বিন ওবাই ও ইহুদিদের যড়যন্ত্র, ইসলামের ক্রমবর্ধমান শক্তির ধ্বংস এবং নবীজি (স.)-কে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করার হীন চক্রান্ত, কাফেরদের সন্ধি-শর্ত ভঙ্গ, বাণিজ্য বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা, কাফেরদের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কা। প্রত্যক্ষ কারণ ছিল- নাখালার ঘটনা, কাফেরদের রণপ্রস্তুতি, আবু সুফিয়ানদের অপপ্রচার, যুদ্ধ প্রস্তুতির জন্য ওহি লাভ ও মক্কাবাসীদের ক্ষোভ।

ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধে রাসুলুল্লাহ (স.)-এর নগণ্যসংখ্যক সাহাবায়ে কেরাম আল্লাহ তাআলার গায়েবি সাহায্যে আবু জেহেলের বিশাল বাহিনীকে পর্যুদস্ত করেছিলেন। এই যুদ্ধকে কোরআন কারিমে ‘সত্য-মিথ্যার মধ্যে পার্থক্যকারী যুদ্ধ’ বলে অভিহিত করা হয়েছে।

মদিনার দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে ৮০ মাইল দূরে এই সশস্ত্র যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ‘আশহুরে হুরুম’ বা নিষিদ্ধ চার মাসের অন্যতম হচ্ছে পবিত্র রমজান। এই রমজানেই মদিনা আক্রমণ করে বসে কাফেররা। তার বিপরীতে আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধের কৌশল গ্রহণ করেছিলেন মুসলিমরা।

আল্লাহর ওপর পূর্ণ বিশ্বাসী মুসলমানদের অস্ত্র ছিল মাত্র তিনটি ঘোড়া, ৭০টি উট, ছয়টি বর্ম ও আটটি তলোয়ার। রসদ কম মনে হলেও বিজয় লাভে তাদের প্রধান উপকরণ ছিল ঈমানি শক্তি। মুসলমানদের বিশ্ব জয়ের সূচনা এবং সর্বোত্তম ইতিহাস রচনার ভিত্তি এই বদর যুদ্ধ। এই যুদ্ধে ৭০ জন মুশরিক নিহত ও ৭০ জন বন্দি হয়। অন্যদিকে মাত্র ১৪ জন মুসলিম বীর সেনানী শাহাদতের অমীয় সুধা পান করেন।

বদরের এ ঘটনা থেকে মুসলিম জাতীর সবচেয়ে বড় শিক্ষণীয় বিষয় হলো—মুসলিম উম্মাহ এমন একটি জাতি, যে নীরবে নিভৃতে অত্যাচার-অনাচার-জুলুম সহ্য করবে না। প্রয়োজনে জীবন দিয়ে হলেও সমাজে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখাকে কর্তব্য হিসেবে গ্রহণ করবে। 

ইসলামকে সমুন্নত রাখার জন্য কাফের-মুশরিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ করবে। ঈমান ও কুফরের মধ্যে পার্থক্য সূচিত করবে। বদর যুদ্ধ মুসলমানকে সর্বাবস্থায় আল্লাহর সাহায্য কামনা করতে শেখায়। আল্লাহর ওপর দৃঢ় ঈমান ও নির্ভর হওয়া শেখায়। যুদ্ধে অবিচল থাকা ও সবর করা শেখায়।

বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে মুসলিমরা ইসলামবিদ্বেষীদের জুলুমের শিকার হচ্ছেন এবং ইসলামের শত্রুরা ইসলামের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে। আর মুসলমানরা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে নীরবে বসে আছেন। তা মোটেও ইসলামের শিক্ষা নয়। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে বদরের যুদ্ধ থেকে শিক্ষা নেওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।