বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরঃ পরীক্ষিত বন্ধুত্বের পরাকাষ্ঠা
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী গত ৪ সেপ্টেম্বর ২০২২ এ চার দিনের সফরে ইন্ডিয়াতে গিয়েছেন এক রাষ্ট্রীয় সফরে। ইন্ডিয়া এবং বাংলাদেশের সম্পর্ক শুরু হয়েছে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের ষেই ক্রান্তি লগ্ন থেকে। বাংলাদেশ এবং ইন্ডিয়ার সম্পর্ক সেই পুরাকাল থেকেই আমাদের এই দুই দেশের মাঝে রয়েছে বন্টিত ইতিহাস, সংস্কৃতি, রীতি নীতি, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং এথনিক সামঞ্জস্য। ভূগোলিকভাবে আমাদের দুটি দেশই একে ওপরের নিকট সম্পূরক অনেক ভাবেই। হিমালয়ের বরফগলা পানিরাশি দিয়ে বিধৌত প্রধান তিনটি নদী ব্যবস্থা তিনটিই সমুদ্রে প্রবাহিত হচ্ছে বাংলাদেশের উপর দিয়ে। বাণিজ্য, সামরিক, নিরাপত্তা এবং ভূ রাজনৈতিক দিক থেকে আমারা এই দুইটি দেশ একবারেই অবিচ্ছেদ্য।
১৯৭১ সালের সেই তুলকালাম দিনগুলোতে যখন পরাশক্তি সহ সব দেশেই বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটী মানুষের উপর নেমে আসা সেই বর্বরোচিত অপমান, অবমননা এবং জেনোসাইড থেকে তাদের কৃপার দৃষ্টি অন্য দিকে সরিয়ে শুধু নিয়েছিল না পক্ষান্তরে হামলাকারীদের সাথে ঐ সকল দেশকে বাড়ীয়ে দিয়েছিল তাদের সহায়তা। আজ তারা আমাদের দেশের জন্য, জনগণের জন্য, আমাদের গণতন্ত্র এর জন্য, উন্নয়নের জন্য কুম্ভীরাশ্রু নির্গমন করে - কি আশ্চর্য - একদা যারা চায়নি আমাদের স্বাধীনতা, কর্ণপাত করে নাই আমাদের লক্ষ কোটি মানুষের আর্তনাদে তারা এখন হতে চায় আমাদের বন্ধু! কি বিচিত্র এই জগত!
ইন্ডিয়া এবং বাংলাদেশ এর বন্ধুত্ব শুধু বান্যিজিক, অর্থনৈতিক, নিরাপত্তাই শুধু নয়, এই দৃঢ় সম্পর্ক আত্মিক, এই সম্পর্ক চিরস্থায়ী এবং অনড় তথা অটুট। ১৯৭১ সালের সেই সময় ইন্ডিয়া আজকের ইন্ডিয়া ছিল না — ইন্ডিয়া তখন ছিল অনেক দিক থেকেই পশ্চাৎগামী, যোগাযোগ ব্যবাস্থা, সামরিক সরঞ্জামের অপ্রতুলতা, অর্থনীতি আপেক্ষিক ভাবে উন্নয়নশীল নয়, উত্তর পূর্ব ইন্ডিয়ায় তখন বিচ্ছিনতাবাদী ইন্সারযেঞ্ছি, বিদেশ নীতিতে একটু পিছুপা এবং আন্তর্জাতিক জোটের সদস্য সঙ্কট - কিন্তু এর কোন কিছুই ইন্ডিয়া কে মানবিকতার উৎকর্ষতা দেখাতে স্তিমিত করতে পারে নাই।
এপ্রিল ১৯৭১ সালে প্রথম সপ্তাহ থেকে ১৫ই ডিসেম্বর ১৯৭১ সাল শেষ দিন পর্যন্ত প্রত্যহ হাজার হাজার নিঃস্ব, জীবনের ভয়ে বিহ্বল, ঘর বাড়ি হীন আবাল বৃদ্ধ বনিতারা প্রবেশ করতে থাকে ইন্ডিয়াতে ত্রিপুরা, আসাম, মেঘালয়া এবং পশ্চিম বাংলায়। ইন্ডিয়া এবং তার উদার জনগণ ব্যবস্থা করে ছিল এই সব শরণার্থীদের জন্য অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান এবং আবাস। ইতিহাসে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর বাংলাদেশের শরণার্থী সঙ্কট ছিল সবচেয়ে বড় শরণার্থী সঙ্কট প্রায় ১ থেকে দেড় কোটি অসহায়, সহায়, সম্বলহীন, মৃত্যুভয়ে আতঙ্কিত বাঙ্গালীরা উপায়ান্তর না পেয়ে ইন্ডিয়া তে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়।
স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধ সংগঠন থেকে শুরু করে অস্ত্র, প্রশিক্ষণ, পোশাক, খাদ্য, গোলাবারুদ, মুক্তি বাহিনী ক্যাম্প, ভারি থেকে হাল্কা অস্ত্র, ম্যাপ, বিনোকুলার থেকে শুরু করে যুদ্ধ করতে যে সমস্থ সামগ্রী প্রয়োজন তার সবই ইন্ডিয়া দিয়েছিল এবং মুক্তি বাহিনীর সাথে যুগপৎ ভাবে সমরে যোগদান করেছিল সেই মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রহর থেকেই। ৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে ইন্ডিয়ান সম্মিলিত বাহিনী এবং মুক্তি বাহিনী যুগপৎ ভাবে পাকিস্তানি দের আত্মসমর্পণ এর মাধ্যমে পরাজিত করে ছিনিয়ে এনে দিতে সক্ষম হয় আমাদের দেশ - বাংলাদেশ!
একটি একাডেমিক রিসার্চ পেপারের উদ্ধৃতিতে লিখেছে, বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধে ইন্ডিয়াকে আজকের মুদ্রায় ইউ এস ডলার ১ শত বিলিয়ন ব্যয় করতে হয়েছিল এবং এটা আশ্চর্য হবার মত কোন মহাকাশীয় সংখ্যা নয় - এটা মনে হয় একটি সত্যি খরচের পরিসংখ্যান।
১৯৭১ সাল থেকে আজ ২০২২ সালের বাংলাদেশ এবং ইন্ডিয়া অনেক চড়াই উৎরাই অতিক্রম করে এখানে এসেছে ; বৈশ্বিক সমস্যা - কোভিড-১৯ এর ব্যাকল্যাস, মুদ্রাস্ফীতি, রাশিয়া - উইক্রেন যুদ্ধ, চীন আগ্রাসী মনোভাব, মুসলমান সংখ্যালঘু ইউঘোরদের উপর চীনা কম্যুনিস্ট পার্টির জেনোসাইড, ইন্ডিয়ান মহাসাগর, দক্ষিণ চায়না সাগর, গনতন্ত্রকামী তাইওয়ান এর অস্তিত্বের হুমকি সহ অন্যান্য সহস্রাধিক সম্যসায় পৃথিবী আজ অতিক্রম করছে ক্রান্তিকাল আর এই সময়ে বাংলাদেশের প্রধান মন্ত্রীর ইন্ডিয়া সফর একটি বিশাল তাৎপর্য পূর্ণ সফর। এই সফর শুধু পারোস্পরিক সহযোগিতা, সমঝোতা, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক, অর্থনীতি, পররাষ্ট্র নীতি মূলক এজেন্ডাতেই সীমাবদ্ধ নয় এই সফর অনেক তাৎপর্যপূর্ণ ইন্ডিয়া এবং বাংলাদেশের ঐতিহাসিক বন্ধুত্বের সুদৃঢ়তার মাইল ফলক হিসাবে। সর্বদা অটুট তাখুক বাংলাদেশ - ইন্ডিয়া বন্ধুত্ব !