চার শেয়ারে বিনিয়োগকারীদের বিশেষ নজর
হীরেন পণ্ডিত
আমরা যখন শান্তিনিকেতনে পৌঁছালাম তখন সূর্য অনেকটা পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে। দূরের বাস জার্নি করে অনেকটাই ক্লান্ত। তবু দেখে যেতে চাই শান্তিনিকেতন। প্রকৃতির ছায়া সুনিবিড় প্রান্তরে ভারতের শান্তিনিকেতন পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার বোলপুর শহরের নিকট অবস্থিত একটি আশ্রম ও শিক্ষাকেন্দ্র। ১৮৬৩ খ্রিষ্টাব্দে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর নিভৃতে ঈশ্বরচিন্তা ও ধর্মালোচনার উদ্দেশ্যে বোলপুর শহরের উত্তরাংশে এই আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। এর পরিপূর্ণতা পায় রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে কবি শান্তিনিকেতনকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন, সীমাহীন জ্ঞানের পরিপূর্ণ বিকাশ চেয়েছিলেন। বিশ্ব মানবতাবাদের চিন্তাধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে শান্তিনিকেতনকে সমগ্র বিশ্বে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন কবি।
এই শান্তিনিকেতনের প্রকৃতি অনেককেই বড় কাছে টানে। ছায়া সুনিবিড় গাছের নিচে নিচে কচিকাঁচাদের ক্লাস, মাঝেমাঝেই লাল সরু পথ, আম্রকুঞ্জে গাছেদের সঙ্গে আলাপ, গৌড় প্রাঙ্গণ, ঘণ্টাঘর, শ্যামলী, উদয়ন—সর্বোপরি সেই বিখ্যাত ছাতিম গাছ যার তলায় বসে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ সাধনায় মগ্ন হয়ে যেতেন। এ যেন এক অন্য রকম পরিবেশ, প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের ভালোবাসার বন্ধন, মহামানবের মিলন মেলা। মুগ্ধ হয়েছি কলাভবনের ভাস্কর্য দেখে, সংগীতভবনের ভেতর থেকে ভেসে আসা সুরের মূর্ছনায় কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে যাওয়া।
১৮৬২ সালে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ বোলপুরে বন্ধুর বাড়ি আসেন। তখন শান্তিনিকেতন ছিল ধুধু মাঠ আর ডাঙা। তার ওপর ভুবন ডাকাতের অত্যাচার। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের এই ছাতিমতলা ও তার আশেপাশের নিরিবিলি পরিবেশ খুবই পছন্দ হয়ে যায়। তিনি অনুভব করেন যে এখানে তিনি মনের শান্তিতে সাধনা করতে পারবেন। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ বন্ধু রায়পুরের জমিদারদের কাছ থেকে এই জায়গাটি মাত্র এক টাকার বিনিময়ে শুভেচ্ছাস্বরূপ কিনে নেন। আসলে জমিদার ভুবন মোহন সিংহ বন্ধুকে এই ডাঙা জমি বিনামূল্যেই দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ কিছুতেই বিনামূল্যে নিতে রাজি হননি, তখন এক টাকা নিয়ে প্রায় কুড়ি একর জমি বন্ধুকে বিক্রি করেন জমিদার ভুবন মোহন সিংহ। এখানেই মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ শান্তির নীড় শান্তিনিকেতনে গৃহস্থাপন করেন। এই ছাতিমতলাতেই তিনি অনুভব করেছিলেন প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ ও আত্মার শান্তি। এই ছাতিমতলার কাছেই রয়েছে উপাসনাগৃহ কাঁচঘর।
১৯০১ সালে এখানে স্থাপিত হয় ব্রহ্মচর্য আশ্রম। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতন আশ্রমের যে বীজ বপন করেছিলেন তার পূর্ণবিকাশ ঘটাতে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতন আসেন। জীবনস্মৃতিতে আমরা পড়েছি যে রবীন্দ্রনাথ কোনোদিনই স্কুলের চারদেয়ালের গণ্ডির মধ্যে শিক্ষাব্যবস্থা পছন্দ করেননি। তিনি চেয়েছিলেন ছাত্রছাত্রীরা প্রকৃতির কোলে বসে মনের আনন্দে শিক্ষা নেবে। ১৯০১ সালে মাত্র ৫ জন ছাত্রকে নিয়ে আশ্রম বিদ্যালয় তপোবনের আদর্শে স্থাপন করেছিলেন। পরবর্তীকালে ১৯২১ সালের ৮ই পৌষ আম্রকুঞ্জে মহাসমারোহে রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়কে সর্বসাধারণের উদ্দেশ্যে উত্সর্গ করেন। দার্শনিক ব্রজেন্দ্রনাথ শীল ঐ সভায় সভাপতিত্ব করেন। রবীন্দ্রনাথ এই সভায় বিশ্বভারতীকে সমস্ত মানবজাতির তপস্যাক্ষেত্র হিসেবে উল্লেখ করেন।
বর্তমানে এখানে ষাটের বেশি ডিপার্টমেন্ট, অগণিত ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষক, কর্মী আছেন। সকলের জন্য বিশ্বভারতীর অবারিত দ্বার, প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের মিলন ঘটাতে দিয়েছিলেন এখানে। ‘দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে/যাবে না ফিরে’—কালোত্তীর্ণ পুরুষ কবিগুরুর সকল সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উদার চিন্তাধারার ছাপ এই দুই লাইনে উপলব্ধি করা যায়।
রবীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতীতে সংগীতচর্চা, নৃত্য, নৃত্যনাট্য স্থাপত্য কলা সংস্কৃতির ধারক ও বাহক করে তোলেন। এছাড়াও বিভিন্ন ভাষার শিক্ষাদান শুরু হয়। গান্ধীজী, নেতাজী, বেনারস থেকে ক্ষিতিমোহন শাস্ত্রী মহাশয়, বিধুশেখর শাস্ত্রী, নন্দলাল বসু, হরিচরণ বন্দ্যাপোধ্যায় প্রমুখ অনেক প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব এসে রবীন্দ্রনাথের চিন্তাধারাকে রূপ দেওয়াতে সহায়তা করলেন। বিশ্বমানবতাবাদকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হলো শান্তিনিকেতনে। কবিতা, নাটক, গান লেখার মধ্য দিয়ে শান্তিনিকেতনে বিশ্বমানবের মিলনের আহ্বান জানান।
১৯১৩ সালে লন্ডন মিশনারি কলেজের উদ্ভিদবিজ্ঞানের অধ্যাপক ও পাদ্রি পিয়ারসন শান্তিনিকেতন আসেন ও এখানকার প্রকৃতি ও পরিবেশ দেখে মুগ্ধ হয়ে তিনি এখানেই তাঁর জীবন সমর্পণ করেন। এখানে একটি সাঁওতাল গ্রামের নাম পিয়ারসন পল্লি। বিশ্বভারতী হসপিটালের নাম পিয়ারসন মেমোরিয়াল হাসপাতাল।
১৯২৬ সালে শিক্ষাসত্র শ্রীনিকেতনে স্থানান্তরিত হয়। শিক্ষাসত্রে শুধুমাত্র গ্রামের দুস্থ-গরিব ছাত্রছাত্রীরা পড়াশোনা করতে পারত। এছাড়া শিক্ষার্থীদের নানারকম বৃত্তিমূলক শিক্ষা যেমন কৃষি, পশুপালন, কুটিরশিল্পে উত্সাহ দেওয়া হতো। শিক্ষার্থীদের বিনা বেতনে শিক্ষা দেওয়া হতো এখানে।
শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের শিক্ষার লক্ষ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আনন্দ পাঠশালা, পাঠভবন ও উত্তর শিক্ষা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। আনন্দ পাঠশালা স্থাপনের ক্ষেত্রে মৃণালিনী দেবীর অনেক অবদান ছিল। এই ব্রহ্মচর্যাশ্রম ও বিদ্যালয়গুলির লক্ষ্য ছিল সর্বাঙ্গীণ ব্যক্তিত্বের বিকাশ তথা শিল্প, সাহিত্য, কলা, সংস্কৃতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে যাতে শিক্ষার্থীর বিচরণ ঘটে তা দেখা। ১৯৫১ সালে দিল্লির পার্লামেন্টের একটি বিল পাসের মাধ্যমে বিশ্বভারতীকে কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমোদিত বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
এবার শান্তিনিকেতনে এসে গাছের তলায় প্রকৃতির উন্মুক্ত গ্রাঙ্গণে শিশু শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদান দেখে মনে হয় সত্যিই যেন তপোভূমিতে চলে এসেছি—ঠিক যেভাবে বহু যুগ আগে মুনি-ঋষিরা তাঁদের শিষ্যদের প্রকৃতির কোলে শিক্ষাদান করতেন।