img

প্রধানমন্ত্রী এবার সশরীরে বইমেলা উদ্বোধন করবেন

প্রকাশিত :  ০৯:৪৩, ২১ জানুয়ারী ২০২৩

প্রধানমন্ত্রী এবার সশরীরে বইমেলা উদ্বোধন করবেন

এবার অমর একুশে বইমেলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে উপস্থিত থেকে উদ্বোধন করবেন বলে জানিয়েছেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। 

শনিবার (২১ জানুয়ারি) দুপুরে বইমেলার কার্যক্রম পরিদর্শন শেষে তিনি সাংবাদিকদের এ কথা জানান।

প্রতিমন্ত্রী বলেন, “প্রধানমন্ত্রী এবার নিজে সশরীরে উপস্থিত হয়ে বইমেলার উদ্বোধন করবেন। এখন পর্যন্ত এমন সিদ্ধান্তই আছে। প্রধানমন্ত্রী ১ ফেব্রুয়ারি বিকেল তিনটায় আসবেন এবং তিনি মেলায় উদ্বোধন ও পরিদর্শনের পর আমরা সবার জন্য বইমেলা উন্মুক্ত করে দেব। আমাদের প্রস্তুতি ভালো আছে এবং এখনও পর্যন্ত সবকিছু আমাদের মতো করেই খুব ভালোভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। আশা করি, আমরা এটি সুন্দর এবং সফলভাবে সমাপ্ত করতে পারব।”

তিনি আরো বলেন, “এটিকে সার্বক্ষণিক মনিটরিংয়ে রাখবো যেন আমরা যথাসময়ে সুষ্ঠুভাবে এটি সম্পূর্ণ করতে পারে। আর বইমেলার একটি নীতিমালা আছে। এখানে যারা অংশগ্রহণ করবে তাদের সবাইকে সেই নীতিমালা মেনেই অংশ নিতে হবে। এছাড়া একটি মনিটরিং কমিটি করা হয়েছে যেটির মাধ্যমে যেসব প্রতিষ্ঠান এই বইমেলা নীতিমালার বাইরে যাবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য। বইমেলাতেই ৭ সদস্যের এই টাস্কফোর্সের একটি কমিটি থাকবে।”

প্রতিমন্ত্রী বলেন, “এই মেলার মাধ্যমে মুক্তচিন্তার কোনো ব্যাঘাত ঘটবে বলে আমার মনে হয় না। তবে একটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে যে কারো বিরুদ্ধে হিংসা বিদ্বেষ বা অগ্রহণযোগ্য কিছু আমরা চাই না। কেননা এটি একটি মুক্তচিন্তার জায়গা। এটি আমাদের প্রাণের মেলা আমরা চাই না প্রাণের মেলায় কেউ কাউকে নিয়ে কটু কথা বলুক।”

আদর্শ প্রকাশনীর অংশগ্রহণ সম্পর্কে প্রতিমন্ত্রী বলেন, “বইমেলার যে নীতিমালা আছে তা মেনে তারা অবশ্যই মেলায় অংশগ্রহণ করতে পারবে। তবে তাদের নতুন যে দাবি নিয়ম-নীতি সংস্কার সেটি সময়ের ব্যাপার হুট করে চাইলেই সেটি সম্ভব নয়। গতবছর তাদের বইয়ে আপত্তিকর কিছু ছিল যেটি এবার আপত্তি জানানো হয়েছিল। সেদিক থেকে ১০ জনের যে নিয়ম সেটি মেনেই আদর্শকে বইমেলায় আসতে হবে এবং শুধু আদর্শ নয় সব প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেই এই নিয়ম নীতি কার্যকর।”

এবারের মেলায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ৪৭২টি প্রতিষ্ঠান এবং ৭১০টি ইউনিট ও বাংলা একাডেমীতে ১০৩টি প্রতিষ্ঠান ও ১৪৭টি ইউনিট অংশ নিচ্ছে। এছাড়া প্যাভিলিয়ন আছে ৩৪টি। সঙ্গে ফুডকোর্ট, নামাজের জায়গাসহ অন্যান্য ব্যবস্থা থাকবে।

img

আয়না ঘরের বন্দি: এক ভয়াল নির্যাতনের ইতিহাস!

প্রকাশিত :  ১১:২০, ০৮ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
সর্বশেষ আপডেট: ১১:৫০, ০৮ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

রেজুয়ান আহম্মেদ

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে নিপীড়ন ও দমন-পীড়নের গল্প নতুন নয়। তবে আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে এমন এক নির্যাতনের পদ্ধতি চালু হয়েছিল, যা মানুষের মনে গভীর আতঙ্কের ছাপ ফেলে গিয়েছে— "আয়না ঘর"। এটি ছিল এক ভয়ংকর জায়গা, যেখানে বন্দিদের শুধু শারীরিকভাবেই নয়, মানসিকভাবেও ভেঙে ফেলার জন্য এক বিভীষিকাময় ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছিল।

এই আয়না ঘর ছিল এক ধরনের মানসিক নির্যাতন কেন্দ্র, যেখানে বন্দিদের চারপাশের দেয়ালে শুধু আয়না ছিল। দিনের পর দিন সেখানে বন্দিরা নিজেদের প্রতিবিম্ব দেখতে বাধ্য হতো, নিজের অস্তিত্ব নিয়ে সন্দেহ করতে বাধ্য হতো। সেখানে কাউকে সরাসরি হত্যা করা হতো না, তবে এমন এক মানসিক চাপ সৃষ্টি করা হতো, যা একজন মানুষকে আস্তে আস্তে ভেতর থেকে মেরে ফেলতে পারত।

এই লেখায় আমরা আয়না ঘরের ভয়াবহ বাস্তবতা, সেখানে নির্যাতিত মানুষদের অভিজ্ঞতা এবং এর সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব নিয়ে আলোচনা করব।

আয়না ঘরের উৎপত্তি ও নির্যাতনের ধরন

একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের দায়িত্ব জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কিন্তু যখন কোনো সরকার ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে ভয়ভীতি ও নিপীড়নকে হাতিয়ার বানায়, তখন মানবাধিকারের লঙ্ঘন চরম আকার ধারণ করে।

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিরোধী দলের কর্মী, সাংবাদিক, ছাত্রনেতা কিংবা সাধারণ মানুষ— যেকোনো ব্যক্তিকে রাতের আঁধারে তুলে নিয়ে যাওয়া হতো। যাদের নাম সরকারের ‘কালো তালিকায়’ চলে যেত, তাদের পরিণতি হতো ভয়াবহ। অনেকে গুম হয়ে যেত, আর যারা ফিরে আসত, তারা আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারত না। কারণ, তারা ছিল আয়না ঘরের বন্দি।

আয়না ঘরের অভ্যন্তরীণ নির্মাণ ও নির্যাতন পদ্ধতি

এই নির্যাতনকেন্দ্রটি ছিল একেবারে ভিন্ন। বন্দিদের এমন এক ঘরে রাখা হতো, যার চারপাশের দেয়ালে ছিল শুধু আয়না। কোনো জানালা থাকত না, বাইরের দুনিয়ার কোনো দৃশ্য দেখা যেত না। ঘরটিকে নিয়ন্ত্রণ করা হতো ভয়ংকর আলোর মাধ্যমে— কখনো অত্যন্ত উজ্জ্বল আলো জ্বালিয়ে চোখ ঝলসে দেওয়া হতো, আবার কখনো সম্পূর্ণ অন্ধকার করে ফেলা হতো।

বন্দিদের চোখ বাঁধা অবস্থায় সেখানে আনা হতো। তারপর হঠাৎ চোখ খুলে দেওয়া হতো, যাতে তারা নিজেদের প্রতিচ্ছবি দেখে বিভ্রান্ত হয়ে যায়।

এই কক্ষে বন্দিদের ওপর চালানো হতো অমানবিক নির্যাতন—

১. প্রচণ্ড ঠান্ডা বা অসহনীয় গরমের মধ্যে রাখা হতো,

২. টানা কয়েক দিন না ঘুমোতে দেওয়া হতো,

৩. নোংরা, দুর্গন্ধযুক্ত খাবার দেওয়া হতো,

৪. আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে আত্মসম্মানবোধ ধ্বংস করা হতো,

৫.কানের কাছে উচ্চশব্দ বাজিয়ে রাখা হতো, যাতে মানসিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়,

৬. পরিবারকে হত্যা করার হুমকি দেওয়া হতো,

৭. আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে বন্দিকে নিজেকেই মারতে বাধ্য করা হতো।

এই নির্যাতন এতটাই ভয়ংকর ছিল যে অনেকে কয়েক দিনের মধ্যেই দিশেহারা হয়ে যেত। তারা ভুলে যেত তারা কোথায় আছে, কতদিন ধরে বন্দি, এমনকি নিজের নামও মনে করতে পারত না।

মানসিক ধ্বংসের কৌশল

এই নির্যাতন ছিল সম্পূর্ণ পরিকল্পিত। কাউকে হত্যা না করেও তাকে জীবন্মৃত করে রাখা ছিল এর মূল উদ্দেশ্য।

বন্দিদের মানসিকভাবে ধ্বংস করার জন্য যেসব কৌশল ব্যবহার করা হতো—

 ১. মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করা: বন্দিদের বলা হতো, তাদের পরিবার মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, তাদের বন্ধুরা বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।

 ২. আয়নার মাধ্যমে বিভ্রম সৃষ্টি করা: বিশেষ আলোর সাহায্যে আয়নায় এমন প্রতিচ্ছবি দেখানো হতো, যাতে মনে হতো বন্দির শরীর বিকৃত হয়ে গেছে।

 ৩. সময় ও বাস্তবতার অনুভূতি ধ্বংস করা: বন্দিরা কতদিন ধরে বন্দি, সেটি বোঝার কোনো উপায় রাখত না। কখনো দিনের বেলা রাতের পরিবেশ তৈরি করা হতো, আবার কখনো রাতেও কৃত্রিম আলো জ্বালিয়ে রাখা হতো।

আয়না ঘর থেকে মুক্তি পেলেও মুক্তি নেই

যারা কোনোভাবে মুক্তি পেত, তারা আর কখনো স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারত না। কেউ মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলত, কেউ আত্মহত্যা করত, কেউ সারাজীবন আতঙ্কে কাটাত।

একজন ভুক্তভোগীর বর্ণনায়—

"আমি আয়না ঘর থেকে বের হওয়ার পরও আমার চারপাশের আয়নাগুলো কথা বলে। যখন ঘরে ঢুকি, মনে হয় আবার বন্দি হয়ে গেছি। আয়নায় নিজেকে দেখলে মনে হয়, আমি আর মানুষ নেই, আমি কেবল এক মৃতপ্রায় ছায়া।"

বন্দিদের সমাজও গ্রহণ করতে চাইত না। তারা ছিল ভয়, আতঙ্ক, ও মানসিক অবসাদের জীবন্ত প্রতীক।

রাজনৈতিক প্রভাব ও ভবিষ্যৎ শঙ্কা

এই নির্যাতন শুধু ব্যক্তি পর্যায়ে সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং এটি পুরো জাতির মনোবল ধ্বংসের জন্য ব্যবহৃত হয়েছিল।

 ১. প্রতিবাদের কণ্ঠ স্তব্ধ করা:

মানুষ সরকারের বিরুদ্ধে কিছু বলতে ভয় পেতে শুরু করল, কারণ তারা জানত এর মূল্য কী হতে পারে।

 ২. সাংবাদিকতা ধ্বংস করা:

সত্য প্রকাশ করলেই গুম হওয়ার ভয় ছিল। ফলে মিডিয়া একসময় সরকারের প্রচারযন্ত্রে পরিণত হলো।

 ৩. একটি ভীতসন্ত্রস্ত প্রজন্ম তৈরি করা:

তরুণদের শেখানো হলো— সত্য বললে, প্রতিবাদ করলে, তাদের পরিণতি হবে আয়না ঘরের বন্দিদের মতো।

আয়না ঘরের স্মৃতি মুছবে না

"আয়না ঘর" ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের এক ভয়ঙ্কর নিপীড়নযন্ত্র। এটি শুধু শারীরিক নির্যাতন নয়, ছিল নির্মম মানসিক নিপীড়নের কেন্দ্র।

হয়তো সেই ঘরগুলো আজ আর নেই, হয়তো সময় বদলাবে, কিন্তু সেই আয়নার প্রতিচ্ছবি বন্দিদের মনে চিরদিন থেকে যাবে।

কিন্তু ইতিহাস ভুলে গেলে, সেই আতঙ্ক আবার ফিরে আসতে পারে। তাই আমাদের দায়িত্ব হলো এই নির্মম সত্যের কথা সবাইকে জানানো, যাতে ভবিষ্যতে আর কেউ আয়না ঘরের বন্দি না হয়।

"যে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলাম, সেই আয়না আমি ভেঙে দিতে চাই।"




রেজুয়ান আহম্মেদ: কলামিস্ট, বিশ্লেষক; সম্পাদক অর্থনীতি ডটকম