img

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে হতাশা দূর করা জরুরি

প্রকাশিত :  ০৭:৩৮, ০৮ এপ্রিল ২০১৯

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে হতাশা দূর করা জরুরি
\r\nরায়হান আহমেদ তপাদার\r\n\r\nমানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশ৷ কিন্তু এই মানবিকতার কারণেই এখন নানা ঝুঁকিতে পড়েছে দেশটি৷ খুব সহসাই এ সংকটের সমাধান হবে না৷ ফলে সারাদেশে রোহিঙ্গাদের ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে, আছে নানা চ্যালেঞ্জও৷ রোহিঙ্গাদের মধ্যে আছে এইডস আক্রান্ত মানুষ৷ বাংলাদেশে এখন কলেরা না থাকলেও রোহিঙ্গাদের মধ্যে রয়েছে সেই সমস্যাও৷ বন উজার হচ্ছে, পাহাড় কেটে ধ্বংস করছে তারা৷ দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক ঝুঁকিও আছে এর সঙ্গে৷ আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যাও প্রকট হতে পারে, বাড়তে পারে নিরাপত্তা ঝুঁকিও৷ সব মিলিয়ে বাংলাদেশ এই সমস্যাগুলো কীভাবে মোকাবেলা করবে সেটা ঠিক করাই এখন একটা চ্যালেঞ্জ৷ বিশ্লেষকরা বলছেন, রোহিঙ্গাদের নিয়ে সরকারকে এবার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করতে হবে৷ না হলে দেশকে কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হতে পারে৷উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অদূরে অবসি’ত নৌকার মাঠের আধিপত্য বিসত্মারকে কেন্দ্র করে দুই রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গ্রম্নপের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ক্যাম্প ইনচার্জসহ পুলিশের একটি দল ঘটনাস’লে পৌঁছালে রোহিঙ্গারা তাঁদের উপর ইটপাটকেল নিড়্গেপ করে। আত্মরড়্গার্থে পুলিশ ৭/৮ রাউন্ড রাবার বুলেট ছুড়লে রোহিঙ্গারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে যায় রোহিঙ্গাদের মধ্যে সংঘর্ষ, খুনোখুনি নতুন কোন বিষয় নয়। তাঁরা এদেশে আশ্রয় নেয়ার পর থেকেই নানান রকম সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়েছে। তাঁরা নিজেদের মধ্যে খুনোখুনি এবং স্থানীয়দের সাথে সংঘর্ষে রোহিঙ্গা সহ স্থানীয় মানুষও খুন হয়েছে তাঁদের হাতে। \r\n\r\nউল্লেখ্য তাঁরা আমাদের দেশের আইন কানুন মানতে চায়না, তোয়াক্কা করতে চায় না বলেও পুলিশের অভিযোগ। তাঁরা এদেশে সুখে শান্তিতে বসবাস করলেও নিজেরাই সব সময় নিজেদের মধ্যে বিবাদ বিসম্বাদে জড়িয়ে পড়ছে। পাশাপাশি ছিনতাই, ডাকাতি, গুম, অপহরণ সহ নানা অপরাধ কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়েছে বলেও জানা যায়।তাদের স্থানীয় অধিবাসীদের কারণে স্থানীয় অধিবাসীরা নানা সঙ্কটের মধ্যে দিন যাপন করছে। কাজের অভাব হচ্ছে, নিত্যব্যবহার্য পণ্যদ্রব্যের দাম বেড়েছে। সুপেয় এবং ব্যবহার্য পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় পানির অভাব দেখা দিয়েছে। স্থানীয় নিম্নবিত্তদের জ্বালানি কাঠের অভাব দিন দিন তীব্রতর হচ্ছে। রোহিঙ্গারা বিভিন্ন ত্রাণসামগ্রী বিক্রি করার ফলে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা লোকসান গুনছে। মোটা দাগে বলতে গেলে স্থানীয় অধিবাসীরা বিরাট সংখ্যক রোহিঙ্গাদের চাপের কাছে যেন সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন দাতা ও সেবা সংস্থাগুলো রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বিভিন্ন ধরণের, অনেকড়্গেত্রে একাধিক দাতা সংস্থা প্রয়োজনের তুলনায় একই ধরণের অতিরিক্ত ত্রাণ সামগ্রী দিচ্ছে।ফলে বিভিন্ন কেনাকাটার জন্য তাঁদের নগদ টাকার প্রয়োজনে তারা ত্রাণসামগ্রী বাজারে বিক্রি করে দিচ্ছে। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় কেউই তাঁদের রান্নার জন্য জ্বালানির ব্যবস্থা করছে না। প্রতি মাসে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য ৬ হাজার ৮০০ টন জ্বালানি কাঠের প্রয়োজন হয় বলে জানা যায়। এরা এসব জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ বাংলাদেশের বনাঞ্চল ধ্বংস করে। কক্সবাজার শিবিরে বাসস্থানচ্যুত রোহিঙ্গারা গাদাগাদি করে আছে। ফলে সেখান থেকে ভাসানচরে তাঁদেরকে স্থানান্তরে আপত্তি জানিয়ে আসছিলো জাতিসংঘ। এদিকে তাঁরা আবার জানিয়েছে যে, ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরে তাদের আপত্তি নেই তবে তাদের জোর করে পাঠানো যাবে না। \r\n\r\nরোহিঙ্গারা স্বেচ্ছায় যেতে চাইলে যাবে অন্যথায় নয়। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী এ কে এম মোজাম্মেল হক গত ১৩ মার্চ’১৯ আইনশৃঙ্খলা বিষয়ক এক বৈঠকের পর জানিয়েছেন, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় কোথায় হবে সেটি বাংলাদেশের নিজস্ব বিষয়। বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে তাঁদেরকে আশ্রয়, নিরাপত্তা ও খাদ্য দেয়া, মানবিক আচরণ, শিক্ষা ও চিকিৎসার মতো মৌলিক চাহিদাগুলো নিশ্চিত করা। এখানে জাতিসংঘের উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। তাঁদের দেখার বিষয় মানবিক দিকগুলোর কোন ঘাটতি আছে কিনা। তিনি অভিযোগের সুরে বলেন, এ পর্যনত্ম দাতা সংস্থাগুলোর কর্তাদের হোটেল বিল বাবদ হয়েছে দেড়শ কোটি টাকা সে হিসেবে রোহিঙ্গাদের পেছনে ২৫ শতাংশও খরচ করা হয়না বরং কর্মকর্তাদের তদারকিতেই ৭৫ ভাগের বেশি অর্থ তাঁরা ব্যয় করছে যা খুব দুঃখজনক। এখানে অনেক এনজিও কাজ করছে তবে তাঁদের কিছু সংখ্যক এনজিও অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করছে যা আমাদের গোয়েন্দা রিপোর্টেও উঠে এসেছে বলে মন্ত্রী জানান। ভাসানচরের আশ্রয় শিবিরের রোহিঙ্গাদের রাখার জন্য সকল প্রসত্মুতি প্রায় সমাপ্ত করা হয়েছে বলে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন আগামী ১৫ এপ্রিলের আগে পড়ে যে কোন সময়ে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের কাজ শুরম্ন হতে পারে। রোহিঙ্গাদের অতি দ্রম্নত ভাসানচরে স্থানান্তরের ব্যাপারে সরকারের সর্বোচ্চ চেষ্টা রয়েছে বলে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী সাংবাদিকদের অবহিত করেন।এ পর্যন্ত ৮ লাখ ৭২ হাজার ৮৮০ জন রোহিঙ্গা বনাঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছে। রোহিঙ্গাদের জন্য ২ লাখ ১২ হাজার ৬০৭ টি গোসলখানা,ত্রাণ সংরক্ষণের জন্য ২০ টি অস্থায়ী গুদাম, ১৩ কিলোমিটার বিদ্যুতের লাইন, ৩০ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ এবং ২০ কিলোমিটার খাল খনন করা হয়েছে। \r\n\r\nবিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক একটি অবকাঠামো তৈরি করবে। এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার বনভূমি ও বনজ সম্পদ পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাবে। এ ছাড়া রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে গেলেও জায়গা জবরদখল হয়ে যেতে পারে এবং স্থাপনাগুলো অপসারণ করে বনায়ন করা কঠিন হবে এমতাবস্তায়, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দিয়ে, মানবিকতা, সহানুভূতি, মহানুভবতা, উদারতার উজ্জ্বল দৃষ্টানত্ম সৃষ্টি করার পাশাপাশি সমসাময়িক সময়ে একমাত্র বাংলাদেশই বিরাট সংখ্যক শরণার্থী আশ্রয় দিয়ে সারা বিশ্বে মর্যাদা, সুনাম, খ্যাতি অর্জন করলেও বাংলাদেশ এখন নিজেই মানবিক, সামাজিক, নৈতিক, আর্থ সামাজিক, প্রাকৃতিক, পরিবেশ বিপর্যয়ের ভয়াবহ, ভয়ংকর সঙ্কটের মুখোমুখি। বাংলাদেশের উন্নয়নের অব্যাহত অগ্রযাত্রা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর চাপে পিষ্ট, ভুলুণ্ঠিত হওয়ার সমূহ আশঙ্কা করছেন রাষ্ট্র ও সমাজ বিজ্ঞানীসহ অপরাধ ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা দেশ ও জাতির গভীর প্রত্যাশা জাতিসংঘ বাস’চ্যুত রোহিঙ্গাদের তাঁদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে বিশ্বনেতৃবৃন্দকে নিয়ে যথাশীঘ্র সম্ভব বাস্তব সম্মত ও কার্যকর উদ্যোগ ও ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। অন্যথায় বাংলাদেশের সব অর্জন ধীরে ধীরে মস্নান হয়ে যেতে পারে। মায়ানমারে ফেরত যাওয়া বাসস্থানচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর নাগরিক এবং রাজনৈতিক অধিকার। মানুষের বেঁচে থাকার ন্যূনতম অধিকার কোন শাসকগোষ্ঠী কেড়ে নিতে পারে না। অথচ অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে মায়ানমারে মানবতার মৃত্যু ঘটেছে। মানুষ তাদের জন্মগত অধিকার হারিয়েছে। কোন সুস্থ মানুষ এমন মানবিক, নৈতিক বিপর্যয় আশা করে না। যত দিন যাচ্ছে, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন বিলম্বি হচ্ছে। \r\n\r\nজাতিসংঘ নানা কথা বললেও মিয়ানমারকে বাধ্য করার ব্যাপারে কোন কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। আনত্মর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অত্যাচারী সেনা সদস্যদের অভিযুক্ত করে শাসিত্ম দিতে না পারলে মিয়ানমারকে কাবু করা যাবে না। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতায় রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পুনর্বাসনে যথাসাধ্য করছে। ভাসানচরে প্রত্যাবাসন তারই একটি অংশ মাত্র। এই প্রচেষ্টায় আমরা জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার গোষ্ঠীসমূহের সমর্থন কামনা করি।পশ্চিমা দেশগুলো রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে বাংলাদেশকে রাজনৈতিক সমর্থন দিয়ে আসছে এবং মানবিক সহায়তাও দিচ্ছে। কিন্তু তাদের সঙ্গেও কিছুটা মতপার্থক্য আছে।সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যতের বিষয়ে পশ্চিমা দেশগুলো চায় বাংলাদেশে তাদের ওপর বিনিয়োগ করতে যাতে মানবসম্পদের উন্নতি করা যায়। কিন্তু সরকার চায় এই বিনিয়োগ রাখাইনে করার জন্য, যাতে করে তারা ফেরত গিয়ে সেখানে সুন্দর জীবনযাপন করতে পারে।একজন কর্মকর্তা বলেন,আমরা সবাই চাই রোহিঙ্গাদের নিরাপদ এবং সম্মানজনক প্রত্যাবাসন। কিন্তু কয়েকটি বিষয়ে তাদের ওপর আমাদের মতপার্থক্য আছে এবং আমরা চেষ্টা করছি কীভাবে একটি কমপ্রোমাইজে পৌঁছানো যায়। তিনি বলেন,যুক্তরাষ্ট্র আমাদের সবর্তোভাবে সহায়তা করছে এবং আমরা চাই তারা জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে আরও বলিষ্ঠ ভূমিকা গ্রহণ করুক।এদিকে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের তৃতীয় দেশে স্থানান্তরের (রিলোকেট) বিষয় নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের মিডিয়ার অপপ্রচারণা নিয়ে বিরক্ত। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রাক্কলন অনুসারে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাংলাদেশে মাথাপিছু আয় ছিল ১ হাজার ৬০২ মার্কিন ডলার৷ সেই হিসাবে এই ৭ লাখ রোহিঙ্গার মাথাপিছু আয় হওয়ার কথা ১১২ কোটি ডলার বা ৮ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা৷ \r\n\r\nকিন্তু আশ্রিত হিসেবে রোহিঙ্গাদের আয়ের কোনো উৎস নেই৷ জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু ব্যয় প্রায় ৭০০ ডলার৷ কিন্তু রোহিঙ্গাদের ব্যয় থাকলেও বৈধপথে আয়ের কোনো উৎস নেই৷ সেই হিসাবে এই ৭ লাখ রোহিঙ্গার  পেছনে সরকারের বছরে ব্যয় হবে প্রায় ৪৯ কোটি ডলার বা ৩ হাজার ৯৯২ কোটি টাকা, যা অর্থনীতির চাকা সচল রাখার ক্ষেত্রে একটি বড় প্রতিবন্ধকতা৷ বর্তমানে কিছু সাহায্য সহযোগিতা পাওয়া গেলেও দীর্ঘমেয়াদি এই সাহায্য অব্যহত থাকবে সেটা বলা মুশকিল৷ যখন পাওয়া যাবে না তখন বাংলাদেশকেই এই টাকা খরচ করতে হবে৷ রোহিঙ্গাদের কারণে বাংলাদেশ বড় ধরনের আর্থিক চাপে পড়তে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞমহল।কারণ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পেছনে বাড়তি মনোযোগ দিতে হয়৷ সেজন্য সেখানে পুলিশ, সেনাবাহিনী, বিজিবিসহ বিভিন্ন বাহিনীর লোকজন নিয়োগ করতে হয়েছে৷ এর ফলে রাষ্ট্রীয় ব্যয় বাড়ছে৷ আর এই ব্যয়টা খরচ হচ্ছে বাজেট থেকে৷ অথচ রোহিঙ্গা সমস্যা না থাকলে এই টাকা অন্য জায়গায় ব্যয় করা যেত৷ সেটা করা গেলে দেশের কিছু মানুষ তো অন্তত ভালো থাকত!।\r\n                                    লেখক ও কলামিস্ট 

মতামত এর আরও খবর

img

গাজা যুদ্ধ বন্ধে বাইডেন কেন এতটা মরিয়া

প্রকাশিত :  ১১:৪১, ১২ মে ২০২৪
সর্বশেষ আপডেট: ১১:৪৮, ১২ মে ২০২৪

জনাথন ফ্রিডল্যান্ড

দ্বিতীয় দফায় নির্বাচিত হবেন কি না তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের উদ্বেগ একেবারে প্রান্তে এসে পৌঁছেছে। জো বাইডেনের পরামর্শ বারবার উপেক্ষা করে আসছিলেন বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। এই উপেক্ষার মূল্য কী হতে পারে, এই সপ্তাহে ইসরায়েল সেটা দেখতে পেল।

ইসরায়েলের ৩ হাজার ৫০০ বোমার চালান আটকে দিয়েছে বাইডেন প্রশাসন। এই অস্ত্র ইসরায়েল গাজার দক্ষিণের শহর রাফা আক্রমণে ব্যবহার করবে, সেই বিবেচনায় অস্ত্রের চালানটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। রাফায় এখন ১০ লাখের বেশি শরণার্থীর আশ্রয়শিবির।

ইসরায়েলের প্রতি জো বাইডেন তাঁর ‘লৌহদৃঢ়’ সমর্থন থেকে সরে আসছেন না। কিন্তু ইসরায়েল রাফা হামলার জন্য যে হুমকি দিয়ে চলেছে, সেটা সফল করতে অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করবেন না। সিএনএনকে বাইডেন বলেছেন, ‘ইসরায়েলের নিরাপত্তা দেওয়া থেকে আমরা সরে আসছি না। অন্যখানে যুদ্ধ করার সক্ষমতা তৈরির পথ থেকে সরে আসছি আমরা।’

ইসরায়েলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিত্র যুক্তরাষ্ট্র। ইসরায়েলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী আইজাক রবিন বলতেন, তাঁর দেশের ১ নম্বর কৌশলগত সম্পদ এই সব অস্ত্র, এমনকি পারমাণবিক অস্ত্র নয়; বরং ওয়াশিংটনের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক। দশকের পর দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় অস্ত্রের জোগানদাতা ও কূটনৈতিক অভিভাবক। 

কিন্তু মাত্র ছয় সপ্তাহের ব্যবধানে ওয়াশিংটন এমন দুটি পদক্ষেপ নিল, যা পুরোপুরি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গেল। গত মার্চ মাসে নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ভেটো দেওয়া থেকে বিরত থাকে যুক্তরাষ্ট্র। ফলে ইসরায়েল প্রস্তাবটি আটকে দিতে চাইলেও ব্যর্থ হয়। আর এখন তো ওয়াশিংটন অস্ত্রের চালান আটকে দিল।

এর থেকেও বড় বিষয় হলো, এই সিদ্ধান্তগুলো এমন একজন রাজনীতিবিদ নিয়েছেন, যিনি ব্যক্তিগতভাবে ইসরায়েলের খুব নিবেদিতপ্রাণ সমর্থক। বাইডেন সেই যুগের একজন ডেমোক্র্যাট, যখন দুই সহস্রাব্দের নির্বাসন ও শাস্তির পর মধ্যপ্রাচ্যে ইহুদিদের আদি বাড়ি প্রতিষ্ঠার বিষয়টি গতি পেতে শুরু করেছে। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের উদারপন্থীদের চোখ তখন রহস্যজনকভাবে বন্ধ ছিল।  

গোল্ডা মেয়ার থেকে শুরু করে ইসরায়েলের প্রত্যেক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বাইডেন দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে। ইসরায়েলের প্রতি বাইডেনের টান বাড়ার ক্ষেত্রে এর একটার ভূমিকা আছে। পূর্বতন প্রেসিডেন্টদের মতো বাইডেনের ইসরায়েলের প্রতি ভ্রাতৃত্ববোধ শুধু নির্বাচনী হিসাব-নিকাশের বিষয় নয়।  

গাজা নিয়ে কোনো চুক্তি হচ্ছে না। কেননা, নেতানিয়াহু কিংবা সিনাওয়ারা কেউই বিশ্বাস করেন না, চুক্তি করলে তাঁদের স্বার্থ রক্ষিত হয়। যেমনটা যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক কর্মকর্তা অ্যারন ডেভিড মিলার বলেছেন, ‘এই সংঘাত বন্ধে একটি পক্ষেরই কেবল সত্যিকারের তাড়া আছে, সেই পক্ষটি হলেন জো বাইডেন।’

অন্যদিকে ১৯৮০-এর দশকে নেতানিয়াহু প্রথম আলোচনার পাদপ্রদীপে উঠে আসেন। তিনি এমন একজন কূটনীতিক, যিনি আমেরিকানদের সঙ্গে সাবলীলভাবে কথা বলতেন। সে সময় থেকেই তিনি নিজেকে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে দাঁড় করান। ইসরায়েলের একজন হবু নেতার জন্য এই দক্ষতা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। 

কয়েক দশক ধরে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তাঁর ভোটারদের এই বার্তা দিয়ে আসছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের মধ্যকার সব ধরনের গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ক্ষেত্রে তিনিই একমাত্র বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তি।

কিন্তু বাস্তব অবস্থাটা এখন কী দাঁড়াল?  চার দশকের বেশি সময়ের মধ্যে বাইডেনই প্রথম প্রেসিডেন্ট যিনি ইসরায়েলকে সামরিক সহায়তা দেওয়া বন্ধ করলেন। (১৯৮২ সালে ইসরায়েলের লেবানন অভিযানের সময় রোনাল্ড রিগ্যান যুদ্ধবিমান দিতে বিলম্ব করেছিলেন।) বাইডেন কেন এটা করলেন? কারণ, নেতানিয়াহু যুক্তরাষ্ট্রের একটি অংশের জনগোষ্ঠীর মধ্যে এমন তিক্ততা তৈরি করেছেন, যেটা আগে দেখা যায়নি।

ইসরায়েলের প্রতি যে যুক্তরাষ্ট্রের সমাজের নিরেট সমর্থন, তাতে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যেভাবে ছাত্র আন্দোলন আছড়ে পড়েছে, সেটা বিস্ময়করই। আন্তর্জাতিক জরিপ সংস্থা গ্যালাপের মার্চ মাসের জরিপ বলছে, ৫১ শতাংশ ইসরায়েলের পক্ষে সমর্থন দিয়েছে, ২৭ শতাংশ সমর্থন দিয়েছে ফিলিস্তিনের পক্ষে। কিন্তু ডেমোক্র্যাট ও তরুণ জনগোষ্ঠী—দুই ক্ষেত্রেই ফিলিস্তিনিদের পক্ষে সমর্থন অনেকটাই বেড়েছে।

জরিপের এই তথ্য বাইডেন ও তাঁর নির্বাচনী প্রচারণা দলকে চিন্তার মধ্যে ফেলেছে। এই অংশের দ্ব্যর্থহীন সমর্থনই ২০২০ সালের নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে পরাজিত করতে ভূমিকা রেখেছিল। গাজাবাসীর দুর্ভোগ সেই ভোটারদের সমর্থন অনিশ্চিত করে তুলেছে। হোয়াইট হাউস নেতানিয়াহুর কাছে পরিকল্পনা চেয়েছিলেন, বেসামরিক জনসাধারণকে হতাহত না করে কীভাবে রাফায় অভিযান করতে পারে ইসরায়েল। 

কিন্তু নেতানিয়াহু সেই পরিকল্পনা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। সেই কারণে ইসরায়েলকে থামানোর জন্য অস্ত্রের চালান আটকে দেওয়ার সরাসরি পথ বেছে নিয়েছে ওয়াশিংটন।

রাফা বাইডেনের জন্য শক্তি পরীক্ষার জায়গাও হয়ে উঠেছে। বাইডেন রাফাকে বিপদরেখা হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন। নেতানিয়াহু যদি সেই বিপদরেখা অতিক্রম করেন, তাহলে বাইডেন দুর্বল হিসেবে চিহ্নিত হবেন।

কিন্তু নেতানিয়াহু এখন পর্যন্ত রণেভঙ্গ দিতে অস্বীকার করেছেন। ইসরায়েলের স্বাধীনতা আন্দোলনকে সামনে রেখে জনগণের উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র ছাড়া আমরা একাই লড়ে যাব। প্রয়োজনে আমরা আমাদের নখ দিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাব।’ 

নেতানিয়াহু চার্চিলের মতো আওয়াজ তুলতে চাইছেন। কিন্তু তাঁর কথাগুলো দুর্বলের কণ্ঠস্বর, সবলের নয়। ওয়াশিংটন চায়, নেতানিয়াহু যেন রাফা অভিযান থেকে সরে আসেন। কিন্তু জোট সরকারের অতি ডানপন্থী মিত্ররা তাঁকে আরও কঠোর হতে বলছেন, রাফা অভিযানের মাধ্যমে হামাসের বিরুদ্ধে পুরোপুরি বিজয়ের জন্য বলছেন।

এই নিরানন্দ নাটকে বাইডেন ও নেতানিয়াহুই কেবল কুশীলব নন; হামাস নেতা ইয়াহিয়া সিনাওয়ারেরও নিজস্ব হিসাব-নিকাশ আছে, নেতা হিসেবে টিকে থাকার সংকল্প রয়েছে। খুব ঘনিষ্ঠভাবে যাঁরা সিনাওয়ারকেও পাঠ করেছেন তাঁরা বিশ্বাস করেন, নির্দোষ মানুষের জীবন রক্ষা করা তাঁর অগ্রাধিকার নয়; বরং যত বেশি গাজাবাসী নিহত হবেন, আন্তর্জাতিক পরিসরে তাঁর শত্রু ইসরায়েলে অবস্থান ততই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সেই পরিস্থিতি তাঁকে বিজয়ী দাবি করতে সহায়তা করবে। সম্প্রতি হামাস যুদ্ধবিরতি চুক্তি মেনে নেওয়ার ঘোষণার পেছনে সিনাওয়ারের এই ভাবনায় কাজ করেছে। 

সিনাওয়ারা সাময়িক কোনো যুদ্ধবিরতি (তাতে অনেক মানুষের প্রাণরক্ষা হয়, দুর্ভোগ কমে) চান না, তিনি চান স্থায়ী যুদ্ধবিরতি। আর তার জন্য সিনাওয়ারা অপেক্ষা করতেও রাজি।

গাজা নিয়ে কোনো চুক্তি হচ্ছে না। কেননা, নেতানিয়াহু কিংবা সিনাওয়ারা কেউই বিশ্বাস করেন না, চুক্তি করলে তাঁদের স্বার্থ রক্ষিত হয়। যেমনটা যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক কর্মকর্তা অ্যারন ডেভিড মিলার বলেছেন, ‘এই সংঘাত বন্ধে একটি পক্ষেরই কেবল সত্যিকারের তাড়া আছে, সেই পক্ষটি হলেন জো বাইডেন।’


জনাথন ফ্রিডল্যান্ড, ব্রিটিশ গণমাধ্যম গার্ডিয়ানের খ্যাতিমান কলামিস্ট

মতামত এর আরও খবর