img

বেকারদের ওপর করের বোঝা: আবেদনের ওপর মূসক বাতিল করা হোক

প্রকাশিত :  ১০:০০, ২৭ আগষ্ট ২০২৩

বেকারদের ওপর করের বোঝা: আবেদনের ওপর মূসক বাতিল করা হোক

সরকার পরিচালনার জন্য প্রচুর টাকার দরকার, এই কথা কেউ অস্বীকার করবে না। জাতীয় রাজস্ব বিভাগ বিভিন্ন সূত্র থেকে এই টাকা আদায় করে থাকে। যেমন নাগরিকের আয়, সম্পত্তি, ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর তারা কর ধার্য করে। তাই বলে চাকরিপ্রার্থীদের ওপরও বাড়তি করের বোঝা চাপিয়ে দিতে হবে?

১৭ আগস্ট অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের এক প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়, চাকরির আবেদনের ক্ষেত্রে মোবাইল অপারেটরের কমিশনের ওপর মূসক বা ভ্যাটের হার হবে ১৫। সাধারণত অনলাইনে আবেদন করা হয় সরকারি মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটর টেলিটকের মাধ্যমে। নিয়ম হলো, টেলিটক আবেদন ফির সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ কমিশন হিসেবে নিতে পারবে।

নবম গ্রেডের একটি চাকরির আবেদন ফি ৬০০ টাকা। এ ক্ষেত্রে টেলিটকের কমিশন হবে ৬০ টাকা। এই ৬০ টাকার ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ হবে, যার পরিমাণ ৯ টাকা। সব মিলিয়ে চাকরিপ্রার্থীর ব্যয় হবে ৬৬৯ টাকা। ভ্যাট আরোপের আগে বাড়তি ৯ টাকা লাগত না।

চাকরিপ্রার্থীরা আবেদন ফি কমানোর দাবিতে আন্দোলন করে আসছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন ক্যাম্পাসে তাঁরা মানববন্ধন করেছেন। একমাত্র বাংলাদেশ ব্যাংক ছাড়া কেউ আবেদন ফি কমায়নি। এখন সেই আবেদন ফির ওপর ভ্যাট আরোপ অনেকটা মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের শামিল।

সরকারের এই সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়ায় সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের টাকা সংগ্রহ বা আয়ের অনেক উৎস আছে। এই খাত থেকে ভ্যাট না নিয়ে সরকার তরুণদের প্রতি কিছুটা মানবিক আচরণ করতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হানও চাকরিপ্রত্যাশীদের কাছ থেকে মূসক না নিলে ভালো হতো বলে মন্তব্য করেছেন।

একজন চাকরিপ্রার্থীর জন্য একবারের আবেদনে ৯ টাকা দেওয়া হয়তো বেশি নয়, কিন্তু একজন চাকরিপ্রার্থীকে চাকরি পেতে বহুবার আবেদন করতে হয়। প্রথম আলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, একজন চাকরিপ্রার্থী ৬০ বার আবেদন করে চাকরি পেয়েছেন। সে ক্ষেত্রে তাঁর বাড়তি খরচটি একেবারে কম নয়।

এর বাইরে চাকরির পরীক্ষার জন্য একজন প্রার্থীকে বাড়ি থেকে চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানে যাওয়ার খরচও জোগাতে হয় টিউশনি কিংবা অভিভাবকের কাছ থেকে টাকা এনে। সে ক্ষেত্রে একজন চাকরিপ্রার্থীর জন্য ভ্যাটের বাড়তি বোঝা অমানবিকই বটে।

সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব যাদের মানবিক হতে বলেছেন—রাজস্ব বিভাগ, চাকরিপ্রার্থীদের প্রতি মানবিক না হয়ে যাঁরা সরকারের কোটি কোটি টাকা কর ফাঁকি দেন, তাঁদের প্রতিই অতি মানবিক আচরণ করে থাকে। কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য হলো যাঁর আয় বেশি, তাঁর কাছ থেকে বেশি কর আদায় করা। 

আর যাঁর আয় নেই, রাষ্ট্রীয় উদ্যোগেই তাঁর ন্যূনতম চাহিদাগুলো পূরণ করা। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই অনেক রাষ্ট্র বেকার ভাতা দিয়ে থাকে। কিন্তু আমাদের রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকেরা তেলা মাথায় তেল দেওয়ার নীতিকেই শ্রেয় বলে মনে করেন।

এই প্রেক্ষাপটে আমাদের দাবি, অর্থ বিভাগের ১৭ আগস্টের প্রজ্ঞাপনটি বাতিল করে চাকরিপ্রার্থীদের বাড়তি করের বোঝা থেকে রেহাই দেওয়া হোক। সেই সঙ্গে চাকরিপ্রার্থীদের আবেদন ফি যথাসম্ভব আরও কমানো হোক। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারলে অন্যরা কেন পারবে না?

img

ভারত-শ্রীলঙ্কা স্থলসংযোগ: স্বপ্ন না বাস্তবতা?

প্রকাশিত :  ০৬:৫৪, ২২ এপ্রিল ২০২৫
সর্বশেষ আপডেট: ০৭:০৮, ২২ এপ্রিল ২০২৫

ভারতের পরিবেশ বিষয়ক থিংক ট্যাংঙ্ক Urbanacres অবলম্বনে

সাইফুল খান

দুই দশকের পুরনো এক স্বপ্ন আবারও উঠে এসেছে দক্ষিণ এশিয়ার কূটনৈতিক আলোচনায়। ভারত চায়, পক প্রণালী পেরিয়ে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে একটি সড়ক ও রেলপথ নির্মাণ করতে। একটি স্থায়ী স্থলসেতু, যা দক্ষিণ এশিয়ার সংযোগকে এক নতুন মাত্রায় নিয়ে যাবে। তবে শ্রীলঙ্কা যেন এবার একটু ভিন্ন পথে হাঁটছে। স্বপ্ন নয়, বাস্তবতা দিয়েই তারা মূল্যায়ন করছে প্রস্তাবটি।

কলম্বোর সিদ্ধান্ত-নির্মাতারা এখন অনেক বেশি সতর্ক। সরকারের অবকাঠামো ও পরিবহন পরিকল্পনা বিভাগের বিশেষজ্ঞরা খোলাখুলিভাবে জানিয়েছেন, “এই মুহূর্তে প্রকল্পটি বাস্তবায়নযোগ্য নয়।” শুধু কারিগরি দিক নয়, তারা তুলেছেন প্রকল্পটির পরিবেশগত ক্ষতি, আর্থিক ভারসাম্য এবং ভূ-রাজনৈতিক জটিলতার প্রশ্ন।

বিশেষ করে গালফ অব মান্নার বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ ও রাম সেতু এলাকা নিয়ে শ্রীলঙ্কার উদ্বেগ স্পষ্ট। ঐ অঞ্চলের প্রবাল প্রাচীর, মাছের প্রজননক্ষেত্র ও পরিযায়ী পাখির আবাসস্থল এই সেতুর কারণে বিপন্ন হতে পারে। আঞ্চলিক জীববৈচিত্র্য রক্ষার যাত্রায় এটি হবে এক বড় ধরনের ধাক্কা এবং এ নিয়ে জনসচেতনতা বাড়ছে, যা ভবিষ্যতে প্রবল জনমতেও রূপ নিতে পারে।

আরেকটি বড় প্রশ্ন উঠেছে অর্থনীতি নিয়ে। এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা সরাসরি বলেছেন, “দেশ এখনো অর্থনৈতিক সংকট থেকে পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়ায়নি। এই মুহূর্তে বড় পরিসরের বিদেশনির্ভর প্রকল্প গ্রহণ মানে ভবিষ্যতের ঝুঁকি বয়ে আনা।”

অন্যদিকে, নয়াদিল্লির স্বপ্ন কিন্তু আঞ্চলিক সংযোগের এক বড় ক্যানভাসে আঁকা। BIMSTEC-এর আওতায় ভারত এমন একটি যোগাযোগব্যবস্থা চায়, যা সড়ক ও রেলপথ দিয়ে শ্রীলঙ্কাকে যুক্ত করবে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে। এতে নাকি বাণিজ্য, পর্যটন ও কার্বনমুক্ত পরিবহন নতুন গতি পাবে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় সমুদ্রের উপর দিয়ে কংক্রিট আর স্টিলের সেতু তৈরি করে পরিবেশবান্ধব লক্ষ্য কীভাবে অর্জিত হবে?

ইতিহাস বলছে, এটাই প্রথম নয়। ২০০০-এর দশকে একবার এমন প্রস্তাব উঠে এসেছিল। তখনও রাজনৈতিক ঐকমত্যের অভাবে তা আলোর মুখ দেখেনি। ২০২৩ সালে শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রপ্রধান নয়াদিল্লি সফরে গেলে যৌথ বিবৃতিতে সংযোগ সহযোগিতার কথা উঠেছিল, কিন্তু বাস্তব অগ্রগতি হয়নি।

তবে এবার প্রেক্ষাপট আরও জটিল। ভারত মহাসাগরে চীনের প্রভাব দিন দিন বাড়ছে। বন্দর নির্মাণ, নৌ অবকাঠামোতে বিনিয়োগ আর কৌশলগত অবস্থান নিয়ে চীন এখন এক গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়। শ্রীলঙ্কা তাদের কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন ধরে রাখতে চায়। ফলে, ভারতের সঙ্গে স্থলসংযোগ মানে শুধু প্রযুক্তিগত নয়, রাজনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার বিষয়ও।

তবে এই স্থগিত সিদ্ধান্তকে ‘প্রত্যাখ্যান’ হিসেবে দেখা ভুল হবে। বরং শ্রীলঙ্কার এই অবস্থান একটি পরিণত কূটনৈতিক অবস্থান।যেখানে স্বল্পমেয়াদী সুবিধার চেয়ে দীর্ঘমেয়াদী পরিবেশগত ভারসাম্য ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

ভারতও বুঝে গেছে, শুধু সেতু নয়, প্রয়োজন ‘আস্থা’র সেতু। তাই তারা এখন বিকল্প পথ খুঁজছে।যেমন- নতুন ফেরি সার্ভিস, সবুজ নৌ পরিবহন করিডোর বা পরিবেশবান্ধব বিমান চলাচল।

অবশেষে একটাই কথা বলা যায়।সংযোগ মানেই কংক্রিট আর স্টিলের সেতু নয়। সংযোগ মানে প্রেক্ষাপট, পরিকল্পনা ও পারস্পরিক সম্মান। আর এখন, ভারত-শ্রীলঙ্কার মধ্যে সেই ‘ভবিষ্যতের সেতু’ গড়ার অপেক্ষা রয়ে গেল।যেদিন পরিবেশ, অর্থনীতি ও ভূ-রাজনীতি একসাথে সবুজ সংকেত দেবে।

সর্বোপরি শ্রীলঙ্কা ভারতের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে খুবই সচেতনভাবে পদক্ষেপ নিতে চাচ্ছে। যা ভারতের কৌশলগত রাজনীতিকে প্রভাবিত করবে।


সাইফুল খান: ইতিহাস, রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশ্লেষক।