img

জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের ত্রিমুখী সংকট

প্রকাশিত :  ০৯:৫৭, ১২ এপ্রিল ২০১৯
সর্বশেষ আপডেট: ০৬:৫০, ১৬ এপ্রিল ২০১৯

 জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের ত্রিমুখী সংকট

মশিউল আলম

একসঙ্গে তিন ফ্রন্টে আক্রমণ শুরু হয়েছে উইকিলিকস ও জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে। এক. অব্যাহত হত্যা-অপহরণের হুমকি ও উসকানির মধ্যে সুইডেনে তথাকথিত যৌন অপরাধের অভিযোগে তাকে লন্ডনে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। দুই. পৃথিবীর কোনো স্থান থেকেই যেন উইকিলিকস ওয়েবসাইটে ঢোকা না যায়, অর্থাৎ তথ্যমহাসড়ক থেকে উইকিলিকসকে সম্পূর্ণ বিতাড়ন করার সর্বাÍক চেষ্টা চলছে। তিন. উইকিলিকসের অর্থায়নের সব উপায় ও অ্যাসাঞ্জের আর্থিক লেনদেন ব্যবস্থা বন্ধ করে দেওয়ার তৎপরতা প্রবল হয়ে উঠেছে।
২৮ নভেম্বর উইকিলিকস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক নথিপত্র প্রকাশ করার সঙ্গে সঙ্গে কানাডার প্রধানমন্ত্রীর সাবেক উপদেষ্টা টম ফ্ল্যানাগান সিবিসি টেলিভিশনে বলেন, জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে হত্যা করা উচিত। এ জন্য ওবামা প্রশাসনের উচিত খুনি ভাড়া করা অথবা ড্রোন ব্যবহার করা। যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান নেত্রী সারাহ পেলিন বলেছেন, আল-কায়েদা আর তালেবান সন্ত্রাসীদের ধরার জন্য আমেরিকা যেভাবে অভিযান চালায়, অ্যাসাঞ্জকে পাকড়াও করতে তেমন অভিযান শুরু করা উচিত। মার্কিন রক্ষণশীল রাজনীতি-বিশ্লেষক ও দি উইকলি স্ট্যান্ডার্ড সাপ্তাহিকের সম্পাদক বিল ক্রিস্টল লিখেছেন, ওবামা প্রশাসন যেন অ্যাসাঞ্জকে অপহরণ বা হত্যা করার কথা ভেবে দেখে। মার্কিন কংগ্রেসের সাবেক স্পিকার নিউইট গ্রিনগ্রিচ বলেছেন, অ্যাসাঞ্জ আমেরিকার শক্রসেনা। শক্রসেনাদের সঙ্গে যে রকম ব্যবহার করতে হয়, অ্যাসাঞ্জের সঙ্গেও তা-ই করা দরকার। বর্ষীয়ান রিপাবলিকান সিনেটর মাইক হিউক্যাবি বলেছেন, মৃত্যুদণ্ড ছাড়া অন্য যেকোনো শাস্তি হবে অ্যাসাঞ্জের জন্য লঘু দণ্ড। মার্কিন সিনেটের রিপাবলিকান নেতা মিচ ম্যাককনেল এনবিসি টিভির মিট দ্য প্রেস অনুষ্ঠানে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে একজন ‘হাইটেক টেররিস্ট আখ্যা দিয়ে বলেছেন, তিনি আশা করছেন, অ্যাসাঞ্জের বিচার করা হবে। মার্কিন কর্তৃপক্ষ অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে সে দেশের গুপ্তচরবৃত্তি-সংক্রান্ত আইন বা স্পাইয়োনেজ অ্যাক্টের অধীনে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ভাবছে। অ্যাসাঞ্জ স্পেনের এল পাইস পত্রিকার সঙ্গে এক অনলাইন সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, মার্কিন ‘মিলিটারি মিলিট্যান্টদের কাছ থেকে তিনি হত্যার হুমকি পাচ্ছেন শত শত; শুধু তাকেই নয়, তার ছেলে ও আইনজীবীদেরও নানা রকম হুমকি দেওয়া হচ্ছে। অ্যাসাঞ্জের ব্রিটিশ আইনজীবীরা গার্ডিয়ান পত্রিকাকে জানিয়েছেন, তাদের পেছনে গোয়েন্দা লেলিয়ে দেওয়া হয়েছে; গোয়েন্দারা সব সময় তাদের অনুসরণ করছেন। কিন্তু হত্যা, অপহরণ, বিচারের এসব হুমকিতে অ্যাসাঞ্জ মোটেও ঘাবড়াননি। এল পাইস পত্রিকাকে তিনি বলেছেন, এর আগে ইসলামি সন্ত্রাসবাদী আর আফ্রিকার দুর্নীতিবাজ সরকারগুলোর কাছ থেকে তিনি হত্যার হুমকি পেয়েছেন অজস্রবার।
তবে সুইডিশ কর্তৃপক্ষ যৌন অপরাধের অভিযোগে অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে নতুন করে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করার পর ইন্টারপোলকে দিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করানোর যে তৎপরতা কদিন ধরে চলল, তাতে তিনি একটু মুশকিলেই পড়েছেন। তিনি মনে করেন, সুইডেনকে তার পেছনে লেলিয়ে দিয়েছে মার্কিন কর্তৃপক্ষ। তাকে গা ঢাকা দিয়ে থাকতে হচ্ছে ব্রিটেনে। যদিও ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ এখন পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা দায়ের করেনি, সুইডেনের অভিযোগের কারণে ব্রিটিশ পুলিশ তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে চায়। মঙ্গলবার মঙ্গলবার লন্ডনে তিনি পুলিশের কাছে আÍসমর্পণ করলে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। একদিন আগেই তার আইনজীবীরা গার্ডিয়ানকে জানিয়েছিলেন, তিনি পুলিশের মুখোমুখি হবেন। এখন, গ্রেপ্তারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে একটি ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে হাজির হয়ে তার জামিনের আবেদন করার কথা। অ্যাসাঞ্জ তা-ই করবেন, এ সিদ্ধান্ত দুই দিন আগেই নিয়েছেন, সে জন্য সমর্থকদের জামিনদার হওয়ার আহ্বানও জানিয়েছেন। আদালত তার জামিন মঞ্জুর করতে পারেন, না-ও পারেন; উভয় ক্ষেত্রে তাকে সুইডিশ কর্তৃপক্ষের কাছে প্রত্যর্পণ মামলার শুনানির জন্য ২৮ দিন সময় থাকবে।
উইকিলিকসকে নিয়ে কারিগরি চ্যালেঞ্জটা কঠিন। যে প্রযুক্তির সাহায্যে এই হাটে-হাঁড়ি-ভাঙা ওয়েবসাইটটি বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মানুষ দেখতে-পড়তে পারে, তার প্রধান অবকাঠামো অ্যাসাঞ্জের হাতে নেই। ওয়েব হোস্টিং কোম্পানিগুলোকে টাকা দিয়ে উইকিলিকস অনলাইনে সচল থাকে। আমেরিকায় প্রথমে আমাজন কোম্পানি উইকিলিকস বন্ধ করে দিয়েছে, তারপর বন্ধ করেছে এভরিডিএনএস কোম্পানিটি। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে উইকিলিকস এখনো বন্ধ হয়নি। উইকিলিকস ডট সিএইচ ওয়েব ঠিকানার মাধ্যমে ওয়েবসাইটটির অধিকাংশ ট্রাফিক চালু আছে। এটি নিয়ন্ত্রণ করছে সুইজারল্যান্ডের পাইরেট পার্টি নামের এক ওয়েব হোস্টিং কোম্পানি। গত রোববার তারা বার্তা সংস্থা এপিকে জানিয়েছে, প্রতি সেকেন্ডে তিন হাজার মানুষ উইকিলিকসের ওয়েবসাইট ভিজিট করছে। ফ্রান্সে যে হোস্টিং কোম্পানি উইকিলিকস হোস্টিং করে, সেটিও তাদের মূল সার্ভার গত রোববার বন্ধ করেছে। তার আগে দেশটির শিল্পমন্ত্রী কঠোর ভাষায় বলেন, যে ওয়েবসাইট গোপনীয় কূটনৈতিক সম্পর্কের রীতিগুলো ভঙ্গ করেছে, সেটিকে হোস্টিং সার্ভিস দেওয়া অগ্রহণযোগ্য। ফ্রান্সে এখন ওয়েবসাইটটি চালু আছে একটি সুইডিশ সার্ভারের মাধ্যমে পাইরেট পার্টির ভাইস প্রেসিডেন্ট বলেছেন, সুইডিশ সার্ভারটিও যদি বন্ধ করা হয়, তবু কোনো ফায়দা হবে না। উইকিলিকসের ভক্ত-অনুরাগীরা নিজেদের সার্ভারে উইকিলিকসের অজস্র মিরর তৈরি করছে। ফলে উইকিলিকস যদি নিজের মূল সাইটটি কখনো হারায়ও এবং পৃথিবীর সব দেশের সব সরকার মিলেও যদি ইন্টারনেট থেকে উইকিলিকসের নথিগুলো সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করে, পারবে না। সবখানে উইকিলিকসের অজস্র কপি আছে।
কিন্তু অ্যাসাঞ্জের জন্য বড় সমস্যা দেখা দিয়েছে আর্থিক ক্ষেত্র। উইকিলিকস কোনো বাণিজ্যিক ওয়েবসাইট নয়, এতে কোনো বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয় না। এর খরচ চলে ভক্ত-অনুরাগীদের চাঁদার টাকায়। পেপল নামে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অনলাইন পেমেন্ট সার্ভিস প্রোভাইডার কোম্পানির মাধ্যমে ভক্তরা উইকিলিকসে চাঁদার অর্থ পাঠায়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র সরকারের চাপে পেপল উইকিলিকসের অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে ওয়েবসাইটটির অর্থাগমের প্রধান পথটিই বন্ধ হয়ে গেছে। তার ওপর গত সোমবার সুইস ব্যাংক অ্যাসাঞ্জের ব্যক্তিগত নামের অ্যাকাউন্টটিও জব্দ করেছে। এটা ঘটতে পারে আন্দাজ করে অ্যাসাঞ্জ অবশ্য সুইজারল্যান্ডের পোস্টাল বিভাগের বাণিজ্যিক শাখা সুইসপোস্টে নিজের নামে একটা অ্যাকাউন্ট খুলেছিলেন। কিন্তু একই দিনে সুইসপোস্টও সেই অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দিয়েছে। তারা বলছে, অ্যাকাউন্টটি খোলার সময় অ্যাসাঞ্জ তার প্লেস অব রেসিডেন্স হিসেবে যে তথ্য দিয়েছিলেন, তা সঠিক নয়। মাস্টারকার্ডও উইকিলিকসকে আর কোনো সার্ভিস দেবে না বলে ঘোষণা করেছে। অ্যাসাঞ্জ এখন ব্যবহার করছেন সুইজারল্যান্ড-আইসল্যান্ডের একটি ক্রেডিট কার্ড প্রসেসিং সেন্টার এবং আইসল্যান্ড ও জার্মানির বিভিন্ন আর্থিক লেনদেনব্যবস্থা। সুইসপোস্টের অ্যাকাউন্ট হোল্ডার হতে হলে সেই দেশে বাসস্থান, সম্পত্তি বা ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড থাকতে হয়। কিন্তু সুইজারল্যান্ডে অ্যাসাঞ্জের কোনো বাসস্থান নেই। মূলত এ কারণেই তিনি সুইজারল্যান্ডে আশ্রয় গ্রহণের আবেদন করবেন বলে শোনা যাচ্ছে। কিন্তু সুইজারল্যান্ডে মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেছেন, অ্যাসাঞ্জকে আশ্রয় দেওয়ার ব্যাপারে সুইজারল্যান্ডের উচিত সতর্কতার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নেওয়া। মহাপরাক্রমশালী বিশ্বমোড়ল যুক্তরাষ্ট্রের চাপ অগ্রাহ্য করে নিরপেক্ষ সুইজারল্যান্ড জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে আশ্রয় দেবে কি না, বলা কঠিন। ওদিকে ব্রিটেনে জামিন না পেলে তাকে সুইডেনে পাঠানো হবে। অ্যাসাঞ্জের ধারণা, তিনি সেখানে ন্যায়বিচার পাবেন না। তার এমন ধারণা সৃষ্টি হওয়ার কারণ, সুইডিশ পুলিশ তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে চেয়েছে, তিনি নিজেও তাতে রাজি ছিলেন, কিন্তু এর মধ্যে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে ইন্টারপোলের রেডলিস্টে তার নাম লেখানো হয়েছে। সুইডেনের মতো দেশে এটা নজিরবিহীন ঘটনা। যুক্তরাষ্ট্রের চাপেই যে সুইডিশ কর্তৃপক্ষ তার বিরুদ্ধে এসব করছে, এ ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত। যুক্তরাষ্ট্রে এখন পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা হয়নি, কিন্তু দেশটির অ্যাটর্নি জেনারেল এরিক হোল্ডার সোমবার বলেছেন, উইকিলিকসের অবসান ঘটানোর জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার আদেশ দেওয়া হয়েছে।
অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে বিশ্বের মহাক্ষমতাধর শক্তিগুলোর সংঘবদ্ধ আক্রমণ দেখতে পাচ্ছি বিশ্বজনমত, বিশেষ করে যুবসমাজ রয়েছে অ্যাসাঞ্জের পক্ষে। পেপল উইকিলিকসের অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করলে ওয়েবসাইটটিতে চাঁদা পাঠানোর প্রধান পথটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর ব্রিটেনের গার্ডিয়ান পত্রিকা অনলাইন সংস্করণে একটা জনমত জরিপ শুরু করেছে। তারা পাঠকদের উদ্দেশে প্রশ্ন রেখেছে: সম্ভব হলে (কারিগরিভাবে) আপনি কি উইকিলিকসকে চাঁদা দেবেন? দেখা যাচ্ছে, ব্যাপক সাড়া। প্রথমজন হ্যাঁ ভোট দিয়ে লিখেছেন, চাঁদা দেবেন জিজ্ঞেস করছেন কেন? বলুন, চাঁদা দিন! আমি দিয়েছি। উইকিলিকসকে চাঁদার টাকা পাঠানোর হাজারটা পথ এখনো খোলা আছে!’ এই পাঠক আরও ১৬২ জনের কাছে সুপারিশ পাঠিয়েছেন উইকিলিকসের পক্ষে ভোট ও চাঁদা দেওয়ার জন্য। পেপল উইকিলিকসের অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দিয়েছে, এর প্রতিবাদে অনেকে ফাক পেপল লিখে নিজের অ্যাকাউন্ট প্রত্যাহার করে নিয়েছেন এবং অন্যদেরও তা করতে বলেছেন। একইভাবে আমাজন উইকিলিকস বন্ধ করে দিয়েছে বলে অনেকে আমাজনকে বয়কট করার আহ্বান জানিয়েছেন। অনেকে লিখেছেন, উইকিলিকস থাকবে, আমরা টাকা পাঠাব।’ কী কী পদ্ধতিতে চাঁদার টাকা পাঠাতে হবে, তাও অন্যদের বাতলে দিয়েছেন অনেকে। কেউ লিখেছেন, উইকিলিকস বন্ধ করা নয়, আমেরিকাসহ যেসব অশুভ স্বৈরশক্তি উইকিলিকসের পেছনে লেগেছে, তাদেরই বাতিল করে দেওয়া উচিত।
জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ যে ত্রিমুখী আক্রমণের মুখে পড়েছেন, তার পরিণতি দেখতে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। তাকে পছন্দ করেন, কিন্তু তার বহুমুখী বিপদ দেখে একটু হতাশ বোধ করছেন, এমন কেউ কেউ আগেভাগেই তাকে সাইবার মার্টার বা সাইবার শহীদ বলা শুরু করেছেন। আবার আমেরিকায় পাবলিক জার্নালিজমের প্রবল প্রবক্তা, হোয়াই জার্নালিস্টস আর ফর? গ্রন্থের খ্যাতিমান লেখক জে রোজেন, যিনি মনে করেন, গণতন্ত্রের ওয়াচডগ হিসেবে প্রথাগত সংবাদমাধ্যমের মৃত্যু হয়েছে। তিনি বলেছেন, মৃত প্রেসের জায়গায় আমরা পেয়েছি উইকিলিকস। তার মতো অন্য অনেকে বলছেন, বিশ্বজুড়ে উইকিলিকস একটা নয়, শত শত, হাজার হাজার, এমনকি লাখ লাখ! তথ্যের ওপর একচেটিয়া অধিকারের দিন শেষ হয়েছে। আমরা সাংবাদিকতার উইকিলিকস যুগে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রবেশ করলাম।

মতামত এর আরও খবর

img

গাজা যুদ্ধ বন্ধে বাইডেন কেন এতটা মরিয়া

প্রকাশিত :  ১১:৪১, ১২ মে ২০২৪
সর্বশেষ আপডেট: ১১:৪৮, ১২ মে ২০২৪

জনাথন ফ্রিডল্যান্ড

দ্বিতীয় দফায় নির্বাচিত হবেন কি না তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের উদ্বেগ একেবারে প্রান্তে এসে পৌঁছেছে। জো বাইডেনের পরামর্শ বারবার উপেক্ষা করে আসছিলেন বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। এই উপেক্ষার মূল্য কী হতে পারে, এই সপ্তাহে ইসরায়েল সেটা দেখতে পেল।

ইসরায়েলের ৩ হাজার ৫০০ বোমার চালান আটকে দিয়েছে বাইডেন প্রশাসন। এই অস্ত্র ইসরায়েল গাজার দক্ষিণের শহর রাফা আক্রমণে ব্যবহার করবে, সেই বিবেচনায় অস্ত্রের চালানটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। রাফায় এখন ১০ লাখের বেশি শরণার্থীর আশ্রয়শিবির।

ইসরায়েলের প্রতি জো বাইডেন তাঁর ‘লৌহদৃঢ়’ সমর্থন থেকে সরে আসছেন না। কিন্তু ইসরায়েল রাফা হামলার জন্য যে হুমকি দিয়ে চলেছে, সেটা সফল করতে অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করবেন না। সিএনএনকে বাইডেন বলেছেন, ‘ইসরায়েলের নিরাপত্তা দেওয়া থেকে আমরা সরে আসছি না। অন্যখানে যুদ্ধ করার সক্ষমতা তৈরির পথ থেকে সরে আসছি আমরা।’

ইসরায়েলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিত্র যুক্তরাষ্ট্র। ইসরায়েলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী আইজাক রবিন বলতেন, তাঁর দেশের ১ নম্বর কৌশলগত সম্পদ এই সব অস্ত্র, এমনকি পারমাণবিক অস্ত্র নয়; বরং ওয়াশিংটনের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক। দশকের পর দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় অস্ত্রের জোগানদাতা ও কূটনৈতিক অভিভাবক। 

কিন্তু মাত্র ছয় সপ্তাহের ব্যবধানে ওয়াশিংটন এমন দুটি পদক্ষেপ নিল, যা পুরোপুরি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গেল। গত মার্চ মাসে নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ভেটো দেওয়া থেকে বিরত থাকে যুক্তরাষ্ট্র। ফলে ইসরায়েল প্রস্তাবটি আটকে দিতে চাইলেও ব্যর্থ হয়। আর এখন তো ওয়াশিংটন অস্ত্রের চালান আটকে দিল।

এর থেকেও বড় বিষয় হলো, এই সিদ্ধান্তগুলো এমন একজন রাজনীতিবিদ নিয়েছেন, যিনি ব্যক্তিগতভাবে ইসরায়েলের খুব নিবেদিতপ্রাণ সমর্থক। বাইডেন সেই যুগের একজন ডেমোক্র্যাট, যখন দুই সহস্রাব্দের নির্বাসন ও শাস্তির পর মধ্যপ্রাচ্যে ইহুদিদের আদি বাড়ি প্রতিষ্ঠার বিষয়টি গতি পেতে শুরু করেছে। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের উদারপন্থীদের চোখ তখন রহস্যজনকভাবে বন্ধ ছিল।  

গোল্ডা মেয়ার থেকে শুরু করে ইসরায়েলের প্রত্যেক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বাইডেন দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে। ইসরায়েলের প্রতি বাইডেনের টান বাড়ার ক্ষেত্রে এর একটার ভূমিকা আছে। পূর্বতন প্রেসিডেন্টদের মতো বাইডেনের ইসরায়েলের প্রতি ভ্রাতৃত্ববোধ শুধু নির্বাচনী হিসাব-নিকাশের বিষয় নয়।  

গাজা নিয়ে কোনো চুক্তি হচ্ছে না। কেননা, নেতানিয়াহু কিংবা সিনাওয়ারা কেউই বিশ্বাস করেন না, চুক্তি করলে তাঁদের স্বার্থ রক্ষিত হয়। যেমনটা যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক কর্মকর্তা অ্যারন ডেভিড মিলার বলেছেন, ‘এই সংঘাত বন্ধে একটি পক্ষেরই কেবল সত্যিকারের তাড়া আছে, সেই পক্ষটি হলেন জো বাইডেন।’

অন্যদিকে ১৯৮০-এর দশকে নেতানিয়াহু প্রথম আলোচনার পাদপ্রদীপে উঠে আসেন। তিনি এমন একজন কূটনীতিক, যিনি আমেরিকানদের সঙ্গে সাবলীলভাবে কথা বলতেন। সে সময় থেকেই তিনি নিজেকে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে দাঁড় করান। ইসরায়েলের একজন হবু নেতার জন্য এই দক্ষতা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। 

কয়েক দশক ধরে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তাঁর ভোটারদের এই বার্তা দিয়ে আসছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের মধ্যকার সব ধরনের গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ক্ষেত্রে তিনিই একমাত্র বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তি।

কিন্তু বাস্তব অবস্থাটা এখন কী দাঁড়াল?  চার দশকের বেশি সময়ের মধ্যে বাইডেনই প্রথম প্রেসিডেন্ট যিনি ইসরায়েলকে সামরিক সহায়তা দেওয়া বন্ধ করলেন। (১৯৮২ সালে ইসরায়েলের লেবানন অভিযানের সময় রোনাল্ড রিগ্যান যুদ্ধবিমান দিতে বিলম্ব করেছিলেন।) বাইডেন কেন এটা করলেন? কারণ, নেতানিয়াহু যুক্তরাষ্ট্রের একটি অংশের জনগোষ্ঠীর মধ্যে এমন তিক্ততা তৈরি করেছেন, যেটা আগে দেখা যায়নি।

ইসরায়েলের প্রতি যে যুক্তরাষ্ট্রের সমাজের নিরেট সমর্থন, তাতে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যেভাবে ছাত্র আন্দোলন আছড়ে পড়েছে, সেটা বিস্ময়করই। আন্তর্জাতিক জরিপ সংস্থা গ্যালাপের মার্চ মাসের জরিপ বলছে, ৫১ শতাংশ ইসরায়েলের পক্ষে সমর্থন দিয়েছে, ২৭ শতাংশ সমর্থন দিয়েছে ফিলিস্তিনের পক্ষে। কিন্তু ডেমোক্র্যাট ও তরুণ জনগোষ্ঠী—দুই ক্ষেত্রেই ফিলিস্তিনিদের পক্ষে সমর্থন অনেকটাই বেড়েছে।

জরিপের এই তথ্য বাইডেন ও তাঁর নির্বাচনী প্রচারণা দলকে চিন্তার মধ্যে ফেলেছে। এই অংশের দ্ব্যর্থহীন সমর্থনই ২০২০ সালের নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে পরাজিত করতে ভূমিকা রেখেছিল। গাজাবাসীর দুর্ভোগ সেই ভোটারদের সমর্থন অনিশ্চিত করে তুলেছে। হোয়াইট হাউস নেতানিয়াহুর কাছে পরিকল্পনা চেয়েছিলেন, বেসামরিক জনসাধারণকে হতাহত না করে কীভাবে রাফায় অভিযান করতে পারে ইসরায়েল। 

কিন্তু নেতানিয়াহু সেই পরিকল্পনা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। সেই কারণে ইসরায়েলকে থামানোর জন্য অস্ত্রের চালান আটকে দেওয়ার সরাসরি পথ বেছে নিয়েছে ওয়াশিংটন।

রাফা বাইডেনের জন্য শক্তি পরীক্ষার জায়গাও হয়ে উঠেছে। বাইডেন রাফাকে বিপদরেখা হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন। নেতানিয়াহু যদি সেই বিপদরেখা অতিক্রম করেন, তাহলে বাইডেন দুর্বল হিসেবে চিহ্নিত হবেন।

কিন্তু নেতানিয়াহু এখন পর্যন্ত রণেভঙ্গ দিতে অস্বীকার করেছেন। ইসরায়েলের স্বাধীনতা আন্দোলনকে সামনে রেখে জনগণের উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র ছাড়া আমরা একাই লড়ে যাব। প্রয়োজনে আমরা আমাদের নখ দিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাব।’ 

নেতানিয়াহু চার্চিলের মতো আওয়াজ তুলতে চাইছেন। কিন্তু তাঁর কথাগুলো দুর্বলের কণ্ঠস্বর, সবলের নয়। ওয়াশিংটন চায়, নেতানিয়াহু যেন রাফা অভিযান থেকে সরে আসেন। কিন্তু জোট সরকারের অতি ডানপন্থী মিত্ররা তাঁকে আরও কঠোর হতে বলছেন, রাফা অভিযানের মাধ্যমে হামাসের বিরুদ্ধে পুরোপুরি বিজয়ের জন্য বলছেন।

এই নিরানন্দ নাটকে বাইডেন ও নেতানিয়াহুই কেবল কুশীলব নন; হামাস নেতা ইয়াহিয়া সিনাওয়ারেরও নিজস্ব হিসাব-নিকাশ আছে, নেতা হিসেবে টিকে থাকার সংকল্প রয়েছে। খুব ঘনিষ্ঠভাবে যাঁরা সিনাওয়ারকেও পাঠ করেছেন তাঁরা বিশ্বাস করেন, নির্দোষ মানুষের জীবন রক্ষা করা তাঁর অগ্রাধিকার নয়; বরং যত বেশি গাজাবাসী নিহত হবেন, আন্তর্জাতিক পরিসরে তাঁর শত্রু ইসরায়েলে অবস্থান ততই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সেই পরিস্থিতি তাঁকে বিজয়ী দাবি করতে সহায়তা করবে। সম্প্রতি হামাস যুদ্ধবিরতি চুক্তি মেনে নেওয়ার ঘোষণার পেছনে সিনাওয়ারের এই ভাবনায় কাজ করেছে। 

সিনাওয়ারা সাময়িক কোনো যুদ্ধবিরতি (তাতে অনেক মানুষের প্রাণরক্ষা হয়, দুর্ভোগ কমে) চান না, তিনি চান স্থায়ী যুদ্ধবিরতি। আর তার জন্য সিনাওয়ারা অপেক্ষা করতেও রাজি।

গাজা নিয়ে কোনো চুক্তি হচ্ছে না। কেননা, নেতানিয়াহু কিংবা সিনাওয়ারা কেউই বিশ্বাস করেন না, চুক্তি করলে তাঁদের স্বার্থ রক্ষিত হয়। যেমনটা যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক কর্মকর্তা অ্যারন ডেভিড মিলার বলেছেন, ‘এই সংঘাত বন্ধে একটি পক্ষেরই কেবল সত্যিকারের তাড়া আছে, সেই পক্ষটি হলেন জো বাইডেন।’


জনাথন ফ্রিডল্যান্ড, ব্রিটিশ গণমাধ্যম গার্ডিয়ানের খ্যাতিমান কলামিস্ট

মতামত এর আরও খবর