বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের হিসাব-নিকাশে ভারতের অবস্থান
‘বাইডেনের সেলফি, বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের নানা হিসাব-নিকাশ’ শিরোনামে আমার আগের লেখায় বাংলাদেশসহ বিশ্বে চীনের ক্রমবর্ধমান ভূমিকার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে কোনো পরিবর্তন এসেছে কি না, তা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। বর্তমান লেখায় বাংলাদেশের অর্থনীতি ও রাজনীতিতে প্রভাবশালী দেশ ভারতের উপস্থিতির প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের স্বরূপ ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছি।
‘তৃতীয় বিশ্বের’ দেশগুলোয় বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের নানা ধরনের শর্ত আরোপের কারণে এসব দেশের চীন-রাশিয়ামুখী হওয়ার বর্তমান যে প্রবণতা, বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্র-ভারতের ভূমিকার দ্বান্দ্বিকতা বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে তা বিবেচনায় রাখা হয়েছে।
ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের মূল শর্ত হলো কাঠামোগত সংস্কার, যার লক্ষ্য প্রাক্-পুঁজিবাদী উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোকে পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করা। তবে নব্য মার্কসবাদী ও নির্ভরশীলতা–বিষয়ক তাত্ত্বিকেরা বিষয়টা দেখেন পুরোনো ঔপনিবেশিক শাসকদের নতুন ঔপনিবেশিক শাসন চালানোর প্রক্রিয়া হিসেবে।
কাঠামোগত সংস্কারের প্রক্রিয়া হিসেবে যে বিষয়গুলোর প্রেসক্রিপশন দেওয়া হয়, সেগুলো হলো সব রকমের ভর্তুকি প্রত্যাহার, কলকারখানা–শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে চিকিৎসাব্যবস্থার যতটা সম্ভব বেসরকারীকরণ, বাজারে সরকারি হস্তক্ষেপের মাধ্যমে পণ্যের দাম নির্ধারণ না করে চাহিদা ও জোগানের মাধ্যমে দাম নির্ধারণ, সব রকমের ট্যারিফ কমিয়ে দিয়ে আমদানি উৎসাহিতকরণ।
অর্থাৎ মোটাদাগে এসব প্রেসক্রিপশনের মূল লক্ষ্য হচ্ছে উন্নয়নশীল বিশ্বকে মুক্তবাজার অর্থনীতিতে যুক্ত করা।
এসব প্রেসক্রিপশনের অনেক কিছুই এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর উন্নয়নকে মাথায় রেখে নয়, বরং পশ্চিমা দুনিয়ার অর্থনৈতিক সুবিধাপ্রাপ্তিকে মাথায় রেখে করা হয় বলে বামপন্থী অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন।
সামাজিক ক্ষেত্রে নারী, সমকামী ও ট্রান্সজেন্ডারদের সম–অধিকারসহ এমন কিছু সংস্কারের কথা বলা হয়, যা শুধু মুসলিমপ্রধান দেশগুলোয় নয়, অনেক অমুসলিম দেশেও সামাজিক বাস্তবতার কারণে বাস্তবায়ন করা অসম্ভব হয়ে পড়ে।
এর বিপরীতে চীন বা রাশিয়া ঋণ বা অনুদান প্রদানের ক্ষেত্রে কোনো শর্ত জুড়ে না দেওয়ায় উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলো এদের কাছ থেকে সহায়তা নেওয়াকে সুবিধাজনক মনে করছে। এসব বিষয় এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলোয় চীনের ব্যাপক অর্থনৈতিক উপস্থিতির সহায়ক হয়েছে।
চীনের এই অর্থনৈতিক উপস্থিতিকে পশ্চিমের অনেক অর্থনীতিবিদ ও নীতিনির্ধারক ‘ঋণফাঁদ’ বলে অভিহিত করছেন। তাঁরা একই সঙ্গে বলছেন, চীনের ঋণের সঙ্গে উচ্চ সুদের বিষয়টা যুক্ত; যদিও এ ধরনের ফাঁদে পড়ার অভিজ্ঞতা আগে অনেক উন্নয়নশীল দেশেরই হয়েছে পশ্চিমা বিশ্ব থেকে ঋণ নেওয়ার পর।
ফলে এর সবকিছুই ‘তৃতীয় বিশ্বের’ দেশগুলোকে পশ্চিমের বিকল্প হিসেবে চীন-রাশিয়ামুখী করছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে চীন, রাশিয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ভারতেরও রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ উপস্থিতি।
ভারতের উপস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মাথাব্যথা নেই। যুক্তরাষ্ট্রের চিন্তার জায়গাটা হচ্ছে অর্থনীতি ও রাজনীতিতে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব।
এশিয়ার পূর্বে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং পশ্চিমে ইসরায়েল ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র এশিয়ায় কাউকে নির্ভরযোগ্য মিত্র মনে করে না। ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য ও সামরিক সম্পর্ক ক্রমে বাড়লেও ভারতকে যুক্তরাষ্ট্র তাদের নির্ভরযোগ্য নয়, বরং কৌশলগত মিত্র হিসেবেই দেখে। কেননা, সোভিয়েত জামানার সূত্র ধরে রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের রয়েছে সুসম্পর্ক। ভারতের প্রতিরক্ষা খাত এখনো বহুলাংশে রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল।
মার্কিন নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ভারত রাশিয়া থেকে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি জ্বালানি আমদানি করেছে, যা এখনো অব্যাহত। বাংলাদেশে ভারতের অর্থনৈতিক এবং অন্যান্যভাবে উপস্থিতিকে তারা দেখে চীনের বিরুদ্ধে একধরনের বাফার হিসেবে।
এ অবস্থায় পূর্ব সীমান্তেও সন্ত্রাসবাদের রাজনীতির উত্থান হলে সেটি তার নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে উঠবে বলে নয়াদিল্লি মনে করে। সবকিছু মিলে বাংলাদেশ নিয়ে দিল্লি যে খুব একটা স্বস্তিতে নেই, সেটা স্পষ্ট। আওয়ামী লীগ বা বিএনপি—এই দুই দলের কারও ওপরই দক্ষিণ ব্লক পুরো নির্ভর করতে পারছে বলে মনে হয় না।
দক্ষিণ এশিয়ায় এ মুহূর্তে ভারত মিত্রহারা। শুধু বাংলাদেশের সঙ্গেই রয়েছে তার সুসম্পর্ক। বাংলাদেশের নানা খাতে ভারতের বড় বিনিয়োগ রয়েছে।
সামরিক-কৌশলগত দিক থেকেও বাংলাদেশ ভারতের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু দেশটিতে চীনের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি ভারতকে গভীর শঙ্কায় ফেলে দিচ্ছে। ফলে বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন নিয়ে নয়াদিল্লির দক্ষিণ ব্লকে একধরনের উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে।
ভারতের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে এর প্রতিফলন ঘটেছে। আগে বাংলাদেশ বা বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে এত বেশি বিশ্লেষণ ভারতের সংবাদমাধ্যমগুলোয় প্রকাশিত হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি ঘোষণার পর থেকে এ প্রবণতা বেড়েছে। এসব বিশ্লেষণ থেকে যে বিষয় উঠে এসেছে, সেটা হলো, বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে ভারত নির্ভরযোগ্য মিত্র মনে করলেও একই সঙ্গে তাদের মনে শঙ্কা জেগেছে বাংলাদেশের সঙ্গে এ সরকারের আমলেই চীনের ক্রমবর্ধমান সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে।
তারা যে সমীকরণ বুঝতে চাইছে, সেটা হলো, ভবিষ্যতে যদি বিএনপি ক্ষমতাসীন হয়, তাহলে সেটা ভারতের স্বার্থের অনুকূলে যাবে, নাকি বাংলাদেশ বিএনপির নেতৃত্বে পুরোপুরি চীনমুখী হয়ে পড়বে। ইসলামপন্থার রাজনীতির সঙ্গে বিএনপির সমীকরণ কী হবে, সেটিও নীতিনির্ধারকেরা অনুধাবনের চেষ্টা করছেন।
ধর্মনির্ভর রাজনৈতিক সন্ত্রাসবাদীদের (প্রচলিত ভাষায় জঙ্গি) বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যেকোনো অপারেশনের বিরোধিতা করে বিএনপির নেতৃত্বের বক্তব্য দেওয়ার একটা প্রবণতা রয়েছে।
সরকারবিরোধিতার অংশ হিসেবে এটা তারা করে থাকলেও দিল্লির নীতিনির্ধারকেরা এ বিষয়ও বুঝতে চেষ্টা করছেন, তাদের ক্ষমতারোহণ দেশটিতে সন্ত্রাসবাদী রাজনীতির পুনরুত্থান ঘটাবে কি না। পাকিস্তানে আফগানিস্তানের তালেবান–সমর্থিত তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তানের উত্থানে চিন্তিত ভারত।
এ অবস্থায় পূর্ব সীমান্তেও সন্ত্রাসবাদের রাজনীতির উত্থান হলে সেটি তার নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে উঠবে বলে নয়াদিল্লি মনে করে। সবকিছু মিলে বাংলাদেশ নিয়ে দিল্লি যে খুব একটা স্বস্তিতে নেই, সেটা স্পষ্ট। আওয়ামী লীগ বা বিএনপি—এই দুই দলের কারও ওপরই দক্ষিণ ব্লক পুরো নির্ভর করতে পারছে বলে মনে হয় না।
দিল্লির বিপরীতে ইসলামপন্থার রাজনীতি নিয়ে ওয়াশিংটনের মাথাব্যথা নেই। তারা মনে করে জামায়াতে ইসলামীসহ ইসলামপন্থী দলগুলোর রাজনীতি করার সুযোগ থাকা উচিত। এসব দলকে তারা গণতান্ত্রিক দল হিসেবে বিবেচনা করে। ফলে, রাজনৈতিক ব্যবস্থায় তাদেরও ভূমিকা থাকা উচিত বলে তারা মনে করে। এসব দলের রাজনীতি করার সুযোগ সংকুচিত হলে সন্ত্রাসবাদনির্ভর রাজনীতির উত্থান হতে পারে—এটা বাইডেন প্রশাসন এমনই মনে করে।
বাংলাদেশের ভবিষ্যতে যারাই ক্ষমতায় আসুক, তাদের সামনে আঞ্চলিক পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে সম্ভাব্য বিকল্প হচ্ছে তিনটি—১. ভারতমুখী পররাষ্ট্রনীতি, ২. চীনমুখী নীতি এবং ৩. চীন-ভারতের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ নীতি। ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম নীতিটির ব্যাপারে আপত্তি নেই। কিন্তু দ্বিতীয় ও তৃতীয়টির ব্যাপারে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র—দুই তরফেরই ঘোর আপত্তি রয়েছে।
এশিয়ায় চীনের যে ক্রমবর্ধমান প্রভাব, সেটি ঠেকানোর নীতি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র কোনো অবস্থাতেই বাংলাদেশে চীনের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং তার সূত্র ধরে সামরিক প্রভাব দেখতে চায় না।
যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, ভারতের তুলনায় চীনের অর্থনৈতিক-সামরিক শক্তি অনেক বেশি হওয়ায় বাংলাদেশের ভারসাম্য নীতি অনুসরণ করার মানে হলো কিছুটা ধীরগতিতে হলেও শেষ পর্যন্ত ভারতকে হটিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও রাজনীতিতে চীনের জায়গা করে নেওয়া। এমন পরিস্থিতি এ দেশকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে মারাত্মক হুমকিতে ফেলবে।
দেখা গেছে, বাংলাদেশসহ যেসব রাষ্ট্রে সব মহলের কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেনি, সেসব রাষ্ট্রের নির্বাচনকে ঘিরে বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর তৎপরতা পরিচালিত হয় মূলত তাদের মনমতো সরকার বসানোর লক্ষ্য নিয়ে।
যেসব রাষ্ট্রে গণতন্ত্র শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে গেছে, সেখানে বাইরের হস্তক্ষেপের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন সম্ভব নয়। ফলে সেসব রাষ্ট্রে নির্বাচনকে ঘিরে বিদেশি রাষ্ট্রের তৎপরতা দেখা যায় না।
কেননা, জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়া অন্য কোনো উপায়ে সেসব দেশে সরকার পরিবর্তনের সুযোগ নেই। বাংলাদেশের প্রতিবেশী নেপাল হচ্ছে তার একটি বড় উদাহরণ। বাংলাদেশের চেয়ে অনেক পরে গণতান্ত্রিক চর্চা শুরু হলেও তারা গণতন্ত্রকে তুলনামূলক বিচারে একটি শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়ে ফেলতে পেরেছে।
ফলে সেখানে এখন মাওবাদী কমিউনিস্ট পার্টির নেতা কমরেড পুষ্পকমল দহল প্রচণ্ড দেশটির প্রধানমন্ত্রী হলেও যুক্তরাষ্ট্র বা ভারতের দেশটির সরকারপ্রধান নিয়ে বলার কিছু নেই।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো যেহেতু ভারত বা নেপালের মতো গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে পারেনি, তাই আগামী নির্বাচন যদি যুক্তরাষ্ট্রের বিবেচনায় গ্রহণযোগ্য না হয় এবং অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিকসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে চীনের ভূমিকা বৃদ্ধি পেতেই থাকে, তাহলে নির্বাচনপরবর্তী যে সরকার গঠিত হবে, তাকে যুক্তরাষ্ট্রের নানা ধরনের চাপের মুখে পড়তে হতে পারে।