img

হাওরে আলিপুরে আরডিএফ’র মসজিদ : মোসল্লিদের মাঝে পুণ্যময় উচ্ছ্বাস

প্রকাশিত :  ০৭:১৪, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩

চারিদিকে থৈ থৈ পানি বেষ্টিত ‘হাওরে আলিপুর’ এক দুর্গম গ্রাম। ঠাঁইহীন অকূল পানি যেন এই নিম্নভূমির অধিবাসীদের বঞ্চিত রেখেছে অধূনা জগত থেকে। তবুও ধর্মীয় জীবনাচার থেকে এতটুকু গাফিল নয় তারা। পূর্বাকাশে সূর্যের লাল আলোর ঢেউগুলো সাদা রং ছড়ানোর আগেই এই জলরাশি পেরিয়ে একদল কোমলমতিকে যেতে হয় মসজিদে। জং ধরা টিন ও পলিথিনঘেরা এমনই ছোট্ট ঘরের মেঝেতে বৃষ্টি এলেই কাদাপানিতে মাখামাখি ! এখানেই চলে শিশুদের পবিত্র কোরআন শিক্ষা ও মুসল্লিদের সালাত। যুগ যুগ ধরে চলে আসা এই কষ্ট লাঘবে এগিয়ে আসে আরডিএফ; আধুনিক নির্মাণশৈলীতে তৈরি করে অপরূপ মসজিদ; এলাকাবসীর দেহমন ভরে ওঠে এক স্বর্গীয় আনন্দে।

সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর উপজেলার দক্ষিণ শ্রীপুর ইউনিয়নের হাওরবেষ্টিত গ্রাম রাজধরপুর। চারদিকে হাওর বলে ‘হাওরে আলিপুর’ নামেই গ্রামটিকে সবাই চিনে। উপজেলা সদর থেকে ইঞ্জিন নৌকায় এক ঘণ্টার দূরত্বে দ্বীপের মতো এ গ্রামে ৩৫টি পরিবারের বসবাস। কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে গ্রামবাসীর মনে একটি জমাট দুঃখ- দেশের সর্বত্র দৃষ্টিন্দন ইমারতের মসজিদের ছড়াছড়ি; সেখানে কি প্রশান্ত মনে সালাত আদায় করছেন, কুরআন অধ্যয়ন করছেন ইবাদতকারিগণ; বিভিন্ন এলাকায় পাকা মসজিদে মাঝে-মধ্যে নামাজ পড়ার সৌভাগ্য হলেও নিজেদের গ্রামের জীর্ণ কুটির সদৃশ ইবাদতখানাটি ধুঁকছে বহুকাল ধরে। টিনের শরীরে অসংখ্য ছিদ্র নিয়ে কোনোমতে দাঁড়িয়ে আছে ছোট্ট এই ঘরটি। বৃষ্টি এলেই অঝোরে পানি ঝরে; সেই পানি আটকানোর প্রয়াসে ছিদ্রের স্থানে স্থানে পলিথিনের দুর্বল বেষ্টনি; সজোরে বৃষ্টি এসে অনায়াসে মেঝে ভিজিয়ে দেয়।  কর্দমাক্ত মেঝেতে পলিথিন কিংবা ছালার উপর বসে কোমলমতিরা কায়দা, ছিপারা ও কালামে পাকের দরস নেয়; মহান প্রভুর সান্নিধ্য পেতে এখানেই দিনে ৫ বার সেজদায় লুটিয়ে পড়ে ধর্মপ্রণ মুসল্লিগণ।

 টিনের বেড়া, মেঝেতে কাদাপানি। চারদিকে পানি, মাঝখানে যেন বিষণ্ন মুখে দাঁড়িয়ে আছে একটি নড়বড়ে ঘর; গ্রামবাসীর মসজিদ বলতে এটিই।

এবাদতখানায় আগে যেখানে  দেওয়ালের পুরোটাও টিন ছিলো না, উপরদিকে পলিথিন।

কাদাপানিতে মাখামাখি মেঝে, উপরে ফুটা চালা। সতেজ সকালে

সেই কোমলমতির ঝাঁক আর স্বর্গসন্ধানী মানুষদের কষ্ট একসময় ছুঁয়ে গেলো কিছু মানবতার ফেরিওয়ালাকে। ওরা তাদেরকে উপহার দিলেন ‘জলের বুকে এক টুকরো স্বর্গের হাসি’। এখন আর নেই সেই কাদাপানির মেঝে, দেওয়ালে নেই ছিদ্র- চালার ফুটাও উধাও। দুধসাধা চার দেওয়ালের ভেতরে, সিমেন্ট-ঢালাই মেঝেতে দাঁড়িয়ে নামাজ শেষে মুসল্লিদের দুচোখ বেয়ে এখন ঝরে শুকরিয়ার অশ্রু।


বিষয়টি নজরে আসে যুক্তরাজ্যভিত্তিক চ্যারিটি সংগঠন ‘রুরাল ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন গ্লোবাল (আরডিএফ)’-এর। তাদের একটি টিম কয়েক মাস আগে এ গ্রাম পরিদর্শন করে এবং নড়বড়ে ঘরটি ভেঙে সেখানে পাকা মসজিদ নির্মাণের আশ্বাস দিয়ে আসে রাজধরপুরের বাসিন্দাদের। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী একসময় সেই কাঁচা ঘর ভেঙে তৈরি হয় পাকা মসজিদ। মসজিদ আল-জামান। গত ৩ সেপ্টেম্বর নফল নামাজের মাধ্যমে পাকা মসজিদটির উদ্বোধন করা হয়।

স্বপ্নের পাকা মসজিদে প্রথম নামাজ আদায় করে রাজধরপুর গ্রামের বাসিন্দা আউয়াল মিয়া অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন। জানান, এটি কষ্টের নয়- পরম আনন্দের কান্না। আউয়াল মিয়া ধরা গলায় বলেন- ‘জীবদ্দশায় এমন একটি মসজিদে ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে পারবো স্বপ্নেও ভাবিনি। অনেক সময় নামাজের সময়ই বৃষ্টি চলে আসতো, ফুটো চালা বেয়ে পানি পড়তো মসজিদের ভেতরে। বেড়ার উপরিভাগ দিয়ে বৃষ্টি ঢুকে মসজিদের ভেতর হয়ে পড়তো বেহাল। আমাদের সন্তানরা সকালে অত্যন্ত কষ্ট করে আরবি পড়তো। এখন আমাদের এসব কষ্ট নেই। যারা আমাদের এমন বেহেশত উপহার দিয়েছেন, সংশ্লিষ্ট সবাইকে আল্লাহ এর বিনিময়ে জান্নাত দান করুন।’

গ্রামটির আরেক বাসিন্দা রাজ্জাক মিয়া। তিনি বলেন- ‘স্বাধীনতার পর থেকে কেউ আমাদের এই দুঃখ বুঝেনি। আরডিএফ নামক সংস্থাটি আমাদের কষ্ট দূর করেছে। মজসিদের ইমাম সাহেবও থাকতেন আমাদের সঙ্গে কষ্ট ভাগাভাগি করে। তার জন্যও আলাদা থাকার ঘর (হুজরা) তৈরি করে দিচ্ছে আরডিএফ। আমরা সংস্থাটির প্রতি চিরকৃতজ্ঞ।’

৩ সেপ্টেম্বর বেলা ১১টার দিকে পাকা মসজিদ উদ্বোধনকালে সেখানে উপস্থিত হন গ্রামের বাসিন্দারা। সবারই চোখে-মুখে ছিলো তৃপ্তি-কৃতজ্ঞতার ছটা। সবাই ছিলেন আরডিএফ’র প্রশংসায় পঞ্চমুখ।

উদ্বোধনকালে উপস্থিত ছিলেন যুক্তরাজ্য থেকে আসা আরডিএফ’র স্বেচ্ছাসেবক জুবের আহমদ চৌধুরী, বাংলাদেশ টিমের জুহের আহমদ চৌধুরী ও  জুনেদ আহমেদ চৌধুরী প্রমুখ।

উল্লেখ্য, ২০০৬ সালে গঠিত চ্যারিটি সংস্থা ‘আরডিএফ’ সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যাপক উন্নয়নমূলক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। দরিদ্র মানুষকে ঘর দেওয়া, গভীর ও সাধারণ নলকূপ প্রদান, দুর্যোগকালীন সময়ে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ, শীতবস্ত্র প্রদান, ঝরে পড়া শিশুদের নিয়ে ‘স্যুপ চিকেন’ (আড্ডা, খাবার-দাবার, বিনোদন) এবং কুরবানির পশু বিতরণসহ নানা উন্নয়নমূলক প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে আরডিএফ। সংস্থাটির কার্যক্রমে আগামীতে আরও বাড়ানোর প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন সংশ্লিষ্টরা। 

  এলাকায় মসজিদ নির্মাণ করলো আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা আরডিএফ গ্লোবাল। 


img

বাংলাদেশ: শান্তি ও সম্ভাবনার ঠিকানা

প্রকাশিত :  ১৯:১৬, ০৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

রেজুয়ান আহম্মেদ

জীবনের প্রয়োজনে, কাজের তাগিদে নানা দেশে ঘুরতে হয়েছে আমাকে— কখনো কর্মসূত্রে, কখনো নতুন কিছু শেখার তাগিদে, কখনো আবার উন্নত জীবনের হাতছানিতে। প্যারিসের ঝলমলে সন্ধ্যা দেখেছি, নিউইয়র্কের আকাশচুম্বী ভবনের নিচে দাঁড়িয়ে বিস্মিত হয়েছি, দুবাইয়ের মরুপ্রান্তরে ভবিষ্যতের শহর গড়ে ওঠা দেখেছি। কিন্তু দিনের শেষে, যখন একটু প্রশান্তির জন্য মন আকুল হয়েছে, তখন বুঝেছি— আমার আসল ঠিকানা একটাই, আমার বাংলাদেশ!

বিদেশের শহরগুলো নিঃসন্দেহে সাজানো-গোছানো, আধুনিক সুযোগ-সুবিধায় সমৃদ্ধ। কিন্তু সেখানকার ব্যস্ততা মানুষকে যেন যন্ত্রে পরিণত করে দেয়। কেউ কারও খোঁজ রাখে না, পাশের ফ্ল্যাটের মানুষও বছরের পর বছর অপরিচিত থেকে যায়। কাজের চাপে হাসির সময় নেই, আত্মীয়তার বন্ধনগুলো যেন শেকড়ছেঁড়া গাছের মতো শুকিয়ে যায়। অথচ বাংলাদেশ! এখানেই সকালবেলা চায়ের দোকানে পরিচিত মুখের সঙ্গে দেখা হয়, বিকেলে পাড়ার আড্ডায় হাসির রোল ওঠে, সন্ধ্যায় পরিবারের সবাই একসঙ্গে বসে গল্প করে। জীবন এখানে এখনো সহজ, হৃদয়ের বন্ধনগুলো এখনো অটুট।

বিদেশে গিয়ে বারবার মনে হয়েছে— অর্থ উপার্জনই কি জীবনের একমাত্র লক্ষ্য? বিশাল বেতনের চাকরি, বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, দামি গাড়ি— এগুলোর মোহ শুরুতে থাকলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে উপলব্ধি হয়, আসল সুখ অন্য কোথাও।

বাংলাদেশের গ্রামগুলোতে এখনো সকালে ঘুম ভাঙে পাখির কিচিরমিচিরে। শীতের ভোরে মাঠের মাঝখান দিয়ে হাঁটার যে প্রশান্তি, তা বিশ্বের কোনো উন্নত শহর দিতে পারে না। শহরের ব্যস্ত জীবনেও মানুষ এখনো একে অপরের খোঁজ রাখে, বিপদে-আপদে পাশে দাঁড়ায়। এমন সম্পর্কের উষ্ণতা কি অন্য কোথাও পাওয়া যায়?

বিদেশে যখন হুট করে বৃষ্টি নামে, তখন জানালা দিয়ে তাকিয়ে মনে পড়ে আমার দেশের বর্ষা! আকাশজুড়ে কালো মেঘের খেলা, টিনের চালে বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ, ভেজা বাতাসের স্নিগ্ধ ছোঁয়া— এসব বিদেশে পাওয়া সম্ভব নয়।

অনেকে ভাবে, উন্নতির জন্য বিদেশে যেতেই হবে। সত্যিই কি তাই? বাংলাদেশেই এখন অগণিত সুযোগ তৈরি হয়েছে। প্রযুক্তির অগ্রগতির ফলে বিশ্ব এখন হাতের মুঠোয়, ঘরে বসেই আন্তর্জাতিক বাজারে কাজ করার সুযোগ রয়েছে। ই-কমার্স, ফ্রিল্যান্সিং, স্টার্টআপ— সবখানেই বাংলাদেশিরা এগিয়ে যাচ্ছে।

একসময় বিদেশি বিনিয়োগের জন্য আমরা অপেক্ষা করতাম, আর এখন? বিশ্বের বড় বড় কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে উদগ্রীব। কারণ আমাদের দেশ দ্রুত অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাচ্ছে। কৃষি, তথ্যপ্রযুক্তি, বাণিজ্য, শিল্প— সবখানেই বাংলাদেশের সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে উঠছে।

বিদেশে গিয়ে কেউ হয়তো কঠোর পরিশ্রম করে অর্থ উপার্জন করেন, কিন্তু সেই টাকা দেশে পাঠানোর পরও সেখানে জীবনযাপন করা সহজ হয় না। অথচ, একই পরিশ্রম যদি বাংলাদেশেই করা যায়, তাহলে আরও স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন কাটানো সম্ভব।

বিদেশের চাকরির নিয়মকানুন এত কঠোর যে ব্যক্তিগত জীবনের স্বাধীনতা প্রায় থাকে না বললেই চলে। কিন্তু বাংলাদেশে? এখানে নিজের মতো করে কাজ করার সুযোগ আছে, উদ্যোক্তা হয়ে কিছু গড়ে তোলার সম্ভাবনা আছে।

অনেকে ভাবে, বিদেশ মানেই বেশি আয়। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, বাংলাদেশেই সঠিক পরিকল্পনা করে কাজ করলে তার চেয়ে বেশি আয় করা সম্ভব। দেশের বাজার ক্রমশ বড় হচ্ছে, মানুষের চাহিদা বাড়ছে, নতুন নতুন ব্যবসার সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে। তাহলে কেন আমরা নিজের দেশ ছেড়ে বিদেশে ছুটব?

পৃথিবীর যত দেশেই যাই না কেন, দিনের শেষে মনে হয়— বাংলাদেশই আমার সবচেয়ে কাছের, সবচেয়ে আপন। শুধু অর্থের জন্য, উন্নতির জন্য, স্বপ্ন পূরণের জন্য বিদেশে যেতে হবে— এই ধারণা বদলানোর সময় এসেছে। আমাদের দেশেই সব সুযোগ আছে, আছে শান্তি, আছে ভালোবাসা।

আমি বহু দেশে ঘুরেছি, নানা সংস্কৃতি দেখেছি, আধুনিক জীবনের স্বাদ পেয়েছি। কিন্তু কোথাও বাংলাদেশের মতো প্রাণের উচ্ছ্বাস পাইনি, পাইনি মাটির টান। তাই বারবার ফিরে আসতে চাই এই পরিচিত আকাশের নিচে, আমার গ্রামবাংলার সবুজ মাটিতে, আমার শহরের কোলাহলে। কারণ, এটাই আমার চিরন্তন ঠিকানা।

রেজুয়ান আহম্মেদ: কলামিস্ট, বিশ্লেষক; সম্পাদক অর্থনীতি ডটকম

মতামত এর আরও খবর