দেশে চরম আকার ধারণ করেছে ডলারের সংকট। সংকট কাটাতে রিজার্ভ থেকে ডলার সরবরাহ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে টান পড়েছে রিজার্ভে। এরই মধ্যে বড় ধাক্কা লেগেছে প্রবাসী আয়ে (রেমিট্যান্স)।
সদ্য বিদায়ী সেপ্টেম্বর মাসে প্রবাসী আয় এসেছে ১৩৪ কোটি ৩৬ লাখ ৬০ হাজার ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় (এক টাকা সমান ১০৯.৫০ টাকা ধরে) এর পরিমাণ ১৪ হাজার ৭১২ কোটি টাকা। এটি গত ৪১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়।
এর আগে ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে এসেছিল ১০৯ কোটি ২৯ লাখ ৬০ হাজার ডলার। এরপর সেপ্টেম্বরের আগে আর কোনো মাসে এত কম রেমিট্যান্স আসেনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য বলছে, বিদায়ী সেপ্টেম্বর মাসের পুরো সময়ে ১৩৪ কোটি ৩৬ লাখ ৬০ হাজার ডলার এসেছে, যা গত বছরের একই মাস (সেপ্টেম্বর) থেকে ১৯ কোটি ৬০ লাখ ডলার কম। গত বছরের সেপ্টেম্বরে এসেছিল ১৫৩ কোটি ৯৬ লাখ ডলার।
এর মধ্যে রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ১১ কোটি ৮৬ লাখ ৬০ হাজার ডলার, বিশেষায়িত দুই ব্যাংকের মধ্যে এক ব্যাংকে এসেছে ৩ কোটি ৫১ লাখ ডলার। বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ১১৮ কোটি ৪৮ লাখ ৪০ ডলার এবং বিদেশি ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ৫০ লাখ ৬০ হাজার ডলার।
তবে আলোচিত সময়ে সাত ব্যাংকের মাধ্যমে কোনো রেমিট্যান্স আসেনি। এসব ব্যাংকের মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্র মালিকানাধীন বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (বিডিবিএল), বিশেষায়িত রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব)। বেসরকারি ব্যাংকের মধ্যে রয়েছে বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংক, কমিউনিটি ব্যাংক, সিটিজেন্স ব্যাংক, বিদেশি খাতের হাবিব ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান, স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া।
এর আগে গত জুলাই মাসে ১৯৭ কোটি ৩০ লাখ ডলারের (১.৯৭ বিলিয়ন ডলার) রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। আগস্টে এসেছিল ১৫৯ কোটি ৯৪ লাখ ডলারের প্রবাসী আয়। গত জুন মাসে রেকর্ড ২১৯ কোটি ৯০ লাখ ডলার (২.১৯ বিলিয়ন ডলার) প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স এসেছিল দেশে। একক মাস হিসেবে যেটি ছিল প্রায় তিন বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। এর আগে ২০২০ সালের জুলাই মাসে সর্বোচ্চ ২৫৯ কোটি ৮২ লাখ ডলারের রেকর্ড প্রবাসী আয় এসেছিল।
খাত সংশ্লিষ্টদের মতে, ২০২০ সালে হুন্ডি বন্ধ থাকায় ব্যাংকিং চ্যানেলে সর্বোচ্চ সংখ্যক রেমিট্যান্স এসেছিল। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসীরা পাঠিয়েছেন ২ হাজার ১৬১ কোটি মার্কিন ডলারের রেমিট্যান্স। এটি এ যাবৎকালের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। এর আগে করোনাকালীন ২০২০-২১ অর্থবছরে সর্বোচ্চ দুই হাজার ৪৭৭ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স এসেছিল দেশে।
ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ: বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে প্রভাব কতটা? আতঙ্ক নয়, প্রয়োজন ঠান্ডা মাথায় মূল্যায়ন!
প্রকাশিত :
১৯:০১, ১৬ জুন ২০২৫
বিশ্ব রাজনীতির টানাপোড়েনের মঞ্চ আবারও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে সংঘর্ষের আশঙ্কা এতদিন আড়ালে থাকলেও এখন তা প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে। তীব্র উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ছে পুরো মধ্যপ্রাচ্যে, যার অভিঘাত পড়ছে বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারে এবং বিনিয়োগকারীদের মনে তৈরি করছে সংশয় ও অনিশ্চয়তা। তবে প্রশ্ন উঠছে—এই যুদ্ধ কি বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে বড় কোনো ধাক্কা আনবে?
সরাসরি উত্তর—খুব একটা নয়। তবে ‘না’ বলেই নিশ্চিন্ত হয়ে বসে থাকা যাবে না। পরিস্থিতি বুঝে, বিচক্ষণতার সঙ্গে এগোনোই হবে সবচেয়ে যুক্তিসঙ্গত কাজ।
যুদ্ধের প্রভাব বিশ্ববাজারে, তবে বাংলাদেশের বাজারের বাস্তবতা ভিন্ন
বিশ্বের বড় অর্থনৈতিক কেন্দ্রগুলোতে যখন রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেয়, তখন তা বাজারে বড় প্রভাব ফেলে—বিশেষ করে অপরিশোধিত জ্বালানি, স্বর্ণ ও ডলারের ক্ষেত্রে। ইতোমধ্যে নিউ ইয়র্ক মার্কেন্টাইল এক্সচেঞ্জে তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি প্রায় ১০ ডলার বেড়েছে। ভবিষ্যতে এ দাম আরও বাড়বে কি না, তা নির্ভর করছে যুদ্ধ কতদিন স্থায়ী হয় তার উপর।
কিন্তু বাংলাদেশের পুঁজিবাজার সেই ধাক্কা পায় অনেক দেরিতে এবং অনেকটাই মৃদু আকারে। কারণ পরিষ্কার—আমাদের শেয়ারবাজার এখনো প্রধানত স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের নিয়ন্ত্রণে। বিদেশি বিনিয়োগ মাত্র ৩ থেকে ৫ শতাংশ হওয়ায় বৈশ্বিক অস্থিরতার তাৎক্ষণিক প্রভাব এখানে তেমন পড়ে না।
বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কিত নন, বরং সচেতনভাবে অপেক্ষমাণ
যুদ্ধের খবরের পর ইউরোপ, আমেরিকা এমনকি কিছু এশীয় বাজারেও ব্যাপকভাবে শেয়ার বিক্রি করা হয়েছে। তবে বাংলাদেশে তেমন পরিস্থিতি দেখা যায়নি। বরং ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে বিগত কয়েকদিন ধরে একটি স্থিতিশীল এবং খানিকটা ইতিবাচক প্রবণতা লক্ষ করা গেছে।
ডিএসই-এর একজন অভিজ্ঞ ব্রোকার হাউজের কর্ণধার বলেন, “এখন আমাদের বিনিয়োগকারীরা অনেক পরিণত। আগের মতো আর গুজব শুনেই হুড়োহুড়ি শুরু করেন না। এখন তারা পরিস্থিতি দেখে, বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন।”
তেলের দাম বাড়লে তার ছায়া পড়বে অর্থনীতিতে, শেয়ারবাজারেও
বাংলাদেশ প্রায় পুরোপুরি জ্বালানি তেলের আমদানির উপর নির্ভরশীল। যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে এবং তেলের দাম যদি ১০০ ডলার ছাড়িয়ে যায়, তাহলে সরকারকে হয় বড় অঙ্কের ভর্তুকি দিতে হবে, নয়তো জনগণের উপর সেই বাড়তি মূল্য চাপিয়ে দিতে হবে। দুই ক্ষেত্রেই অর্থনীতিতে চাপ বাড়বে।
এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বাড়বে, পরিবহন খরচ ও কৃষি উৎপাদনের খরচও বেড়ে যাবে। সবকিছুরই প্রভাব পড়বে উৎপাদন খরচে, কমবে কোম্পানির মুনাফা, এবং একপর্যায়ে শেয়ারবাজারে তা প্রতিফলিত হবে।
তবে এর সবটাই নির্ভর করবে সরকারের বাজেট প্রস্তুতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ব্যবস্থাপনা এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পদক্ষেপের ওপর।
ব্যাংক ও বিমা খাত: বিনিয়োগকারীদের নিরাপদ আশ্রয়
যুদ্ধ পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকারীরা ঝুঁকিমুক্ত খাতের দিকে ঝোঁকেন। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ব্যাংক ও বিমা খাত এখনও তুলনামূলকভাবে নিরাপদ মনে করা হয়। বিশেষ করে যেসব ব্যাংক নিয়মিত লভ্যাংশ দেয় এবং আয় নির্ভরযোগ্য, সেসব কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ রয়েছে।
সম্প্রতি ব্যাংক খাতে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে—খেলাপি ঋণ কমেছে, ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের অগ্রগতি হয়েছে, এবং গ্রাহকের আস্থা কিছুটা ফিরে এসেছে। বিমা খাতেও একই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, বিশেষ করে জীবন বিমা কোম্পানিগুলোতে।
স্বর্ণ ও নিরাপদ সম্পদে ঝোঁক বাড়লেও বাংলাদেশের সুযোগ সীমিত
আন্তর্জাতিক অস্থিরতার সময়ে স্বর্ণের প্রতি ঝোঁক বাড়ে, কারণ এটি ঐতিহ্যগতভাবে ‘সেফ হ্যাভেন’ হিসেবে পরিচিত। তবে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে সরাসরি স্বর্ণে বিনিয়োগের সুযোগ সীমিত। ফলে কিছু বিনিয়োগকারী বিকল্প পন্থায় মূল্য সংরক্ষণের চেষ্টা করলেও, সেটি বাজারে বড় কোনো প্রভাব ফেলবে না।
যদি বাংলাদেশ ব্যাংক যথাযথভাবে রিজার্ভ ব্যবস্থাপনা করে এবং মুদ্রার স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে পারে, তবে টাকাও একটি স্থিতিশীল ও বিশ্বাসযোগ্য মুদ্রা হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
ডলার সংকট ও বৈদেশিক বাণিজ্যের ঝুঁকি
যুদ্ধের প্রভাবে যদি ডলারের মূল্য বিশ্ববাজারে বেড়ে যায়, তাহলে আমদানি খরচ বাড়বে। এর প্রভাব পড়বে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য থেকে শুরু করে শিল্প উৎপাদন পর্যন্ত। এতে মুদ্রাস্ফীতির চাপ বাড়বে এবং কিছু উৎপাদনমুখী কোম্পানির আয় হ্রাস পেতে পারে, যা শেয়ারের দামে নেতিবাচক প্রতিফলন ঘটাবে।
তবে বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে ডলার সরবরাহে সক্রিয় হয়েছে এবং বাজারে ভারসাম্য আনার চেষ্টা করছে, যা বিনিয়োগকারীদের আস্থা বজায় রাখতে সহায়ক।
সার্বিক মূল্যায়ন: যুদ্ধের প্রভাব সীমিত, তবে সচেতনতা জরুরি
সব দিক বিবেচনায় বলা যায়, বর্তমানে ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে তাৎক্ষণিক কোনো বড় ধরনের নেতিবাচক ধাক্কার আশঙ্কা নেই। কারণগুলো হলো:
বিদেশি বিনিয়োগের হার কম,
বাজার অধিকাংশই স্থানীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত,
অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক ভিত্তি এখনও তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল।
তবে যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে, এবং বিশ্ববাজারে জ্বালানি ও মুদ্রার অস্থিরতা বাড়লে, তার কিছু পরোক্ষ প্রভাব বাংলাদেশেও দেখা যেতে পারে। তখন কোম্পানির খরচ বাড়বে, মুনাফা কমবে এবং বাজারে কিছুটা নেতিবাচক সাড়া দেখা দিতে পারে।
বিনিয়োগকারীদের জন্য পরামর্শ: আবেগ নয়, বিশ্লেষণই হোক সিদ্ধান্তের ভিত্তি
এই মুহূর্তে বিনিয়োগকারীদের উচিত আতঙ্কিত না হয়ে তথ্য-ভিত্তিক বিশ্লেষণের উপর ভর করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। শক্ত ভিত্তির কোম্পানিতে, যেগুলো নিয়মিত লভ্যাংশ দেয় এবং যাদের ব্যালান্স শিট সুদৃঢ়, তাতে বিনিয়োগ ধরে রাখা বুদ্ধিমানের কাজ।
বিশ্ব রাজনীতি কারো হাতের মুঠোয় নেই। কিন্তু নিজের বিনিয়োগ পরিকল্পনা, অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ ও ভবিষ্যৎ মূল্যায়নের ভিত্তিতে সচেতন সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব। বাংলাদেশের শেয়ারবাজার এখন আগের তুলনায় অনেক বেশি সহনশীল, পরিণত এবং বিনিয়োগবান্ধব।
তাই যুদ্ধের শব্দে বিচলিত না হয়ে, বাস্তবতার নিরিখে বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাই হোক সবার লক্ষ্য।