নগরবাউল জেমসের আজ ৫৯তম জন্মদিন
তরুণ প্রজন্মের মনে অন্যরকম উন্মাদনা সৃষ্টিকারী এই রকস্টার একাধারে গায়ক-গীতিকার, গিটারিস্ট, সুরকার ও অভিনেতা ফারুক মাহফুজ আনাম জেমস। বলা চলে ব্যান্ড সঙ্গীত জগতের সমৃদ্ধ এক অধ্যায়ের নাম জেমস। বাংলাদেশের তো বটেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বাংলা এবং হিন্দি ভাষাভাষি সঙ্গীতপ্রেমী মানুষের কাছে এক মহাতারকা। তরুণ প্রজন্মের কাছে সঙ্গীত উন্মাদনার নাম। আজ ২ অক্টোবর তার জন্মদিন। ৫৯ পেরিয়ে আজ ষাট বছরে পা রাখলেন সঙ্গীতের নক্ষত্র নগর বাউল।
জন্মদিন উপলক্ষে জেমসের ম্যানেজার রুবাইয়াৎ রবিন ঠাকুর জানান, যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক স্থানে পারফর্ম করে কয়েকদিন আগে দেশে ফিরেছেন জেমস। শুক্রবারও একটি স্টেজ শোতে অংশ নেন তিনি। এ মাসে আরও কয়েকটি কনসার্টে অংশ নেয়ার কথা রয়েছে তার। আগামী ৫ অক্টোবর বসুন্ধরার আইসিবির ৪ নাম্বার হলে একটি কনসার্ট আছে। এছাড়া তার নতুন মৌলিক গান তৈরির পরিকল্পনা চলছে। নতুন বছরের প্রথম মাসেই তার নতুন মৌলিক গান আসার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে আপাতত গুরু বিশ্রামে আছেন বলে জানান তিনি।
এদিকে আজ জন্মদিনকে ঘিরে বরাবরের মতো জেমসের ঘরে থাকছে না কোনো আয়োজন। পারিবারিকভাবে একটা কেক কাটা হবে। সারাদিন বাসায় থাকবেন তিনি। এমনটিই জানান রবিন। তবে জেমস নিজে থেকে কোনো আয়োজন না রাখলেও তার দেশ বিদেশের ভক্তরা নানা আয়োজনের মাধ্যমে জেমসের জন্মদিন পালন করবেন।
১৯৬৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন জেমস নওগাঁয়। তবে বেড়ে ওঠেন চট্টগ্রাম শহরে। জেমসের বাবা ছিলেন একজন সরকারি কর্মচারী, যিনি পরবর্তীতে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। সঙ্গীত জেমসের পছন্দের হলেও তার পরিবারের পছন্দ ছিল না। গানের জন্য বাবার সাথে অভিমান করে তিনি কিশোর বয়সে ঘর ছেড়ে জেমস চট্টগ্রামের আজিজ বোর্ডিংয়ে থাকতে শুরু করেন। সেখানে থেকেই তার সঙ্গীতের ক্যারিয়ার শুরু হয়। এহসান এলাহী ফানটি ও কিছু বন্ধুদের নিয়ে ১৯৭৭ সালে তিনি রক ব্যান্ড ‘ফিলিংস’ প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে তিনি ‘নগর বাউল’ নামে ব্যান্ড দল গঠন করেন। ব্যান্ডের সদস্য হিসেবে ‘অনন্যা’ (১৯৮৯), ‘পালাবে কোথায়?’ (১৯৯৫), ‘দুঃখিনী দুঃখ করো না’ (১৯৯৭), ‘ঠিক আছে বন্ধু’ (১৯৯৯) এর মতো হিট অ্যালবাম উপহার দেন। ১৯৯০ এর দশকে ফিলিংসের মুখ্যব্যক্তি হিসেবে মূলধারার খ্যাতিতে উঠে আসেন, যা ‘বিগ থ্রি অফ রক’ এর মধ্যে অন্যতম, যারা এলআরবি এবং অর্কের পাশাপাশি বাংলাদেশে হার্ড রক সঙ্গীত বিকাশে ভূমিকা রাখে। ফিলিংসকে বাংলাদেশের সাইকেডেলিক রকের প্রবর্তক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাই তাকে ‘গুরু’ নামে অভিহিত করেন ভক্তরা।
নগরবাউল ব্যান্ডের মূল ভোকাল ও গিটারিস্ট জেমস। কবি শামসুর রাহমান, প্রিন্স মাহমুদ, লতিফুল ইসলাম শিবলীর লেখা গান তিনি কণ্ঠে তুলে নিয়েছেন, যেগুলোর বেশিরভাগই জনপ্রিয় হয়েছে। শিল্পী জীবনের প্রথম দিকে তিনি জিম মরিসন, মার্ক নফলার এবং এরিক ক্লাপটনের মতো সঙ্গীত শিল্পীদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হন। ১৯৮৭ সালে ফিলিংস ব্যান্ডের সাথে তার প্রথম অ্যালবাম ‘স্টেশন রোড’ রিলিজ হয়। ১৯৮৮ সালে মুক্তি পায় তার প্রথম একক অ্যালবাম ‘অনন্যা’। বাংলা ব্যান্ড সঙ্গীতে আলাদা কণ্ঠের কারণে পশ্চিমবঙ্গেও খুব জনপ্রিয় জেমস। সেই সূত্রে ২০০৪ সালে বাঙালি সঙ্গীত পরিচালক প্রিতমের সাথে কাজ করেন। ২০০৫ সালে তিনি বলিউডের ‘গ্যাংস্টার’ সিনেমায় প্লে-ব্যাক করেন। তার গাওয়া ‘ভিগি ভিগি’ গানটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় এবং সে সময় এক মাসেরও বেশি সময় তা বলিউড টপচার্টের শীর্ষে ছিল। এছাড়া ২০০৬ সালে বলিউডের ‘লামহে’ চলচ্চিত্রে ‘চল চলে’ গানে কণ্ঠ দেন। ২০০৭ সালে ‘লাইফ ইন এ মেট্রো’ সিনেমায় প্লেব্যাক করেন। সর্বশেষ তিনি ‘ওয়ার্নিং নামের হিন্দি চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক করেছেন। তার গাওয়া ‘বেবাসি’ গানটি ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে মুক্তি পায়।
চলচ্চিত্রে তার গাওয়া গান দুটি হলো ‘রিশতে’ এবং ‘আলবিদা’ (রিপ্রাইস)। সর্বশেষ হিন্দি চলচ্চিত্রে তিনি ‘ওয়ার্নিং’ সিনেমায় তার গাওয়া ‘বেবাসি’ গানটি মুক্তি পায় ২০১৩ সালের। ২০০০ সালের প্রথম দিকে জেমস পেপসির বিজ্ঞাপন এবং ২০১১ সালে এনার্জি ড্রিংক বø্যাক হর্সের বিজ্ঞাপনে কাজ করেন। বলিউডের ‘লাইফ ইন এ মেট্রো’ এবং ২০১৩ সালে ‘ওয়ার্নিং’ সিনেমার ‘বেবাসি’ গানের চিত্রেও কাজ করেন। জেমস গাজী আহমেদ শুভ্রর সাথে ‘রেড ডট এন্টারটেইনমেন্ট’ প্রডাকশন হাউস পরিচালনা করেন।
দেশের ব্যান্ড মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে অসংখ্য জনপ্রিয় গান উপহার দিয়েছেন জেমস। তার উল্লেখযোগ্য গানের মধ্যে রয়েছে ‘তারায় তারায়’, ‘লেইস ফিতা লেইস’, ‘সুলতানা বিবিয়ানা’, ‘হতেও পারে এই দেখা শেষ দেখা’, ‘কবিতা তুমি স্বপ্নচারিণী’, ‘দুষ্টু ছেলের দল’, ‘দিদিমণি’, ‘দুঃখিনী দুঃখ করো না’, ‘তোর সব কিছুতে নয়ছয়’, ‘বাবা কত দিন দেখি না তোমায়’, ‘গুরু ঘর বানাইলা কী দিয়া’, ‘লিখতে পারি না কোনো গান’, ‘এক নদী যমুনা’, ‘মা’, ‘বাংলাদেশ’ ইত্যাদি। এছাড়া জেমসের গাওয়া জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে ‘স্টেশন রোড’ (১৯৮৮), ‘অনন্যা’ (১৯৮৮),‘জেল থেকে বলছি’ (১৯৯৩), ‘পালাবে কোথায়’ (১৯৯৫), ‘নগর বাউল’ (১৯৯৬), ‘দুঃখিনী দুঃখ করোনা’ (১৯৯৭), ‘লেইস ফিতা লেইস’ (১৯৯৮), ‘ঠিক আছে বন্ধু’ (১৯৯৯),‘কালেকশন অফ ফিলিংস’ (১৯৯৯), ‘দুষ্টু ছেলের দল’(২০০১), ‘আমি তোমাদেরই লোক’ (২০০৩), ‘জনতা এক্সপ্রেস’ (২০০৫) ‘তুফান’ (২০০৬), কাল যমুনা (২০০৮) প্রভৃতি। বাংলা চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক ‘কষ্ট’ (২০০০), ‘আসবার কালে আসলাম একা’ (মনের সাথে যুদ্ধ, ২০০৭) ‘মাটির ঠিকানা’ (মাটির ঠিকানা, ২০১৩), ‘দেশা আসছে’ (দেশা : দ্য লিডার, ২০১৪), ‘এত কষ্ট কষ্ট লাগে’ (ওয়ার্নিং, ২০১৫) ‘বিধাতা’ (সুইটহার্ট, ২০১৬), ‘তোর প্রেমেতে অন্ধ হলাম’ (‘সত্তা’, ২০১৭) ‘প্রেম ও ঘৃণা’ (জিরো ডিগ্রি), হিন্দি চলচ্চিত্র ‘ভিগি ভিগি’ (২০০৫, গ্যাংস্টার), ‘চল চলে’ (২০০৬, ও লামহে), ‘আলবিদা’ (রিপ্রাইস), ‘রিশতে’ (২০০৭, লাইফ ইন এ মেট্রো), ‘বেবাসি (২০১৩, ওয়ার্নিং থ্রিডি)।
সঙ্গীত ক্যারিয়ারে নানা সম্মানায় ভূষিত হয়েছেন জেমস। এর মধ্যে ‘দেশা: দ্য লিডার’ সিনেমার জন্য ২০১৪ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান জেমস। এছাড়া ২০১৬ সালে সিটিসেল-চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ডস, মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার ২০০১, বিজ্ঞাপনের জন্য সেরা মডেল, সিজেএফবি পারফরম্যান্স পুরস্কার প্রভৃতি। সব মিলিয়ে এই ৬ দশকের জীবনে নানা অর্জন তার প্রাপ্তির ঝুলিতে রয়েছে। ব্যক্তিজীবনে জেমস দুই বিয়ে করেছেন। তার প্রথম স্ত্রী রথি ছিলেন একজন চলচ্চিত্র অভিনেত্রী। ১৯৯১ সালে বিয়ের পর ২০০৩ সালে তাদের বিচ্ছেদ হয়ে যায়। রথির সঙ্গে বিচ্ছেদের আগেই ২০০২ সালে জেমস বিয়ে করেন বেনজির সাজ্জাদকে। জেমসের দুই কন্যা সন্তান জান্নাত এবং জাহান ও পুত্র সন্তানের নাম দানেশ।