img

আমেরিকা ইস্যুতে শেখ হাসিনা ও ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্য কী ইঙ্গিত দিচ্ছে?

প্রকাশিত :  ১২:০৬, ০৪ অক্টোবর ২০২৩
সর্বশেষ আপডেট: ১২:২০, ০৪ অক্টোবর ২০২৩

আমেরিকা ইস্যুতে শেখ হাসিনা ও ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্য কী ইঙ্গিত দিচ্ছে?

তলে তলে আপস হয়ে গেছে - আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের এমন বক্তব্য বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন আলোচনার সূত্রপাত করেছে। মি. কাদের এই বক্তব্য দেবার একদিন আগেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লন্ডনে বলেছেন, "বেশি স্যাংশন দিলে আমরাও স্যাংশন দিতে পারি।" তিনি আমেরিকাকে ইঙ্গিত করে কড়া সমালোচনা করেছেন। আমেরিকা ইস্যুতে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্য আলাদা ধরণের। এটি নিয়েই মূলত কৌতুহল।

মি. কাদের তার বক্তব্যে ভারতের প্রসঙ্গও টেনে এনেছেন। তার কথায় - দিল্লি আছে। আমেরিকার দিল্লিকে দরকার।

"আমরা আছি, দিল্লিও আছে। দিল্লি আছে, আমরা আছি। শত্রুতা কারো সঙ্গে নেই। সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব। শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর কন্যা, এমন ভারসাম্য সবার সঙ্গে করে ফেলেছেন, আর কোনো চিন্তা নেই," মঙ্গলবার এক সমাবেশে বলেন ওবায়দুল কাদের।

শেখ হাসিনা এবং ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যের তাৎপর্য কী? কিংবা এসব বক্তব্য কী বার্তা দিচ্ছে?

বিষয়টি নিয়ে আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতা কোন মন্তব্য করতে চাননি। তারা মনে করেন, সভাপতি ও সাধারন সম্পাদকের বক্তব্য নিয়ে প্রতিক্রিয়া দেয়া ঠিক হবে না।

'অনর্থক বক্তব্য নয়'

তবে দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাসিম বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, দলের সভাপতি ও সাধারন সম্পাদকের বক্তব্যের মধ্যে কোন ভিন্নতা নেই।

"রাজনৈতিক নেতা হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের পরিস্থিতি অনুযায়ী নির্দেশনামূলক বক্তব্য দিয়েছেন," বলেন মি. নাসিম।

"প্রধানমন্ত্রী যথার্থই বলেছেন ভিসা নীতি- সেটা কার্যকর হোক আর না হোক, তা নিয়ে আমাদের উদ্বেগের কিছু নেই। আর সাধারণ সম্পাদক যে বক্তব্য নিয়েছেন সেটিও অনর্থক নয়। এর মর্মার্থ দলের ভেতরে বাইরে যারা বোঝার তারা বুঝেছেন," বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

মি. নাসিম বলেন, দলের নেতাদের নিজের দলের নেতাকর্মীদের যেমন বার্তা দেয়ার বিষয় থাকে, তেমনি যারা অপপ্রচার করে তাদের জবাব দেয়ারও বিষয় থাকে। প্রধানমন্ত্রী ও সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্যে তারই প্রতিফলন ঘটেছে বলে তিনি মনে করেন।

দলটির তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক সেলিম মাহমুদ বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র এবং অন্য আরেকটি দেশের নিজস্ব ভিসা নীতি নিয়ে বাংলাদেশের কারও চিন্তার কিছু নেই। সেটিই বোঝানোর চেষ্টা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

“সাধারণ সম্পাদক বোঝাতে চেয়েছেন যে ভারত ও বাংলাদেশের বন্ধুত্ব এবং জাতীয় স্বার্থ একই সূত্রে গাঁথা। এখানে বাংলাদেশকে আলাদা করে ক্ষুদ্র বা বিচ্ছিন্ন ভাবার সুযোগ নেই,” মি. মাহমুদ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন।

'নেতা-কর্মীদের চাঙ্গা করতে এ বক্তব্য'

আমেরিকা ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বক্তব্য দিয়ে আসছেন ২০২১ সালের ডিসেম্বর থেকে।তখন বাংলাদেশের এলিট ফোর্স র‍্যাব ও তার কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে আমেরিকা। এরপর থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বর্তমান সরকারের এই টানাপোড়েন শুরু হয়।

এরপর যুক্ত হয় আগামী নির্বাচন নিয়ে ঢাকার নিযুক্ত আমেরিকার রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের নানা তৎপরতা, যা নিয়ে প্রকাশ্যেই বিভিন্ন সময় অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়েছে আওয়ামী লীগের দিক থেকে।

তবে আমেরিকাকে নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ আরো বেশি সমালোচনামুখর হয় নির্বাচনকে সামনে রেখে ভিসা নীতি ঘোষণার পর।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার মনে করেন, দলের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের 'চাঙ্গা করতেই' আমেরিকা ইস্যুতে এমন ধরণের বক্তব্য দিচ্ছেন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা।

“কারণ নির্বাচন সামনে রেখে আমেরিকা আর কী পদক্ষেপ নেয় বা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কী করে- তা নিয়ে দলটির বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা আছে। সে কারণেই হয়তো পরিস্থিতিকে সহজ করতে কিংবা কর্মী সমর্থকদের উজ্জীবিত করতে এমন বক্তব্য এসেছে শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের দিক থেকে। এগুলো খুব একটা পরিকল্পিত বলে মনে হয়নি বরং মনে হয়েছে কথার ফুলঝুরি মাত্র,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

আপসের দাবি কেন?

আ্ওয়ামী লীগের নেতাদের সাথে কথা বলে এমন ধারণা পাওয়া গেছে যে ওবায়দুল কাদের হয়তো ভিসা নীতিসহ নির্বাচনকে সামনে রেখে আমেরিকার ক্রমবর্ধমান চাপ নিয়ে নেতাকর্মীদের ‘মনস্তাত্ত্বিক চাপ’ কমানোর কৌশল হিসেবে এসব কথা বলছেন।

কেউ কেউ আবার বলছেন ‘এটি নিতান্তই রাজনৈতিক কৌশল’ এবং এর মূল উদ্দেশ্য হলো যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে বিরোধী দল বিশেষ করে বিএনপি যেভাবে ব্যাখ্যা করছে তার পাল্টা ধারণা জনমনে তৈরি করা।

আওয়ামী লীগের কোন কোন নেতা বলছেন, ভিসা নীতি নিয়ে পুলিশ, প্রশাসন কিংবা রাষ্ট্রের কোন অংশের মধ্যে যাতে ‘চিন্তার ছাপ’ তৈরি না হয় সেজন্য হয়তো মি. কাদের এভাবে বলে থাকতে পারেন।

ড. সেলিম মাহমুদ মনে করেন, শেখ হাসিনা এবং ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্য পরস্পরবিরোধী হয়েছে এমনটা তারা মনে করেন না।

“প্রধানমন্ত্রী পরিষ্কার করে বলেছেন যে ভিসা নীতি একটা দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। এটি বাংলাদেশের কারও জন্য চিন্তার বিষয় নয়। অন্যদিকে ওবায়দুল কাদের বলতে চেয়েছেন যে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে নিবিড় বন্ধুত্ব রয়েছে। উভয় দেশের জাতীয় স্বার্থ একই সূত্রে গাঁথা। আবার ভারতের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আছে, বাংলাদেশেরও আছে। তাই যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক নিয়ে অপপ্রচারের যে সুযোগ নেই সেটিই আমাদের সাধারণ সম্পাদক বলেছেন,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

‘তলে তলে আপস হয়ে গেছে’ বলে মি. কাদের কী বোঝাতে চেয়েছেন? সে প্রসঙ্গে মি. মাহমুদ কোন মন্তব্য করেননি।

তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক শান্তনু মজুমদার মনে করছেন করছেন উভয় নেতার বক্তব্যই মাঠে দেয়া রাজনৈতিক বক্তৃতার অংশ, যেগুলো তারা নেতাকর্মীদের 'উজ্জীবিত করার' জন্যই বলেছেন বলে তিনি মনে করেন।

“ এ বিষয়ে ওনাদের বক্তব্যগুলো খুব পরিকল্পিত বলে মনে হয়নি বরং দুটো বক্তব্যই মনে হচ্ছে কথার ফুলঝুরি। এর কোনটাই দলের অবস্থানকে প্রতিফলিত করেনি"

"রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রে এটা কমন স্ট্রাটেজি। সমর্থকদের মনোবল উজ্জীবিত রাখা। এটাই শেষ কথা নয়। নির্বাচনকে সামনে রেখে সমর্থক গোষ্ঠীকে চাঙ্গা রাখার একটা প্রয়াস,” বলছিলেন মি. মজুমদার।

বিবিসি বাংলা

মতামত এর আরও খবর

img

করিম চাচার খোলা চিঠি: হর্নের শব্দে ম্লান আমার শেষ বেলার শান্তি!

প্রকাশিত :  ১৩:০১, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪
সর্বশেষ আপডেট: ১৩:৩২, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪

আমার নাম করিম উদ্দিন। বয়স এখন ৮০ ছুই ছুই। শরীরটা আর আগের মতো নেই। হাত-পায়ের জোর আগের চেয়ে কমে গেছে। চোখের দৃষ্টি ঝাপসা, কানেও ঠিকমতো শুনতে পাই না। তবুও, আমার জীবনটা ভালোই চলে যাচ্ছিল। গ্রামের ছোট্ট বাড়ি, একটু জায়গা জমি, চারপাশে গাছগাছালি—এই নিয়েই আমি থাকি। এ বয়সে এসে মানুষের চাওয়ার আর কী থাকতে পারে? শান্তি। হ্যাঁ, শান্তি-ই তো চেয়েছিলাম। কিন্তু, এ দেশে শান্তিতে মরতে পারবো কিনা সেটা নিয়ে বড় সন্দেহ!

ছেলেমেয়ে বড় হয়েছে, তারা এখন শহরে থাকে। কেউ কেউ বিদেশেও থাকে। ওদের সঙ্গে যখন ফোনে কথা হয়, একটাই বিষয় ওরা বারবার বলে—বিদেশে নাকি কেউ রাস্তায় হর্ন বাজায় না। রাস্তায় গাড়ি চলে, কিন্তু সেই গাড়ি যেন শব্দহীন। ওদের কথা শুনে মনে হয়, বিদেশ মানেই যেন এক স্বর্গ! আমি তো জানি না, ওই স্বর্গের আসল চিত্র কেমন। তবে আমার এই ছোট্ট গ্রামে শান্তির ন্যূনতম টুকুও নেই।

গ্রামের রাস্তায় এখন প্রচুর গাড়ি চলে। একটু আগেও যেখানে কাঁঠাল গাছের ছায়ায় বসে বিশ্রাম নিতাম, এখন সেখানে বড় বড় বাস, ট্রাক, প্রাইভেট কার, মোটরসাইকেল দাপিয়ে বেড়ায়। সবচেয়ে কষ্টের বিষয় হচ্ছে, এই সব গাড়ির চালকরা যেন হর্ন না বাজিয়ে থাকতে পারে না। যেখানে যানবাহনের অল্পই প্রয়োজন, সেখানে মানুষ প্রতিনিয়ত হর্ন বাজিয়ে এক ধরনের আতঙ্ক তৈরি করে। হর্নের সেই তীব্র শব্দ আমার বয়স্ক কানে বাজে বুলেটের মতো। হৃদয় যেন থেমে যায় মাঝে মাঝে। মনে হয়, মরার আগেই শান্তি মিলবে না এই দেশে!

ছেলেমেয়েদের বিদেশে যাওয়ার পরে মাঝে মাঝে ওদের সঙ্গে কথা বলি। ওরা বলেছে, বিদেশে কেউ রাস্তায় হর্ন বাজায় না। গাড়ি চলে নিয়ম মেনে, মানুষের প্রতি সম্মান দেখিয়ে। আর আমাদের দেশে? রাস্তায় বেরুলে মনে হয়, মানুষ যেন প্রতিযোগিতায় নেমেছে কে কত জোরে হর্ন বাজাতে পারে। প্রত্যেকটা হর্ন যেন গায়ের মধ্যে কাঁপুনি ধরিয়ে দেয়। এ দেশে কি কেউ মানুষের কানের মর্ম বোঝে না? বয়স্ক মানুষদের প্রতি কি কোনো সম্মান নেই?

শহরে তো হর্নের শব্দ সহ্য করার মতো নয়, কিন্তু গ্রামেও এখন এমন অবস্থা হয়ে গেছে যে শান্তি নেই। রাস্তায় গাড়ি চলবে, এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু, হর্নের দরকার কী? ওরা কি জানে না, হর্ন বাজানোর ফলে শুধু আমার মতো বৃদ্ধরাই কষ্ট পায় না, ছোট ছোট বাচ্চারাও ভয় পায়। আমার নাতি-নাতনিরা যখন আসে, ওদের মুখে কান্নার শব্দ শোনা যায়। এত তীব্র শব্দ, বাচ্চাগুলো ভয়ে কুঁকড়ে যায়। আমি ভাবি, এটাই কি আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ?

আমার আর কিছুদিনই বাঁচার সম্ভাবনা। মরার আগে একটু শান্তি চেয়েছিলাম। কিন্তু এ হর্নের আওয়াজ আমার সেই শেষ বেলার শান্তিটুকু কেড়ে নিয়েছে। প্রার্থনা করি, এ দেশের মানুষ যেন কিছুটা সহানুভূতিশীল হয়। হর্নের জন্য অন্যের কষ্টের বিষয়টা যেন তারা বোঝে। মানুষের কান, হৃদয়—এসবও তো সংবেদনশীল। গায়ের উপর দিয়ে গাড়ি চলে গেলে যেমন ব্যথা হয়, তেমনি হর্নের তীব্র আওয়াজও আমার মাথার মধ্যে কাঁপুনি ধরে। আমি আর পারি না, বুঝলে!

বিদেশে থাকে এমন কিছু মানুষ আমাকে একবার বলেছিল, ওদের রাস্তায় নাকি আইন খুব কঠিন। কেউ হর্ন বাজালে সাথে সাথেই শাস্তি পায়। ভাবলাম, আমাদের দেশে এমন কোনো নিয়ম হবে না কেন? আমাদের দেশেও তো আইন আছে, কিন্তু কেন মানা হয় না? কোথায় সেই শৃঙ্খলা? শুধু গাড়ির চালকেরাই নয়, সবাই যেন হুটহাট যা খুশি তাই করে বেড়ায়। আইন আছে, কিন্তু তার প্রয়োগ নেই। আর তার ফল ভোগ করছি আমরা, সাধারণ মানুষ।

আমার শেষ ইচ্ছা শুধু একটাই—এই দেশটা যেন শান্তি পায়। মানুষের মধ্যে মানবিকতা জাগুক। হর্নের আওয়াজে আমি হয়তো আমার বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেব, কিন্তু আমার মতো যারা বয়স্ক, তাদের কষ্ট যেন আর সহ্য করতে না হয়। তরুণরা যেন এ বিষয়টি নিয়ে ভাবে, এই সমস্যার সমাধান খোঁজে। শুধু বয়স্করাই নয়, এই হর্নের সমস্যা থেকে মুক্তি পেলে শিশুরা নিরাপদে বেড়ে উঠতে পারবে। আমাদের সমাজ, আমাদের দেশ, এসব তো আমাদেরই, তাই আমাদের দায়িত্ব এই দেশটাকে সুন্দর করে তোলা।

এখন হয়তো আমার সময় শেষের দিকে, কিন্তু এই চিঠিটা লিখে রেখে যাচ্ছি তাদের জন্য যারা আমার পরে আসবে। দেশটা এমন হোক, যেখানে রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে মানুষকে হর্নের শব্দে কষ্ট পেতে হবে না।

মতামত এর আরও খবর