img

মৃত্যুই কি ফিলিস্তিনী মানুষের স্বাধীনতা?

প্রকাশিত :  ১৫:৩৭, ০২ নভেম্বর ২০২৩

মৃত্যুই কি ফিলিস্তিনী মানুষের স্বাধীনতা?

Palestine-A four thousand year history — এই বইটির লেখক নূর মাসালহা। তিনি একজন প্রফেসর এবং প্যালেষ্টাইনের (ফিলিস্তিন) বংশোদ্ভূত। এই বইটি আমি পড়িনি, তবে বইয়ের শুরুতে লেখা ফিলিস্তিনের গেঁাড়ার ইতিহাস আমি পেয়েছি। বর্তমানে ফিলিস্তিনি জনগনের উপর যে নির্মম হত্যাযজ্ঞ চলছে তা নিয়ে লেখার আগে এই বই থেকে ফিলিস্তিনের অতীতের কিছু ইতিহাস তুলে ধরছি। তাহলে পাঠকরা জানতে পারবেন ফিলিস্তিনের জন্মের গোড়ার কথা এবং এই বীর জাতির যুদ্ধের ইতিহাস।  

লেখক নূর মাসলাহা লিখেছেন, “প্যালেষ্টাইন বা ফিলিস্তিন নামটা এসেছে বাইবেলের ওল্ড টেষ্টামেন্ট থেকে। তবে প্যালেষ্টাইন দেশটি কিন্তু বাইবেলের থেকেও পুরনো। আর এই বিষয়টিকেই জোর দিয়ে দেখিয়েছেন তিনি। আমরা যদি ফিলিস্তিন জাতি এবং তাদের সংস্কৃতির আদি উৎসবের খেঁাজ করতে যাই, তা হলে দেখা যাবে —বাইবেলের বহু আগে থেকেই ফিলিস্তিনি জাতির একটি নিজস্ব 

সংস্কৃতি এবং পরিচয় রয়েছে। সেই ব্রোঞ্জ যোগ থেকে শুরু করে আমরা যদি বিভিন্ন ধরণের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন দেখি, তাহলে দেখা যাবে বাইবেলের বিভিন্ন ঘটনার কারণে আসলে ফিলিস্তিনের প্রকৃত ইতিহাস বিকৃত হয়েছে। ইসরায়েলের সাথে কনফ্লিক্টও এর একটি বড় কারণ। তবে ফিলিস্তিনের ইতিহাস আসলে খুবই রোমাঞ্চকর এবং অনেক জটিল। 

সবচেয়ে প্রাচীনকালে যেসব অঞ্চলে মানুষ বসতি স্থাপন করেছিল তার মধ্যে একটি হলো বর্তমান ইসরায়েল—প্যালেষ্টাইন অঞ্চল। কিন্তু এই অঞ্চলের দখল নিয়ে ইতিহাসের প্রথম থেকেই চলছে একের পর এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। ভেবে অবাক হতে হয়, কয়েক হাজার বছরের পুরনো সেই লড়াই এখনো পর্য্যন্ত চলছে। তার অবশ্য কারণও রয়েছে। এদিক থেকে বিবেচনা করলে,  এই অঞ্চলটি হলো তিনটি মহাদেশের মিলনস্থল, তাই ভূ—রাজনৈতিক কারণে অঞ্চলটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কালে কালে বিভিন্ন সা¤্রাজ্য এই অঞ্চলকে দখলে রাখতে চেয়েছে। 

প্রাচীন মিশরীয়রা, প্রাচীন পার্সিয়ানরা, আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট, রোমান সা¤্রাজ্য, মধ্যযুগীয় মুসলিম রাজবংশ, ক্রুসেডাররা, অটোম্যান সা¤্রাজ্য, আর একদম হাল আমলে এসে ব্রিটিশ সা¤্রাজ্য এই অঞ্চল শাসন করেছে। ব্রিটিশরা এই অঞ্চল ছেড়ে দেওয়ার পর সারা বিশ্বের ইহুদীরা এই এলাকার একটি বড় অংশ দখল করে তাদের নিজেদের জাতির জন্য ”ইসরায়েল রাষ্ট্র” স্থাপন করে। আর এর পর থেকে লেগেই আছে বিখ্যাত ইসলাইল—প্যালেষ্টাইন যুদ্ধ। 

ইসরায়েলের ইহুদীরা মনে করে যে, প্যালেষ্টাইনের বাসিন্দারা এই অঞ্চলে নতুন এসে বসতি গড়েছে, আর ইহুদীরা নিজেরা হলো এই অঞ্চলের আদি বাসিন্দা। কিন্তু নূর মাসলাহা সম্পূর্ণ ভিন্ন এক বাস্তবতা তুলে ধরেছেন তার এই বইতে। তিনি প্রচুর পরিমান প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ ও প্রাচীন লিপির সাহায্যে দেখিয়েছেন যে, প্যালেষ্টা্ইন ধারণাটাই আসলে বাইবেলের প্যালেষ্টাইনের চেয়ে অনেক পুরনো। অর্থাৎ ইহুদীরা ওল্ড টেষ্টামেন্টের রেফারেন্স দিয়ে যে ইতিহাস বলে, আসলে এই অঞ্চলের ইতিহাস আরও বেশি পুরনো। তার মানে ওল্ড টেষ্টামেন্টে উল্লিখিত সময়ে আদি ইহুদী গোষ্ঠী যখন এই অঞ্চলে এসে বসতি স্থাপন করে, তার আগের থেকেই এই অঞ্চলে প্যালেষ্টাইনের জনগন বসবাস করতো। তিনি ব্রোঞ্জ যুগ থেকে শুরু করে আধুনিক যুগ পর্যন্ত প্যালেষ্টাইন অঞ্চলের ইতিহাসকে একদম ছবির মত করে তুলে ধরেছেন।” 

নূর মাসলাহার উপরোক্ত লেখাটি পড়ে জানা গেলো যে, প্যালেষ্টাইনের বাসিন্দারা কোন দিনই তাদের দেশে স্বাধীন ভাবে থাকার বা চলাফেরা করার স্বাধীনতা পায়নি। কি দুর্ভাগ্য তাদের। প্রাচীন মিশরীয়রা থেকে শুরু করে ব্রিটিশ সা¤্রাজ্য পর্যন্ত এই অঞ্চল শাসন করেছে হাজার হাজার বছর, শাসন আর শোষনের মধ্য দিয়ে কাটাতে হয়েছে এই বীর ফিলিস্তিনীদের। হাজার হাজার বছরে কত লাখ লাখ ফিলিস্তিনী মানুষ তাদের দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছেন দখলদার বাহিনীর সাথে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে তার কোন  হিসাব নেই! আমার ভাবতেও অবাক লাগে যে, এই হাজার হাজার বছরের মধ্যেও কি মুসলমান রাষ্ট্রগুলো একত্রিত হয়ে ফিলিস্তিনীদের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণার  আওয়াজ তুলতে পারলো না? যদিও এই অঞ্চলটি তিনটি মহাদেশের মিলনস্থল, তাই ভূ—রাজনৈতিক কারণে অঞ্চলটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তার পরওতো এই মানুষগুলোকে তাদের চলাফেরা, নিজেদের কৃষ্টি বজায় রেখে স্বাধীনভাবে চলা ফেরার সুযোগ দেয়া উচিৎ ছিলো। এই হাজার হাজার বছর ধরে কোন মুসলমান দেশই তাদের কোনো গুরুত্ব দেয়নি বলেই আজও চলছে তাদের উপর অত্যাচার নির্য্যাতন, হত্যাযজ্ঞ। এই ইহুদীরা জানে যে, তাদের সাথে রয়েছে বর্তমান বিশ্বের একটি বৃহৎ শক্তি আমেরিকা এবং তাদের সাথে যুক্তরাজ্য সহ ইউরোপীয়ান ইউনিয়নের দেশগুলো। তারাই মুসলমান দেশগুলোর মধ্যে একটি সাথে আরেকটির দ্বন্ধ বাঁধিয়ে রেখেছে। যদিও তারা বৃহৎ শক্তি কিন্তু তারপরও তারা মুসলমানদের ভয়ে আতঙ্কিত। তারা ভালো করেই জানে যে, যদি মুসলিম দেশগুলো একই ছাদের নীচে চলে আসে, তাহলে তারা যতো শক্তিশালী হোক না মুসলমানের সাথে যুদ্ধ করে জয়ী হতে পারবে না। এ কারণেই তারা ভবিষ্যৎ মাষ্টার প্লান করে অধিকাংশ মুসলমান দেশগুলোতে আমেরিকা তাদের সামরিক ঘাঁটি তৈরী করে শক্ত আসন গড়ে তুলেছে এবং বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দিয়ে এই দেশগুলোকে তাদের হাতের মুঠোয় রেখে দিয়েছে। সুতরাং ফিলিস্তিনের বর্তমানের এই ক্রান্তিলগ্নে, তাদের দু:সময়ে যেখানে গত কয়েক সপ্তাহের যুদ্ধে প্রায় ৬ হাজার মানুষ, সদ্য ভূমিষ্ট হওয়া শিশু থেকে শুরু বুড়ো লোককে আত্মাহুতি দিতে হয়েছে এবং দিন দিন শত শত মানুষ ইরায়েলের আগ্নেয়াস্ত্রের হামলায় মারা যাচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে, ”মৃত্যুই যেন তাদের স্বাধীনতা!” একমাত্র ইরান, ইরাক, সৌদি আরব ছাড়া এই যুদ্ধের বিরুদ্ধে কোন মুসলমান দেশই এ ব্যাপারে কোন মাথা গলাচ্ছে না, তবে এর মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই ইসরায়েলের এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কঠোর ভাষায় নিন্দা জ্ঞাপন  করেছেন এবং অনতিবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন। 

আল জাজিরা ডট কম এর ৩১ অক্টোবরের খবরে প্রকাশ, গত ৭ অক্টোবর থেকে ইসরায়েলী দখলদার বাহিনীর এয়ার রেইড এবং গ্রাউন্ড এটাক’এ গাজায় এখন পর্যন্ত প্রতিদিন প্রায় ৪২০ জন করে ছোট ছোট শিশুরা নিহত হচ্ছে এবং আহত হচ্ছে। হাজারো শিশু এবং মহিলা, পুরুষ নিহত হওয়ার কারণে পুরো গাজা উপত্যকা একটি কবরস্থানে পরিণত হয়েছে।  

ফিলিস্তিনীদের উপর ইসরায়েলের এই আক্রমনের প্রধান লক্ষ্যই হচ্ছে, পুরো গাজা এবং ফিলিস্তিন এলাকা দখলে নেয়া এবং ভবিষ্যতে যাতে তারা মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে সে জন্য সদ্য ভুমিষ্ট হওয়া সন্তানদের থেকে শুরু করে মধ্যবয়সী যুবক যুবতীদের হত্যা করা। এটি হচ্ছে আমেরিকা— ইসরায়েলের একটি মাষ্টারপ্ল্যান। এ কারণেই তারা গাজায় বসবাসরত অধিবাসীদের গাজা ছেড়ে যাওয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছে সেই সঙ্গে ফিলিস্তিনীদেরও। গাজাবাসী এবং ফিলিস্তিনীরা যদি আত্মরক্ষার জন্য তাদের বসতি  ছেড়ে চলে যায়, তা হলে হয়তো দেখা যাবে যে, জাতিসংঘের মাধ্যমে হামাস, হিজবুল্লাহ এবং ইসলামিক জেহাদের নেতৃবৃন্দদের গাজায় যুত্থবিরতির প্রস্তাব দেয়া হবে। এই যুদ্ধ বিরতি মেনে নিলে তখন তারা গাজা এবং ফিলিস্তিনকে সুন্দর ভাবে ঘরবাড়ি তৈরী করে দেয়ার জন্য এলাকা থেকে সরে যাওয়ার জন্য বলবে। তারা সরে গেলে এই এলাকাগুলোকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করে ঠিকই সুন্দর ভাবে বড় বড় অট্টালিকা গড়ে তোলা হবে, তবে এখানে স্থান হবে ইহুদীদের। এভাবেই তারা দখল করে নেবে পুরো গাজা, ফিলিস্তিন এলাকা। 

এখন কথা হচ্ছে, বিশ্বের ৫৭টি মুসলিম দেশের শাসকরা কি ইহুদীদের এই মাষ্টার প্লানের চিন্তাধারা বুঝতে পারছেন? যদি বুঝে থাকেন, তাহলে এখনই সব মুসলিম দেশগুলোকে একত্রিত হয়ে একই ছাদের নীচে আসতে হবে এবং সিদ্ধান্ত নিতে হবে কি ভাবে ইরায়েলের হাত থেকে গাজা এলাকা রক্ষা করা যায় এবং ফিলিস্তিনী জনগণকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে মূল্যায়ন করা যায়। এ ব্যাপারে বলিষ্ট ভূমিকা রাখতে পারে সৌদি আরব। কেননা, সৌদি আরব হচ্ছে বিশ্বের মুসলমান দেশগুলোর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ। সৌদি বাদশা যদি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে এক হয়ে কাজ করার জন্য মুসলমান দেশগুলোর রাষ্ট্র প্রধানদের আহ্বান জানান তাহলে আমার মনে হয়, এই আহ্বানে সবাই সাড়া দেবে। এরপর কোন এক দেশে রাষ্ট্রপ্রধানরা একত্রে বসে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন কি ভাবে ইসরায়েলের এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়া যায়। এই বিষয়টি ভালো ভাবে চিন্তা ভাবনা করে একটা ফমুর্লা বের করার জন্য সব মুসলমান দেশের রাষ্ট্র প্রধান এবং জনগণকে অনুরোধ জানাচ্ছি।   

 তবে একটি কথা মনে রাখতে বিশ্বের যতো অ—মুসলিম দেশগুলো আছে তারা কিন্তু সবাই একই ছাদের নীচে আছে অর্থাৎ এরা সবাই মুসলমানদের বিরুদ্ধে এক। সুতরাং এদের বিশ্বাস করতে নেই। নাসারাদের  ব্যাপারে আল্লাহ পাক কোরআন শরীফে স্পষ্টই বলে দিয়েছেন, যার অর্থ হচ্ছে— ”হে মুমিনগণ, ইহুদী ও নাসারাদের তোমরা বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। তারা একে অপরের বন্ধু। আর তোমাদের মধ্যে যে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে, সে নিশ্চয় তাদেরই একজন। নিশ্চয় আল্লাহ যালিম কওমকে হিদায়াত দেন না।”— আল বায়ান 

লন্ডন ৩১ অক্টোবর ২০২৩  


মতামত এর আরও খবর

img

দেশটা যাচ্ছে রসাতলে, আর আমরা ঠাঁই নিচ্ছি বাসার তলে! –হেঁটে চলা এক হতাশ নাগরিকের আর্তি

প্রকাশিত :  ১৬:৫৯, ২৯ মে ২০২৫

“দেশ উন্নয়নের মহাসড়কে”—এই বাক্যটি এখন এতটাই পরিচিত এক প্রচারণায় পরিণত হয়েছে যে ঘুমের মধ্যেও শুনতে পাই। এতবার, এতভাবে বলা হয়েছে যে এখন মনে হয়—এ যেন সরকারের মুখে বাজতে থাকা একটি পুরোনো ক্যাসেটমাত্র। অথচ বাস্তব চিত্র কী? চলার মতো একটি সাইকেলও যেন এখন নাগালের বাইরে! যার গাড়ি আছে, সে ছুটছে হরিণের গতিতে; আর যার কিছুই নেই, সে বসে থাকে রাস্তার পাশের ফাটলে। এই বাস্তবতায় নিঃসন্দেহে বলা যায়—দেশ কোনো মহাসড়কে নয়, বরং ধাবিত হচ্ছে রসাতলের দিকেই।

আমরা সাধারণ মানুষ। দিন গুনে, কষ্ট গুনে বেঁচে থাকি। আমাদের নেই ঝকঝকে গাড়ি, নেই সুগন্ধময় নীতিমালা। ঘাম ঝরাই, মাথা খাটাই, আর প্রতিদিন বাস্তবতার কাছে হেরে যাই। আমাদের স্বপ্ন ভাঙে, ব্যবসা ধসে পড়ে, তবুও থেমে থাকি না। কারণ কষ্ট আমাদের জীবনের রুটির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে। আর দেশের যাঁরা ‘বিলিয়নিয়ার’, তাঁদের জীবন আবর্তিত হয় গলফ কোর্স, কফিশপ আর শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কনফারেন্স রুম ঘিরে। আমাদের হাঁচি-কাশিও তাঁদের কাছে যেন একধরনের শব্দদূষণ।

আর প্রধান উপদেষ্টার কথা কী বলব? তাঁর দিনরাত কাটে উন্নয়নের অঙ্ক কষে। কোন প্রকল্পে কত কোটি টাকা যাবে, কোন বিদেশিকে কোন রঙের গালিচায় অভ্যর্থনা জানানো হবে—এসব নিয়েই তাঁর ব্যস্ততা। অথচ দেশের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা কীভাবে বাঁচছে, আদৌ বাঁচছে কি না—সেই খোঁজ তাঁর এজেন্ডায় নেই। তাঁর কাছে উন্নয়ন মানে শুধু টাকা-পয়সার হিসাব।

আমাদের মতো ছোট ব্যবসায়ীরা এখন প্রায় হাল ছেড়ে দিয়েছি। দোকানের ভাড়া বাকি, কর্মচারীদের বেতন দেওয়া যাচ্ছে না, পণ্য স্টকে জমে আছে—বিক্রি নেই। এমনকি পিঁপড়েও যদি দোকানে ঢুকে পড়ে, মনে হয়—চিনিটা অন্তত কেউ খেয়ে গেল! এটাই বা কম কী?

ব্যাংকে গেলেও আশার আলো নিভে যায়। ঋণের আবেদন করলেই বলা হয়—“ফাইন্যান্সিয়াল রিস্ট্রাকচারিং চলছে, স্যার।” অর্থাৎ—এখন কিছুই পাওয়া যাবে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র নিজেই বলছেন—দশটিরও বেশি ব্যাংক দেউলিয়ার পথে। তাহলে প্রশ্ন উঠে—আমরা যাব কোথায়? কোথায় সেই আশ্বাস, সেই নিরাপদ সঞ্চয়ের ভরসা?

এই দেশের আরেক অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য হলো—প্রত্যেকে যেন একেকজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী! চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে কিংবা ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে দেশ ও উন্নয়ন নিয়ে বড় বড় তত্ত্ব দেন। কিন্তু বাস্তবায়নের সময় পাশে থাকেন না কেউ। উন্নয়নের ট্রেন কখনোই প্ল্যাটফর্মে আসে না—আমরা শুধু দাঁড়িয়ে থাকি আর চুল পাকতে দেখি। এমনকি মনে হয়, মেট্রোরেল ফরিদপুরে পৌঁছাতে পৌঁছাতে আমরা কবরে চলে যাব।

আর পুঁজিবাজার? সেখানে এখন যা চলছে, তা দিয়ে একটি ‘হরর-ট্র্যাজেডি’ সিনেমা বানানো সম্ভব! সূচক পড়ছে, আর বিনিয়োগকারীরা একে একে ফাঁদে পড়ছেন। এই বাজারের ভিত্তি কী? উত্তর আসে—“আস্থা।” আমরা বলি—“আস্থার স্টকটা কোথায়?”

এই বিপর্যয়ের অন্যতম রচয়িতা বিএসইসির চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ। তাঁর একটি মাউস ক্লিকেই সূচক যেন তলানিতে নেমে যায়! পুঁজিবাজারের পতন এমনভাবে হচ্ছে, যেন আকাশে না-ওড়া ঘুড়িকেও কেউ গুলি করে নামিয়ে দিচ্ছে! অফিসের দরজায় নাকি লেখা থাকে—“Investor beware: Survival not guaranteed.”

অন্যদিকে অর্থ উপদেষ্টা সালেউদ্দিন আহমেদের ভাবনা এমন—উন্নয়নের প্রসঙ্গ উঠলেই বলেন, “দেখা যাবে, ভাবা যাবে; না হলেও সমস্যা নেই।” তাঁর এই নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে উন্নয়ন নয়, বরং হতাশার এক করুণ চিত্রপটই আঁকা যায়।

আমরা যাঁদের জন্য দিনরাত খেটে যাচ্ছি, তাঁরা আমাদের কণ্ঠ শোনেন না। বড়লোকেরা কফির কাপ হাতে ভাবেন—“গরিব মানেই অলস।” তাঁরা জানেন না, আমরা প্রতিদিন সকালে দোকানের ঝাঁপ তুলি, বিক্রি না হলে রাতে স্ত্রীর চোখের জবাব দিই, সন্তানের স্কুল ফি বাকি রাখি—তবুও মন থেকে চেষ্টা থামাই না।

উন্নয়ন মানে শুধু বড় বড় প্রকল্প নয়। উন্নয়ন মানে হচ্ছে—একজন দোকানদার যেন দিনের শেষে হাঁফ ছেড়ে ঘুমাতে পারেন; একজন মা-বাবা যেন সন্তানের স্কুলের বেতন দিতে পারেন; একজন কর্মচারী যেন মাসের শেষে বেতন হাতে পান। এটাই উন্নয়নের মৌলিক রূপ।

আশার কথা হলো, এখনো কিছু মানুষ আছেন, যাঁরা হার মানেননি। ঝড় এলেও তাঁরা দাঁড়িয়ে থাকেন, কান্না গিলে হাসেন। তাঁরা দেশ ছাড়েন না, কারণ বিশ্বাস করেন—এই দেশ আমাদের, সাধারণ মানুষের। এই দেশ সরকারের নয়, উপদেষ্টাদের নয়, ধনীদেরও নয়—এই দেশটা আমাদের, যাঁরা কোনো ব্যালান্সশিটে নেই, কিন্তু কাঁধে করে দেশটাকে টেনে নিয়ে চলেছেন।

একদিন যদি এই দেশ ঘুরে দাঁড়ায়, তাহলে ইতিহাসে লেখা থাকবে—“এই দেশকে এগিয়ে নিয়েছিলেন সেই মানুষগুলো, যাঁদের গায়ে ঘাম ছিল, কিন্তু নাম ছিল না খবরে।”

আর যদি কিছুই না হয়, যদি সত্যিই দেশ রসাতলে যায়—তবুও অন্তত বলতে পারব, আমরা চেষ্টার ত্রুটি রাখিনি। যেমন ফুটপাতে বসে থাকা এক শিশুটি বলে—“আমরা তো খাটছি ভাই। যারা উপরে আছেন, তাঁরা যদি একটু নিচে তাকান, তাহলে হয়তো আমরাও বাঁচার একটা রাস্তা পাব।” আর যদি তাঁরা না তাকান, তাহলে আমাদেরই গড়তে হবে সেই পথ—হোক বাঁশের সাঁকো, হোক কাঁধে তুলে নেওয়া—আমরা চলতেই থাকব।