আন্তর্জাতিক হিফজুল কুরআন বিষয়ক মেগা রিয়েলিটি শো ও প্রতিযোগিতা ‘কুরআনের নূর পাওয়ার্ড বাই বসুন্ধরা গ্রুপ’র দ্বিতীয় আসরের অডিশন সিলেট শুরু হলো থেকেই । এতে অংশ নিয়েছেন সিলেট বিভাগের অন্তত পাঁচ শতাধিক হাফেজ।
দেশসেরা অনূর্ধ্ব-১৬ বছর বয়সী পবিত্র কুরআনের হাফেজদের সম্মাননা ও পুরস্কার দেওয়া হবে। শুক্রবার (২৪ নভেম্বর) সকাল ৮টায় সিলেটের জামেয়া মাদানিয়া ইসলামিয়া কাজিরবাজার মাদরাসা প্রাঙ্গণে প্রতিযোগিতার রেজিস্ট্রেশন পর্ব শুরু হয়। তার আগে থেকে খুদে হাফেজদের মিলনমেলায় পরিণত হয় মাদরাসা প্রাঙ্গণ।
সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশের কুরআনে হাফেজদের উৎসাহ দিতেই এই আয়োজন। দেশসেরা হাফেজদের আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছেন তারা। আর এ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও দেশের মুখ উজ্জ্বল করতে চায় খুদে হাফেজরা।
এখানকার প্রতিযোগীদের প্রত্যাশা, সিলেটের সেরা থেকে দেশসেরা হয়ে বিশ্বে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করবে তারা। এর মাধ্যমে ইসলামের খেদমতের পাশাপাশি দেশের মুখও উজ্জ্বল করতে চায় তারা। আর এমন সুযোগ করে দেওয়ার জন্য বসুন্ধরা গ্রুপের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা তাদের।
কুরআন মুখস্থ, তাজবিদের অনুসরণ, কণ্ঠের মাধুর্যতা- এ বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দিয়েই সেরা হাফেজ নির্বাচন করছেন বিচারকরা। বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের সিনিয়র পেশ ইমাম শায়খুল হাদিস মুফতি মুহিব্বুল্লাহিল বাকী আন নদভী প্রতিযোগিতার প্রধান বিচারকের দায়িত্ব পালন করছেন।
আয়োজকরা জানান, এবারের কুরআনের নূর প্রতিযোগিতায় জাতীয় পর্যায়ের প্রথম বিজয়ী পাবেন ১০ লাখ টাকা ও সম্মাননা। দ্বিতীয় বিজয়ী পাবেন সাত লাখ টাকা ও সম্মাননা। তৃতীয় পুরস্কার পাঁচ লাখ টাকা ও সম্মাননা। চতুর্থ ও পঞ্চম পুরস্কার দুই লাখ টাকা করে এবং সম্মাননা। এছাড়া ষষ্ঠ থেকে অষ্টম স্থান অর্জনকারী বাকি তিনজন পাবেন এক লাখ টাকা করে আর্থিক পুরস্কার ও সম্মাননা। এবারও জাতীয় পর্যায়ের আট বিজয়ী, তাদের পরিবার ও ওস্তাদকে ওমরাহ পালনের জন্য সৌদি আরব পাঠানো হবে।
অন্যদিকে প্রতিযোগিতার আন্তর্জাতিক পর্যায়ের প্রথম বিজয়ী পাবে ১৫ লাখ টাকা ও সম্মাননা। দ্বিতীয় বিজয়ী পাবে ১০ লাখ টাকা ও সম্মাননা এবং তৃতীয় বিজয়ী পাবে পাঁচ লাখ টাকা ও সম্মাননা।
সংগ্রাম দত্ত: মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলাকে বলা হয় আগর-আতরের আঁতুড়ঘর। এই শিল্পের খ্যাতি দেশের গণ্ডি পেরিয়ে এখন বহির্বিশ্বেও ছড়িয়ে পড়েছে। আগর-আতরকে বাংলাদেশের ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে অনুমোদন দিয়ে এরইমধ্যে জার্নাল প্রকাশিত হয়েছে।
বাংলাদেশে আগর শিল্পের ইতিহাস এই সুজানগর পুরোটা দখল করে আছে। এই জনপদ থেকে প্রতিবছর কোটি কোটি টাকার কাঁচা আতর মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে রফতানি হয়। চাহিদা ভালো থাকায় প্রচুর পরিমাণে আগর কাঠও রফতানি হচ্ছে। এসব কাঠ ধূপের মতো জ্বালিয়ে সুগন্ধি তৈরি করে। মৌলভীবাজার জেলায় ৪০০ বছর ধরে রাজত্ব করছে আগর-আতর। এ খ্যাতি সেই মোঘল আমল থেকে। আগরগাছ থেকে প্রক্রিয়াজাতের মাধ্যমে আতর তৈরি করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিক্রি করা হয়, যার সুঘ্রাণ ছড়িয়েছে দেশে দেশে।
বড়লেখা উপজেলার সুজানগরকে বলা হয় আগরের রাজধানী। পাহাড়ি এলাকায় সবচেয়ে বেশি আগরের চাষ হয়ে থাকে। আবার বাগান তৈরির পাশাপাশি বসতবাড়ির আশপাশে গাছ লাগানো হয়। বাড়ির আঙিনা থেকে এই চাষ এখন শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।
বাণিজ্যিকভাবে আগরের চাষ বেড়েছে এ অঞ্চলে। এই শিল্পের সঙ্গে মৌলভীবাজারের ৪০ থেকে ৫০ হাজার মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত রয়েছেন। সুজানগর ইউনিয়নে গেলে দেখা মিলবে বাগানে ও বসতঘরের পাশে দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি আগরগাছ। গ্রামীণ মেঠোপথ ধরে হাঁটলেই নাকে আসে আগর-আতরের সুঘ্রাণ। কারখানার মালিক ও শ্রমিকদের কেউ বাড়ির উঠানে আগরগাছের ছোট ছোট ফালি কাটছেন, আবার কেউবা ব্যস্ত কারখানায় আতর তৈরিতে। আগর-আতর ব্যবসায় জড়িত জেলার ব্যবসায়ীদের নিয়ে গঠিত হয়েছে বাংলাদেশ আগর অ্যান্ড আতর ম্যানুফ্যাকচারার অ্যান্ড এক্সপোর্টার অ্যাসোসিয়েশন।
জানা গেছে, সুজানগরে প্রায় ২৫০টি ছোট ও মাঝারি আগর-আতর কারখানা গড়ে উঠেছে। এছাড়া জেলার অন্যান্য স্থানে রয়েছে আরও প্রায় ৫০টির মতো। জেলা থেকে বছরে আনুমানিক ৫ হাজার লিটার কাঁচা আতর এবং ১০ থেকে ১৫ হাজার কেজি আগরকাঠ বিদেশে রফতানি হয়। প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট পরিপক্ব আগরগাছের প্রতি কেজি কাঠ ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকায় বিক্রি হয়। আর সাধারণ কাঠ মানভেদে ২০০ থেকে হাজার টাকায়। একেকটি কারখানায় মাসে ১ থেকে ৫ লিটার তরল আতর উৎপাদিত হয়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, আগর থেকে আতর সংগ্রহের পদ্ধতিটি সনাতন। প্রাকৃতিকভাবে আগরগাছে সৃষ্ট ক্ষতে জমে কষ। গাছের ক্ষতস্থান কেটে তা জ্বাল দিয়ে তৈরি হয় সুগন্ধি আগর। কিন্তু প্রাকৃতিকভাবে গাছে কখন ক্ষত হবে এজন্য অপেক্ষা করতে হতো বছরের পর বছর। প্রাকৃতিক উপায়ে উৎপাদনের চাহিদা পূরণ করা ছিল অসম্ভব। তাই এখানকার বাসিন্দারা আবিষ্কার করেন বর্তমান লোহার পেরেক মারা পদ্ধতি। ফলে সাত-আট বছরের মাথায় একটি আগরগাছ থেকে এখন আগর-আতর উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে।
ব্যবসায়ীদের অনেকে পর্যাপ্ত মূলধনের অভাবে বিশ্বায়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আতর উৎপাদনে নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার করতে পারছেন না। তাছাড়া এখানকার কারখানাগুলো অনেক ছোট, সবার পক্ষে পুরো প্রক্রিয়া শেষ করে রফতানিও সম্ভব হচ্ছে না।
দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিস্তীর্ণ সমতল ভূমিতে সুগন্ধিযুক্ত আগরের চাষ অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করা সম্ভব । আগর গাছের রস, কাঠ ও ছাল উন্নতমানের সুগন্ধি ও ওষুধ কারখানায় কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ায় আগর চাষ করে যে কেউই আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারে।
আগর একটি অপ্রচলিত গাছ হলেও আগরের গাছ থেকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় বের করা রস দিয়ে অর্গানিক আতর ও সুগন্ধি তৈরি হয়। বিশ্বব্যাপী এর দাম ও চাহিদা অনেক।
আগরের রস অনেক মূল্যবান। প্রকারভেদে এক তোলা আগরের রস থেকে তৈরি আতরের মূল্য দশ থেকে বিশ হাজার টাকা। দেশের বিভিন্ন স্থানে বাণিজ্যিকভিত্তিতে আগরের বাগান চাষের সঙ্গে প্রক্রিয়াকরণ শিল্প কারখানা গড়ে উঠলে কৃষিতে নতুন বৈচিত্র্য আসবে ।
আগরের তৈরি আতর ও সুগন্ধি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে প্রচুর চাহিদা রয়েছে। সম্ভাবনাময় এ আগর চাষ করে যে কেউই নিজের ভাগ্য বদলাতে পারেন।
আগর মূলত একটি গাছের নাম। আগর শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো উৎকৃষ্ট বা সুগন্ধি বিশিষ্ট কাঠ। ইংরেজিতে এর নাম এলো ওড (Aloe Wood বা Wagle Wood), আরবিতে বলে উদ, দক্ষিণ এশিয়ায় পরিচিত নাম গাডরউদ, মালয়েশিয়ান ভাষায় গাহারু, হারবাল ইউনানি চিকিৎসায় এর নাম উদহিন্দ এবং আয়ুর্বেদিক ভাষায় অগুরু বলে পরিচিত ও সমাদৃত। বাংলা, আরবি এবং ফারসিসহ বিভিন্ন ভাষার সংমিশ্রণে অপভ্রংশ হয়ে আগর নামটির উৎপত্তি হয়েছে। পৃথিবীতে কবে কোথায় আগর-আতরের চাষাবাদ শুরু হয়েছে তার সঠিক ইতিহাস বের করা মুশকিল। তবে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার রেইন ফরেস্টই আগর গাছের আদিস্থান হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে। আগর গাছ থেকে বিশেষ কালো রঙের কাঠ পাওয়া যায়, যা আগর কাঠ নামে পরিচিত। স্থানীয় ভাষায় যা ‘মাল’ বলে অভিহিত করা হয়। স্থানীয়ভাবে যারা আগর কাঠ শনাক্ত করেন তাদের ‘দৌড়াল’ বলা হয়।
বাংলাদেশে মূলত Aquilaria agallucha Ges Aquilaria malaccenesis এবং Aquilaria malaccenesis প্রজাতির আগর গাছ চাষ হয়। ট্যাক্সোনোমিকেলি আগর গাছ Thymelaeaceae পরিবারের অন্তর্গত। আগর গাছ লম্বায় প্রায় ১৫ থেকে ৪০ মিটার এবং বেড় বা ব্যাস ০.৬-২.৫ মিটার হয়। শাখা-প্রশাখবিহীন সোজা লম্বা গাছটি দেখতে এবং আকার আকৃতিতে অনেকটা শাল বা গজারি গাছের মতো। এ গাছে সাদা রঙের ফুল এবং ফলগুলো ক্যাপসুল আকৃতির হয়। আগর গাছের পাতা দেখতে অনেকটা লিচু গাছের পাতার মতো, অনেকে বকুল গাছের পাতার সাথেও মিলাতে পারেন। সাদা রঙের আগর কাঠ খুব নরম হয়। ফলে আতর উৎপাদনের উপকরণ সংগ্রহ ও জ্বালানি কাঠ ছাড়া অন্য কোনো কাজে এ গাছ ব্যবহার হয় না।
আগর কাঠকে ঈশ্বরের কাঠ বলা হয়। পূর্ব এশিয়া ও জাপানে আগর কাঠ পূজার অর্ঘ্য উপকরণ। মধ্যপ্রাচ্যে আগর কাঠের ব্যবসা ও সমাদর হাজার বছরের পুরনো। আগরের সুগন্ধ প্রশান্তিদায়ক, অনেকেই শরীরের শক্তি বৃদ্ধিতে সহায়ক হিসেবে কাজে লাগে। নানাবিধ ওষুধ, পারফিউম, পারফিউম জাতীয় দ্রব্যাদি-সাবান, শ্যাম্পু এসব প্রস্তুতে আগর তেল ব্যবহার করা হয়। সাধারণত গৃহে, বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে সুগন্ধি ছড়ানোর জন্য আগর-আতর ব্যবহার করা হয়। আগর আতরের পাশাপাশি আগর কাঠের গুঁড়া বা পাউডার ধূপের মতো প্রজ্জ্বলনের মাধ্যমে সুগন্ধি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান এবং মুসলিম ধর্মালম্বী সবাই আগর আতর ও আগর কাঠের গুঁড়া ব্যবহার করে। আতর বাংলাদেশে তরল সোনা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।
আগর গাছ বাড়ির আঙিনায়, রাস্তার পাশে, পতিত জমি, টিলার ঢালে, টিলা বা পাহাড়ে এমনকি পরিত্যক্ত জায়গায় আগর গাছ লাগানো যায়। পাহাড় বা টিলা জমিতে আগর গাছ ভালো জন্মে। তবে সব জমিতেই কমবেশি জন্মে।
গাঢ় বাদামি বর্ণের ৩.৮১ সে.মি.-৫.০০ সে.মি (১.৫ থেকে ২ ইঞ্চি) লম্বা ক্যাপসুল জাতীয় ফল থেকে বীজ সংগ্রহ করা হয়। প্রতি ফলে দুটো বীজ হয়। বীজের অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা খুব অল্প সময়ের জন্য থাকে। সাধারণত ৭ থেকে ১০ দিন পর্যন্ত অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা স্থায়ী থাকে। বীজ থেকে চারা তৈরি করা হয়। বীজ বপনের উৎকৃষ্ট সময় মার্চ-এপ্রিল। চারা উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিশেষ প্রক্রিয়া অবলম্বন করতে হয়। প্রথমে বালুর বেডে বীজগুলো বিছিয়ে দিয়ে ওপরে আবারও বালু দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। এখানে বীজগুলো অঙ্কুরিত হয়। প্রায় ২০ থেকে ২৫ দিন পরে পলিব্যাগে চারা স্থানান্তরিত হয়। চারা গজানোর জন্য অস্থায়ী শেডের ব্যবস্থার প্রয়োজন হয়। চারায় নিয়মিত পানি সেচের ব্যবস্থা রাখতে হয়।
বর্ষা মৌসুম আগর গাছের চারা রোপণের উৎকৃষ্ট সময়। বাংলাদেশে জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাসে আগরের চারা রোপণ করলে গাছ টিকে বেশি। স্কুল, কলেজ, রাস্তা দুই পাশেও আগরের চারা রোপণ করা যায়। সামাজিক বনায়ন কর্মসূচিতেও আগর গাছ লাগানো যেতে পারে। রোপণের সময় প্রতিটি গর্তে জৈব সার-কম্পোস্ট সার, টিএসপি, এমওপি, জিপসাম সার গাছের বয়স অনুযায়ী প্রয়োগ করা যেতে পারে। রোপণের সময় সারি থেকে সারির দূরত্ব ১.৫২ মি.-১.৮২ মি. (৫-৬ ফুট) এবং চারা থেকে চারার দূরত্ব ৯১.৪৪ সে.মি.-১.২২ মি. (৩-৪ ফুট) বজায় রাখা উত্তম। সাধারণত ১-২ বছর বয়সী আগরের চারা লাগানো হয়। একক বাগানের ক্ষেত্রে কম দূরত্ব এবং মিশ্র বাগানের ক্ষেত্রে একটু বেশি দূরত্ব রাখা উচিত। অন্যান্য গাছের মতো চারা রোপণের আগে দৈর্ঘ্যে ৫০ সেন্টিমিটার প্রস্থে ৫০ সেন্টিমিটার এবং গভীরতায় ৫০ সেন্টিমিটার আকারের গর্ত তৈরি করে পচা গোবর ও সার প্রয়োগ করা ভালো।
এই আন্তঃফসলটি সাধারণত প্রথম ৩ থেকে ৫ বছর পর্যন্ত মিশ্র ফসল যেমন শাকসবজি ও ডাল জাতীয় ফসল চাষ করা যায়। পরবর্তীতে কয়েক বছর ছায়া পছন্দকারী সর্পগন্ধা ঔষধি গাছের আবাদ করা যায়। আদা এবং হলুদও চাষ করা হয়। তাছাড়া সুপারি, কফি, রাবার, পামগাছসহ অধিকাংশ বনজ গাছ আগর গাছের সাথে মিশ্র ফসল হিসেবে চাষ করা যায়। বিভিন্ন দেশে এলাচও চাষ করে।
আন্তঃপরিচর্যায় খরা মৌসুমে পানি সেচ দিতে হয়। প্রয়োজনমতো আগাছা দমন করতে হবে। তাছাড়া নিয়ম করে কিছু রাসায়নিক সার দিলে গাছের বৃদ্ধি দ্রুত হয়। এক্ষেত্রে নতুন আগর গাছের বাগানে কোনো রাসায়নিক সার প্রয়োগ করতে হয় না। আগর গাছের বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে সার ব্যবহার করা যায়। একবার বর্ষার আগে এবং একবার বর্ষার পরে অর্থাৎ বছরে দুইবার সার প্রয়োগ করা উত্তম।
আগরের তেমন কোনো রোগ হয় না তবে মাঝে মাঝে গোড়া পচা রোগ এবং ডাইব্যাক রোগে গাছের ডালপালা শুকিয়ে যায়। প্রয়োজনীয় ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করে ভালো ফল পাওয়া যায়। আগর চাষের ক্ষেত্রে বিছা পোকা পাতা ঝাঁঝরা করে ফেলে। সাইপারমেথ্রিন গ্রুপের কীটনাশক ব্যবহার করে বিছা পোকার আক্রমণ দমানো যায়।
আগর সংগ্রহের সময় প্রাকৃতিকভাবে আগর গাছে আগর তৈরি হতে ২৫-৩০ বছর সময় লেগে যায়। তবে কৃত্রিমভাবে ৫-৬ বছর বয়সী আগর গাছে পেরেক মেরে এসব গাছ ১৫-১৬ বছর হলেই আগর কাঠ সংগ্রহ করা যায়। আগর কাঠ সংগ্রহের জন্য গাছ কর্তনের উপযোগী হয়েছে কিনা তা বিবেচনা করা হয় মূলত গাছ কতটুকু রুগ্ন হয়েছে তার ওপর ভিত্তি করে। গাছের বয়স, গাছের বৃদ্ধি ও শারীরতাত্ত্বীয় পরিপক্বতা বিবেচনা করে আগর গাছ কর্তন করা হয় না বরং গাছের বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যাওয়া, দৃশ্যমান ক্ষতযুক্ত কাণ্ড, কাঠের বিকৃতি, ক্ষুদ্র পাতা, মূল কাণ্ড ও শাখার ওপর মরা লক্ষণ এসব দেখে আগর কাঠ কর্তন করা ও সংগ্রহ করা হয়। সারা বছরই আগর কাঠ সংগ্রহ করা গেলেও জানুয়ারি থেকে এপ্রিল মাসই আগর কাঠ সংগ্রহের উৎকৃষ্ট সময়। এ সময় গাছ সুপ্ত অবস্থায় থাকে বলে আগর কাঠে আতর বা তেলের পরিমাণ বেশি ও গুণগত মানের পাওয়া যায়। একটি প্রাপ্তবয়স্ক গাছ থেকে ২.০ থেকে ২.৫ কেজি পরিমাণ আগর কাঠ পাওয়া যায়।
আগর গাছে দুইভাবে আগর তৈরি হয় যথাক্রমে প্রাকৃতিক ও কৃত্রিমভাবে।
প্রাকৃতিক উপায়ে আগর গাছ হতে আগর উৎপন্ন হতে প্রায় ২৫-৩০ এমনকি ৫০ বছর সময়ের প্রয়োজন হয়। তবে আগর গাছের বয়স ৫-১০ বছর থেকেই গাছে আগর জমা হতে থাকে। এক্ষেত্রে গাছের বিভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্নভাবে কালো বর্ণ ধারণ করে। দেখতে ছোপ ছোপ আকারে অনেকটা সারি কাঠের মতো। তবে সারি কাঠ যেমন অনেকটা বা পুরোটা অংশজুড়ে কালো হয় এক্ষেত্রে ঠিক তেমনটি হয় না। আগর গাছে নির্দিষ্ট স্থানে কালো হওয়া শুরু হলে তা পূর্ণ হতে প্রায় ৪ থেকে ৬ বছর লেগে যায়। এটি প্রাকৃতিক পদ্ধতি। গাছের এ কালো অংশকেই বলা হয় আগর বা আগর কাঠ।
কৃত্রিম পদ্ধতিতে এক ধরনের কাণ্ড ছেদক পোকা আগর গাছে ছিদ্র তৈরি করে পরে সেখানে ছত্রাকের আক্রমণে গাছ প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিতে গিয়ে জৈবনিক প্রক্রিয়ায় আগর গাছের ওই ক্ষত স্থানের চারপাশে বাদামি-কালো রঙের আস্তরণ তৈরি হয় যা আগর উৎপাদনের মূল উপকরণ। এ ধারণাকে কাজে লাগিয়ে মানুষ কৃত্রিমভাবে পেরেক মেরে ক্ষত সৃষ্টি করে, ফলে সেখানে আগর সঞ্চিত হয়। এ পদ্ধতিতে খুব কম সময়ে আগর গাছ থেকে আতর তৈরির কাঁচামাল সংগ্রহ করা সম্ভব। এ পদ্ধতিতে ১০-১২ বছরের ১০-১২ ইঞ্চি পরিধির আগর গাছের গায়ে ৪-৫ ইঞ্চি পরপর সারিবদ্ধভাবে গাছের নিচ থেকে শুরু করে ওপর পর্যন্ত পেরেক (তারকাঁটা) গেঁথে দেয়া হয়। সরেজমিন পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, ২.৫৪ সে.মি.-৫.০০ সে.মি. (১-২ ইঞ্চি) পরপর সারিবদ্ধভাবে ৩.৮১ সে.মি.-৫.০০ সে.মি. ১.৫ থেকে ২.০ ইঞ্চি সাইজের তারকাঁটা ৪ থেকে ৫ বছর বয়সি গাছে লাগানো হয়েছে। তারকাঁটা লাগানোর সময় একটা কৌশল হিসেবে অর্ধেক অংশ পরিমাণ তারকাঁটা গাছের কাণ্ডে ঢুকানো হয়, একটু আড়াআড়িভাবে লাগানো পেরেকের বাইরের অংশটুকু গাছের বৃদ্ধির সাথে সাথে কাণ্ডের ভেতর ঢুকে যায়। গাছের তারকাঁটা গাঁথা অংশে কৃত্রিমভাবে আঘাতের ফলে ছত্রাকের আক্রমণ সহজেই ঘটে ফলে তারকাঁটার চারপাশের কাঠে ৫-৬ বছরের মধ্যেই বাদামি-কালো রঙের আস্তরণ তৈরি হয়। পরে সে গাছগুলো কেটে আগর-আতর উৎপাদনের কাঁচামাল বের করা হয়। সাধারণত গাছের পুরুত্ব ও আকারের ওপর তারকাঁটা পোতা নির্ভর করে। এক্ষেত্রে গাছের বয়সটা মুখ্য নয়।
আগরের বাজার ব্যবস্থাপনাও ভালো। বিশ্বে আগর আতর পণ্যের প্রায় ১৬০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের রফতানি বাজার রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো আগর উড চিপস ও আতরের খুব চাহিদা রয়েছে। বাংলাদেশে আগর কাঠের বিভিন্ন প্রকার মান রয়েছে যথা- ডবল সুপার, আগর প্রপার, কলাগাছি আগর, ডোম আগর। আগর আতর শিল্প থেকে দেশি ও বিদেশি অনেক আতর তৈরি হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো জান্নাতুল নাঈম, জান্নাতুল ফেরদাউস, শাইখা, হজরে আসওয়াদ, সুলতান, উদ, কিং হোয়াইট, আল ফারেজ, কুল ওয়াটার এসব নামের আতর বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। আগর কাঠের বাজারদর প্রতি কেজি পাঁচ ডলার থেকে দশ হাজার ডলার। গুণগত মানের ওপর নির্ভর করে এক তোলা আতর ৫-১৫ হাজার ডলার পর্যন্ত বিক্রি হয়। তাছাড়া আগর গাছের ডাস্ট বা উচ্ছিষ্টগুলোও রফতানিযোগ্য। বর্তমানে সংযুক্ত আরব আমিরাত, সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান, সৌদি আরবসহ অন্যান্য দেশে এসব ডাস্ট প্রক্রিয়াজাত করে ২০-২২টি পণ্য উৎপাদন করে। আগর তেলের মান বহুবিদ এবং আন্তর্জাতিক বাজারে মান অনুযায়ী আগর কাঠের দামও কম-বেশি হতে পারে। প্রাথমিক বিবেচনায় দাম নির্ধারণে কাঠের মান ও উৎপাদনকারী দেশের ওপর নির্ভর করে। ভিন্ন ভিন্ন দেশের গ্রাহক বা ব্যবসায়ীরা ভিন্ন ভিন্ন গুণাবলি বিবেচনায় রেখে আগর কাঠের মান-দাম নির্ধারণ করে থাকেন। মধ্যপ্রাচ্য ও ভারতে আগর কাঠের তেল থেকে প্রাপ্ত গন্ধ বা সুরভী মুখ্য বিষয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সিঙ্গাপুর আগর ব্যবসার মূলকেন্দ্র। প্রধান প্রধান উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া অন্যতম।
এটি লাভজনক ব্যবসা আগর শিল্প। আগর-আতর উৎপাদন অত্যন্ত লাভজনক ব্যবসা। এ ব্যবসায় অল্প পুঁজি বিনিয়োগ করে বেশি মুনাফা আয় করা সম্ভব। এক কেজি কালো কাঠের মূল্য প্রায় ২ লাখ টাকা। একটি আগর কাঠসমৃদ্ধ প্রাপ্তবয়স্ক গাছের মূল্য ৫-১০ লাখ এমনকি ২০-২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। গবেষণায় দেখা যায়, আগর প্লান্টেশনে বিনিয়োগ করে উচ্চ মুনাফা অর্জন করা সম্ভব। অন্য জরিপে জানা যায়, সঞ্চয়পত্রে ১ ডলার বিনিয়োগ করলে ১২ বছর পর ৪.২১ ডলার পাওয়া যায়, অপরদিকে আগর গাছে ১ ডলার বিনিয়োগ করলে ১১৭ থেকে ৭৩৬ ডলার আশা করা যায়। তাছাড়া আগর শিল্প একটি পরিবেশবান্ধব শিল্প।
আগর আতর শিল্পের বিকাশে এ শিল্পকে ঢেলে সাজাতে প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা, পলিসি, উদ্যোগ ও উদ্যোগের যথাযথ বাস্তবায়ন। আগর শিল্পের মানোন্নয়নে সুপারিশ হলো: সরকারি উদ্যোগে আগর নিয়ে আধুনিক মানসম্মত গবেষণা করা; কৃষি সম্প্রসারণ কর্মী, উদ্যোক্তা, আগর শ্রমিক, কারিগরদের যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। আগর থেকে বিশ্বমানের প্রসাধনী পণ্য সামগ্রী তৈরির সুযোগ সৃষ্টি করা; সরকারি উদ্যোগে ঋণ সুবিধা প্রদান করা; সরকারি খাস জমি বিশেষ করে টিলাগুলো লিজ প্রদান করা; আগর শিল্পের জন্য আলাদা অবকাঠামো ও বিসিক শিল্প নগরী স্থাপন করা; গ্যাস ও বিদ্যুৎ বিল খাতে বিশেষ সুবিধা প্রদান করা; রফতানি প্রক্রিয়া সহজতর করতে ফরওয়ার্ড লিংকেজের ব্যবস্থা করা; প্রাকৃতিক আগর দিয়ে উৎপাদিত প্রসাধনীর আনুষঙ্গিক রাসায়নিক দ্রব্যাদি আমদানি সুবিধা বৃদ্ধি করা (শুল্কমুক্ত করা) যাতে দেশীয় পণ্যের গুণগত মান বৃদ্ধি করে অধিক মূল্যে রফতানি করা সহজতর হয়, ট্যাক্স হলিডে (শুল্ক রেয়াত) সুবিধা দেয়া। সমন্বিত গবেষণার জন্য আগর উন্নয়ন বোর্ড-সেল গঠন করা। সরকারি উদ্যোগে গবেষণা এবং প্যাটেন্টরাইট প্রদানের ব্যবস্থা করা। সর্বোপরি কৃষি বিভাগ, বন বিভাগ, কাস্টমস বিভাগ, পুলিশ বিভাগ, বিজিবি ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সম্মিলিত প্রচেষ্ঠা ও উদ্যোগ গ্রহণ করা।
আগর শিল্পের সম্ভাবনাও ব্যাপক। বড়লেখা উপজেলায় ছোট বড় প্রায় ৩০০টি আগর আতর ফ্যাক্টরি রয়েছে। এ এলাকায় পরিকল্পিতভাবে আরও আগর কারখানা তৈরির সুযোগ রয়েছে। তাছাড়া দেশে বর্তমানে সিলেট তথা মৌলভীবাজার, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে আগর চাষ করার উপযোগী জায়গা রয়েছে। গতানুগতিক বা সনাতন পদ্ধতির পরিবর্তে কৃত্রিম পদ্ধতির মাধ্যমে স্বল্প সময়ে বেশি পরিমাণ আগর ও আগরজাত দ্রব্যাদি উৎপাদন করা সম্ভব। বাংলাদেশী অনেক ব্যক্তি দুবাইসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে আগর শিল্প গড়ে তুলেছেন। এসব শিল্পের অধিকাংশ শ্রমিকই বাংলাদেশী। কাঁচামাল আমদানি সংক্রান্ত জটিলতা দূরীভূত হলে আমাদের দেশে এ শিল্প স্থাপন করা সম্ভব হবে এবং দেশীয় শ্রমের সুযোগ বৃদ্ধি পাবে, কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়বে; ফলে গ্রামীণ অর্থনৈতিক উন্নয়ন হবে।
আগর ও আতর দুটি পণ্য জিআই স্বীকৃতি পেয়েছে।
আগর গাছ ও আতর একটি অতি মূল্যবান সম্ভাবনাময় সুগন্ধি। আভিজাত্যের প্রতীক হওয়া সত্ত্বেও আমাদের দেশে এখনও এ আগর শিল্পটি অবিকশিত। অত্যন্ত শক্তিমান এ সম্পদ মধ্যপ্রাচ্যসহ দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। তাছাড়া জাপান, ইউরোপ এবং অন্যান্য দেশেও প্রসাধনী হিসেবে ব্যবহার করা হয়। চাহিদা বৃদ্ধির সাথে রফতানিমুখী এ শিল্পের বিকাশে জরুরি ভিত্তিতে আগর গাছের ওপর গবেষণা জোরদার, চাষ সম্প্রসারণ ও ব্যবস্থাপনাসহ প্রক্রিয়াজাতকরণে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহারে আধুনিকায়ন করার উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত। ব্যক্তি উদ্যোগ থেকে বেরিয়ে এসে সরকারি মাধ্যমে রফতানি নিশ্চিত করা দরকার। এতে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন এবং গ্রামীণ জনপদের ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। তাছাড়া পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায়ও ভূমিকা রাখা সম্ভব। এ শিল্পের মাধ্যমে রাজস্ব বৃদ্ধি পাবে, ফলে দেশের সুষম অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়ক হবে।