পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটো শক্তি বাড়িয়ে চলেছেইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে থামনোই তাদের বড় লক্ষ্য। এই লক্ষ্যে অর্থ, অস্ত্র ও কৌশল সবকিছু নিয়ে মাঠে নেমেছেন পশ্চিমা নেতারা। এবার ন্যাটোর শক্তি আরও বাড়াতে জোটে ২০ হাজার সেনা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ব্রিটেন।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসের ইউরোপজুড়ে কাজ করতে ২০ হাজার সেনা দেবে যুক্তরাজ্য। এ ছাড়া যুদ্ধজাহাজ ও যুদ্ধবিমান মোতায়েন করবে দেশটি।
ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এদের মধ্যে ১৬ হাজার সেনা ফেব্রুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত পূর্ব ইউরোপে থাকবেন। এ ছাড়া বিমানবাহী একটি স্ট্রাইক গ্রুপ ও এফ৩৫বি যুদ্ধবিমান ও গোয়েন্দা বিমান মোতায়েন করা হবে।
চলতি বছর ন্যাটো প্রতিষ্ঠার ৭৫ বছর উদযাপন হবে। এ উপলক্ষে বিশাল সামরিক মহড়ার আয়োজন করবে সদস্য দেশগুলো।
যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষামন্ত্রী গ্রান্ট শ্যাপস বলেছেন, আমি আজ ঘোষণা করতে পারি যে স্নায়ুযুদ্ধ শেষের পর ন্যাটোর সবচেয়ে বড় সেনা মোতায়েনে ২০ হাজার সেনা পাঠাবে যুক্তরাজ্য। ন্যাটোর ৩০টি সদস্য দেশ ছাড়াও সুইডেনের সেনাবাহিনীর সঙ্গে আমাদের সামরিক বাহিনীর সদস্যরা যোগ দেবেন।
এর আগে গত সপ্তাহে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক আগামী অর্থবছরে ইউক্রেনকে দেওয়া সহায়তার পরিমাণ বাড়িয়ে আড়াই বিলিয়ন পাউন্ড করার ঘোষণা দেন। এটা আগের বছরের তুলানায় ২০০ মিলিয়ন পাউন্ড বেশি।
২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে কিয়েভকে সব ধরনের সহায়তা দিয়ে আসছে পশ্চিমারা। সহায়তার পাশাপাশি ন্যাটোর সামরিক শক্তিও জোরদার করা হয়েছে। তবে সম্প্রতি পশ্চিম থেকে আসা সহায়তায় ভাটা পড়েছে। নানা জটিলতার কারণে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইউক্রেনকে অর্থ সহায়তা দিতে পারছে না।
টিউলিপ (সদ্য পদত্যাগ করা ব্রিটিশ ট্রেজারি মন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিক) এমন দুটি জগতের অংশীদার হয়ে উঠেছিলেন, যেখানে আলাদা নিয়মে খেলা চলে। এখন তার পরিবারের সুনাম বাংলাদেশ ও ব্রিটেন—উভয় জায়গায়ই কলঙ্কিত। আর তিনি কোনো জায়গাতেই সান্ত্বনা খুঁজে পাচ্ছেন না। দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত এক নিবন্ধে এমন বক্তব্য তুলে ধরেছেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন লেখক ও সাংবাদিক সলিল ত্রিপাঠী। তার মতে, বাংলাদেশের মানবাধিকার নিয়ে অদ্ভুতভাবে নীরব থেকেছেন টিউলিপ সিদ্দিক।
সলিল লিখেছেন, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস ব্রিটিশ ট্রেজারি মন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনেছেন। এ বিষয়টি সত্যিই অস্বাভাবিক। ড. ইউনূস বাংলাদেশে অর্থ পাচারকে ‘সরাসরি ডাকাতি’ বলে অভিহিত করে তা থেকে টিউলিপ সুবিধা পেয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন এবং তাকে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের সঙ্গে টিউলিপের জড়িত থাকার অভিযোগ প্রকাশিত হওয়ার পর পরিস্থিতি দ্রুত পাল্টে যায়। বিপদে থাকা ব্রিটিশ ট্রেজারি মন্ত্রীর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ ছড়িয়ে পড়ে। তিনি চীন সফরে যাওয়া সরকারি প্রতিনিধিদলে যোগ দেওয়া থেকে বিরত থাকেন এবং মন্ত্রীদের আচরণবিধি নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনাকারী প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা লরি ম্যাগনাসের কাছে বিষয়টি তদন্তের জন্য তুলে দেন এবং অবশেষে গত সপ্তাহে পদত্যাগ করেন। টিউলিপ তার বিরুদ্ধে আনা দুর্নীতির অভিযোগ ‘সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন’ বলে দাবি করেন।
চলতি মাসে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমস জানায়, টিউলিপ তার খালা বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ এক ডেভেলপারের কাছ থেকে লন্ডনের কেন্দ্রে একটি দুই-বেডরুমের ফ্ল্যাট উপহার পেয়েছেন। টিউলিপ দাবি করেন, এই ফ্ল্যাটটি তিনি তার বাবা-মায়ের কাছ থেকে পেয়েছেন। তবে ম্যাগনাসকে তিনি জানান, এই বাড়িটি যে একজন বাংলাদেশি ব্যবসায়ীর উপহার ছিল, তা তিনি সম্প্রতি জানতে পেরেছেন।
টিউলিপ ২০১৮ সাল পর্যন্ত হ্যাম্পস্টেডে তার ছোট বোনের নামে থাকা আরেকটি ফ্ল্যাটে থাকতেন। এই ফ্ল্যাটটিও হাসিনা সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আরেক ব্যবসায়ী উপহার দিয়েছিলেন। বর্তমানে তিনি ব্রিটিশ আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত এক ব্যবসায়ীর ভাড়া করা বাড়িতে বসবাস করছেন। ২০১৫ সালে সিদ্দিক প্রথম পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হন। নির্বাচনে জয়ের পর তিনি তার সমর্থকদের ধন্যবাদ জানান, বিশেষ করে ব্রিটিশ আওয়ামী লীগের বাংলাদেশি সদস্যদের অকুণ্ঠ সমর্থনের কথা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেন।
টিউলিপ সিদ্দিককে ঘিরে ২০১৩ সালের একটি ছবি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। ছবিটিতে তাকে তার খালা হাসিনা ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে দেখা গেছে। ছবিটি বাংলাদেশে ১২ বিলিয়ন ডলারের পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ চুক্তি স্বাক্ষরের সময় তোলা। টিউলিপ দাবি করেন, এটি স্রেফ একটি পারিবারিক সফর এবং তিনি সেখানে গিয়েছিলেন পর্যটক হিসেবে। ম্যাগনাস তার ব্যাখ্যা মেনে নিয়েছেন। তবে এখন টিউলিপ বাংলাদেশের ওই চুক্তি নিয়ে দুর্নীতির তদন্তের মুখোমুখি।
এদিকে, লরি ম্যাগনাস লন্ডনে টিউলিপের বাড়িগুলোর বিষয়েও কোনো নিয়ম ভঙ্গের প্রমাণ পাননি এবং লেনদেনের বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেননি। তবে তিনি স্বীকার করেছেন, তার কাছে তথ্য ছিল সীমিত এবং টিউলিপের পারিবারিক সম্পর্কের কারণে সৃষ্ট ভাবমূর্তি ঝুঁকি সম্পর্কে আরও সচেতন হতে পারতেন। তিনি এটাও উল্লেখ করেন যে, প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার টিউলিপের দায়িত্ব পালনের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করতে চাইলে করতে পারেন। একপর্যায়ে পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছায়, টিউলিপ পদত্যাগে বাধ্য হন।
সলিল ত্রিপাঠী আরও লেখেন, তবে হাসিনা ক্ষমতায় থাকলে হয়তো বিষয়গুলো ভিন্ন হতে পারত। কিন্তু গত বছর আগস্টে হাসিনার ক্রমবর্ধমান অজনপ্রিয় শাসনের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে তিনি পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন। হাসিনা সরকারের আমলে গুম, নিখোঁজ এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা বেড়ে যায়। পাশাপাশি গণমাধ্যম ও ইন্টারনেটের ওপর দমনপীড়ন চালানো হয়। ভিন্নমতাবলম্বী, মানবাধিকার কর্মী এবং সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার করা হয়। হাসিনা তার পিতার খ্যাতি পুনঃস্থাপনে অনেক কাজ করলেও তার শাসনামলের এত বিরোধিতা সৃষ্টি হয় যে, তার পতনের পর বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক বাড়ি আক্রমণ করে পুড়িয়ে দেওয়া হয়, তার ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা হয়।
সলিল লেখেন, মুজিবের অসম্মানের জন্য হাসিনা অনেকাংশেই দায়ী। তিনি নিজেকে সারা বিশ্বের কাছে ধর্মীয় মৌলবাদ মোকাবিলায় দৃঢ় অবস্থানে থাকা একজন নেতা হিসেবে উপস্থাপন করেন এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মতো একজন শক্তিশালী মিত্র পেয়েছিলেন। অন্যদিকে, টিউলিপ বহু জায়গায়, যেমন—সিরিয়া ও গাজায় মানবাধিকার নিয়ে সক্রিয়ভাবে কথা বলেছেন। কিন্তু বাংলাদেশের দ্রুত অবনতি হওয়া মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে অদ্ভুতভাবে নীরব থেকেছেন এবং বারবার বলেছেন যে তিনি কেবল ‘একজন ব্রিটিশ এমপি’। তবে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের সঙ্গে টিউলিপের সম্পর্কই তার রাজনৈতিক জীবনে বিপদ ডেকে আনে।
বাংলাদেশে রেজিম পরিবর্তনের সুযোগে প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলো প্রায়ই প্রতিশোধ নিতে তাদের পূর্বসূরিদের বিরুদ্ধে মামলা এবং তদন্তের মাধ্যমে বিদ্বেষ চরিতার্থ করে থাকে। কিন্তু হাসিনার বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো (এবং টিউলিপ সম্পর্কে ওঠা প্রশ্নগুলো) রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নয়। রাজনীতিবিদদের অভিযোগ তোলার পেছনে যাই উদ্দেশ্য থাকুক না কেন, বাস্তবতা হলো—বিশ্বব্যাংক পদ্মা নদীর ওপর সেতু নির্মাণের জন্য ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের ঋণ বাতিল করেছিল বিশ্বাসযোগ্য দুর্নীতির অভিযোগের কারণে। এ ছাড়া হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশে গুম এবং বিচারবহির্ভূত হত্যার মাধ্যমে মানবাধিকার রক্ষা কর্মীদের দমন করার ঘটনায় জাতিসংঘের মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা তীব্র সমালোচনা করেছিলেন।