img

স্বপ্ন এখন লাশ ঘরে

প্রকাশিত :  ০৯:৪৭, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
সর্বশেষ আপডেট: ০৯:৫১, ২৯ এপ্রিল ২০২৪

স্বপ্ন এখন লাশ ঘরে

কান্না করিস না মৌরি।

চল আমরা হাসপাতালে যাই।

মনটা ভাল নেই। তবুও যেতে হবে। কারন ওর পাশে তো কেউ নেই। এই শহরে আমরাই ওর আপনজন।

হ্যাঁ। হাসপাতালে তো যেতেই হবে। গভীর রাতে হাসপাতালে রেখে এসেছি। এখন পর্যন্ত খবর নিতে পারি নাই। একটু পরে শাহনাজ আসার কথা। ও আসলেই কলেজের খবরটা শুনে বের হব।

আচ্ছা কেয়া তুই বল ভালবাসা কি পাপ?

যে ভালবাসার জন্য লিজাকে এমন করে খেসারত দিতে হচ্ছে।

লিজার বাড়ি কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুরে গ্রামে। এক প্রত্যন্ত গ্রাম। ব্রম্মপূত্র নদের কয়েক দফা ভাঙনে সর্বশান্ত ওই গ্রামের প্রতিটি মানুষ। এই গ্রামে খুবই গরীব ঘরের কন্যা সে। তিন ভাই বোনের মধ্যে লিজা সবার বড়। ঢাকা শহরে রিক্সা চালিয়ে সংসার চালান লিজার বাবা রমজান আলী। নিজ উপজেলা কিংবা জেলাতে রিক্সা চালালে লিজাকে অনেকের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হতে হয়। সহপাঠিরা লিজাকে রিক্সা চালকের মেয়ে বলে হেয় করে। তাই লিজার অনুরোধে দুর শহরে রিক্সা চালায় রমজান। ছোট বেলা থেকেই মেধাবী ছিল লিজা। জিপিএ ৫ পেয়ে এসএসসি ও এইচ এসসি পাশ করার কারনে উপজেলায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লিজা নামটি বেশ আলোচিত। উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় সংগঠন থেকে লিজা পায় কৃতি শিক্ষার্থী সংবর্ধনাও। অনেকটা গোবরে পম্মাফুল ফোটার মত। তাই রমজান আলী রিক্সার হ্যান্ডেলে হাত আর প্যাটেলে পা রেখে স্বপ্ন দেখে মেয়েকে নিয়ে। বড় মেয়ে লিজা একদিন অনেক বড় হবে। পড়ালেখা শেষ করে চাকুরী করবে। দেশ সেবার পাশাপাশি ছোট ভাইবোনদেরও প্রতিষ্ঠিত করবে। একদিন হয়তো আর রিক্সা চালাতে হবে না তাকে। লিজা চাকুরী করলে অফিস থেকে গাড়ী পাবে। সেই গাড়ী নিয়ে গ্রামে আসবে। সবাই বলবে দেখ রমজানের মেয়ে গাড়ী নিয়ে এসেছে। গর্বে বুক ভরে যাবে সেদিন। আর আমার মেয়ে লিজা তা পারবে। কেননা এ পর্যন্ত সব পরীক্ষায় ফাস্ট হয়েছে সে।

এইচ এস সি পাশ করার পর উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের জন্য লিজা ভর্তি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। প্রকৌশলী বিশ্ববিদ্যালয়ে মেধা তালিকায় স্থান পায় সে। কিন্তু ভর্তি হলেই তো আর পাশের সনদ হাতে চলে আসবে না। পড়ালেখা চালিয়ে যেতে হবে। আর পড়া লেখা চালানোর এত খরচ জোগানো সম্ভব নয় তার রিক্সা চালক বাবার। তাই ওই আকাশ ছোয়া স্বপ্নের সমাধি রচনা করে রংপুরে সরকারী বেগম রোকেয়া কলেজে ইংরেজী বিভাগে পড়ার পরীক্ষা দেন। মেধাতালিকায় লিজার রোল চলে আসে। ভর্তি হয়ে নিয়মিত ক্লাস শুরু করে লিজা। বেগম রোকেয়া সরকারী কলেজে দু’টি ছাত্রী হোস্টেল। ছাত্রীর তুলনায় কলেজ হোস্টেলে সিট কম। তাই হোস্টেলের সিট পেতে লবিং তদবির করতে হয়। কিন্তু এ ধরনের সুপারিশ করার কেউ ছিল না লিজার। তাই প্রথম দিকে কলেজের পাশে মালিকানা ছাত্রী নিবাসে সিট নিতে হয় তাকে। কষ্টের জীবনে নেমে আসে আরও কষ্ট। পড়ালেখার খরচ চালাতে চালাতে হিমশিত খায় রিক্সা চালক রমজান।

লিজার মা শারীরিকভাবে খুবই অসুস্থ। স্থানীয় ডাক্তার বলেছেন, এভাবে ওষধ খেলে হবে না। শহরে নিতে হবে। ভাল ডাক্তার দেখাতে হবে। পরীক্ষা নীরিক্ষা করতে হবে। কেননা তার তোর লিভারের জটিল সমস্যা আছে। কিন্তু রমজান আলীর ইচ্ছা থাকলেও উপায় নাই। কারন এত টাকা তার কাছে নাই। স্ত্রীর চিকিৎসা করাবে কেমনে? মেয়ে লেখাপড়ার খরচ দিতে হবে তো। শহরের বড়ো কলেজে পড়ছে তার মেয়ে লিজা।

এদিকে, মায়ের অসুস্থতার খরব পেয়ে গ্রামে ছুটে আসে লিজা। অসুস্থ মাকে জড়িয়ে কান্না করে। মেয়ের চোখের পানি মুছে দিতে দিতে মা বলে,এভাবে কাদিস না। আমার কিছু হবে না। তুই পড়ালেখা শেষ করে চাকুরী করবি। আর তোর চাকুরীর বেতনের টাকা দিয়ে আমাকে ভাল ডাক্তার দেখাবি। আমি সুস্থ হয়ে যাব। পারবি না তুই। আমি জানি আমার মেয়ে পারবে। মায়ের মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে লিজা। কয়েকদিন মায়ের সেবা করে আবার ক্যাম্পাসে চলে আসে সে।

এবার মাথায় ঢুকে পড়ালেখার পাশাপাশি আয় করার চিন্তা। রুমমেট মৌরির কাছে জানতে চায় কিভাবে আয় করা যায়। অন্তত নিজের পড়ালেখার খরচ হলেই হবে।

অনেক ভেবে মৌরি বলে, উপায় একটা আছে।

কি উপায়?

প্রাইভেট পড়াতে হবে। কিন্তু…….

প্রাইভেট পড়াতে আমি পারবো। কিন্তু কি?

কিন্তুটা হচ্ছে, প্রাইভেট পাওয়াটা কঠিণ হবে। তবুও দেখি আমার একটা বন্ধু আছে। তাকে বলে কোন ব্যবস্থা করা যায় কি না?

আমার বন্ধু ইমরান। কারমাইকেল কলেজে মাস্টার্সে পড়ে। রংপুরের স্থানীয় বাসিন্দা। ওদের বাড়ি গাড়ি সবই আছে। এলাকার প্রভাবশালীও বটে। পরদিন তার সঙ্গে দেখা করে প্রাইভেট এর কথা জানালো। ইমরানও প্রস্তাবটা লুফে নিয়ে প্রাইভেট খুঁজতে শুরু করলো। প্রাইভেট এর আপডেট প্রতিদিন ফোনে জানায় ইমরান। কয়েকদিন পর একটা প্রাইভেট পড়ার সুযোগ পায় লিজা। ইংরেজী বিভাগের ছাত্রী হওয়ায় প্রাইভেট পেতে বেশি সময় লাগেনি। সপ্তম শ্রেনীর ছাত্রী হƒদি। পুলিশ লাইন স্কুল এন্ড কলেজে পড়ে। মেয়েটির বাবা পুলিশে চাকুরী করেন। মেয়েটিকে তার বাসায় গিয়ে পড়াতে হয় । লিজার আনন্দের শেষ নেই। প্রতিদিন রুটিন করে হৃদিকে পড়াতে যান তার বাসায়। খুব যত্নসহকারে পড়ান। নির্ধারিত সময়ের কিছু আগে গিয়ে উপস্থিত হন। আবার নির্ধারিত সময়ের পরেও কিছু সময় পড়ান। কেননা, এই প্রাইভেটের বেতনের উপর নির্ভর করে লিজার ভবিষৎ পড়ালেখা। তাই কোনকিছুর কমতি সে করতে নারাজ।

এদিকে, প্রাইভেট খুঁজে দেওয়ার কারনে প্রায় প্রতিদিন ফোনে ইমরানের সাথে কথা হয় লিজার। কথা বলতে- বলতে এক পর্যায়ে ভাল বন্ধুত্ব হয় দুজনের মধ্যে। লিজাও কৃতজ্ঞার জায়গা থেকে এ সর্ম্পকটা ধরে রাখে।

প্রাইভেট থেকে নিয়মিত বেতন পাওয়ায় পড়ালেখা চালিয়ে যায় লিজা। সময় গুছিয়ে নিয়ে প্রতিদিন দুটো প্রাইভেট পড়ায় সে। নিজের খরচ চালানোর পরও ছোট ভাই বোনের পড়ালেখার জন্য টাকা পাঠায়।

সময়ের ব্যস্ততার মাঝে ইমরান থেমে নেই। ফোনে কথা বলার ফাঁদে ফেলে আস্তে-আস্তে দেখা করা শুরু করে। একটা সময়ে রোজ দিনেই দেখা হয় তাদের। প্রায় বছর খানিক পাড়ি দেওয়ার পর লিজার মনে ভিতরে একটা আস্থার জায়গা করে নেয় ইমরান। ভাললাগা থেকে শুরু হয় ভালবাসা।

লিজা অনেকটা ভেবেই এ পথের পথিক হয়েছে। ইমরান ভাল ছেলে শহরের স্থানীয়। সে পাশে থাকলে অনেক সমস্যা থেকে রেহাই পাবে সে। পথে ঘাটে কত ছেলে প্রতিদিন উৎপাত করে। ইমরান থাকলে রাস্তায় ছেলেরা আর উৎপাত করার সাহস পায় না।

বন্ধু মৌরি ওদের দু জনের প্রেমের সম্পর্ক জেনেছে। মৌরিও বাধা দেয়নি। কারন লিজার মত একটি মেয়ে যদি ভাল ছেলে খুঁজে পায় । তাতে সমস্যা কী? উল্টো লিজার উপকার হবে। লেখাপড়ায় আর কোন বেগ পেতে হবে না । জীবনে দু:খ কষ্টের ঘানি অনেক টেনেছে। এভাবে যদি সুখের সন্ধান পায় তবুও ভাল।

ইমরান প্রতিদিন লিজাকে নিয়ে ঘুরতে যায়। কোন দিন সুরভী উদ্যান, কোনদিন চিকলীর বিল, শিরিন পার্ক, খেয়া পার্ক, চিড়িয়াখানা, তাজহাট জমিদার বাড়ী ও ভিন্নজগৎ। রংপুরে থাকলেও এর আগে এসব জায়গাগুলো ঘুরে দেখা হয়নি লিজার। প্রেম ভালবাসার খুনসূটিতে আর হাতে হাত রেখে পথ চলতে চলতে কেটে যায় মাস বছর।

এভাবে জীবনের ঘোড়াঘুড়ি শেষ হতে না হতেই সরকারি চাকুরী হয় ইমরানে। খুশিতে আত্মহারা লিজা। যাকে নিয়ে ঘর বাধবে, সে এখন সরকারী চাকুরে। মনে কত ছন্দের আলপনা আঁেক। কিন্তু, বিধির বিধান বড়ই কঠিন। এ হাসি দীর্ঘ হলো না লিজার।

চাকুরীর ক মাস যেতে না যেতেই পাল্টে যেতে থাকে ইমরান। আগের মত খোঁজ রাখে না লিজার। দেখা করে না আগের মত। ফোন করেও নেয় না খবর। ব্যস্ততার অযুহাতে আড়াল করতে থাকে নিজেকে। কোন কিছুতেই হিসেব মেলে না লিজার। অস্থির হয়ে ওঠে সে। কারন বিয়ে প্রলোভন দেখিয়ে দুজনের মধ্যে শারীরিক সর্ম্পক হয়েছে কয়েক মাস ধরে। অনার্স শেষ বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছে লিজা। পরীক্ষার ফল প্রকাশ পেলেই বিয়ে পিড়িতে বসবে তারা। এমনটাই কথা ছিলো দুজনের মধ্যে। কিন্তু ইমরানের এমন আচরন মোটেও ভাল ঠেকছে না তার কাছে।

কি করবে ভেবে পাচ্ছে না লিজা।

বান্ধবী মৌরির কাছে খুলে বলে সব কথা। কিভাবে কবে কখন তাদের শারিরীক সর্ম্পকও হয়েছিল। এখন সে কি করবে। কোথায় যাবে। কার কাছে গিয়ে দাঁড়াবে।

মৌরি আশ্বস্ত করে বলে আপাতত ভেঙ্গে পরিস না। অপেক্ষা কর। তুই বিসিএস কোচিং চালিয়ে যা। কিছুদিন পর সব ঠিক হয়ে যেতে পারে। প্রেম পিরিতির মধ্যে এসব মান- অভিমান থাকবে।

এখন প্রায় রাতে ফোনে ঝগড়া হয় দুজনের মধ্যে। কিন্তু লিজাকে বিয়ে করতে রাজি হয় না। উল্টো দুজনের শারীরিক সম্পর্কের সময় মোবাইলে যে নগ্ন ছবি তুলেছিল, সেই ছবি ইন্টারনেটে ছেড়ে দেওয়ারও হুমকী দেয় ইমরান। কিন্তু ইমরানের প্রতি তার অগাদ বিশ^াস। সম্পর্কের টানাপোড়নে এসব হুমকী-ধামকি আসতেই পারে। তাই এসব আমলে না নিয়ে ভাঙ্গা মনে অস্থির জীবন কাটতে থাকে। আধার কেটে আলো আসার অপেক্ষায়…

সেদিন শুক্রবার। সকাল থেকে কাপড় ওয়াশ করেন লিজা। মনের ভিতর কাল বৈশাখী ঝড় বয়ে যাওয়ার চিত্র তার শরীরে ফুটে ওঠেছে। হঠাৎ রুমে দৌড়ে আসে মৌরি। লিজাকে ধমক দিয়ে মৌরি বলে, ছেলে মানুষ কথা বললেই তার প্রেমে পড়তে হয় না। কাছে ডাকলে বিছানায় যাওয়া যায় না। ছেলেরা শুধু ভোগ করেই ক্ষান্ত হন না। তারা আরো অনেককিছু করতে পারে।

লিজা জানতে চায় কেন?

কী হয়েছে?

কিছু না হওয়ার তো বাকী নেই।

সর্বনাশ হয়ে গেছে রে লিজা। এই বলে হাতে থাকা মোবাইলটা সামনে ধরে। লিজা মোবাইলের মনিটরেও তাকিয়ে নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছে না। এটা কি করে সম্ভব? ইমরান এ কাজ কেমনে করলো?

লিজার নগ্ন ছবিগুলো ফেসবুকে দিয়েছে। লিজার ফেসবুক বন্ধুদের এ ছবি ট্যাগ ও করেছে। লিজার বন্ধু তালিকায় তার স্কুল কলেজের শিক্ষকরাও আছেন।

মুহুর্তে যেন আকাশ ভেঙে পড়ল মাথায়। এই অশুভ ঝড় কিভাবে মোকাবিলা করবে লিজা? চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে পাথর হয়ে গেছে সে। এদিকে, রিক্সা চালক বাবা। অসুস্থ্য মা। ছোট ভাই বোনের স্বপ্নময় জীবন। চোখের সামনে জোনাক পোকা জ¦লতে থাকল।

ম্যাসের মধ্যে সকলের কাছ থেকে আস্তে আস্তে আলাদা হয় সে। রুমে একাই বসে থাকে। কোন প্রাইভেট সে পড়েও না আবার পড়াতেও যায় না। স্বাভাবিক জীবন থেকে সরে আসে লিজা।পাল্টে যায় তার সাজানো পৃথিবী। গোসলা নেই। খাওয়া নেই। ঘুম নেই। দুচোখ দিয়ে শুধু শ্রাবনের বারি ধারা ঝরে যায়। এভাবে চলে যায় কয়েকদিন। এ কয়েকদিনে পৃথিবী ছোট হয় তার কাছে। বেহিসাবি মন হঠাৎ করে অংক কষে। মিলে নেয় জীবনের হিসাব। গভীর রাতে আত্মহত্যার পথ বেঁচে নেয়।

অস্পষ্ট শব্দে রাতে ঘুম ভেঙ্গে যায় মৌরির। মনটা তার মোচড় দিয়ে ওঠে। তাই রুমের সুইচ অন করে দেয়। বৈদ্যুতিক আলোয় নিজের রুমটা ভাল করে দেখে নেয়। কিন্তু না তেমন কোন আলামত চোখে পড়লো না। তাই আবার ঘুমানোর প্রস্তুতি নিয়ে বিছানার দিকে যায়। তার আগে বাথরুমে যেতে ধরে।

ক্ষণপরে থেমে- থেমে গোঙরানী শব্দ কানে ভেসে আসে। বাথরুম না গিয়ে আস্তে- আস্তে লিজার রুমের দিকে যায় মৌরি। যতই এগিয়ে যায় ততই গোঙরানী শব্দটা স্পস্ট হয়। লাথি মারতেই খুলে যায় দরজা। ভিতরে ঢুকেই সুইচ অন করতেই দেখে ফ্যানের সাথে ঝুলে আছে লিজা। ওড়না পেছানো গলা। মুখ থেকে ফ্যানা বের হচ্ছে।

হাউ মাউ করে চিৎকার দেয় মৌরি। চিৎকার শুনে আশে পাশে রুম থেকে সকলেই ছুটে আসে। দ্রুত ফ্যান থেকে খুলে নিচে নামায় লিজাকে। এরপর কয়েকজন ধরে ম্যাস থেকে বের করে রাস্তায় এসে দাড়ায়। রিক্সা খোজে সবাই। কিছুক্ষণ পর একটি রিক্সাযোগে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেয় লিজাকে। ডিউটি ডাক্তার দেখে বলেন এখনো মারা যায়নি। তবে তার অবস্থাও ভাল নয়। প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হবে। রাতে তো আর তেমন কিছু করা যাচ্ছে না। সকালে টেস্টগুলো করতে হবে। এরপর প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে বেডে ভর্তি করা হয় লিজাকে। বেডে নেওয়ার পর একে-একে সবাই চলে যায় ম্যাসে।

পরদিন সকালে মৌরি চোখের পানি মুচছে আর আর কেয়া বলছে, মনটা ভাল লাগছে না। এমন সময় রুমে আসে শাহনাজ। সে জানায়,অর্নাস ফাইনালের রেজাল্ট হবে আজ। মৌরি আরো কেঁদে ওঠে। লিজার আজ রেজাল্ট হবে। অথচ কোন বিপদে সে এখন জীবন মৃত্যুর মাঝে। চল আমরা কলেজে যাই। কলেজে রেজাল্ট নিয়ে হাসপাতালে যাব।

টেবিলের ড্রয়ার থেকে লিজার রোল নম্বর বের করে নেয় মৌরি। কেয়াকে সঙ্গে নিয়ে কলেজে যায়। কলেজের নোটিশ বোর্ডে নিজের রোল খুজে পায় কেয়া ও মৌরি। তারা দু জনে দ্বিতীয় বিভাগে পাস করেছে। পাসের আনন্দে মুখে হাসি আসলেও মনের হাঁসি হাসতে পারছে না। এবার লিজার রোল মেলাতে গিয়ে দেখে ফাস্ট ক্লাস পেয়েছে লিজা। খুবই আনন্দিত দু’জন। লিজার ভাল রেজাল্টে কলেজের শিক্ষকরাও বেশ আনন্দ বোধ করছে। কিন্তু প্রকাশ করতে পারছে না। কয়েকজন তো বলেই দিলেন এত ভাল রেজাল্ট অথচ মেয়েটা কী ভুল পথে পা দিয়েছে। নস্ট হয়ে গেছে মেয়েটা। এমন মেয়েকে নিয়ে কোন বাবা মা ই স্বপ্ন দেখবে না।

এসব কথা শুনেও না শোনার ভান করে মৌরি ও কেয়া। মৌরি কেয়াকে ডাক দিয়ে বলে চল আমরা হাসপাতালে যাই। ওর পাসের খবরটা দেই। এত বড় খবর শোনার পর হয়তো কিছুটা হলেও শান্তি পাবে। রিক্সায় বসে দুজনেই রওয়ানা দেন হাসপাতালে। রিক্সায় ওটার পর দুজনের মধ্যে কোন কথা নেই। দুজনেই নীরব। দুজনেই ভাবছেন লিজার কথা। কত সাদা সিদে মেয়েটা । অথচ কোন ঝড়ে সবকিছু তছনছ হয়ে গেল। যে লিজাকে নিয়ে বাবা মা, ভাই, বোন, আত্বীয় স্বজন, বন্ধু, বান্ধবী, শিক্ষক শিক্ষিকা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গর্ববোধ করবে। তারা সবাই আজ ঘৃনাভরে ধিক্কার দিচ্ছে। এভাবে ভাবতে ভাবতে হাসপাতালের গেটে এসে দাড়ালো রিকসা। দুজনেই ওয়ার্ডের যান। নির্ধারিত বেডে গিয়ে দেখেন অন্য রোগী শুয়ে আছে। পাশে তার স্বজন। রোগীর শরীরে স্যালাইন চলছে। পাশে থাকা স্বজনের কাছে মৌরি জানতে চায়, এই বেডে যে রোগী ছিল সে কোথায়?

কোন জবাব দিতে পারেনি ওই রেগীর স্বজনরা। দুজনেই হেটে গেলেন নার্স রুমে। ডিউটিরত নার্স চেয়ারে নেই। অপেক্ষা করলেন দুজন। কিছুক্ষণ পর ডিউটিরত নার্স চেয়ারে বসলেন। মৌরি জানতে চাইলেন, ওই বেডের রোগী লিজা এখন কোথায়। বেডের নম্বর আর নাম শুনে থমকে গেলেন নার্স। জানতে চাইলেন লিজার আপনারা কেন হন?

আমরা ওর বান্ধবী।

ওর বাবা মা কেউ আসেনি।

না। তাদেরকে জানানো হয়নি।

কেন?

লিজা একটু সুস্থ হলে তারপর ওদের পরিবারকে জানাবো। তাছাড়া ওর মা অনেক বড় রোগে আক্রান্ত। এ খবর জানলে আরো সমস্যা হতে পারে। শুনেছি ওর বাবা রিক্সা চালান ঢাকায়।

কিন্তু লিজা তো আর সুস্থ হবে না…

চমকে যায় মৌরি ও কেয়া। দুজন দুজনের দিকে তাকায়।

মৌরি নিজেকে আর সামলে রাখতে না পেরে নার্সকে ধমক দিয়ে বলেন, এসব আজে বাজে কথা বলে সময় নস্ট করবেন না। লিজার জন্য অনেক বড় সুখবর নিয়ে এসেছি। ওকে তাড়াতাড়ি জানাতে হবে। বলুন লিজা কোথায়। মাথা নিচু করে নার্স বললেন, ভোরবেলায় লিজা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে। লিজা এখন লাশ ঘরে…


লেখক

উমর ফারুক

কবি ও সাংবাদিক

img

মায়ের ভালোবাসা!

প্রকাশিত :  ০৯:২০, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪
সর্বশেষ আপডেট: ০৯:২৪, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪

রেজুয়ান আহম্মেদ

মেঘলা আকাশ, গুমোট বাতাস, সিলেটের জৈন্তাপুর ফেরিঘাট এলাকার মেঠোপথে এক অদৃশ্য দুঃস্বপ্নের ছায়া। দূরে এক পাহাড়ি নদীর স্রোত যেন ক্রমেই ভয়ংকর হয়ে উঠছে। বন্যার খবর ছড়িয়ে পড়েছে, আর লোকজন দলবেঁধে নিরাপদ স্থানে ছুটছে। তবে গ্রামের শেষপ্রান্তে একটি ছোট্ট কুঁড়েঘরে তখনও এক মা তার ছোট্ট সন্তানকে বুকের মধ্যে চেপে ধরে বসে আছে। সুলতানা, এই মায়ের নাম, আর তার ছোট্ট ছেলের নাম নাবিল।

সুলতানার জীবন ছিল সংগ্রামের এক নিঃশেষ পরিসংখ্যান। তিন বছর আগে সে তার প্রিয়জন, তার স্বামীকে হারিয়েছে। একাকী, অদম্য শক্তি আর সাহস নিয়ে, গ্রামীণ জীবনে সংসারের হাল ধরেছিল। তার দিন গিয়েছিল অন্যের বাড়িতে হাঁড়ি ধুয়ে, কাজ করে, আর রাতে বাড়ি ফিরে তার একমাত্র ছেলেকে স্নেহের মাঝে মানুষ করার চেষ্টা। নাবিল ছিল তার জীবনের একমাত্র আশ্রয়, জীবনের একমাত্র প্রেরণা। মায়ের মুখে সবসময় শুনত, “তোর জন্যই আমি বাঁচি, রে। তুই-ই আমার স্বপ্ন।”

কিন্তু সে দিনটা ছিল অন্যরকম। বন্যার স্রোত যখন বাড়তে লাগল, প্রতিবেশীরা এসে বলল,

“সুলতানা, তুই এখনো বসে আছিস? পানি কিন্তু সব ডুবিয়ে দিচ্ছে। চল, আমাদের সঙ্গে চল।”

সুলতানা তার চোখে একবার তাকাল তার ছেলেকে। কোলের নাবিল তখন গভীর ঘুমে। তার ছোট্ট নিঃশ্বাসে যেন পৃথিবীর সমস্ত শান্তি ছিল। সুলতানা মৃদু হেসে বলল,

“তোমরা যাও। আমার ছেলে ঘুমাচ্ছে। ওকে নিয়ে কীভাবে বেরোব? ঘুম থেকে জাগলেই যাব।”

কিন্তু এই কথাগুলো ছিল শুধু সন্তানকে সুরক্ষিত রাখার অজুহাত। তার বুকের ভেতরে চলছিল এক গভীর দ্বন্দ্ব। “আমি যদি বের হই, নাবিলকে বাঁচাতে পারব তো?”

ঘরের ভেতর পানি ঢুকতে শুরু করল। সময় ছিল না, তাড়াহুড়া করে সুলতানা ঘরের কোণায় রাখা একটি পুরনো কাঠের বাক্স টেনে আনল। ভাবল, যদি এই বাক্সে ছেলেকে রাখে, তবে হয়তো স্রোতের হাত থেকে রক্ষা পাবে। দ্রুত সে তার গায়ের চাদর দিয়ে বাক্সটি মুড়িয়ে দিল, যেন পানি ভেতরে না ঢোকে।

ছেলেকে বাক্সে রেখে সুলতানা নিজে বসে রইল বাক্সের পাশে। তার হাত শিশুটির গায়ে রেখে বারবার অনুভব করছিল, “আমার জীবন যাক, কিন্তু ও যেন বাঁচে।” ঘরের ভেতর পানি আরও বেশি বাড়তে লাগল, সুলতানা বাক্সটি শক্ত করে ধরে রেখে পানির স্রোতের সঙ্গে লড়াই করল। তার কণ্ঠে একটিই প্রার্থনা ছিল,

“হে আল্লাহ, আমার সন্তানকে বাঁচাও। ওর জীবন যেন আমার চেয়েও বেশি দামি হয়।”

বন্যার স্রোতে ভেসে গেল কুঁড়েঘর। সুলতানা এক হাত দিয়ে বাক্সটি ধরে রেখেছিল, আর অন্য হাত দিয়ে একটি গাছের ডাল আঁকড়ে রইল। অনেকক্ষণ ধরে লড়াই করার পর সুলতানা বুঝতে পারল, তার শরীর আর স্রোতের সঙ্গে লড়তে পারছে না। কিন্তু মায়ের মন যেন দেহের শারীরিক শক্তি ছাড়িয়ে এক অনুপ্রেরণা হয়ে কাজ করছিল। শেষবারের মতো ছেলেকে চুমু খেয়ে, বাক্সটি ঠেলে দিল পানির বিপরীতে। তার শরীর আর শক্তি ছিল না, কিন্তু বুকের ভেতর তার একক সাধনা ছিল—“আমার সন্তান যেন বাঁচে।”

সুলতানা নিজের হাত ছেড়ে দিয়ে স্রোতের সঙ্গে মিলিয়ে গেল। পরদিন ভোরে গ্রামবাসী একটি ভাসমান বাক্স দেখতে পেল। বাক্সটি খোলার পর তারা দেখল, নাবিল জীবিত আছে, শুকনো চাদরে মুড়ে রাখা। কিন্তু তার মা আর নেই।

গ্রামের মানুষ কাঁদল। সবাই বলল, “মায়ের ভালোবাসা এমনই। নিজের জীবন দিয়ে সন্তানকে বাঁচায়।”

মায়ের ভালোবাসা পৃথিবীর সবচেয়ে নিঃস্বার্থ অনুভূতি। এটি সময়, স্থান বা পরিস্থিতি মেনে চলে না। মা তার সন্তানের জন্য যা করতে পারেন, তা আর কেউ কখনো করতে পারবে না। মায়ের ভালোবাসা শুধুমাত্র প্রেম নয়, এটি এক আত্মত্যাগ, এক বিশাল শক্তি, যা পৃথিবীর সমস্ত শক্তির সামনে দাঁড়িয়ে সন্তানকে রক্ষা করে। মা শুধুই মা নয়, সন্তানের পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী রক্ষাকবচ।

এটাই মা-বাবার প্রতি সন্তানের প্রতি দায়িত্ব, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা যেন কখনো শেষ না হয়। মা তার সন্তানকে শুধু জন্মই দেয় না, তাকে ভালোবাসা দিয়ে গড়ে তোলে, আর সেই ভালোবাসা পৃথিবীর সবচেয়ে অমূল্য রত্ন।

এই ভালোবাসার কোনও সীমা নেই। এটি নিজস্বতায়, জীবনের প্রতি অটুট বিশ্বাসে ভরা। সত্যিকার অর্থে, একজন মা তার সন্তানের জন্য যা করতে পারেন, তা আর কেউ কখনো করতে পারবে না, কারণ মা যেন এক পৃথিবী, যা তার সন্তানকে লালন-পালন করার জন্য এক অনবদ্য শক্তি সঞ্চয় করে রাখে।