img

আজ পঁচিশে বৈশাখ, কবিগুরুর ১৬৩তম জন্মদিন

প্রকাশিত :  ০৬:১০, ০৮ মে ২০২৪

আজ পঁচিশে বৈশাখ, কবিগুরুর ১৬৩তম জন্মদিন

 আজ পঁচিশে বৈশাখ, বাংলা সাহিত্যের অনন্যপ্রতিভা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মদিন। ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দ অর্থাৎ ১২৬৮ বঙ্গাব্দের এই দিনে কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে জন্ম নিয়েছিলেন বিশ্বকবি।

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উৎকর্ষের নায়ক তিনি। বাঙালির আত্মিক মুক্তি ও সার্বিক স্বনির্ভরতার প্রতীক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সংকটে প্রতিরোধ ও অভিযাত্রার প্রেরণাও তিনি।

কবিগুরুর জন্মদিন প্রথম বার পালিত হয়েছিল তার ২৬ বছর বয়সে, ১৮৮৭ সালে। প্রিয় ভাগনি সরলাদেবী ‘জীবনের ঝরাপাতা’য় লিখেছেন, ‘রবি মামার প্রথম জন্মদিন উৎসব আমি করাই। তখন মেজ মামা ও নতুন মামার সঙ্গে তিনি ৮৯ পার্ক স্ট্রিটে থাকেন। অতি ভোরে নিঃশব্দে বাড়ির বকুল ফুলের নিজের হাতে গাঁথা মালার সঙ্গে অন্যান্য ফুল ও একজোড়া ধুতি চাদর তাঁর পায়ের কাছে রেখে প্রণাম করে তাকে জাগিয়ে দিলাম, এরপর সেদিন বাড়িতে সবাই মিলে জন্মদিন পালন হয়েছিল।’ পরে শান্তিনিকেতনে ১৯১০ সাল থেকে নিয়মিত কবির জন্মদিন পালিত হয়ে এসেছে। ১৯৩১ সালে কবির ৭০ বছর বয়সে তো রীতিমতো আলোড়ন তুলে জন্মদিনের অনুষ্ঠান হয়েছিল। অনুষ্ঠান কমিটির সভাপতি ছিলেন জগদীশচন্দ্র বসু, মূল উদ্যোক্তা অমল হোম। এই উপলক্ষে প্রকাশিত ‘The book of Tagore Golden’-এ নিবন্ধ লিখেছিলেন দেশবিদেশের গুণী মানুষেরা।

প্রতি বছর জন্মদিন উপলক্ষে তিনি কিছু লিখতেন। সব কবিতাতেই সেই অনন্ত জিজ্ঞাসা, ‘কে আমি?’ চিরন্তন এই প্রশ্ন থেকে ‘এই আমি প্রথমজাত অমৃত’ উত্তরে ফেরার চেষ্টা। সেসব কবিতাই আমাদের দলিল দস্তাবেজ। বাংলা ১৩৪৪ সালে আলমোড়াতে বসে ‘জন্মদিন’ কবিতায় লিখছেন, ‘দৃষ্টিজালে জড়ায় ওকে হাজারখানা চোখ,/ ধ্বনির ঝড়ে বিপন্ন ঐ লোক।/ জন্মদিনের মুখর তিথি যারা ভুলেই থাকে,/ দোহাই ওগো, তাদের দলে লও এ মানুষটাকে।’

রবীন্দ্রভূমির এক ভাগ কাব্য আর তিন ভাগ গদ্য। চিন্তা ব্যাখ্যা বাস্তববোধ তার প্রতিভার বুনিয়াদ; সেই মাটি থেকে উঠে আকাশ ছুঁয়েছে তার কল্পনা, ভাবাদর্শ, বিশ্বচেতনা। জীবন ও জগদ্বেদনার আলোয় কবির চিত্ত উদ্ভাসিত হয়ে সত্যের সুন্দর ভাষ্য রচনা করেছেন সংগীতে। কত অসাধারণ সব গান রচনা করেছেন তিনি! এক আশ্চর্য ক্ষমতা রবীন্দ্রসংগীতের। দেখা গেল সাধারণ মানুষ, যার জীবন হতদরিদ্রের নিঃস্বতায় জর্জরিত নয়, একটুখানি মানবিক সুবাতাস গ্রহণের সামান্য অবকাশটুকু আছে, সে যেন রবীন্দ্রনাথের গানে ঠিকই তার মনের পুষ্টি পেয়ে যায়।

বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় বলেন, ‘বাংলার পথে, ঘাটে, হাটে, মাঠে, এমনকি সুদূর নিভৃত পল্লির ঘরে প্রাঙ্গণে তাহার গানের সুর বাজিয়া উঠিতেছে।’ কারণ তিনি জানেন, ‘রবীন্দ্রনাথ খাঁটি বাঙালি কবি। রবীন্দ্রনাথের যে সত্যকার কবি-মূর্তি, তাহা সেই বাংলার বৈষ্ণব কবিরই প্রতিচ্ছবি। ’

বাঙালির পরম আরাধ্য এই মহাত্মার জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী পৃথক বাণী দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন বলেছেন, ‘মনুষ্যত্বের বিকাশ, মানবমুক্তি ও মানবপ্রেম ছিল রবীন্দ্রনাথের জীবনবোধের প্রধান পাথেয়। সাহিত্যের মাধ্যমে তিনি গেয়েছেন মানবতার জয়গান।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘রবীন্দ্রদর্শনের প্রধান বিষয় হচ্ছে অসাম্প্রদায়িক চেতনা, বিশ্বমানবতাবোধ ও মানুষে মানুষে মিলন। তাকে (রবীন্দ্রনাথ) জীবনমুখী শিক্ষাদর্শনের পথপ্রদর্শকও বলা যায়। তিনি শান্তি ও মানবতার কবি। বিশ্বমানবতার সংকটে তিনি সব সময় গভীর উদ্বেগ বোধ করতেন।’

কর্মসূচি :কবিগুরুর জন্মজয়ন্তী উপলক্ষ্যে ছায়ানট দুই দিনব্যাপী রবীন্দ্র-উত্সবের আয়োজন করেছে। অনুষ্ঠান আরম্ভ হবে আজ সন্ধ্যা ৭টায়। দুই দিনব্যাপী এই উৎসবে পরিবেশিত হবে একক ও সম্মেলক গান, নৃত্য, পাঠ-আবৃত্তি। অনুষ্ঠানে ছায়ানটের শিল্পী ছাড়াও আমন্ত্রিত শিল্পী ও দল অংশ নেবেন। উৎসব সবার জন্য উন্মুক্ত। এছাড়া বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর তাদের মিলনায়তনে বিকাল ৪টায় আয়োজন করেছে ‘আত্মশক্তির উদ্বোধনেই নিহিত মানবমুক্তি’ শীর্ষক সেমিনার ও আলোচনা সভা। বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করেছে শিল্পকলা একাডেমি, বেলা ১১টায় তিন দিনের এ অনুষ্ঠান উদ্বোধন করবেন স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। এছাড়া থাকছে চ্যানেল আইয়ের ‘পর্দা জুড়ে ২৪ ঘণ্টা রবীন্দ্রমেলা’।

img

মায়ের ভালোবাসা!

প্রকাশিত :  ০৯:২০, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪
সর্বশেষ আপডেট: ০৯:২৪, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪

রেজুয়ান আহম্মেদ

মেঘলা আকাশ, গুমোট বাতাস, সিলেটের জৈন্তাপুর ফেরিঘাট এলাকার মেঠোপথে এক অদৃশ্য দুঃস্বপ্নের ছায়া। দূরে এক পাহাড়ি নদীর স্রোত যেন ক্রমেই ভয়ংকর হয়ে উঠছে। বন্যার খবর ছড়িয়ে পড়েছে, আর লোকজন দলবেঁধে নিরাপদ স্থানে ছুটছে। তবে গ্রামের শেষপ্রান্তে একটি ছোট্ট কুঁড়েঘরে তখনও এক মা তার ছোট্ট সন্তানকে বুকের মধ্যে চেপে ধরে বসে আছে। সুলতানা, এই মায়ের নাম, আর তার ছোট্ট ছেলের নাম নাবিল।

সুলতানার জীবন ছিল সংগ্রামের এক নিঃশেষ পরিসংখ্যান। তিন বছর আগে সে তার প্রিয়জন, তার স্বামীকে হারিয়েছে। একাকী, অদম্য শক্তি আর সাহস নিয়ে, গ্রামীণ জীবনে সংসারের হাল ধরেছিল। তার দিন গিয়েছিল অন্যের বাড়িতে হাঁড়ি ধুয়ে, কাজ করে, আর রাতে বাড়ি ফিরে তার একমাত্র ছেলেকে স্নেহের মাঝে মানুষ করার চেষ্টা। নাবিল ছিল তার জীবনের একমাত্র আশ্রয়, জীবনের একমাত্র প্রেরণা। মায়ের মুখে সবসময় শুনত, “তোর জন্যই আমি বাঁচি, রে। তুই-ই আমার স্বপ্ন।”

কিন্তু সে দিনটা ছিল অন্যরকম। বন্যার স্রোত যখন বাড়তে লাগল, প্রতিবেশীরা এসে বলল,

“সুলতানা, তুই এখনো বসে আছিস? পানি কিন্তু সব ডুবিয়ে দিচ্ছে। চল, আমাদের সঙ্গে চল।”

সুলতানা তার চোখে একবার তাকাল তার ছেলেকে। কোলের নাবিল তখন গভীর ঘুমে। তার ছোট্ট নিঃশ্বাসে যেন পৃথিবীর সমস্ত শান্তি ছিল। সুলতানা মৃদু হেসে বলল,

“তোমরা যাও। আমার ছেলে ঘুমাচ্ছে। ওকে নিয়ে কীভাবে বেরোব? ঘুম থেকে জাগলেই যাব।”

কিন্তু এই কথাগুলো ছিল শুধু সন্তানকে সুরক্ষিত রাখার অজুহাত। তার বুকের ভেতরে চলছিল এক গভীর দ্বন্দ্ব। “আমি যদি বের হই, নাবিলকে বাঁচাতে পারব তো?”

ঘরের ভেতর পানি ঢুকতে শুরু করল। সময় ছিল না, তাড়াহুড়া করে সুলতানা ঘরের কোণায় রাখা একটি পুরনো কাঠের বাক্স টেনে আনল। ভাবল, যদি এই বাক্সে ছেলেকে রাখে, তবে হয়তো স্রোতের হাত থেকে রক্ষা পাবে। দ্রুত সে তার গায়ের চাদর দিয়ে বাক্সটি মুড়িয়ে দিল, যেন পানি ভেতরে না ঢোকে।

ছেলেকে বাক্সে রেখে সুলতানা নিজে বসে রইল বাক্সের পাশে। তার হাত শিশুটির গায়ে রেখে বারবার অনুভব করছিল, “আমার জীবন যাক, কিন্তু ও যেন বাঁচে।” ঘরের ভেতর পানি আরও বেশি বাড়তে লাগল, সুলতানা বাক্সটি শক্ত করে ধরে রেখে পানির স্রোতের সঙ্গে লড়াই করল। তার কণ্ঠে একটিই প্রার্থনা ছিল,

“হে আল্লাহ, আমার সন্তানকে বাঁচাও। ওর জীবন যেন আমার চেয়েও বেশি দামি হয়।”

বন্যার স্রোতে ভেসে গেল কুঁড়েঘর। সুলতানা এক হাত দিয়ে বাক্সটি ধরে রেখেছিল, আর অন্য হাত দিয়ে একটি গাছের ডাল আঁকড়ে রইল। অনেকক্ষণ ধরে লড়াই করার পর সুলতানা বুঝতে পারল, তার শরীর আর স্রোতের সঙ্গে লড়তে পারছে না। কিন্তু মায়ের মন যেন দেহের শারীরিক শক্তি ছাড়িয়ে এক অনুপ্রেরণা হয়ে কাজ করছিল। শেষবারের মতো ছেলেকে চুমু খেয়ে, বাক্সটি ঠেলে দিল পানির বিপরীতে। তার শরীর আর শক্তি ছিল না, কিন্তু বুকের ভেতর তার একক সাধনা ছিল—“আমার সন্তান যেন বাঁচে।”

সুলতানা নিজের হাত ছেড়ে দিয়ে স্রোতের সঙ্গে মিলিয়ে গেল। পরদিন ভোরে গ্রামবাসী একটি ভাসমান বাক্স দেখতে পেল। বাক্সটি খোলার পর তারা দেখল, নাবিল জীবিত আছে, শুকনো চাদরে মুড়ে রাখা। কিন্তু তার মা আর নেই।

গ্রামের মানুষ কাঁদল। সবাই বলল, “মায়ের ভালোবাসা এমনই। নিজের জীবন দিয়ে সন্তানকে বাঁচায়।”

মায়ের ভালোবাসা পৃথিবীর সবচেয়ে নিঃস্বার্থ অনুভূতি। এটি সময়, স্থান বা পরিস্থিতি মেনে চলে না। মা তার সন্তানের জন্য যা করতে পারেন, তা আর কেউ কখনো করতে পারবে না। মায়ের ভালোবাসা শুধুমাত্র প্রেম নয়, এটি এক আত্মত্যাগ, এক বিশাল শক্তি, যা পৃথিবীর সমস্ত শক্তির সামনে দাঁড়িয়ে সন্তানকে রক্ষা করে। মা শুধুই মা নয়, সন্তানের পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী রক্ষাকবচ।

এটাই মা-বাবার প্রতি সন্তানের প্রতি দায়িত্ব, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা যেন কখনো শেষ না হয়। মা তার সন্তানকে শুধু জন্মই দেয় না, তাকে ভালোবাসা দিয়ে গড়ে তোলে, আর সেই ভালোবাসা পৃথিবীর সবচেয়ে অমূল্য রত্ন।

এই ভালোবাসার কোনও সীমা নেই। এটি নিজস্বতায়, জীবনের প্রতি অটুট বিশ্বাসে ভরা। সত্যিকার অর্থে, একজন মা তার সন্তানের জন্য যা করতে পারেন, তা আর কেউ কখনো করতে পারবে না, কারণ মা যেন এক পৃথিবী, যা তার সন্তানকে লালন-পালন করার জন্য এক অনবদ্য শক্তি সঞ্চয় করে রাখে।