img

আইন ভেঙেই মুক্তবিশ্ব সুরক্ষা করবে আমেরিকা !

প্রকাশিত :  ১৩:১৩, ০২ জুন ২০২৪

আইন ভেঙেই মুক্তবিশ্ব সুরক্ষা করবে আমেরিকা !

গিডিয়ন রাঞ্চম্যান

মারাত্মক বিচ্যুতিতে ভুগছে পশ্চিমা বিশ্বের পররাষ্ট্রনীতির সারবত্তা হিসেবে পরিচিত ‘আইনভিত্তিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা’ (রুলবেজড ইন্টারন্যাশনাল অর্ডার) অনেক দিন ধরেই। এই বাগ্‌ধারাটা সাধারণ মানুষের কাছে কোনো অর্থই বহন করে না। ফলে এটি একটি হতোদ্যম ধারণায় রূপ নিয়েছে। জনগণ স্বাধীনতা বা মাতৃভূমি রক্ষার জন্য যুদ্ধে যেতে পারে। কিন্তু কেউই এই ‘আইনভিত্তিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা’ রক্ষার জন্য লড়তে ও মরতে প্রস্তুত নন।

এরপরও পশ্চিমের সব প্রবীণ নীতিপ্রণেতা এ প্রত্যয়ের প্রেমে ডুবে রয়েছেন বলে প্রতীয়মান হয়। চীন সফরকালে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন আইনভিত্তিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার ওপর জোর দিয়েছেন। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রনীতির কেন্দ্রে এই প্রত্যয়কে রেখেছেন। তাঁর সম্ভাব্য উত্তরসূরি স্যার কেয়ার স্টারমার, যিনি একজন আইনজীবী, একইভাবে এ ধারণার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

মি. ব্লিঙ্কেন ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরোধিতা করে যুক্তি দিয়েছিলেন যে যুক্তরাষ্ট্র নগ্ন ক্ষমতা নয়, বরং আইনভিত্তিক বিশ্বের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু আইন মানে হলো সংগতিপূর্ণ পদক্ষেপ। আর আমেরিকার নিজের কর্মকাণ্ডই তো আইনভিত্তিক ব্যবস্থার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অংশকে উপেক্ষা করছে।

বিগত দুটি সপ্তাহে আমেরিকার এসব বিরোধপূর্ণ ও সংগতিহীন কাজ উন্মোচিত হয়েছে। চীনের তৈরি বৈদ্যুতিক যানবাহনের ওপর বাইডেন প্রশাসন যে শতভাগ আমদানি শুল্ক আরোপ করেছে, তা তো আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের বিধানের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ হিসেবে দেখা প্রায় অসম্ভব। আমেরিকা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) বিধিবিধান মেনে চলতে আগ্রহী, এই শুল্কারোপ সেই ধারণা বা আভাস নাকচ করে দিয়েছে।

ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আনবে, এমন পদক্ষেপের ক্ষেত্রে আমেরিকার প্রতিক্রিয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ। আন্তর্জাতিক আইন প্রয়োগে বৈশ্বিক আদালতকে সমর্থন দেওয়ার বদলে ব্লিঙ্কেন বরং যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস তথা আইনসভাকে বলেছেন যে তাঁদের প্রশাসন আইসিসির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথা বিবেচনা করছে।

অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্র তার এসব পদক্ষেপের পক্ষে যুক্তি দিতে পারে। এমন যুক্তি দেওয়াও সম্ভব যে আইসিসি তার এখতিয়ারের বাইরে গেছে বা ভুলভাবে চলমান সংঘাতে হস্তক্ষেপ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র এ–ও বলতে পারে যে চীন দশকের পর দশক ধরে আন্তর্জাতিক আইনকানুন লঙ্ঘন করে চলেছে।

রাশিয়া ও চীন বরাবরই দাবি করে আসছে যে তাদের যাবতীয় কর্মকাণ্ড আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ। এমনকি যখন মোটেও তা নয়, তখন তারা একই দাবি করে। যুক্তরাষ্ট্রকেও কখনো এ রকম করতে হবে। আন্তর্জাতিক আইনকে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে কৌশলগতভাবে ব্যবহার করা তো গণতান্ত্রিক ও কর্তৃত্ববাদী শক্তিগুলোর মধ্যে বাড়তে থাকা লড়াইয়ের অন্যতম উপাদান।

কিন্তু প্রবাদ প্রচলিত রয়েছে, রাজনীতিতে যখন আপনি কিছু ব্যাখ্যা করতে থাকবেন, তখন আপনি হারতে থাকবেন। দুনিয়ার এক বিশাল অংশজুড়ে এখন আমেরিকার এই আইনভিত্তিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা ধরে রাখার দাবি অনেকটা তাচ্ছিল্যের চোখেই দেখা হয়। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় কী? একটা উত্তর হলো ব্লিঙ্কেন ও তাঁর লোকজনের এই আইনকানুনের বিশ্বব্যবস্থা নিয়ে কম কথা বলা। আর বেশি কথা বলতে চাইলে তা হলো মুক্তবিশ্বের পক্ষে বলা। কেননা এটাই পশ্চিমা দুনিয়ার পররাষ্ট্রনীতিকে অধিকতর অর্থবহভাবে তুলে ধরে।

যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও ইউক্রেনের মতো গণতান্ত্রিক দেশগুলো আজকে কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রগুলোর, প্রধানত চীন ও রাশিয়ার ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষে রাশ টানতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। যে দুনিয়ায় এ দেশগুলো অধিক শক্তিশালী হয়ে উঠবে, সে দুনিয়া মুক্ত মানুষ ও অন্যান্য দেশের জন্য কম নিরাপদ হবে।

আইনভিত্তিক ব্যবস্থা আসলে একটি পূর্ণমাত্রার স্থিতিশীলতা দাবি করে। তাই এর পক্ষে জোরালো অবস্থান নেওয়ার চেয়ে বরং মুক্তবিশ্বের পক্ষে অবস্থান নেওয়া উত্তম। সেখানে কিছু প্রয়োজনীয় অসামঞ্জস্য ও খানিক অস্থিতিশীলতা দেখা দেয়। ঠান্ডা যুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা অগণতান্ত্রিক সরকারগুলোর সঙ্গে কিছুটা কৌশলগত মৈত্রীবন্ধন গড়ে তুলেছিল, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটানো।

আজকের বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্র আবারও প্রধান কর্তৃত্ববাদী শক্তিগুলোর সঙ্গে বৃহত্তর লড়াইয়ের স্বার্থে কিছু স্বাচ্ছন্দ্যহীন ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান নিচ্ছে। আইনকানুনের বিশ্বব্যবস্থার নামে চীনা বৈদ্যুতিক যানবাহনের ওপর যুক্তরাষ্ট্র যে শুল্কারোপ করেছে, তার কোনো মানেই হয় না। বরং এটা অধিকতর অর্থবহ হিসেবে দেখা যেতে পারে তখনই, যখন ভবিষ্যৎ দুনিয়ার শিল্প খাতে চীনের আধিপত্য ঠেকানোর একটি পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করা হবে।

দক্ষিণ চীন সাগরের ওপর চীনের ভৌগোলিক মালিকানার দাবিকে যুক্তরাষ্ট্র যথাযথভাবেই জাতিসংঘের সমুদ্রবিষয়ক সনদের বিধিবিধান লঙ্ঘন হিসেবে অভিযুক্ত করেছে। মুশকিলটা হলো যুক্তরাষ্ট্র নিজে এই সনদে অনুস্বাক্ষর করেনি। তাহলে এটা মনে করতে অসুবিধা কোথায় যে যুক্তরাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য আইনভিত্তিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকে রক্ষা করা নয়, বরং একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যপথ যেন একটি কর্তৃত্ববাদী দেশের নিয়ন্ত্রণে চলে না যায়, তা রুখে দেওয়ার চেষ্টা করা।

ইসরায়েলের বিষয়ে তাহলে কী বলা যায়? বাইডেন যা করছেন, তার অনেকটাই যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। কিন্তু গণতান্ত্রিক মিত্রদের রক্ষা করার বাসনাই তাঁর জন্য ইসরায়েলকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন দেওয়ার নেপথ্যে সক্রিয়। গাজায় নেতানিয়াহু গণহত্যা চালিয়েছেন—এ ধারণা প্রত্যাখ্যান করা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য লজ্জাজনক। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের একমাত্র গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র যখন কাঠগড়ায় দাঁড়াচ্ছে, তখন সিরিয়া ও ইরানের নেতারা তাঁদের অপরাধের বিচার এড়াতে পারছেন—এমনভাবে দেখলে যুক্তরাষ্ট্রের অস্বস্তিটা বোঝা বোধ হয় সহজ হয়।

আইনভিত্তিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা নিয়ে বাগাড়ম্বরকে সংযত করে আনা মানে আবার এই নয় যে আন্তর্জাতিক আইনকেই পরিত্যাগ করতে হবে। বরং তা করতে গেলে দুনিয়াজুড়ে নৈরাজ্য নেমে আসবে। এ ধরনের কাজ বাস্তবতাবর্জিত ও অজ্ঞতার শামিল। এমন অনেক আন্তর্জাতিক আইন আছে, যার উল্টো দিকে গিয়ে দাঁড়ানো খুবই অসুবিধাজনক। ভ্লাদিমির পুতিন, সম্ভবত শিগগিরই নেতানিয়াহু দেখতে পাবেন যে তাঁদের পৃথিবী ভ্রমণ পরিকল্পনা ভীষণভাবে সীমিত হয়ে গেছে, আর তা আইসিসির গ্রেপ্তারি পরোয়ানার কারণে।

রাশিয়া ও চীন বরাবরই দাবি করে আসছে যে তাদের যাবতীয় কর্মকাণ্ড আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ। এমনকি যখন মোটেও তা নয়, তখন তারা একই দাবি করে। যুক্তরাষ্ট্রকেও কখনো এ রকম করতে হবে। আন্তর্জাতিক আইনকে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে কৌশলগতভাবে ব্যবহার করা তো গণতান্ত্রিক ও কর্তৃত্ববাদী শক্তিগুলোর মধ্যে বাড়তে থাকা লড়াইয়ের অন্যতম উপাদান।

এর মানে আবার এই নয় যে দুই পক্ষই সমমাত্রার নৈতিক অবস্থানে রয়েছে। ঠান্ডা যুদ্ধ ও বিশ শতকের প্রথম দিককার লড়াইগুলোর মতো মুক্তবিশ্ব ও মুক্তসমাজ রক্ষার স্বার্থে নির্মম হলেও বিশ্বের গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর সে জন্য দুঃখ প্রকাশ করার দরকার নেই।


গিডিয়ন রাঞ্চম্যান ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসের আন্তর্জাতিক বিষয়ক প্রধান ভাষ্যকার।

মতামত এর আরও খবর

|| মকিস মনসুর ||

img

শিক্ষকদেরকে অসম্মান করা জাতির জন্য অত্যন্ত কলঙ্কজনক!

প্রকাশিত :  ১৮:৫৪, ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪

|| মকিস মনসুর ||

শিক্ষকের ঋণ কখনো শোধ করা যায় না। আজ আমরা জীবনের যেখানেই প্রতিষ্ঠিত থাকি না কেন, আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক—শিক্ষিকাদের অবদান অনস্বীকার্য। শিক্ষকরা মানুষ গড়ার কারিগর। শিক্ষকমাত্রই বিশেষ মর্যাদা ও সম্মানের ব্যক্তি। শিক্ষাকে যাবতীয় উন্নয়নের চালিকাশক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হলে, শিক্ষকের ভূমিকার গুরুত্ব অপরিসীম।বলতে গেলে এর বিকল্প নেই। শিক্ষার হাতেখড়ি যদিও শুরু হয় পরিবার থেকে, কিন্তু তার পূর্ণতা পায় একজন শিক্ষকের হাতে। 

মহান আল্লাহু রাব্বুল আলামিন শিক্ষকদের আলাদা মর্যাদা দিয়েছেন। তাদের সম্মানে ভূষিত করেছেন। ফলে সমাজে শিক্ষকমাত্রই বিশেষ মর্যাদা ও সম্মানের ব্যক্তি। 

পবিত্র কোরআনে নাজিলকৃত প্রথম আয়াতে জ্ঞানার্জন ও শিক্ষাসংক্রান্ত কথা বলা হয়েছে।

মহান আল্লা তা’আলা বলেন, ‘পড়! তোমার প্রতিপালকের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। যিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন একবিন্দু জমাট রক্ত থেকে। পড়! আর তোমার প্রতিপালক পরম সম্মানিত। যিনি কলমের দ্বারা শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন, যা সে জানত না।’ (সুরা আলাক, আয়াত ১—৫)

আমাদের প্রিয় বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা  (সা:) (আ:) এরশাদ করেন, ‘তোমরা জ্ঞান অর্জন করো এবং জ্ঞান অর্জনের জন্য আদব—শিষ্টাচার শেখো। এবং যার কাছ থেকে তোমরা জ্ঞান অর্জন করো, তাকে সম্মান করো। (আল—মুজামুল আওসাত, হাদিস ৬১৮৪)

মনুষ্যত্বের বিকাশের জন্য আমাদের কোনো না কোনোভাবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় যেতে হয়। বিভিন্ন শাস্ত্র অধ্যয়নে জানা যায়, মানুষের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায় ছিল গুরুগৃহ, অর্থাৎ জ্ঞান অর্জনের জন্য গৃহ ত্যাগ করে শিক্ষাগুরু বাড়িতে যেতে হতো। পবিত্র হাদিস হিসেবে প্রচলিত আছে, জ্ঞান অর্জনের জন্য সূদুর চীন দেশে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে। জ্ঞান অর্জন বা শিক্ষার মূলমন্ত্রই হলো সঠিক জীবন দর্শন দান। এই জীবন দর্শন দান করেন শিক্ষক। একটি শিশু যখন শিক্ষকের কাছে যায় তখন মন থাকে খালি ক্যানভাস। শিক্ষক তাঁর জ্ঞানের তুলি দিয়ে সেখানে জীবনের ছবি আঁকেন। ধীরে ধীরে মানব শিশুকে মানবে পরিণত করেন। জগতের ভালো—মন্দ, ন্যায়—অন্যায় বিচার—বিশ্লেষণের বোধ সঞ্চারিত করেন। স্বামী বিবেকানন্দ যথার্থই বলেছেন, ‘মানুষের অন্তর্নিহিত পরিপূর্ণ বিকাশই হলো শিক্ষা, আর তাঁর পথপ্রদর্শক হলেন শিক্ষক।’ তাই শিক্ষা যদি হয় জাতির মেরুদণ্ড, তবে শিক্ষক হলেন সেই মেরুদণ্ড গড়ার প্রধান কারিগর। একজন শিক্ষকের ভূমিকা ব্যতিত কোনো জাতিই শিক্ষিত জাতিতে পরিণত হতে পারে না।

একজন শিক্ষার্থী প্রকৃত মানুষ রূপে গড়ে ওঠার পেছনে বাবা—মা’ আমাদের প্রথম শিক্ষক হলে ও আসল শিক্ষক হলেন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষক যারা আমাদের প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলেন।

শিক্ষকরা জাতিকে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করে নিজেরা মোমের মতো নিঃশেষিত হন। একজন শিক্ষক নিজে শিক্ষা অর্জন করার পর পরই অপরকে সেই শিক্ষায় শিক্ষিত ও চরিত্র গঠনে ভূমিকা পালন করে থাকেন। 

ইদানিং বাংলাদেশের বতমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে লিখতে বাধ্য হচ্ছি, কোনো শিক্ষক যদি ভুল করেন প্রমাণ সাপেক্ষে তদন্ত করে প্রসাশনিক অ্যাকশন নেওয়ার বিধান রয়েছে। দোষী সাব্যস্ত হলে, আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে বিচার করা হবে। এটাই বাস্তবতা। 

একজন শিক্ষকের দোষ/গুণ/ভালো/মন্দ অনেক বিষয় থাকতেই পারে। সে বিচারের ভার শিক্ষার্থীরা নেবে কেন? 

সারা দেশব্যাপি শিক্ষকদের পদত্যাগে বাধ্য করানোর এক হিড়িক দেখা যাচ্ছে। ফেইসবুক ও টিভি চ্যানেল এবং বিভিন্ন পত্রিকার নিউজে বেশ কিছু ছবি এসেছে, একজন স্যারকে জো\'রপূর্বক পদ\'ত্যাগ করানোর সময় স্ট্রো\'ক করেছেন। সত্য কি না জানিনা গতকাল নাকি এই সম্মানিত শিক্ষক মারা গেছেন। আরেকজন ম্যাডামকে জুতা গলায় দেওয়া হয়েছে। অন্যান্যদেরকে মার পিট করা হয়েছে, যাতে শিক্ষার্থীরা শারিরীর আক্রমন করেছে শিক্ষকদের এ এক হৃদয়বিদারক কান্নার চিত্র। একজন শিক্ষক! 

সারা জীবন শিক্ষকতা পেশায় কাটিয়ে ছাত্রদের বেত্রাঘাতে তার পিটেই আকা হলো ক্ষতবিক্ষত বাংলাদের মানচিত্র ২০২৪? ক্ষমা করো হে জাতির শিক্ষাগুরু আমরা তোমার নিরাপত্তা দিতে পারিনি আমরা লজ্জিত!!!

শিক্ষকদের বিচার করার দায়িত্ব কখনো শিক্ষার্থীদের হতে পারে না। প্রশাসন আছে, আইন আছে, আছে পরিচালনা কমিটি। এমন বেয়াদবি শিক্ষার্থীরা করবে কেন? কোন ভাবেই ছাত্ররা বা অন্যরা শিক্ষককে অপদস্ত হেনাস্থা করে জোর পুর্বক পদত্যাগ করানো, এটা অপ —সংস্কৃতি, অমানুষিক, অমানবিক, 

শিক্ষকদেরকে অসম্মান করা জাতির জন্য অত্যন্ত কলঙ্কজনক! 

ফেইসবুকে করা একজন ব্যক্তির কমেন্ট পুরাপুরি তুলে ধরছি, কোন শিক্ষকের অপরাধের পক্ষে আমি নই। শিক্ষক অপরাধ করেছেন, দালালি করেছেন, নানান রকম অনিয়ম করেছেন, অতএব তাঁকে শাস্তি পেতে হবে, আমি আপনার সাথে একমত। এমন অপরাধী কোন শিক্ষক স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করতে না চাইলে তাঁকে পদত্যাগে বাধ্য করাতে যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে প্রক্রিয়া করতে হবে,তাই বলে ছাত্ররা ইচ্ছামত বেয়াদবি করবে? মিডিয়ার সামনে এসে ‘আমি অমুক স্যারের মাথায় থাপ্পড় মেরে উল্লাস করছে আবার আরেকজন এর গায়ে হাত তুলতে পেরেছি!’ বলে বিজয়ের হাসি হাসবে? সেই চিত্র বা সাল কি ভূলে যাবে জনগন। শিক্ষকদের পদত্যাগে বাধ্য করার এটাই কি একমাত্র পদ্ধতি?

সদ্য পদত্যাগ কারী একজন শিক্ষকের মনে আকুতি। 

কী দেখার কথা, কী দেখছি?

সদ্য পদত্যাগ করা একজন প্রতিষ্ঠান প্রধানের লেখনিঃ

আমি যেহেতু প্রায় ২২ বছর যাবৎ প্রতিষ্ঠান প্রধান হিসেবে ছিলাম তাই ব্যর্থতা আমারই। 

প্রিয় এলাকাবাসী ক্ষমা করবেন চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিনি। আমাদের যেমন সীমাবদ্ধতার অভাব নেই, তেমন চেষ্টারও ত্রুটি ছিল না। কিন্তু পারিনি।

আসলে একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি হয় ছাত্রদের জন্যে, ভাটি এলাকার এই কলেজটিও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দরিদ্র এলাকা ছাত্র ছাত্রীদের উচ্চ শিক্ষার সুযোগ হাতের নাগালে পৌঁছে দেয়ার উদ্দেশ্য।

সুতরাং তাদের চাহিদা মোতাবেক সাজাতে হয়।

আমি আমার ছাত্রদেরকে নিজের সন্তানের মত ভালোবেসেছি।

তাদের উত্তম ভবিষ্যৎ এর জন্য চেষ্টা করেছি, আদর দিয়েছি, সোহাগ করেছি, ধমক দিয়েছি, বুকে টেনে নিয়েছি, কিন্তু চাহিদা পুরন করতে পারিনি।

ইদানিং এ আমার কিছু কথার দ্বারা আমি আমার সন্তানসম ছাত্রদেরকে বেশী কষ্ট দিয়ে ফেলেছি।

তাই তারা আমাকে আর চায়না। ক্ষমার কোনো সুযোগও নেই, বিচার ছাড়াই ফাঁসির ব্যবস্থা হয়ে গেছে।

আমি মেনে নিয়েছি।

সারা পৃথিবীতেই তো সন্তানের জীবন সাজাতে গিয়ে অনেক বাবা—মা রাই নিঃস্ব হচ্ছে, পথে বসছে। আমি ব্যতিক্রম হব কেন?

তারাতো কোমলমতি বুঝতে পারেনি এক বাবাকে শাস্তি দিতে গিয়ে তারা তার আরেক ভাই /বোনের রিজিক বন্ধের হাতিয়ার হয়েছে।

আমার কোমলমতি শিক্ষার্থীদের আর কি দোষ? সারা বাংলাদেশে এত এত পদত্যাগ, ওরা যদি একটা দু\'টা পদত্যাগ না করাতে পারে।

তাহলে এটা তাদের ব্যর্থতা মনে হবে!

পৃথিবীর সব বাবার মত আমিও সব সময় আমার সন্তানের বিজয় দেখতে চাই।

আমি একজন ব্যর্থ মানুষ, তবুও স্বপ্ন দেখতাম এই ক্যাম্পাস থেকে সাদা কাফনে বা লাল গালিচায়, ফুলেল শুভেচ্ছায় বিদায় হবো, আমার স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেল। এক নিমিষেই সব শেষ।

এই শেষ বয়স এসে পৃথিবীর কারোর প্রতি আমার কোন অভিযোগ নেই, কষ্ট পেয়েছি, প্রাণ খুলে কেঁদেছি, হালকা হয়েছি, মেনে নিতে চেষ্টা করছি।

সবকিছুর ফয়সালাতো উপর থেকেই হয়।

আল্লাহর কাছে বলেছি \"হে আল্লাহ তোমার দুনিয়া তো অনেক বড়, তুমি নিশ্চয়ই কোন না কোন জায়গায় আমার জন্য, আমার সন্তানের জন্য উত্তম রিজিক এবং সম্মানের ব্যবস্থা করে রেখেছো।

“আমি আশা করতে চাই বা বলতে চাই.. বাংলাদেশের তথা পৃথিবীর কোন ছাত্র যেন তার নিকৃষ্ট শিক্ষকটিরও রিজিক বন্ধের হাতিয়ার না হয়।

কারণ, এই পদ্ধতি যে কত বেদনার, কত কষ্টের তা আমি ভুক্তভুগি ভালোভাবে টের পেয়েছি।

আমি যেন এই পদ্ধতিতে বিদায় হওয়ার পৃথিবীর শেষ শিক্ষকটি হতে পারি।

শিক্ষক বিদায় করার অনেক পদ্ধতি আছে। সেগুলো প্রয়োগ করা হোক, ছাত্র দিয়ে কেন?

ভালো থেকো ‘চাতলপাড় ডিগ্রি কলেজ’ খুব ভালো থেকো”। আমীন।

চাতলপাড় ডিগ্রি কলেজের সদ্য পদত্যাগ কারী একজন শিক্ষকের মনের আকুতি এই লেখা পড়ে খুউব লজ্জা হচ্ছিলো, এ কি হচ্ছে, এটা কোন ধরনের অমানুষিক ও অমানবিক কার্যক্রম। 

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের ঠাকুর বলেছিলেন মানুষ তো সবার ঘরে জন্মায়, কিন্তু মানুষ্যত্ব সবার ঘরে জন্মায় না।”

স্যার এ পি যে আব্দুল কালাম বলেছিলেন, মেধাবী হয়ে গর্ব করার কিছু নেই, শয়তান ও কিন্তু মেধাবী হয়। মনুষ্যত্ব ও সততা না থাকলে সে মেধা ঘৃণিত, কোনো সুস্থ মানুষ এইসব অপকর্ম সাপোর্ট করতে পারেনা। এসব বন্ধ করানো হচ্ছে না কেনো, রাষ্ট্রের দায়িত্বশীলরা কি চোখ থাকিতে অন্ধ হয়ে আছেন। আমাদের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুস সাহেব  ও একজন শিক্ষক ছিলেন। প্লিজ একটু চোখ খুলুন, বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে যেভাবে শিক্ষকদেরকে লাঞ্ছিত করা হচ্ছে, সম্মানিত শিক্ষকদের এই অপমান কেনো অবস্থাতেই মেনে নেওয়া যায় না, এটা খুবই দুঃখজনক।

আগে শিক্ষক দেখে শিক্ষার্থীরা ভয় পেতো, এখন শিক্ষার্থীদের দেখে শিক্ষককেরা ভয় পাচ্ছে । জাতির জন্য এর চেয়ে লজ্জা আর কি হতে পারে; আমাদের প্রাণের বাংলাদেশে শিক্ষকদের প্রতি কতিপয় নামধারী মেধাবীদের সন্ত্রাসী আচরনে প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। মানুষের মধ্যে মানুষ্যত্ব এবং পশুত্ব দুটোই থাকে। কিন্তু অমানুষের মধ্যে আদৌ মানুষ্যত্ব থাকেনা, যা থাকে তার পশুত্ব।

প্রকৃত শিক্ষা যে অর্জন করেছে সে কখনও শিক্ষকের সাথে বেয়াদবি করতে পারে না, এসব ঘটনার জন্য আমি বা আমরা সব ছাত্রদের দায়ি করতে চাই না।

যে  সব নামধারী ছাত্র আজ তার শিক্ষকের গায়ে হাত তুলছে আগামীতে সে তার বাবার গায়ে হাত তুলতেও দ্বিধা বোধ করবে না।

এসব বন্ধ না করা হলে শিক্ষকের অভিশাপ নিয়ে এই প্রজন্ম কোনোদিন কিছু করতে পারবে না।

শিক্ষক এর বিচার করার দায়িত্ব কোনো শিক্ষার্থীর হতে পারে না। যিনি একটি অক্ষর শিখিয়েছেন তিনিও শিক্ষক সম্মানের পাত্র।

দোষী হলে উর্ধতন কর্তৃপক্ষ অব্যাহতি/চাকুরিচ্যুতি বা যেকোন শাস্তিমুলক ব্যবস্থা নিবে; কিন্তু অভদ্র বেয়াদবেরা হেনস্থা করে জোরপুর্বক পদত্যাগ করাবে? তা নিতান্ত অমানবিক, সন্ত্রাসতুল্য অপরাধ। 

শিক্ষকের মর্যাদা সমুন্নত রাখতে না—পারলে, নীতি নৈতিকতা ও জাতির বিপর্যয় অনিবার্য।

সকল বিবেকবান মানুষের মতো  আজকের এই লিখনীর মাধ্যমে আমি ও এর তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানাচ্ছি, এবং আশাকরছি এই সব অমানুষিক, অমানবিক কাজ যাতে বন্ধ হয় এর যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা সহ দোষীদের বিচারের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা হোক। আসুন, “শিক্ষক হচ্ছেন পিতার সমান, সারাজীবন জানাবো সম্মান” এই হোক আমাদের সবার অঙ্গীকার। 

জয় হোক মানবতার, মানুষ্যত্ব জাগ্রত হোক, প্রানের বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।

লেখকঃ মোহাম্মদ মকিস মনসুর, চেয়ারম্যান, ইউকে বিডি টিভি; প্রধান সমন্নয়ক; প্রতিভা মেধা প্রকল্প; সম্পাদকমন্ডলীর সভাপতি, ডেইলি সিলেট এন্ড দৈনিক মৌলভীবাজার মৌমাছি কন্ঠঃ সম্পাদক, ওয়েলস বাংলা নিউজ


মতামত এর আরও খবর