img

বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘ: মোহাম্মদ হান্নান

প্রকাশিত :  ২০:৩৬, ১৭ জুন ২০২৪
সর্বশেষ আপডেট: ০৭:১৫, ১৮ জুন ২০২৪

বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘ: মোহাম্মদ হান্নান

মোহাম্মদ হান্নান

বিশ্বব্যাপী শান্তি ও মানবতা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী আমেরিকার লসএন্জেলেসে পঞ্চাশটি দেশের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত আলোচনার ভিত্তিতে জাতিসংঘ গঠিত হয় ১৯৪৫ সালে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রাণহানি ও সম্পদের ক্ষয় ক্ষতির প্রতি আলোকপাত করেই এই সংগঠন সৃষ্টি করা হয়, যেনো আর কখনও বিশ্বযুদ্ধ না হয়। তাই বলে একেবারে যুদ্ধ হবে না এমনটা নিশ্চিত করা যাবে না। যুদ্ধ হবে, কেননা মানুষের মত পার্থক্যের অবসান কোনদিন হবে না। স্বার্থের কাছে বিবেকের পরাজয় হয় বলেই বিবাদ সৃষ্টি এবং পরবর্তীতে তাহা যুদ্ধে পরিণত হয়। এমন ভাবনা থেকেই জাতিসংঘ নামে এই আন্তর্জাতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এর প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে, কোথাও যুদ্ধ সংগঠিত হলে তাহা বন্ধ করে মীমাংসা করে দেয়ার জন্য সুপারিশ পেশ করা। পরবর্তীতে ১৯৪৬ সালে লণ্ডনে অনুষ্ঠিত আলোচনার প্রেক্ষিতে নিরাপত্তা পরিষদ নামে পনেরো সদস্য বিশিষ্ট একটি অঙ্গ সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা হয়। অতি দ্রুততম সময়ে সংগঠিত যুদ্ধ বন্ধ করে মীমাংসার জন্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করাই এই সংগঠনের মূল লক্ষ্য। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, রাশিয়া ও চীনকে স্থায়ী সদস্য নির্বাচিত করা হয়েছে। বাকি দশ সদস্যের পাঁচ সদস্য দুই বছর মেয়াদে নির্বাচন করে দেবে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ। জাতিসংঘের চার্টারে বলা হয়েছে, নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য সংখ্যা পনেরো এবং নয় সদস্যের সমর্থনে সিংদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারবে। স্থায়ী সদস্যদেরকে ভিটো প্রদানের ক্ষমতার কথা চার্টারের কোথাও বলা হয় নাই। জাতিসংঘের সকল সদস্য দেশগুলোকে নিয়ে গঠিত সাধারণ পরিষদ। বর্তমান সময়ে সাধারণ পরিষদের সদস্য সংখ্যা ১৯৩এ পৌঁছে গেছে। নিরাপত্তা পরিষদের কাউকে ভিটো ক্ষমতা প্রদান করার জন্য, সাধারণ পরিষদে কোন প্রস্তাব গ্রহণ করা হয় নাই। সাধারণ পরিষদের প্রণীত নির্দেশনা অনুযায়ী, নিরাপত্তা পরিষদ সকল কর্ম সম্পাদন করবে। তাই ইহাকে জাতিসংঘের অভ্যন্তরে অন্য পাঁচটির মত আরো একটি সংগঠন হিসাবেই গণ্য করা হয়। গণহত্যার মত মানবিক বিপর্যয় ও সংগঠিত যুদ্ধ থামানোই তার কাজ।

কিছুদিন আগে ইসরাইলী আগ্রাসনে গাজায় চলমান নিয়মতান্ত্রিক গণহত্যা রদ করতে নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক বসেছিল। নয়ের অধিক সংখ্যক সদস্য যুদ্ধবিরতির পক্ষে ভোট দিলেও যুক্তরাষ্ট্র ভিটো পেশ করেছে। ফলে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব গৃহীত হয় নি। এভাবে নিরাপত্তা পরিষদের তিনটি অধিবেশনে  যুক্তরাষ্ট্র ভিটো  প্রদান করেছে। অর্থ্যাৎ যুক্তরাষ্ট্র, মানবতা ও যুদ্ধ বন্ধের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে জাতিসংঘের চার্টারে বর্ণিত নিয়ম লঙ্গন করেছে। কারণ যুদ্ধ প্রলম্বিত করার জন্যে এই পরিষদ গঠিত হয় নাই বরং যুদ্ধ থামিয়ে মীমাংসার উপায় উদ্ভাবন করাই এই সংগঠনের দায়িত্ব। চতুর্থ অধিবেশনে যুক্তরাষ্ট্র ভিটো প্রদান না করে ভোটদানে বিরত থেকেছে। তাই যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব পাশ হয়েছে। এবার ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু বলে দিয়েছে, সে কারো কথা শুনবে না। সে যুদ্ধ চালিয়ে যাবে যতক্ষণ পর্যন্ত হামাস বাহিনী পুরোপুরি ধ্বংস না হয়েছে। নিরাপত্তা পরিষদে গৃহীত প্রস্তাব কেউ অমান্য করলে তৎক্ষণাত তাহা বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয়। প্রয়োজনে শক্তির প্রয়োগ করে যুলুম, নির্যাতন ও রক্তপাত ঠেকাতে হবে। এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব পরিষদের আওতাধীন রয়েছে। তবে এমন দায়িত্ব পালনের জন্য সাধারণ পরিষদের সহায়তার প্রয়োজন হতে পারে। কারণ সকল কাজের ব্যয় বরাদ্ধ ও সামরিক শক্তির যোগান সেখান থেকেই আসবে। অতএব নিরাপত্তা পরিষদ জাতিসংঘের আজ্ঞাধীন থেকেই বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করবে, ইহাই স্বাভাবিক। উল্লিখিত দায় পালন করে, পরিষদে গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে না পারলে ইহা একটি ব্যর্থ সংগঠনে পরিণত হবে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, নিরাপত্তা পরিষদ, অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে না পেরে বিমূঢ় হয়ে আছে। জাতিসংঘের চার্টারে যুদ্ধ থামানোর কথা বলা হয়েছে, প্রলম্বিত করার কথা বলা হয় নি। সারা বিশ্ব বলে চলেছে, ইসরাইল আগ্রাসনের মাধ্যমে গাজায় নির্বিচার গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে Israeli Defence Forces (IDF). নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স ইসরাইলকে আর্থিক অনুদান ও বন্ধুত্বের সমর্থনসহ অস্ত্রের যোগান দিয়ে চলেছে। মুরব্বী সংগঠনের দায়িত্ব যুদ্ধ থামানো, যুদ্ধ চালিয়ে যাবার জন্য অস্ত্র ও অর্থের যোগান দেয়ার কথা নয়। নিরাপত্তা পরিষদের কোন সদস্য রাষ্ট্র সরাসরি অথবা পরোক্ষ ভাবে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে থাকলে অথবা যুদ্ধে সম্পৃক্ত কোন দেশকে সমর্থন দিয়ে থাকলে, যুদ্ধবিরতির লক্ষ্যে অনুষ্ঠিত অধিবেশনে মতামত প্রদানে বিরত থাকতে হবে। চার্টারে এমনটাই বলা হয়েছে। গাজায় পরিচালিত এবং চলমান ইসরাইলের যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র শুধু সমর্থন দিয়েই ক্ষান্ত নয় বরং অস্ত্র ও অর্থের যোগান দিয়ে চলেছে। এমতাবস্থায় যুদ্ধবিরতির উদ্দেশ্যে আহুত নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশনে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে ভোটদানের যৌক্তিকতা দেখি না। তাছাড়া নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচটি স্থায়ী সদস্যদেরকে ভিটো ক্ষমতা প্রদানের কথা, জাতিসংঘের চার্টারের কোথাও বলা হয় নি। নিজেরাই সমযোতার মাধ্যমে ভিটো ক্ষমতার অধিকারী হয়ে গেছেন। পরিস্থিতি বিবেচনায় মনে হয়, সাধারণ পরিষদের অবশিষ্ট ১৮৮ দেশও মেনে নিয়েছে। ভিটো ক্ষমতার বিষয়ে বিশদ আলোচনা না করে নির্বোধের মত মেনে নেয়া বিবেকবানদের কাম্য হতে পারে না। কারণ, গণহত্যার নীরব দর্শক হওয়া সুস্থ মন মানসিকতার পরিচয় নয়। নৈতিকতার প্রশ্নে বিবেক যদি অসহায় হয়, বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা কিছুতেই সম্ভব নয়। 

নিরাপত্তা পরিষদ তথা জাতিসংঘের লক্ষ্যই হচ্ছে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। ভেটো প্রয়োগ করে যুদ্ধ প্রলম্বিত করাকে সংগঠন বিরোধী কাজ বিবেচনা করতে হবে। কোন একটি রাষ্ট্র আজ পরিষদের সদস্য রাষ্ট্র সংগঠন বিরোধী কাজ করে চলেছে। এজন্য জবাবদিহি করার কথা। বাস্তবে এমনটা হচ্ছে না, বিশ্ব বরং বাংলাদেশের চলচিত্র জগতের স্বনামধন্য কমেডি অভিনেতা হাবা হাশমতের মত কিংকর্তব্যবিমূঢ় ভুমিকা পালন করছে। নিরাপত্তা পরিষদ সদস্যের দায়িত্বহীন কর্মকাণ্ডের জন্য জাতিসংঘ দণ্ড প্রদান করতে পারছে না। উল্টা শাসিত হচ্ছে। জাতিসংঘ ভুলে গেছে, শান্তি রক্ষার জন্য দেশে দেশে শান্তিবাহিনী প্রেরণ করছে। স্মরণ রাখা প্রয়োজন, নিরাপত্তা পরিষদ জাতিসংঘের সৃষ্টি এবং বরাদ্ধ নির্ভর। আর জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সৃষ্টি যেমন নয়, বরাদ্ধ নির্ভরশীলও নয়। জাতিসংঘের চার্টারে বর্ণিত নিয়মাবলি মেনে দায় পালন করছে না যুক্তরাষ্ট্র। যে কারণে জাতিসংঘ বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায়, কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে।

অপরদিকে সাধারণ পরিষদের এক অধিবেশনে জাতিসংঘে পেলেস্টাইনকে পূর্ণ মাত্রার সদস্য পদ প্রদানের জন্য ব্যাপক আলোচনা পরবর্তী ভোট গ্রহণ করা হয়েছে। এই অধিবেশনে ১৪৩ সদস্য রাষ্ট্র পেলেস্টাইনের অন্তর্ভুক্তির পক্ষে ভোট দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ ৯টি রাষ্ট্র বিপক্ষে এবং ২৫টি রাষ্ট্র ভোটদানে বিরত থেকেছে। চার্টারে বর্ণিত নিয়মানুসারে, পেলেস্টাইনকে জাতিসংঘে অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব পাশ হয়েছে। অর্থ্যাৎ পেলেস্টাইলকে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে। পরবর্তীতে ভোটদানে বিরত থাকা ২৫ দেশের মধ্যে নরওয়ে, আয়ারল্যান্ড ও স্পেইন আনুষ্ঠিকভাবে পেলেস্টাইনকে স্বীকৃতি জানিয়েছে। ফলে বিরত থাকা সদস্য দেশের সংখ্যা দাঁড়ালো ২২ আর স্বীকৃতি প্রদানকারী দেশের সংখ্যা ১৪৬ এ উন্নীত হলো।

সাধারণ পরিষদে গৃহীত প্রস্তাবের বাস্তবায়ন করতে নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন নিতে হবে। নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন চেয়ে প্রস্তাব উত্থাপন করলেই যুক্তরাষ্ট্র ভিটো দেবে, ইহাতে কোন সন্দেহ নাই। নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন ব্যতীত সাধারণ পরিষদে গৃহীত প্রস্তাব কার্যকর করা যাবে না, যদিও চার্টারে একথার কোন উল্লেখ নাই। তবু কেন নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন চাই? যুক্তরাষ্ট্র সকল সময় ইসরাইলের পাশে পেলেস্টাইন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলে আসছে, এখনও বলছে - পাশাপাশি দুই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই একমাত্র সমাধান। অথচ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বিরোধিতা করে পেলেস্টাইনের বিপক্ষে ভোট দিয়েছে। এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিচারিতার রূপ উন্মোচিত হয়েছে।

অবস্থা বিবেচনায় মনে হয়, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ সৃষ্টি করে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে। জাতিসংঘ, গাজায় চলমান গণহত্যার যুদ্ধ বন্ধ করতে না পারলে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা করবে  কিভাবে? যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স যুদ্ধের সূচনা লগ্নে ইসরাইলকে ঘোর সমর্থন দিয়েছে। IDFএর নির্বিচার নারী, শিশু ও বেসামরিক জনগোষ্ঠীর পরে চালিত গণহত্যা এবং বসতির স্থাপনা ধ্বংসের তাণ্ডব দেখে যুদ্ধ বন্ধের পক্ষে নিরব সমর্থন করছে। বৈশ্বিক মানবতা রক্ষা ও শান্তি নিশ্চিত করার জন্য নিরাপত্তা পরিষদের দায় ও ক্ষমতার প্রতি আলেকপাত করলে আমরা দেখি -

The Security Council foster negotiations imposes sanctions and authorises the use of force including the deployment of peacekeeping missions.

উল্লিখিত বর্ণনা থেকে, মানবতা ও শান্তি রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত থেকে কোন সদস্য রাষ্ট্র, নিরাপত্তা পরিষদে উপস্থাপিত প্রস্তাবের বিরোধিতা করার সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। এতদ্ব্যতীত যদি কোন সদস্য রাষ্ট্র যুদ্ধরত এক গোষ্ঠীর প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে থাকে, সিদ্ধান্ত গ্রহণের বেলায় ও পরিষদের নিরপেক্ষতা বজায় রাখার জন্য সেই সদস্যকে ভোটদানে বিরত থাকা বাঞ্চনীয়। জাতিসংঘ ও তার অঙ্গ সংগঠন যৌক্তিক বিতর্কে উপনীত হতে পারে কিন্তু সরাসরি কোন রাষ্ট্রের পক্ষে অথবা বিপক্ষে অবস্থান নিতে পারে না। কারণ জাতিসংঘ বিশ্বশান্তি ও মানবিক কল্যানের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। 

মোহাম্মদ হান্নান: কলামিস্ট, বিশিষ্ট সংগঠক, কবি

img

বংশের পরিচয়!

প্রকাশিত :  ১২:০০, ১২ মে ২০২৫

রেজুয়ান আহম্মেদ

আষাঢ়ের এক ভিজে বিকেল। আকাশের গর্জন থেমে গেছে বটে, কিন্তু বাতাসে এখনো ভেসে বেড়াচ্ছে কাঁচা মাটির ঘ্রাণ। উঠোনে জমে আছে নিঃশব্দতা। দূরের বাঁশঝাড়ের ফাঁক দিয়ে ভেসে আসছে ঝিঁঝিঁ পোকার একটানা গান—যেন সময় থেমে গেছে, কিংবা নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে।  

রতন মাস্টার বসে আছেন পুরোনো আমগাছটার ছায়ায়। হাতে নাইলনের সুতো, বাঁধছেন মাছ ধরার জাল। দেখে মনে হয়, এই জালের ফাঁকেই তিনি বুনে চলেছেন জীবনের গল্প—ভাঙা স্বপ্ন, না বলা কথা, হারিয়ে যাওয়া সময় আর কিছু গোপন কষ্ট।  

ঠিক এমন সময়, গ্রামের পেছনের কাদা-ঢালা পথ বেয়ে এসে দাঁড়াল সজল। আধময়লা ছেঁড়া জিন্স, হাঁটুর কাছ থেকে ঝুলে থাকা ইয়ারফোনের তার, আর চোখজোড়া যেন কিছু হারানোর গ্লানিতে ঘোলাটে।  

সে আমগাছের গুঁড়ির পাশে দাঁড়িয়ে, একটু নিচু গলায় বলল,  

— “মাস্টার চাচা... শহরের বন্ধুরা মজা করে বলে ‘রংপুরের মফিজ’। তাদের পূর্বপুরুষরা কেউ জমিদার, কেউ ব্যারিস্টার। আর আমার শিকড় তো চাষার ঘরে...”

রতন মাস্টার চশমাটা একটু উঁচু করে তাকালেন। চোখের কোণায় বয়সের ভাঁজ হলেও, দৃষ্টিতে ছিল একরাশ কোমলতা। ঠোঁটে মৃদু হাসি টেনে বললেন,  

— “চা খাবি সজল? পাতলা লেবু চা, না কি গাঢ় দুধ চা?”

সজলের গলা কেঁপে উঠল, সে ফিসফিস করে বলল,  

— “যে চায়ের কাপে বংশের গরিমার সুবাস থাকে, সেই চা চাই…”

রতন মাস্টার জালটা থামিয়ে পাশে রাখলেন। একটু নীরব হয়ে বললেন,  

— “আয়, আজ তোকে একটা গল্প শোনাই। এক চাষার গল্প, যার হাতে ছিল না জমিদারি দলিল, কিন্তু মুঠোয় ছিল বিশুদ্ধ স্বপ্ন আর সৎ ইচ্ছে।” 

এ গল্প আসলে তাঁর নিজের—রতন মাস্টারের। মাটির ঘরে জন্ম তাঁর, টিনের চাল ভেদ করে বৃষ্টির পানি যে ঘরে প্রতিরাতে বালিশ ভিজিয়ে দিত। বাবা শিবু মণ্ডল, গরিব কৃষক; আধ বিঘা জমি, আর সারাদিনের হাড়ভাঙা খাটুনি। মা পদ্মা দেবী রোজ ভোরে বলে উঠতেন,  

— “মানুষের উপকার করিস রতন। মানুষের পাশে দাঁড়ানোই তো সবচেয়ে বড় ধর্ম।”

রতনের বয়স তখন বারো, সেদিনই তাঁর বাবা না-ফেরার দেশে চলে যান। সেই ছোট্ট কাঁধে সংসারের ভার। গরুর পিঠে চড়ে দুধ বিক্রি করতেন সকালে, আর রাতে স্কুলের জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে পড়তেন। পাড়ার ছেলেরা হাসত, বলত—“দুধওয়ালা পণ্ডিত!” 

রতন হেসে বলত, “এক গরু দিচ্ছে শরীরের শক্তি, আরেকটা মনকে দিচ্ছে জ্ঞানের আলো—দুটোই দরকার মানুষ বাঁচাতে।”

একবার পরীক্ষার হলে সবাই নকল করছে। রতন সাদা খাতা জমা দেয়। শিক্ষক রেগে গিয়ে বললেন, “তুই ফেল করলি!”  

রতনের জবাব ছিল—“খাতায় ফেল, কিন্তু বিবেকের খাতায় তো একশো!” 

দিন গড়াতে গড়াতে তাঁর পাঠশালায় ভিড় বাড়ে। গরিব, অনাথ, পথশিশু—সবাই তাঁর ছাত্র। একদিন গ্রামের চেয়ারম্যান ঠাট্টা করে বললেন, “চাষার ঘরে জন্ম নিয়ে এত পড়া শিখে কী করবি?”

রতনের উত্তর ছিল, “জন্ম তো আমার হাতে ছিল না। কিন্তু আমি মানুষের মতো মানুষ হবো, এটা আমার সিদ্ধান্ত!”

মুসলিম-হিন্দু, জাত-পাত তাঁর কাছে কিছুই গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। ঈদের সকালে গোপাল কাকার বাড়ি গিয়ে হাতে মিষ্টি তুলে দিতেন, আবার দুর্গাপূজায় মুসলিম ছেলেদের সাথে মিলে মণ্ডপে আলপনা আঁকতেন।  

একবার মন্দিরে আগুন ধরলে, তিনি দৌড়ে ঢুকে যান আগুনে। হাত পুড়ে গেলেও মুখে শুধু বললেন, “মানুষের ধর্মে আগুন লাগলে, পানি ঢালাটাই তো আমার কাজ।”

একদিন এক রাজনীতিবিদ এলেন ভোট চাইতে। রতন জিজ্ঞেস করলেন, “গ্রামের সেই অন্ধ মা যার চোখে অস্ত্রোপচারের টাকা নেই, আপনি কি তাঁর জন্য কিছু করেছেন?”

তিন দিন পর রাজনীতিবিদ এসে প্রণাম করে বললেন, “আপনি শিখিয়ে দিলেন, রাজনীতি মানে পকেট ভরা না, হৃদয় ভরা!”

সজল নীরবে শুনছিল। সেদিন থেকে তার ভেতরটা বদলে গেল। ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেও আর শহরের চাকরির পেছনে ছুটল না। গড়ে তুলল ‘মাটির পাঠশালা’। সেখানে এখন রাস্তার শিশুরা শেখে অক্ষর চিনতে, আর স্বপ্ন দেখতে। রতনের কথা সে লিখে রেখেছে ডায়েরির প্রথম পাতায়—  

“বংশের পরিচয় রক্তে নয়, কর্মে।” 

পঁচিশ বছর কেটে গেছে...  

গ্রামের মেলায় মাইক হাতে সজল দাঁড়িয়ে বলছে,  

— “আমার পেছনে নেই জমিদার বংশ, নেই ইতিহাসের ভারি গরিমা। আছে এক মাটির মানুষ, যিনি আমাকে শিখিয়েছেন—মানুষের পরিচয় তার আদর্শে, তার কাজে।”

মাঠজুড়ে করতালির শব্দ। ছাপড়া ঘর থেকে হেঁটে এলেন এক বৃদ্ধ—রতন মাস্টার। পায়ের জুতা নেই, কিন্তু চোখে জল। গ্রামের মানুষ চিৎকার করে উঠল,  

— “এই তো আমাদের গর্ব, আমাদের বংশ!”  

রতন মাস্টার চোখ মুছে শুধু বললেন,  

— “বংশ মানে জন্ম নয়। বংশ মানে নদীর মতো হওয়া—নিজের পথ নিজেই বানিয়ে, সবার পিপাসা মেটানো।”

তোমার জন্ম হয়তো মাটির ঘরে, কিন্তু কর্ম যদি হয় আকাশ ছোঁয়া, তবে সেই কর্মই তোমার শ্রেষ্ঠ পরিচয়। কারণ, সত্যিকারের বংশ পরিচয় রক্তে নয়—আদর্শে।