img

কোভিড—১৯ টিকা প্রযুক্তিঃ ভবিষ্যৎ চিকিৎসা বিজ্ঞানে নব দিগন্ত উন্মোচন

প্রকাশিত :  ০১:০৯, ২৯ জুন ২০২৪

কোভিড—১৯ টিকা প্রযুক্তিঃ ভবিষ্যৎ চিকিৎসা বিজ্ঞানে নব দিগন্ত উন্মোচন

মানব সভ্যতার ইতিহাসে মহামারী নতুন কিছু নয়, তবুও কোভিড—১৯ মহামারী বিশ্বকে এক অভূতপূর্ব সঙ্কটের মুখে ঠেলে দিয়েছিল। এই মহামারীর ভয়াবহতা অনেকটাই প্রশমিত হয়েছে, কিন্তু এই সংকটের মোকাবিলায় বিজ্ঞানীদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও অভূতপূর্ব সাফল্যের কথা বিশ্ব কখনোই ভুলবে না। এই সাফল্যের মূলে রয়েছে অতি অল্প সময়ে কোভিড—১৯ এর টিকা আবিষ্কার। যে টিকা প্রযুক্তি ব্যবহার করে এই টিকা তৈরি করা হয়েছে তা নিঃসন্দেহে চিকিৎসা বিজ্ঞানের একটি যুগান্তকারী ঘটনা। এটি কেবল করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়েই নয়, বরং ভবিষ্যতে আরও বহু রোগের চিকিৎসায় আশার আলো দেখাচ্ছে।

টিকা প্রযুক্তির ভিত্তিঃ mRNA এর বিপ্লব

কোভিড—১৯ টিকা তৈরিতে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত প্রযুক্তি হলো মেসেঞ্জার আরএনএ (mRNA) প্রযুক্তি। mRNA হলো এক ধরনের জেনেটিক উপাদান, যা কোষের নিউক্লিয়াসে ডিএনএ থেকে তথ্য বহন করে কোষের সাইটোপ্লাজমে নিয়ে যায়। এই তথ্যের ভিত্তিতেই কোষ প্রোটিন তৈরি করে।

mRNA টিকা এই জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে তৈরি। এখানে, ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের জেনেটিক কোড mRNA আকারে দেহে প্রবেশ করানো হয়। mRNA কোষের অভ্যন্তরে প্রবেশ করার পর, কোষের রাইবোজোম এই mRNA এর নির্দেশ অনুযায়ী ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিন তৈরি করে। এই প্রোটিন দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার নজরে আসলে, রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভাইরাসের এই প্রোটিনের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি করে। ফলে ভবিষ্যতে আসল ভাইরাস দেহে প্রবেশ করলে, দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা তাকে চিনতে পারে এবং দ্রুত প্রতিহত করতে সক্ষম হয়।

mRNA প্রযুক্তির সুবিধা

প্রচলিত টিকাগুলোতে দুর্বল বা নিষ্ক্রিয় ভাইরাস ব্যবহার করা হয়, যা কিছু ক্ষেত্রে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। কিন্তু mRNA টিকা ভাইরাসের কোনো জীবিত উপাদান বহন করে না, ফলে এটি অধিকতর নিরাপদ। এছাড়াও, mRNA টিকা উৎপাদন প্রক্রিয়া তুলনামূলকভাবে সহজ এবং সাশ্রয়ী, যা বৃহৎ পরিসরে টিকাদান কর্মসূচি বাস্তবায়নে বিশেষ সুবিধাজনক।

সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এর দ্রুত উৎপাদন ক্ষমতা। mRNA টিকার উৎপাদন প্রক্রিয়া অত্যন্ত দ্রুত, যা কোনো মহামারীর সময় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই সুবিধার কারণেই কোভিড—১৯ এর মতো অতিমারীর সময় খুব অল্প সময়ের মধ্যে টিকা উৎপাদন ও বিতরণ সম্ভব হয়েছিল।

কোভিড—১৯ টিকার প্রভাব ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

কোভিড—১৯ টিকা ইতিমধ্যেই বিশ্বব্যাপী মৃত্যুহার উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করেছে। এটি কেবল মৃত্যুহারই কমায়নি, বরং এই রোগের তীব্রতাও অনেক কমিয়ে দিয়েছে। ফলে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার হারও কমেছে এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর চাপ অনেকটাই লাঘব হয়েছে।

কিন্তু mRNA টিকা প্রযুক্তির সম্ভাবনা কেবল কোভিড—১৯ এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এই প্রযুক্তি ভবিষ্যতে অন্যান্য সংক্রামক রোগ যেমন ইনফ্লুয়েঞ্জা, এইডস, ম্যালেরিয়া প্রভৃতির বিরুদ্ধেও কার্যকর টিকা তৈরিতে নতুন সম্ভাবনা তৈরি করেছে। এছাড়াও, এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে ক্যান্সারের মতো জটিল রোগের চিকিৎসায় ব্যক্তি—নির্ভর টিকা তৈরির সম্ভাবনা রয়েছে, যা চিকিৎসা বিজ্ঞানে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে।

চ্যালেঞ্জ ও সতর্কতা

mRNA টিকা প্রযুক্তি এখনও অনেকটা নতুন। এটি সম্পর্কে আমাদের আরও অনেক কিছু জানার বাকি। কিছু ক্ষেত্রে এই টিকার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। তবে, দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব সম্পর্কে এখনও পর্যাপ্ত তথ্য নেই। তাই এই প্রযুক্তি ব্যবহারে সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন।

mRNA টিকা সংরক্ষণ ও পরিবহনের জন্য অতিশীতল তাপমাত্রার প্রয়োজন হয়, যা উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তবে বিজ্ঞানীরা ইতোমধ্যেই এমন mRNA টিকা তৈরির চেষ্টা করছেন, যা সাধারণ ফ্রিজের তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা যাবে।

উপসংহার

কোভিড—১৯ মহামারী বিশ্বকে এক কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যেতে বাধ্য করেছে। কিন্তু এই সংকটের মধ্য দিয়েই বিজ্ঞানীরা সজঘঅ টিকা প্রযুক্তির মতো একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার উপহার দিয়েছেন। এই প্রযুক্তি কেবল কোভিড—১৯ এর বিরুদ্ধেই নয়, ভবিষ্যতে আরও বহু রোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমাদের সবচেয়ে বড় অস্ত্র হয়ে উঠতে পারে। তবে, যেকোনো নতুন প্রযুক্তির মতো, এর সম্ভাব্য ঝুঁকি সম্পর্কে সজাগ দৃষ্টি রাখা অপরিহার্য।

এই প্রযুক্তি ভবিষ্যতে কী নিয়ে আসবে, তা সময়ই বলে দেবে। তবে একটি কথা নিশ্চিত যে, সজঘঅ টিকা প্রযুক্তি চিকিৎসা বিজ্ঞানে নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে। ভবিষ্যতে হয়তো এমন একদিন আসবে, যেদিন সংক্রামক রোগের ভয় আর আমাদের পিছু ছাড়বে না

mRNA টিকা প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

mRNA টিকা প্রযুক্তি চিকিৎসা বিজ্ঞানের একটি যুগান্তকারী অর্জন। এর বিপুল সম্ভাবনা কেবল সংক্রামক রোগের চিকিৎসাতেই সীমাবদ্ধ নয়। বিজ্ঞানীরা ইতোমধ্যে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে ক্যান্সার, জেনেটিক রোগ, এমনকি হৃদরোগের চিকিৎসার সম্ভাবনা নিয়ে গবেষণা করছেন।

ক্যান্সারের চিকিৎসাঃ ক্যান্সার কোষের অনন্য বৈশিষ্ট্যগুলো চিহ্নিত করে, mRNA টিকা ব্যক্তি—নির্ভর (ঢ়বৎংড়হধষরুবফ) চিকিৎসা প্রদানের সম্ভাবনা রাখে। এই টিকা ক্যান্সার কোষগুলোকে সনাক্ত করে ধ্বংস করতে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে প্রশিক্ষণ দিতে পারে।

জেনেটিক রোগের চিকিৎসাঃ mRNA প্রযুক্তি ব্যবহার করে ত্রুটিপূর্ণ জিনের কার্যকারিতা পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হতে পারে। এর মাধ্যমে জিন থেরাপির ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হতে পারে।

হৃদরোগের চিকিৎসাঃ হৃদপেশির ক্ষতিগ্রস্থ কোষগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করতে সজঘঅ টিকা ব্যবহারের সম্ভাবনা নিয়ে গবেষণা চলছে। এটি সফল হলে হৃদরোগের চিকিৎসায় এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসতে পারে।

সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ এবং সমাধান

পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াঃ যেকোনো টিকার মতোই mRNA টিকাতেও কিছু পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। তবে, বিজ্ঞানীরা ক্রমাগত এই টিকাগুলোর নিরাপত্তা এবং কার্যকারিতা উন্নত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবঃ mRNA টিকার দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব নিয়ে এখনও গবেষণা চলছে। তবে, এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য ইতিবাচক।

অতিশীতল সংরক্ষণঃ mRNA টিকা সংরক্ষণ এবং পরিবহনের জন্য অতিশীতল তাপমাত্রার প্রয়োজন হয়, যা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তবে, বিজ্ঞানীরা ইতোমধ্যে এমন সজঘঅ টিকা তৈরির চেষ্টা করছেন, যা সাধারণ ফ্রিজের তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা যাবে।

জনসচেতনতাঃ mRNA টিকা নিয়ে অনেক ভুল তথ্য এবং গুজব প্রচলিত আছে। জনসাধারণের মধ্যে এই টিকা সম্পর্কে সঠিক তথ্য প্রচার করা অত্যন্ত জরুরি।

সর্বশেষ কথাঃ কোভিড—১৯ টিকা প্রযুক্তি বিজ্ঞানের অগ্রগতির একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এটি আমাদেরকে দেখিয়েছে যে, মানব সভ্যতা যেকোনো প্রতিকূলতাকে জয় করার ক্ষমতা রাখে। mRNA টিকা প্রযুক্তি আমাদেরকে একটি সুস্থতর ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে এটি আরও বহু জীবন বাঁচাতে এবং মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে সহায়তা করবে বলে আমরা আশা রাখতে পারি।

‘সুস্থ দেহে সুস্থ মন’ এই প্রবাদ বাক্যটি আমরা সবাই জানি। কোভিড—১৯ টিকা প্রযুক্তি এই লক্ষ্য অর্জনে বিজ্ঞানের এক অমূল্য অবদান। আসুন, আমরা এই প্রযুক্তির সম্ভাবনাগুলোকে কাজে লাগিয়ে একটি রোগমুক্ত বিশ্ব গড়ে তুলি।

ডঃ গোলাম কবির এমবিবিএস, পিজিডিপ, এমএসসি, মেডিক্যাল ডিরেক্টর, মেডপিস লন্ডন

মতামত এর আরও খবর

|| মকিস মনসুর ||

img

শিক্ষকদেরকে অসম্মান করা জাতির জন্য অত্যন্ত কলঙ্কজনক!

প্রকাশিত :  ১৮:৫৪, ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪

|| মকিস মনসুর ||

শিক্ষকের ঋণ কখনো শোধ করা যায় না। আজ আমরা জীবনের যেখানেই প্রতিষ্ঠিত থাকি না কেন, আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক—শিক্ষিকাদের অবদান অনস্বীকার্য। শিক্ষকরা মানুষ গড়ার কারিগর। শিক্ষকমাত্রই বিশেষ মর্যাদা ও সম্মানের ব্যক্তি। শিক্ষাকে যাবতীয় উন্নয়নের চালিকাশক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হলে, শিক্ষকের ভূমিকার গুরুত্ব অপরিসীম।বলতে গেলে এর বিকল্প নেই। শিক্ষার হাতেখড়ি যদিও শুরু হয় পরিবার থেকে, কিন্তু তার পূর্ণতা পায় একজন শিক্ষকের হাতে। 

মহান আল্লাহু রাব্বুল আলামিন শিক্ষকদের আলাদা মর্যাদা দিয়েছেন। তাদের সম্মানে ভূষিত করেছেন। ফলে সমাজে শিক্ষকমাত্রই বিশেষ মর্যাদা ও সম্মানের ব্যক্তি। 

পবিত্র কোরআনে নাজিলকৃত প্রথম আয়াতে জ্ঞানার্জন ও শিক্ষাসংক্রান্ত কথা বলা হয়েছে।

মহান আল্লা তা’আলা বলেন, ‘পড়! তোমার প্রতিপালকের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। যিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন একবিন্দু জমাট রক্ত থেকে। পড়! আর তোমার প্রতিপালক পরম সম্মানিত। যিনি কলমের দ্বারা শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন, যা সে জানত না।’ (সুরা আলাক, আয়াত ১—৫)

আমাদের প্রিয় বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা  (সা:) (আ:) এরশাদ করেন, ‘তোমরা জ্ঞান অর্জন করো এবং জ্ঞান অর্জনের জন্য আদব—শিষ্টাচার শেখো। এবং যার কাছ থেকে তোমরা জ্ঞান অর্জন করো, তাকে সম্মান করো। (আল—মুজামুল আওসাত, হাদিস ৬১৮৪)

মনুষ্যত্বের বিকাশের জন্য আমাদের কোনো না কোনোভাবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় যেতে হয়। বিভিন্ন শাস্ত্র অধ্যয়নে জানা যায়, মানুষের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায় ছিল গুরুগৃহ, অর্থাৎ জ্ঞান অর্জনের জন্য গৃহ ত্যাগ করে শিক্ষাগুরু বাড়িতে যেতে হতো। পবিত্র হাদিস হিসেবে প্রচলিত আছে, জ্ঞান অর্জনের জন্য সূদুর চীন দেশে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে। জ্ঞান অর্জন বা শিক্ষার মূলমন্ত্রই হলো সঠিক জীবন দর্শন দান। এই জীবন দর্শন দান করেন শিক্ষক। একটি শিশু যখন শিক্ষকের কাছে যায় তখন মন থাকে খালি ক্যানভাস। শিক্ষক তাঁর জ্ঞানের তুলি দিয়ে সেখানে জীবনের ছবি আঁকেন। ধীরে ধীরে মানব শিশুকে মানবে পরিণত করেন। জগতের ভালো—মন্দ, ন্যায়—অন্যায় বিচার—বিশ্লেষণের বোধ সঞ্চারিত করেন। স্বামী বিবেকানন্দ যথার্থই বলেছেন, ‘মানুষের অন্তর্নিহিত পরিপূর্ণ বিকাশই হলো শিক্ষা, আর তাঁর পথপ্রদর্শক হলেন শিক্ষক।’ তাই শিক্ষা যদি হয় জাতির মেরুদণ্ড, তবে শিক্ষক হলেন সেই মেরুদণ্ড গড়ার প্রধান কারিগর। একজন শিক্ষকের ভূমিকা ব্যতিত কোনো জাতিই শিক্ষিত জাতিতে পরিণত হতে পারে না।

একজন শিক্ষার্থী প্রকৃত মানুষ রূপে গড়ে ওঠার পেছনে বাবা—মা’ আমাদের প্রথম শিক্ষক হলে ও আসল শিক্ষক হলেন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষক যারা আমাদের প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলেন।

শিক্ষকরা জাতিকে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করে নিজেরা মোমের মতো নিঃশেষিত হন। একজন শিক্ষক নিজে শিক্ষা অর্জন করার পর পরই অপরকে সেই শিক্ষায় শিক্ষিত ও চরিত্র গঠনে ভূমিকা পালন করে থাকেন। 

ইদানিং বাংলাদেশের বতমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে লিখতে বাধ্য হচ্ছি, কোনো শিক্ষক যদি ভুল করেন প্রমাণ সাপেক্ষে তদন্ত করে প্রসাশনিক অ্যাকশন নেওয়ার বিধান রয়েছে। দোষী সাব্যস্ত হলে, আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে বিচার করা হবে। এটাই বাস্তবতা। 

একজন শিক্ষকের দোষ/গুণ/ভালো/মন্দ অনেক বিষয় থাকতেই পারে। সে বিচারের ভার শিক্ষার্থীরা নেবে কেন? 

সারা দেশব্যাপি শিক্ষকদের পদত্যাগে বাধ্য করানোর এক হিড়িক দেখা যাচ্ছে। ফেইসবুক ও টিভি চ্যানেল এবং বিভিন্ন পত্রিকার নিউজে বেশ কিছু ছবি এসেছে, একজন স্যারকে জো\'রপূর্বক পদ\'ত্যাগ করানোর সময় স্ট্রো\'ক করেছেন। সত্য কি না জানিনা গতকাল নাকি এই সম্মানিত শিক্ষক মারা গেছেন। আরেকজন ম্যাডামকে জুতা গলায় দেওয়া হয়েছে। অন্যান্যদেরকে মার পিট করা হয়েছে, যাতে শিক্ষার্থীরা শারিরীর আক্রমন করেছে শিক্ষকদের এ এক হৃদয়বিদারক কান্নার চিত্র। একজন শিক্ষক! 

সারা জীবন শিক্ষকতা পেশায় কাটিয়ে ছাত্রদের বেত্রাঘাতে তার পিটেই আকা হলো ক্ষতবিক্ষত বাংলাদের মানচিত্র ২০২৪? ক্ষমা করো হে জাতির শিক্ষাগুরু আমরা তোমার নিরাপত্তা দিতে পারিনি আমরা লজ্জিত!!!

শিক্ষকদের বিচার করার দায়িত্ব কখনো শিক্ষার্থীদের হতে পারে না। প্রশাসন আছে, আইন আছে, আছে পরিচালনা কমিটি। এমন বেয়াদবি শিক্ষার্থীরা করবে কেন? কোন ভাবেই ছাত্ররা বা অন্যরা শিক্ষককে অপদস্ত হেনাস্থা করে জোর পুর্বক পদত্যাগ করানো, এটা অপ —সংস্কৃতি, অমানুষিক, অমানবিক, 

শিক্ষকদেরকে অসম্মান করা জাতির জন্য অত্যন্ত কলঙ্কজনক! 

ফেইসবুকে করা একজন ব্যক্তির কমেন্ট পুরাপুরি তুলে ধরছি, কোন শিক্ষকের অপরাধের পক্ষে আমি নই। শিক্ষক অপরাধ করেছেন, দালালি করেছেন, নানান রকম অনিয়ম করেছেন, অতএব তাঁকে শাস্তি পেতে হবে, আমি আপনার সাথে একমত। এমন অপরাধী কোন শিক্ষক স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করতে না চাইলে তাঁকে পদত্যাগে বাধ্য করাতে যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে প্রক্রিয়া করতে হবে,তাই বলে ছাত্ররা ইচ্ছামত বেয়াদবি করবে? মিডিয়ার সামনে এসে ‘আমি অমুক স্যারের মাথায় থাপ্পড় মেরে উল্লাস করছে আবার আরেকজন এর গায়ে হাত তুলতে পেরেছি!’ বলে বিজয়ের হাসি হাসবে? সেই চিত্র বা সাল কি ভূলে যাবে জনগন। শিক্ষকদের পদত্যাগে বাধ্য করার এটাই কি একমাত্র পদ্ধতি?

সদ্য পদত্যাগ কারী একজন শিক্ষকের মনে আকুতি। 

কী দেখার কথা, কী দেখছি?

সদ্য পদত্যাগ করা একজন প্রতিষ্ঠান প্রধানের লেখনিঃ

আমি যেহেতু প্রায় ২২ বছর যাবৎ প্রতিষ্ঠান প্রধান হিসেবে ছিলাম তাই ব্যর্থতা আমারই। 

প্রিয় এলাকাবাসী ক্ষমা করবেন চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিনি। আমাদের যেমন সীমাবদ্ধতার অভাব নেই, তেমন চেষ্টারও ত্রুটি ছিল না। কিন্তু পারিনি।

আসলে একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি হয় ছাত্রদের জন্যে, ভাটি এলাকার এই কলেজটিও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দরিদ্র এলাকা ছাত্র ছাত্রীদের উচ্চ শিক্ষার সুযোগ হাতের নাগালে পৌঁছে দেয়ার উদ্দেশ্য।

সুতরাং তাদের চাহিদা মোতাবেক সাজাতে হয়।

আমি আমার ছাত্রদেরকে নিজের সন্তানের মত ভালোবেসেছি।

তাদের উত্তম ভবিষ্যৎ এর জন্য চেষ্টা করেছি, আদর দিয়েছি, সোহাগ করেছি, ধমক দিয়েছি, বুকে টেনে নিয়েছি, কিন্তু চাহিদা পুরন করতে পারিনি।

ইদানিং এ আমার কিছু কথার দ্বারা আমি আমার সন্তানসম ছাত্রদেরকে বেশী কষ্ট দিয়ে ফেলেছি।

তাই তারা আমাকে আর চায়না। ক্ষমার কোনো সুযোগও নেই, বিচার ছাড়াই ফাঁসির ব্যবস্থা হয়ে গেছে।

আমি মেনে নিয়েছি।

সারা পৃথিবীতেই তো সন্তানের জীবন সাজাতে গিয়ে অনেক বাবা—মা রাই নিঃস্ব হচ্ছে, পথে বসছে। আমি ব্যতিক্রম হব কেন?

তারাতো কোমলমতি বুঝতে পারেনি এক বাবাকে শাস্তি দিতে গিয়ে তারা তার আরেক ভাই /বোনের রিজিক বন্ধের হাতিয়ার হয়েছে।

আমার কোমলমতি শিক্ষার্থীদের আর কি দোষ? সারা বাংলাদেশে এত এত পদত্যাগ, ওরা যদি একটা দু\'টা পদত্যাগ না করাতে পারে।

তাহলে এটা তাদের ব্যর্থতা মনে হবে!

পৃথিবীর সব বাবার মত আমিও সব সময় আমার সন্তানের বিজয় দেখতে চাই।

আমি একজন ব্যর্থ মানুষ, তবুও স্বপ্ন দেখতাম এই ক্যাম্পাস থেকে সাদা কাফনে বা লাল গালিচায়, ফুলেল শুভেচ্ছায় বিদায় হবো, আমার স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেল। এক নিমিষেই সব শেষ।

এই শেষ বয়স এসে পৃথিবীর কারোর প্রতি আমার কোন অভিযোগ নেই, কষ্ট পেয়েছি, প্রাণ খুলে কেঁদেছি, হালকা হয়েছি, মেনে নিতে চেষ্টা করছি।

সবকিছুর ফয়সালাতো উপর থেকেই হয়।

আল্লাহর কাছে বলেছি \"হে আল্লাহ তোমার দুনিয়া তো অনেক বড়, তুমি নিশ্চয়ই কোন না কোন জায়গায় আমার জন্য, আমার সন্তানের জন্য উত্তম রিজিক এবং সম্মানের ব্যবস্থা করে রেখেছো।

“আমি আশা করতে চাই বা বলতে চাই.. বাংলাদেশের তথা পৃথিবীর কোন ছাত্র যেন তার নিকৃষ্ট শিক্ষকটিরও রিজিক বন্ধের হাতিয়ার না হয়।

কারণ, এই পদ্ধতি যে কত বেদনার, কত কষ্টের তা আমি ভুক্তভুগি ভালোভাবে টের পেয়েছি।

আমি যেন এই পদ্ধতিতে বিদায় হওয়ার পৃথিবীর শেষ শিক্ষকটি হতে পারি।

শিক্ষক বিদায় করার অনেক পদ্ধতি আছে। সেগুলো প্রয়োগ করা হোক, ছাত্র দিয়ে কেন?

ভালো থেকো ‘চাতলপাড় ডিগ্রি কলেজ’ খুব ভালো থেকো”। আমীন।

চাতলপাড় ডিগ্রি কলেজের সদ্য পদত্যাগ কারী একজন শিক্ষকের মনের আকুতি এই লেখা পড়ে খুউব লজ্জা হচ্ছিলো, এ কি হচ্ছে, এটা কোন ধরনের অমানুষিক ও অমানবিক কার্যক্রম। 

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের ঠাকুর বলেছিলেন মানুষ তো সবার ঘরে জন্মায়, কিন্তু মানুষ্যত্ব সবার ঘরে জন্মায় না।”

স্যার এ পি যে আব্দুল কালাম বলেছিলেন, মেধাবী হয়ে গর্ব করার কিছু নেই, শয়তান ও কিন্তু মেধাবী হয়। মনুষ্যত্ব ও সততা না থাকলে সে মেধা ঘৃণিত, কোনো সুস্থ মানুষ এইসব অপকর্ম সাপোর্ট করতে পারেনা। এসব বন্ধ করানো হচ্ছে না কেনো, রাষ্ট্রের দায়িত্বশীলরা কি চোখ থাকিতে অন্ধ হয়ে আছেন। আমাদের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুস সাহেব  ও একজন শিক্ষক ছিলেন। প্লিজ একটু চোখ খুলুন, বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে যেভাবে শিক্ষকদেরকে লাঞ্ছিত করা হচ্ছে, সম্মানিত শিক্ষকদের এই অপমান কেনো অবস্থাতেই মেনে নেওয়া যায় না, এটা খুবই দুঃখজনক।

আগে শিক্ষক দেখে শিক্ষার্থীরা ভয় পেতো, এখন শিক্ষার্থীদের দেখে শিক্ষককেরা ভয় পাচ্ছে । জাতির জন্য এর চেয়ে লজ্জা আর কি হতে পারে; আমাদের প্রাণের বাংলাদেশে শিক্ষকদের প্রতি কতিপয় নামধারী মেধাবীদের সন্ত্রাসী আচরনে প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। মানুষের মধ্যে মানুষ্যত্ব এবং পশুত্ব দুটোই থাকে। কিন্তু অমানুষের মধ্যে আদৌ মানুষ্যত্ব থাকেনা, যা থাকে তার পশুত্ব।

প্রকৃত শিক্ষা যে অর্জন করেছে সে কখনও শিক্ষকের সাথে বেয়াদবি করতে পারে না, এসব ঘটনার জন্য আমি বা আমরা সব ছাত্রদের দায়ি করতে চাই না।

যে  সব নামধারী ছাত্র আজ তার শিক্ষকের গায়ে হাত তুলছে আগামীতে সে তার বাবার গায়ে হাত তুলতেও দ্বিধা বোধ করবে না।

এসব বন্ধ না করা হলে শিক্ষকের অভিশাপ নিয়ে এই প্রজন্ম কোনোদিন কিছু করতে পারবে না।

শিক্ষক এর বিচার করার দায়িত্ব কোনো শিক্ষার্থীর হতে পারে না। যিনি একটি অক্ষর শিখিয়েছেন তিনিও শিক্ষক সম্মানের পাত্র।

দোষী হলে উর্ধতন কর্তৃপক্ষ অব্যাহতি/চাকুরিচ্যুতি বা যেকোন শাস্তিমুলক ব্যবস্থা নিবে; কিন্তু অভদ্র বেয়াদবেরা হেনস্থা করে জোরপুর্বক পদত্যাগ করাবে? তা নিতান্ত অমানবিক, সন্ত্রাসতুল্য অপরাধ। 

শিক্ষকের মর্যাদা সমুন্নত রাখতে না—পারলে, নীতি নৈতিকতা ও জাতির বিপর্যয় অনিবার্য।

সকল বিবেকবান মানুষের মতো  আজকের এই লিখনীর মাধ্যমে আমি ও এর তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানাচ্ছি, এবং আশাকরছি এই সব অমানুষিক, অমানবিক কাজ যাতে বন্ধ হয় এর যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা সহ দোষীদের বিচারের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা হোক। আসুন, “শিক্ষক হচ্ছেন পিতার সমান, সারাজীবন জানাবো সম্মান” এই হোক আমাদের সবার অঙ্গীকার। 

জয় হোক মানবতার, মানুষ্যত্ব জাগ্রত হোক, প্রানের বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।

লেখকঃ মোহাম্মদ মকিস মনসুর, চেয়ারম্যান, ইউকে বিডি টিভি; প্রধান সমন্নয়ক; প্রতিভা মেধা প্রকল্প; সম্পাদকমন্ডলীর সভাপতি, ডেইলি সিলেট এন্ড দৈনিক মৌলভীবাজার মৌমাছি কন্ঠঃ সম্পাদক, ওয়েলস বাংলা নিউজ


মতামত এর আরও খবর