img

বাংলাদেশিদের কিডনি অপসারণ, গ্রেপ্তার অ্যাপোলোর চিকিৎসক

প্রকাশিত :  ০৬:১৬, ০৯ জুলাই ২০২৪

বাংলাদেশিদের কিডনি অপসারণ, গ্রেপ্তার অ্যাপোলোর চিকিৎসক

কিডনি পাচার চক্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লি ভিত্তিক ইন্দ্রপ্রস্থ অ্যাপোলো হাসপাতালের এক নারী চিকিৎসককে গ্রেপ্তার করেছে দিল্লি পুলিশ। ৫০ বছর বয়সী ও চিকিৎসক ডা. বিজয়া কুমার বাংলাদেশ ও ভারতে কিডনি পাচার করতেন।

প্রাথমিক অভিযোগে জানা গেছে, ওই নারী চিকিৎসক রাজধানীর সংলগ্ন নয়ডা শহরে ‘যথার্থ’ নামের একটি হাসপাতালে অপারেশনের নামে অন্তত ১৫ থেকে ১৬ জন ব্যক্তির কিডনি সরিয়েছেন। কিডনি পাচারকারী দলের সদস্য হিসেবে এসব অপারেশন করেছেন তিনি। যাদের কিডনি তিনি সরিয়েছেন, তাদের অধিকাংশই বাংলাদেশের নাগরিক। ২০২১ থেকে ২০২৩ সালের বিভিন্ন সময়ের মধ্যে হয়েছে এসব অপারেশন।

পুলিশ জানিয়েছে, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সক্রিয় এই চক্র মধ্যবর্তী ব্যক্তি বা দালালদের মাধ্যমে দরিদ্র বাংলাদেশিদের অর্থের লোভ দেখিয়ে নয়াদিল্লির আশপাশের কিছু হাসপাতালে নিয়ে আসত। সেসব হাসপাতালে চক্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা বাংলাদেশিদের কিডনি অপসারণ করতেন।

দিল্লিতে একাধিক কিডনি পাচারকারী চক্র সক্রিয়। ডা. বিজয়া কুমারি যে চক্রটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন, সেই চক্রের অধিকাংশই বাংলাদেশি। গত মাসে নয়াদিল্লি থেকে এই চক্রের তিনজনকে গ্রেপ্তার করে দিল্লি পুলিশ। তাদের সবাই বাংলাদেশের নাগরিক।

বিশ্বের অধিকাংশ দেশের মতো ভারতেও অর্থের বিনিময়ে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রি করা নিষিদ্ধ এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তবে, কোনো ব্যক্তি যদি স্বেচ্ছায় কাউকে কিডনি বা অন্য কোনো প্রত্যঙ্গ প্রদান করতে চান, তাহলে তা বৈধ। এক্ষেত্রে দাতা ও গ্রহীতার নাম-পরিচয় ও অন্যান্য তথ্য কর্তৃপক্ষকে জমা দিতে হয়।

দিল্লি পুলিশ জানিয়েছে, চক্রটি কেবল বাংলাদেশ থেকে আসা ভিকটিমদের কিডনি অপারেশন করত এবং দিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনে এসব অপারেশন সংক্রান্ত বিভিন্ন ভুয়া নথি প্রদান করত। সেসব নথিও জব্দ করেছে পুলিশ।

ডা. বিজয়া কুমারি নয়াদিল্লির ইন্দ্রপ্রস্থ অ্যাপোলো হাসপাতালের একজন জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা এবং কিডনি প্রতিস্থাপন বিষয়ক সার্জন। প্রায় ১৫ বছর আগে জুনিয়র ডাক্তার হিসেবে ইন্দ্রপ্রস্থ অ্যাপোলোতে যোগ দেন তিনি।

অ্যাপোলোর পাশাপাশি নয়ডার ‘যথার্থ’ হাসপাতালের ভিজিটিং কনসালটেন্ট ও সার্জনও ছিলেন ডা. বিজয়া কুমার। ওই হাসপাতালের অতিরিক্ত মেডিকেল সুপারিটেন্ডেন্ট সুনীল বালিয়ান জানিয়েছেন, যেসব ব্যক্তির কিডনি তিনি অপসারণ করেছেন, তাদের কেউই ওই হাসপাতালের রোগী ছিলেন না। ভিজিটিং কনসালটেন্ট হিসেবে তিনি রোগী ভর্তির জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বরাবর সুপারিশ করতে পারতেন। যে ১৫-১৬ জন বাংলাদেশির কিডনি তিনি অপারেশন করেছেন, তাদের সবাইকে তার সুপারিশের ভিত্তিতেই ভর্তি করা হয়েছিল।

ডা. বিজয়া কুমারি ব্যতীত ইন্দ্রপ্রস্থ অ্যাপোলো হাসপাতালের আর কোনো চিকিৎসকের বিরুদ্ধে কিডনি পাচার চক্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এই চিকিৎসককে সাময়িক বরখাস্ত করেছে।

img

অর্থনীতির অন্ধকারে বাংলাদেশ: নির্বাচনের আলো কি শেষ আশার প্রদীপ?

প্রকাশিত :  ০৬:০১, ১৬ মার্চ ২০২৫
সর্বশেষ আপডেট: ০৬:০৬, ১৬ মার্চ ২০২৫

রেজুয়ান আহম্মেদ

বাংলাদেশ এক কঠিন সময় পার করছে। দেশের প্রধান শিল্পাঞ্চলগুলোতে তালা ঝুলছে, হাজার হাজার শ্রমিক কাজ হারিয়ে দিশেহারা, বিনিয়োগকারীরা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। অথচ রাজনৈতিক অস্থিরতার সুর ক্রমশ চড়া হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই অচলাবস্থা থেকে মুক্তির একমাত্র পথ হতে পারে একটি নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। কিন্তু সেই সুযোগ কি আদৌ আসবে?

গাজীপুরের টঙ্গী, কালিয়াকৈর কিংবা নারায়ণগঞ্জ—কয়েক বছর আগেও যেখানে শ্রমিকদের কর্মব্যস্ততায় মুখর ছিল, সেখানে আজ নীরবতা। গত এক বছরে শুধু গাজীপুরেই প্রায় ৩০০টি গার্মেন্টস ও শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। চাকরি হারিয়েছেন অন্তত ৫০,০০০ শ্রমিক।

অমিত (৩২), একজন সেলাই অপারেটর, কণ্ঠ ভারী করে বললেন, "কারখানা বন্ধ হওয়ার পর তিন বেলা খেতেও পারছি না। বাড়িঘর বিক্রি করেও ঋণ শোধ করতে পারিনি।"

শিল্প মালিকদের সংগঠন BGMEA জানিয়েছে, ক্রমাগত বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি, আমদানি জটিলতা ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে উদ্যোক্তারা নতুন বিনিয়োগ করতে ভয় পাচ্ছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক গার্মেন্টস মালিক বললেন, "ব্যাংকের ঋণের বোঝা বইতে পারছিলাম না, শেষমেশ কারখানা বিক্রি করতে বাধ্য হলাম।"

বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ ২০২২ সালে ছিল ৩.৫ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২৩ সালে কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১.২ বিলিয়নে। জাপান, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলো তাদের প্রকল্প স্থগিত করেছে।

একজন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধি বললেন, "বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও অবকাঠামো সংকট বিনিয়োগের জন্য বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।"

অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এই পরিস্থিতিকে "অর্থনৈতিক হার্ট অ্যাটাক" বলে বর্ণনা করে বলেন, "বিদেশি বিনিয়োগ ছাড়া শুধু রেমিট্যান্স ও গার্মেন্টস খাতের ওপর ভরসা রেখে অর্থনীতিকে সচল রাখা সম্ভব নয়।"

অর্থনৈতিক সংকটের পাশাপাশি সামাজিক অবক্ষয়ও বাড়ছে। গাজীপুরের বাসিন্দা রিনা আক্তার (৪০) বললেন, "আমার ছেলে স্কুলে যেতে ভয় পায়। মাসখানেক আগে ছিনতাইকারীরা ওর জুতো পর্যন্ত নিয়ে গেছে!"

পুলিশের পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৩ সালের প্রথম ছয় মাসে দেশে ছিনতাই ও চাঁদাবাজির হার বেড়েছে ৬৫%।

মনোবিজ্ঞানী ড. ফারহানা মোবিন বলেন, "যখন মানুষের সামনে বেঁচে থাকার উপায় কমে আসে, তখন তারা সহজ পথ খোঁজে। অনেকেই বাধ্য হয় অপরাধে জড়াতে।"

বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে সরকারের সংলাপ নেই, রাজনৈতিক মেরুকরণ চরমে পৌঁছেছে। আগামী জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে অনিশ্চয়তা আরও ঘনীভূত হয়েছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. তাসনিম সিদ্দিকী সতর্ক করে বলেছেন, "যদি অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন না হয়, তাহলে সরকারের বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে। আর অর্থনীতি আরও গভীর সংকটে পড়বে।"

আন্তর্জাতিক সংস্থা ডেমোক্রেসি ওয়াচ এক প্রতিবেদনে বলেছে, বাংলাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতা ও নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা উদ্বিগ্ন।

সম্ভাব্য সমাধান কী?

অর্থনীতিবিদদের মতে, সংকট কাটাতে এখনই তিনটি পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি:

 ১. নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা: সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন।

 ২. বিনিয়োগবান্ধব নীতি গ্রহণ: কর হ্রাস, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূরীকরণ এবং বিদ্যুৎ-গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিতকরণ।

 ৩. সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি সম্প্রসারণ: বেকারদের জন্য আর্থিক সহায়তা ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

গাজীপুরের বস্তিবাসী করিম মিয়া আক্ষেপ করে বললেন, "নেতারা যদি একদিন আমাদের মতো না খেয়ে থাকতেন, তাহলে বুঝতেন এই দুর্দশার অর্থ কী!"

বাংলাদেশের অর্থনীতি আজ গভীর সংকটে। রাজনৈতিক ঐক্য ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত ছাড়া এই অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে পাওয়া কঠিন। নইলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে আমরা ক্ষমার অযোগ্য হয়ে থাকব।

কবি রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, "অন্ধকারে আলো জ্বালো, যাত্রা শুরু করো আগামীর পথে।" এখন সেই আলো জ্বালানোর সময় এসেছে।


রেজুয়ান আহম্মেদ: লেখক, বিশ্লেষক; সম্পাদক অর্থনীতি ডটকম