প্রকাশিত :
২০:২৪, ০৭ আগষ্ট ২০২৪
ম. আমিনুল হক চুন্নু
শোকের মাস আগস্ট মাস। এই মাসে বাংলাদেশে সংগঠিত হয়েছে ইতিহাসের ভয়াবহতম হত্যাকান্ড ও নারকীয় গ্রেনেড হামলা। তাই ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস। মানব সভ্যতার ইতিহাসে ঘৃণাও নৃশংসতম হত্যাকান্ডের কালিমালিপ্ত বেদনাবিধুর শোকের দিন। ১৯৭৫ সালে এই দিনে মানবতার শত্রু প্রতিক্রিয়াশীল ঘাতকচক্রের হাতে বাঙালি জাতির মুক্তি আন্দোলনের মহানায়ক, বিশ্বের লাঞ্চিত- বঞ্চিত- নিপীড়িত মানুষের মহান নেতা,বাংলা ও বাঙালির হাজার বছরের আরাধ্য পুরুষ, বাঙালির চিরন্তন প্রেরণার চিরন্তন উৎস, স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির অহংকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়।
সেদিন ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম এই হত্যাকান্ডে বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী, মহীয়সী নারী বেগম ফজিলাতুন্নেছা, জ্যেষ্ঠ পুত্র মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন শেখ কামাল,দ্বিতীয় পুত্র বীর মুক্তিযোদ্ধা লেফটেন্যান্ট শেখ জামাল,কনিষ্ঠ পুত্র শিশু শেখ রাসেল, নবপরিণীতা পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল,মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক শেখ ফজলুল হক মণি ও তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী বেগম আরজু মনি, স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম সংগঠক ও বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি আব্দুর সেরনিয়াবাত,তাঁর ছোট মেয়ে বেবী সেরনিয়াবাত,কনিষ্ঠ পুত্র আরিফ সেরনিয়াবাত, দৌহিত্র সুকান্ত আবুল্লাহ বাবু, ভাইয়ের ছেলে শহীদ সেরনিয়াবাত, আব্দুল্লাহ নঈম খান রিন্টু, বঙ্গবন্ধুর প্রধান নিরাপত্তা অফিসার কর্ণেল জামিল উদ্দিন আহমেদ ও কর্তব্যরত অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী নৃশংসভাবে নিহত হন।
এই শোক যদিও বলা হয়,বাঙালি জাতির জন্য শক্তিতে পরিণত হয়েছে, তবু ১৫ আগস্ট এলে শোকের মাতম ওঠে জাতীয় জীবনে। বাঙালি জাতির পক্ষে এ শোক কখনো ভুলে থাকা সম্ভব নয় কোনোভাবেই। ১৫ আগস্টের ঘটনা বাঙালি জাতিকে ধারাপাতের হিসাবে ২২ বছর পিছিয়ে দিলেও চেতনাগতভাবে পিছিয়ে দিয়েছে এতটাই যে,আজও আমরা ১৫ আগস্টের সেই অভিঘাত বয়ে বেড়াচ্ছি এবং হয়তো অনাদিকাল বয়ে বেড়াতে হবে। কেননা এ শোক সান্ত্বনাহীন।
১৯৭৫ সালের ওই রাতে যে ঘটনা ঘটে গেছে, তা কেউ কখনো ভাবতে পারেনি। তবু কেন অবিশ্বাস্য এই ঘটনা ঘটে গেল? এ প্রশ্নের উত্তর আজও বাঙালিরা খুঁজে পায়নি। কোনো অংকই এ প্রশ্নের উত্তর মেলাতে পারে না আজও। মুক্তি দিতে পারে না জাতিকে তার জনক হারানোর কষ্ট থেকে উদগত বেদনাকেও। দেশ স্বাধীন হয়েছে মাত্র সাড়ে তিন বছরের মতো। নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে ক্ষত-বিক্ষত দেশ। একদিকে সেই ক্ষতের চিহ্ন। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ শেষে দেশ পুননির্মাণের আরেক কঠিন লড়াইয়ে নিমজ্জিত বঙ্গবন্ধু। তখন পর্যন্ত সব দেশের স্বীকৃতি মেলেনি। সব দেশ বাংলাদেশ পুনর্নির্মাণে তখন পর্যন্ত তাঁর পাশে নেই। সে পরিস্থিতিতেও স্বাধীন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। সেটাও আরেকটি রণক্ষেত্র। সুযোগ খুঁজছে অনকূল সময়ের। চারিদিকে অসন্তোষ। আত্মকলহ। অপপ্রচার। বৈরী বিদেশীরাও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। ওতপেতে আছে সবাই।
যারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রকৃত মিত্র ছিলেন, তাদের কেউ কেউ এই নির্মম হত্যাকান্ডের পর লিখলেন,- ‘‘ কাঁদো বাঙালি কাঁদো।‘’ কিন্তু বাঙালিরা আর কত জীবন কাঁদবে,কত রক্ত দেখবে, কত অশ্রু ঝড়াবে? বাঙালিরা মুক্তিযুদ্ধে রক্ত দিল, প্রিয়জন হারানোর বেদনায়, স্বজনের কান্নায় বাংলার পরিবেশ ভারী হয়ে উঠল। এখনো ১৫ আগস্টের দুঃস্বপ্ন সামনে এসে দাঁড়ালে বুকের কষ্টটা চেপে বসে। ১৫ আগস্টকে ভুলে থাকা বাঙালি জাতির পক্ষে কখনোই সম্ভব হবে না। যতদিন বাংলাদেশ এবং বাঙালি থাকবে, ততদিন বাঙালির বুকে ১৫ আগস্টের শোক চেপে থাকবে। বাঙালিকে শোক বয়ে বেড়াতে হবে৷ তবে ১৫ আগস্টের হত্যা,ষড়যন্ত্রই প্রথম বা শেষ নয়। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে থেকেই মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু হয। সেই ষড়যন্ত্র একটা রূপ নেয় ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর পরিবারের প্রায় সব সদস্যকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে। এরপর প্রায় ৪৯ বছর কেটে গেল, সেই ষড়যন্ত্র শেষ হলো না। এখনো চলছে।
তবে বিশেষভাবে বক্তব্য, ১৫ আগস্ট ১৯৭৫-এ ৬০ জন গভর্ণরের শপথ ও দায়িত্ব গ্রহণ উপলক্ষে সারাদেশের সর্বস্তরের আওয়ামী লীগরাই সশরীরে ঢাকায় উপস্থিত ছিলেন। অথচ সেই পৈশাচিক হত্যাকান্ডের পর কারও পক্ষ থেকে বিন্দুমাত্র প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ গড়ে তোলার তোলার চেষ্টা করা হয়নি। নিয়তির নির্মম পরিহাস হিসেবে খন্দকার মোস্তাকের নেতৃত্বাধীন নতুন সরকারে বঙ্গবন্ধুর বেশ কয়েকজন চির বিশ্বস্থ বন্ধু ও ডাইসাইটে মন্ত্রীও হাসিমুখে দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন।
নিম্নে বাস্তবের সাথে মিল রেখে বিষয়টি আলোচনা করতে চাই- তাহলো যীশু খ্রীষ্টের বারো জন শিষ্যদের মধ্যে যুদাস একজন। তার পরিচয় আমরা জানি। আবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দল আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যে মোশতাক একজন। তার পরিচয়ও আমরা জানি।
যে রাতে যীশুকে ধরিয়ে দেয়া হবে, তার আগে যুদাস ইহুদীদের বলেছিল, যেহেতু আমরা সকলেই দেখতে একই রকম। তোমাদের সামনে আমি যার গালে চুমু দিব, বুঝে নিও তিনিই যীশু। ঠিক এরকম চিত্র দেখি মোশতাকের বেলায়ও। আমরা দেখি এই মোশতাক মুজিবের গালে চুমু দিচ্ছে অর্থাৎ মোশতাক জানতো যুদাসের কথা। একদিন তার হাতেই মুজিবের পরিণতি হবে যীশু খ্রীস্টের মত। তারই বাস্তব নির্দশন রেখেছে সে।
যীশু খ্রীস্ট হলেন মানুষের আত্মিক মুক্তিদাতা এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালিকে রাজনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে পরিচালিত করেছিলেন। তো, যীশু খ্রীষ্ট এবং বঙ্গবন্ধু মুজিব দুজনই হয়েছিলেন রাজনৈতিক চক্রান্তের শিকার। তাঁদের উভয়কেই নির্মমভাবে জীবন দিতে হয়েছে। তাঁদের হত্যা করার জন্য যারা চূড়ান্তভাবে ষড়যন্ত্রের কুশীলব হিসেবে কাজ করেছে এবং সফল হয়েছে তারা যুদাস ও মোশতাক ইতিহাসে তারা ঘৃর্ণিত হয়ে আছে এবং মানবসভ্যতা যতদিন টিকে থাকবে, ততদিন মানুষ তাদের প্রতি ঘৃর্ণা প্রদর্শন ও ধিক্কার দিয়েই যাবে।
মোশতাকের চরিত্র জানতেন তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলামসহ আওয়ামী লীগের উচ্চ পর্যায়ের নেতারা। তাঁরা অনেক সময় মোশতাক সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুকে অবহিতও করেছেন। কিন্তু, বঙ্গবন্ধু সরল বিশ্বাসে এই মোশতাককেই তাঁর পাশে রেখেছেন। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলার প্রবাসী সরকার যখন ভারতে থেকে মুক্তিযুদ্ধকে সফলতার দিকে এগিয়ে নেয়ার প্রয়াসে ব্যস্ত, তখন মোশতাক ইয়াহিয়ার সাথে কনফেডারেশনে পৌঁছানোর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। এমন কি, জাতিসংঘে স্বাধীন বাংলাদেশ নয়, তথাকথিত পাকিস্তানের অখন্ডতা রক্ষার জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। অন্যদিকে, তাজউদ্দীনের নেতৃত্বাধীন স্বাধীন বাংলার প্রবাসী সরকারের বুদ্ধিমত্তায় এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরাগান্ধীর অকুন্ঠ সমর্থনে মোস্তাকের ষড়যন্ত্র ভেস্তে যায়।
১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হল, ভারতের অবস্থানকারী প্রবাসী সরকারের সকলে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। সে সময় মোশতাকও বাংলাদেশে আসে। একাত্তরের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন এবং কলকাতা হয়ে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় আসলে আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে) নিয়ে আসার সময় গাড়িবহরে বঙ্গবন্ধুর পাশে জিন্নাহ টুপি পরিহিত এই মোশতাককে দেখা যায়। বঙ্গবন্ধু তাঁর মন্ত্রীসভায় মোশতাককে বাণিজ্যমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন। এমনকি তিয়াত্তরে জাতীয় নির্বাচনে কুমিল্লা থেকে মোশতাককে জিতিয়ে আনার জন্য হেলিকপ্টারে ব্যালট পেপার ভর্তি ব্যালট বাক্স নিয়ে আসা হয়। অর্থাৎ মোশতাকের ষড়যন্ত্র তখন চূড়ান্ত পরিণতির পর্যায়ে এগিয়ে যায়।
ফারুক রশিদ গং তাদের কিলিং মিশন সফল করতে খন্দকার মোশতাককে বেছে নিয়েছিলেন। তারা মোশতাকের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত ছিল। এই মোশতাকই অবলীলায় হয়ে পড়ে তাদের হাতের পুতুল। মোশতাকের প্রতি অন্ধ স্নেহ-ভালবাসার মাশুল দিকে হয়েছে বঙ্গবন্ধুকে।
পনের আগস্ট বঙ্গবন্ধু তাঁর পরিবার পরিজনসহ মোট ১৮ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়৷ সেদিন বঙ্গবন্ধু তাঁকে এবং পরিবারকে রক্ষা করতে তৎকালীন সেনাপ্রধান শফিউল্লাহকে আহবান জানালেও শফিউল্লাহ এগিয়ে আসেননি। এমন কি রক্ষীবাহিনীও নিস্ক্রিয় ছিল।
বঙ্গবন্ধুকে দৈহিকভাবে হত্যা করা হলেও তাঁর মৃত্যু নেই। তিনি চিরঞ্জীব। কেননা একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা এবং স্থপতি তিনিই। যতদিন এ রাষ্ট্র থাকবে, ততদিন অমর তিনি। সমগ্র জাতিকে তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রেরণায় প্রস্তুত করেছিলেন ঔপনিবেশিক শাসক- শোষক পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে। তাই চিরঞ্জীব তিনি এ জাতির চেতনায়৷ বঙ্গবন্ধু কেবল একজন ব্যক্তি নন, এক মহান আদর্শের নাম। তাইতো,এক অজপাড়াগাঁ থেকে উঠে এসে ক্রমেই তিনি সাতকোটি বাঙালির আশা-আকাঙ্কার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিলেন। রাজনীতি যদি মানুষের জন্য হয়, বঙ্গবন্ধু সারাজীবন সেই মানুষের রাজনীতি করেছেন। জীবনের ১৪টি বছর কারাগারের অন্ধপ্রকোষ্ঠে কাটিয়েছেন। বাংলার মানুষের অধিকারের প্রশ্নে কখনও আপস করেননি। বঙ্গবন্ধু কখনও বিশ্বাস করতেন না যে, কোনো বাঙালি তাঁকে হত্যা করবে।
দেশের রাজনীতিতে এমন দুর্বৃত্তায়ন চলতে পারে না। মুক্তিযুদ্ধের মূল নীতিকে সমুন্নত করতে হবে। বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি দর্শন ও চেতনাকে লালন করতে হবে। এই দর্শন ও চেতনা হলো সাম্য। মানবিক মর্যাদা আর ন্যায় বিচারের মাধ্যমে শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা। রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন এবং পশ্চিমাদের, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের অনানুষ্ঠানিক আগ্রাসনে দেশ বিপদাপন্ন। রাজনীতিকে রাহুমুক্ত ও আগ্রাসন প্রতিরোধ করতে হলে সব অভিমান, ক্ষোভ ভুলে মুক্তিযুদ্ধের সব পক্ষকে এগিয়ে আসতে হবে। সৃষ্টি করতে হবে একাত্তরের মতো ইস্পাত কঠিন ঐক্য ও সংহতি।
১৫ আগস্ট কেবল বঙ্গবন্ধু হত্যার সাথে আঘাত করা হয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ওপর। মোশতাক ও ফারুক- রশিদ-ডালিম খুনিচক্রের লক্ষ্য শুধু বঙ্গবন্ধুসহ তাঁর পরিবারকে নিশ্চিহ্ন করাই ছিল না, ছিল মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত বাংলাদেশকে ধ্বংস করে দেওয়া৷ ১৫ আগস্টের পরস্পরায় একই ৭৫ এর ৩ নভেম্বর ঢাকার কেন্দ্রীয় কারা অভ্যন্তরে হত্যা করা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ এবং আস্থাভাজন রাজনৈতিক সহচর চার জাতীয় নেতাকে।
এ সমস্ত হত্যাকান্ড বাঙালির ইতিহাসে যোগ করেছে এক কালো অধ্যায়। এখান থেকে বাঙালিও বাংলাদেশে আর কোনদিন গ্লানিমুক্ত হতে পারবে না।
এ কথা স্বাধীকার করতেই হবে, পচাত্তরের পনের আগস্টের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ফসল এখনকার বাংলাদেশ। সে সময় খন্দকার মোশতাকের ষড়যন্ত্রের মাশুল দিচ্ছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের জনগণ! আগামী প্রজন্ম এবং ভবিষ্যৎ ও দিয়ে যাবে।
প্রয়াত শিক্ষাবিদ, কবি, লেখক ডক্টর আবু হেনা মোস্তফা কামাল তাঁর ‘‘মৃত্যুকে জয় করেছেন‘’- শীর্ষক লেখায় বলেছেন, - ‘‘যীশু নিহত হয়েছিলেন। এখন কোটি কোটি মানুষ ক্রস ধারণ করে তাঁকে স্মরণ করে মুজিবও একদিন তাই হবেন৷‘’
১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে আলজিয়ার্সে জোটনিরপেক্ষ (ন্যাম) সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর সাথে সাক্ষাতের পর কিউবার প্রেসিডেন্ট ফিডেল ক্যাস্ট্রে মন্তব্য করেছিলেন,- ‘‘আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি। তাঁর ব্যক্তিত্ব ও সাহসিকতা হিমালয়ের মত। তাঁকে দেখার পর সে রকম অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে।‘’
তবে চেতনার আলোকে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল, সেই চেতনার পতাকাকে সমুন্নত রাখার দায়িত্ব আমাদেরকে নিতে হবে। জাতির যেকোন ক্রান্তিলগ্নে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রতিটি নেতাকর্মী ও দেশপ্রেমে উদ্দীপ্ত প্রতিটি নাগরিক মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের গৌরবদীপ্ত অতীতের ধারাবাহিকতায় নিজেদেরকে এগিয়ে নিতে হবে এবং যতদিন মানুষের হৃদয়ে স্পন্দন থাকবে, বিশ্বের বুকে বাংলাদেশও বাঙালি থাকবে- হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি,স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা, ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম ততদিন শ্রদ্ধাভরে উচ্চারিত হবে।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পুরো রাজনৈতিক ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সাফল্য ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদান। সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা জাতির জনককে রক্ষা করতে না পারা এবং হত্যাকান্ডের খবর শুনে প্রতিবাদ, প্রতিরোধে দেশকে উত্তাল না করা। জীবনের ঝুঁকি জাতীয় নেতৃত্বের কেউ নিলে সারা দেশকে উত্তাল করতে পারত। ১০ হাজার লোক নিয়ে ঢাকায় মিছিল করার সক্ষমতা ছিল। একটু কিছু শুরু করলে তা ছড়িয়ে পড়ত সারা দেশে। প্রতিবাদী জনতার কতজনকে খুনিরা শেষ করতে পারত? সেদিনের সিদ্ধান্তহীনতা, ব্যর্থতার ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়েই আওয়ামী লীগকে আগামীর পথে চলতে হবে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কয়েকটি কবিতার লাইন দিয়ে শেষ করতে চাই,- ‘‘..... রেখেছ বাঙালি ক\'রে মানুষ করনি\' প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন,...... ‘’কবি তুমি দেখে যাও বাঙালি মানুষ হয়েছে।’’ বিশ্বের দরবারে বঙ্গবন্ধু বাংলা ও বাঙালিকে সম্মানিত করেছেন। মাথা উচুঁ করে দাঁড়াবার সাহস দেখিয়েছেন, সেই সাহস ও তিনি জুগিয়েছেন। সবশেষে তাঁর নিজের প্রাণ দিয়ে তিনি বাংলা ও বাঙালির প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার প্রমাণ দিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে হত্যার গ্লানি এবং তাঁর পবিত্র রক্তের দায় বাঙালিকে চিরদিন বহন করে যেতেই হবে।
এ বিশ্বে বাংলাদেশ, বাঙালি ও বাংলা ভাষা যতদিন থাকবে, ততদিন উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে থাকবেন বাংলাদেশের স্থপতি, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের, ভাষা আন্দোলনের এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক হিসেবেই তিনি স্মরণীয়,বরণীয় হয়ে থাকবেন বাংলাদেশের ও বিশ্বের মানুষের মননে। জাতীয় শোক দিবসে সর্বস্তরের বাঙালির সঙ্গে আমরাও গভীরভাবে শোকাহত। ১৫ আগস্ট ও পরবর্তী সময়ে জেল হত্যাকান্ডসহ নানা অনাকাঙ্ক্ষিত হত্যাকান্ডে নিহতদের আত্মার শান্তি কামনা করি।
তাই দেশপ্রেমিক সব শক্তিকে উক্ত ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সদা সর্বদা সজাগ থাকতে হবে। স্বাধীনতার শত্রুরা যেন আর কোনো সুযোগ না পায়। বাঙালি জাতি আর যেন কোনো ষড়যন্ত্রের শিকার না হয়।
লেখকঃ শিক্ষাবিদ, গবেষক, কলামলেখক ও সমাজবিজ্ঞানী, প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ নুরজাহান মেমোরিয়াল মহিলা ডিগ্রি কলেজ, সিলেট। পিএইচডি (ফেলো)।