করিম চাচার মর্যাদার লড়াই
রেজুয়ান আহম্মেদ
করিম চাচার জীবন এক বিশাল ব্যঙ্গাত্মক সাহিত্যেই যেন আবদ্ধ ছিল। তার লেখার মধ্যে এত জীবন, এত গভীরতা, এমনকি এত হাস্যরস ছিল যে, পাঠকরা প্রায়ই ভেবে বসতেন, "এ তো সত্যিই জীবনের গল্প, করিম চাচার জীবনের গল্প!" কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, যতই তার লেখাগুলো পাঠকদের মন জয় করুক না কেন, সাহিত্যের মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কারের দৃষ্টিতে করিম চাচা যেন এক অদৃশ্য সত্তা ছিলেন।
করিম চাচার বাড়িতে বইয়ের স্তূপ দেখে যে কেউ মনে করত, "এ তো নিশ্চয়ই কোনো পুরস্কৃত লেখকের সংগ্রহ।" অথচ সেই বইগুলোর প্রতিটি পৃষ্ঠা যেন করিম চাচার বেদনার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছিল, যেখানে তার প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য, স্বীকৃতির জন্য আর্তনাদ করত।
একদিন করিম চাচার মনের কষ্ট এতটাই বৃদ্ধি পেল যে তিনি তার ছেলেমেয়েদের কাছে দুটি অনুরোধ করলেন। প্রথমত, তিনি জীবিত অবস্থায় মরণোত্তর পুরস্কার গ্রহণ করতে চান। দ্বিতীয়ত, তিনি জীবিত থাকাকালীনই তার মৃত্যুদিবস পালন করতে চান। কারণ করিম চাচার মতে, মৃত্যুর পর পুরস্কার পাওয়ার কোনো মানে নেই, যখন তিনি তার স্বীকৃতি দেখে যেতে পারবেন না, তখন তা মূল্যহীন।
করিম চাচার এই অদ্ভুত অনুরোধ শুনে তার ছেলেমেয়েরা ভীষণভাবে অবাক হয়ে গেল। তারা বুঝতে পারল যে করিম চাচার অবজ্ঞা সাহিত্যের জগতে তার প্রতি অবিচার করেছে, আর সে কারণেই হয়তো তার এই অদ্ভুত আবদার।
করিম চাচার ছেলে রফিক প্রথমে কিছুটা কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করল, "বাবা, জীবিত অবস্থায় মরণোত্তর পুরস্কার কীভাবে পাওয়া যায়?"
করিম চাচা তার চিন্তিত মুখে একগাল হাসি মিশিয়ে বললেন, "তোমরা যা বলছো, তা এক ধরনের ছেলেমানুষি। কিন্তু আমি কী বলতে চাচ্ছি, তা তোমরা বোঝোনি। যখন আমার মতো লেখক জীবিত থাকতেই সম্মান, স্বীকৃতি না পায়, তখন মরণোত্তর পুরস্কারের কোনো মূল্য থাকে না। আমি মরার পর কিছুই দেখতে পারব না, আর তাই জীবিত থাকতেই সবকিছু চাই।"
রফিক হাসতে হাসতে বলল, "তাহলে বাবার মৃত্যুদিবস কবে ঠিক করা হবে?"
করিম চাচা কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, "ধরো, আগামীকাল। কাল থেকেই আমার মৃত্যুদিবস পালন করবে। কিছু অতিথি ডাকবে, কিছু স্মরণসভা করবে, আর শেষে আমার জীবনের ওপর আলোচনা করবে। তবে আমি যেন জীবিত থাকাকালীনই শুনতে পাই কীভাবে তোমরা আমার স্মৃতি সংরক্ষণ করছো।"
পরের দিন করিম চাচার বাসায় শুরু হলো উৎসবমুখর পরিবেশ। চারদিকে সাজসজ্জা, অতিথিদের আগমন, আর করিম চাচার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের পরিকল্পনা।
করিম চাচা সবকিছু দেখছেন আর মন থেকে হাসছেন। এটা ছিল এক ধরনের বিদ্রূপ—একজন জীবিত মানুষের মৃত্যুদিবস পালন করার জন্য।
সন্ধ্যা নামতেই করিম চাচা নিজের জন্য একটি চেয়ার ঠিক করে বসলেন এবং তার চারপাশে ছেলেমেয়েরা, আত্মীয়স্বজন, এমনকি কিছু পাঠকও বসে গেল। একে একে সবাই তার জীবনের ওপর বক্তব্য দিতে শুরু করল। সবাই এমনভাবে কথা বলছিল যেন করিম চাচা আসলেই মারা গেছেন। করিম চাচা সবকিছু শুনে হাসতে হাসতে বললেন, "আরে, আমি তো এখানেই আছি। তোমরা কি সত্যিই মনে করো যে আমি আর বেঁচে নেই?"
কেউ একজন মজা করে বলল, "করিম চাচা, আপনি তো আজকেই মারা গেছেন, তাই আমরা আপনার স্মরণসভা করছি।"
সবাই হেসে উঠল। কিন্তু করিম চাচা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, "সত্যিই, আমার লেখাগুলো হয়তো পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান কাজগুলোর মধ্যে একটি। তবে কোনো পুরস্কার না পাওয়া মানে আমার লেখাগুলোর স্বীকৃতি নেই। তাই আমি ভাবলাম, মরণোত্তর পুরস্কার আর মৃত্যুদিবস যেন জীবিত থাকতেই পালন করা যায়। কারণ মৃত্যুর পরে সেসবের কোনো মানেই থাকে না।"
সেদিনের সেই মজার, বিদ্রূপাত্মক স্মরণসভা শেষে করিম চাচা আর একবার নিজের লেখার দিকে তাকালেন। তার প্রতিটি শব্দ যেন তার হৃদয়ের গভীর কষ্টের প্রতিফলন হয়েছিল। যদিও তিনি জীবনের শেষ পর্যন্ত কোনো পুরস্কার পাননি, তবে তার হাসির গল্পগুলো আর তার মৃত্যু দিবসের সেই স্মরণসভা যেন সাহিত্যের ইতিহাসে এক নতুন রসিকতার জন্ম দিল।
এভাবেই করিম চাচা একটি ব্যঙ্গাত্মক হাস্যরসাত্মক চরিত্রে পরিণত হয়ে রইলেন, যার জীবনের সবচেয়ে বড় চাওয়া ছিল জীবিত অবস্থায় তার কাজের স্বীকৃতি। আর সেই স্বীকৃতির অভাবে তার জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত যেন এক গভীর বেদনাবিধুর হাসির গল্পে পরিণত হলো।