শেয়ার বাজারে গেইমলারদের কৌশল: একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র -রেজুয়ান আহম্মেদ
বাংলাদেশের শেয়ার বাজারে বিনিয়োগকারীদের বিভিন্ন স্তরের মধ্যে বিশেষ একদল গেইমলার রয়েছে, যারা নানা ধরনের কৌশল ও প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাজারে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করে থাকে। এই গেইমলাররা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য বিপদজনক হয়ে উঠতে পারে, কারণ তারা বাজারকে নিজেদের ইচ্ছামত প্রভাবিত করতে সক্ষম। এখানে আলোচনা করা হবে কিভাবে এই গেইমলাররা শেয়ার বাজারে গেম সাজায় এবং তার প্রভাব কী হতে পারে।
১. গেইম শুরু: গুজব ছড়ানো
গেইমলারের প্রথম কৌশল হলো বাজারে গুজব ছড়ানো। তারা বিশেষ কিছু কোম্পানির শেয়ারের মূল্য বাড়ানো বা কমানোর জন্য বিভিন্ন ধরনের ভিত্তিহীন তথ্য ছড়ায়। যেমন, কোনো কোম্পানির নতুন চুক্তি সম্পাদনের খবর, কোম্পানির শেয়ার মূল্য হঠাৎ বেড়ে যাওয়া, অথবা কোম্পানির শেয়ার বিভক্তির ঘোষণা ইত্যাদি নিয়ে মিথ্যা গুজব ছড়ানো হয়। এই গুজবের মাধ্যমে গেইমলাররা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক বা লোভ সৃষ্টি করে, যা তাদের বিনিয়োগের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে।
২. প্রাইস ম্যানিপুলেশন: কৃত্রিম চাহিদা সৃষ্টি
গেইমলারের দ্বিতীয় প্রধান কৌশল হলো প্রাইস ম্যানিপুলেশন, যা তাদের সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র। তারা নিজেদের নিয়ন্ত্রিত একাধিক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে একযোগে নির্দিষ্ট শেয়ার কিনে, যার ফলে সেই শেয়ারের চাহিদা কৃত্রিমভাবে বেড়ে যায়। সাধারণ বিনিয়োগকারীরা এই মূল্য বৃদ্ধিকে সত্যি ভেবে আরও শেয়ার কিনতে শুরু করে, যা বাজারে শেয়ারের মূল্য আরও বৃদ্ধি পায়। এরপর যখন মূল্য তাদের নির্ধারিত লক্ষ্যে পৌঁছে যায়, তখন গেইমলাররা হঠাৎ করে সেই শেয়ার বিক্রি করে দেয়, যা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য বিশাল লোকসান তৈরি করে।
৩. ইনসাইডার ট্রেডিং: অভ্যন্তরীণ তথ্যের অপব্যবহার
গেইমলারেরা অনেক সময় ইনসাইডার ট্রেডিং-এর মাধ্যমে তাদের গেইম সাজায়। এই প্রক্রিয়ায় তারা কোম্পানির অভ্যন্তরীণ তথ্য, যেমন আর্থিক বিবৃতি, ব্যবসায়িক পরিকল্পনা, বা বড় ধরনের চুক্তির খবর আগে থেকেই পেয়ে যায়। এই তথ্যের ভিত্তিতে তারা আগে থেকেই শেয়ার কেনাবেচা করে, যার ফলে তারা অধিক মুনাফা অর্জন করতে সক্ষম হয়, এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীরা প্রতারিত হয়।
৪. পাম্প অ্যান্ড ডাম্প কৌশল
গেইমলারদের মধ্যে বহুল প্রচলিত আরেকটি কৌশল হলো পাম্প অ্যান্ড ডাম্প। তারা প্রথমে বিভিন্ন ফোরাম, সোশ্যাল মিডিয়া এবং গোপন চক্রের মাধ্যমে একটি শেয়ারকে ‘হট’ শেয়ার হিসেবে প্রচার করে। এতে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা সেই শেয়ার কিনতে শুরু করে। শেয়ারের দাম উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেলে, গেইমলাররা তাদের সংগ্রহ করা শেয়ার বিক্রি করে দেয়। এর ফলে শেয়ারের দাম হঠাৎ করেই পড়ে যায় এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীরা বড় ধরনের লোকসানের সম্মুখীন হয়।
৫. কার্টেল গঠন: সমন্বিত গেইম
কিছু গেইমলার একত্রে একটি কার্টেল তৈরি করে। এই কার্টেল বিভিন্ন স্টকের উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। তারা সমন্বিতভাবে বাজারে একটি নির্দিষ্ট শেয়ারের উপর আক্রমণ চালায় এবং নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করে গেইম চালায়। তারা কখন সেই শেয়ার কিনবে এবং কখন বিক্রি করবে তা আগে থেকেই পরিকল্পনা করে, যার ফলে শেয়ারের মূল্য প্রভাবিত হয় এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীরা বিভ্রান্ত হয়।
৬. সাধারণ বিনিয়োগকারীদের প্রভাব
গেইমলারদের এই কৌশলগুলো সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য মারাত্মক হতে পারে। তারা বাজারের প্রকৃত চিত্র বুঝতে না পেরে গুজব, গেইমলারদের প্রচারণা, এবং শেয়ারের আকস্মিক মূল্য পরিবর্তনের ফাঁদে পা দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অনেক সময় তারা নিজেদের সমস্ত সঞ্চয় হারিয়ে ফেলে এবং আর্থিক সংকটে পড়ে যায়।
৭. নিয়ন্ত্রক সংস্থার ভূমিকা
গেইমলারদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে নিয়ন্ত্রক সংস্থার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (BSEC) এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত গেইমলারদের চিহ্নিত করা এবং তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া। পাশাপাশি সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য বাজারে সতর্কতা অবলম্বনের নির্দেশনা দেওয়া উচিত যাতে তারা এই ধরনের গেইমলারদের কৌশলের শিকার না হন।
শেয়ার বাজারে গেইমলারদের ক্রিয়াকলাপ শুধুমাত্র সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য নয়, দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির জন্যও হুমকিস্বরূপ। এই ধরনের প্রভাব থেকে বাজারকে রক্ষা করতে হলে শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা প্রয়োজন, যা গেইমলারদের কার্যক্রমকে নিরীক্ষণ করবে এবং প্রয়োজনে কঠোর ব্যবস্থা নেবে। সাধারণ বিনিয়োগকারীদেরও বাজার সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং সঠিক তথ্যের ভিত্তিতে বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি, যাতে তারা গেইমলারদের ফাঁদে না পড়ে।