স্বপ্নের সিঁড়ি -রেজুয়ান আহম্মেদ
মহসিনের চোখে এখনও মায়ের কাঁদা মুখ ভাসছে। গ্রামের মেঠো পথে, মায়ের আঁচল ধরে শেষ বিদায় নিতে নিতে বলেছিল, \"মা, তুই চিন্তা করিস না। আমি টাকা পাঠাবো, তুই শুধু ভালো থাকিস।\" এরপরে মহসিনের কাঁধে ঝুলেছে তার জীবনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ, আর সেই চ্যালেঞ্জের নাম দুবাই।
দুবাইয়ের উজ্জ্বল আলোর নিচে দাঁড়িয়ে মহসিনের মনে হলো, এখানকার আলোয় যেন তার নিজের জীবনটা অন্ধকার হয়ে গেছে। এ দেশ যে এত দূরত্বের, তা হয়তো তার আগে জানা ছিল না। শহরের আধুনিক দৃষ্টিনন্দন ভবনগুলো, মরুভূমির মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল বিশাল কাচের গায়ে সোনালী আলো, সব কিছুই যেন স্বপ্নের মতো। কিন্তু সেই স্বপ্ন দ্রুত কষ্টের বাস্তবতায় পরিণত হলো।
প্রথম কিছু দিন মহসিনের সবকিছুই নতুন লাগছিল। মরুভূমির বুকে গড়ে ওঠা উঁচু উঁচু ভবন, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের মুখাবয়ব, এক নতুন জগৎ। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এই জগৎ তার জন্য দুঃস্বপ্নের মতো হয়ে উঠলো। কাজের জায়গার কঠোর পরিশ্রম, মালিকের কড়া শাসন, এবং দৈনিক জীবনযাপনের মানসিক চাপ—সব কিছু একত্রে তার জীবনকে একেবারেই ভেঙে ফেলছিল।
মহসিনের কাজ ছিল গড়ে ওঠা প্রাসাদসম ভবনের নির্মাণশ্রমিক। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত অবধি তার কাজ চলত, আর এই কাজে ব্যবহৃত সামগ্রী আর যন্ত্রপাতির ভারে তার শরীর কখনও কখনও ভেঙে পড়তো। বাড়ি থেকে আসা ফোনকলগুলো ধীরে ধীরে বিরল হয়ে গেল, মা আর বোনের সঙ্গে কথা বলাও কমে গেল। দিন গুলো কাটতে থাকলো একঘেয়ে পরিশ্রম আর একাকীত্বে।
মহসিন ভেবেছিল, কিছু টাকা জমিয়ে দেশে ফিরে একদিন নিজের মতো করে বাঁচবে। কিন্তু প্রতিদিনের খরচ, ঋণের বোঝা আর পরিবারের চাহিদা তাকে দিন দিন আরও ভারাক্রান্ত করে তুলল। তার স্বপ্নের সিঁড়ি যেন দিন দিন আরো তীব্র হয়ে উঠছিল, আর প্রতিটি ধাপ তাকে আরও গভীর কষ্টের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল।
কখনও কখনও রাতে, যখন শহরের আলো নিভে যায়, মহসিন একা বসে ভাবতো—এই বিশাল শহরে থেকেও সে যেন একেবারেই একা। তার কষ্টের মধ্যে বিরামহীন ভাবে আবেগে ভেসে চলত তার দেশের কথা, মায়ের মুখ, বোনের হাসি, আর বাবা-মায়ের অসুস্থতা। এই চিন্তা তাকে ধীরে ধীরে গ্রাস করছিল, অথচ তার সংগ্রামের দিনগুলোও চলছিল।
তবুও, প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে কাজে যাওয়া মহসিনের একমাত্র রুটিন ছিল। প্রতিটি দিনের পরিশ্রম তাকে নতুন কিছু শেখাতো, নতুন কিছু ভাবতে বাধ্য করতো। তার মায়ের কথা, বোনের বিয়ের চিন্তা, বাবার অসুস্থতা—এসব চিন্তা তাকে চালিয়ে নিতে সহায়তা করছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন, তার কঠোর পরিশ্রম একদিন সফলতা এনে দেবে।
একদিন, মাসের শেষে, মহসিন একটি বড় অঙ্কের টাকা পাঠানোর পর মা ফোনে তাকে বললো, \"তোর টাকায় এবার বোনের বিয়ে ভালোভাবে দিতে পারবো। তোর জন্য আমরা গর্বিত।\" এই কথাগুলো শুনে মহসিনের চোখে পানি চলে আসে। তার কষ্টের মধ্যে এক টুকরো সুখ খুঁজে পায় যখন সে বুঝতে পারে, তার পরিশ্রম, ত্যাগ, আর কষ্ট সবই তার পরিবারের ভালো থাকার জন্য।
দুবাইয়ের এই অন্ধকারেও, মহসিনের স্বপ্নের সিঁড়ি ধীরে ধীরে উজ্জ্বল হতে শুরু করলো। তার কঠোর পরিশ্রম ও আত্মত্যাগের মাধ্যমেই তার পরিবারের জীবন কিছুটা ভালো হল। তার জীবন যে যতটা কঠিন, ততটাই তা পূর্ণ ও প্রাপ্তির। দুবাইয়ের আলো আর অন্ধকার, সব কিছু মিলিয়ে, মহসিনের জীবন এখন এক অভূতপূর্ব সংগ্রামের কাহিনী।
মহসিন জানে, তার স্বপ্নের সিঁড়ি এখনও চলমান। প্রতিটি ধাপ তার জীবনের নতুন চ্যালেঞ্জ, আর প্রতিটি চ্যালেঞ্জ তাকে আরও শক্তিশালী করে তুলছে। একদিন তার জীবন ফিরে আসবে এক নতুন রূপে, যেখানে সব কষ্টের পরিমান শুধু একটি স্মৃতি হয়ে থাকবে।