বাংলাদেশের গার্মেন্টস খাতের ভবিষ্যৎ: জিএসপি নিষেধাজ্ঞা উঠানোর পর নতুন সম্ভাবনার দুয়ার
রেজুয়ান আহম্মেদ
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র সরকার বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হওয়া পণ্যের ওপর যে জেনারালাইজড সিস্টেম অফ প্রেফারেন্সেস (জিএসপি) সুবিধার নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল, তা অবশেষে উঠিয়ে দিয়েছে। এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের তৈরি পোশাক (গার্মেন্টস) খাতের জন্য অত্যন্ত ইতিবাচক এবং তা ভবিষ্যতের জন্য নতুন সম্ভাবনার দুয়ার উন্মোচন করবে।
জিএসপি নিষেধাজ্ঞা: পটভূমি ও প্রভাব
২০১৩ সালের রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে জিএসপি সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে। যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্তের মূল কারণ ছিল বাংলাদেশে কর্মপরিবেশ এবং শ্রমিকদের অধিকার সম্পর্কে উদ্বেগ। এই নিষেধাজ্ঞার কারণে কিছু পণ্য আমেরিকায় শুল্কমুক্ত সুবিধা হারায়, যদিও গার্মেন্টস পণ্য সরাসরি এই তালিকার অন্তর্ভুক্ত ছিল না। তারপরও এর ফলে আমেরিকান বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকদের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে।
নিষেধাজ্ঞা উঠানোর প্রভাব
জিএসপি নিষেধাজ্ঞা উঠানোর ফলে, বাংলাদেশের গার্মেন্টস পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধা ফিরে আসছে। এতে গার্মেন্টস পণ্য আবারও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রতিযোগিতামূলক দামে পৌঁছানো সম্ভব হবে, যা বাংলাদেশি রপ্তানিকারকদের জন্য একটি বড় সুবিধা। এখন এই খাতের সামগ্রিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পের প্রবৃদ্ধির ধারা
বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম গার্মেন্টস রপ্তানিকারক দেশ। দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশেরও বেশি আসে গার্মেন্টস থেকে। গত এক দশকে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও এই খাত উল্লেখযোগ্যভাবে প্রবৃদ্ধি লাভ করেছে। ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার মতো বাজারে বাংলাদেশি পোশাকের চাহিদা দিন দিন বেড়েছে।
জিএসপি নিষেধাজ্ঞা উঠানোর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রপ্তানির পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাবে। এতে বাংলাদেশি গার্মেন্টস কোম্পানিগুলো নতুন বিনিয়োগ এবং কারখানার সম্প্রসারণের পরিকল্পনা করবে। নতুন কাজের সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আরো ত্বরান্বিত হবে।
প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকার সুযোগ
বর্তমানে বাংলাদেশ ভারত, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া এবং অন্যান্য গার্মেন্টস রপ্তানিকারক দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতার মুখোমুখি। জিএসপি সুবিধা ফিরে পাওয়ার ফলে বাংলাদেশি গার্মেন্টস পণ্যগুলোর প্রতিযোগিতা সক্ষমতা অনেকগুণ বৃদ্ধি পাবে। শুল্কমুক্ত সুবিধার ফলে মার্কিন ক্রেতারা বাংলাদেশি পণ্যের প্রতি আরও আগ্রহী হবেন, কারণ সাশ্রয়ী মূল্যে ভালো মানের পণ্য পেতে তাঁরা সবসময় আগ্রহী।
ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ
যদিও জিএসপি সুবিধা ফিরে পাওয়া একটি বড় অর্জন, তবুও গার্মেন্টস শিল্পের ভবিষ্যতকে টেকসই করতে হলে কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা প্রয়োজন। প্রথমত, কারখানাগুলোর মধ্যে নিরাপত্তা এবং শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষার বিষয়ে আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখতে হবে। আন্তর্জাতিক বাজারে টিকে থাকতে হলে কর্মপরিবেশ এবং উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, পরিবেশগত স্থায়িত্ব বজায় রাখতে হবে। বাংলাদেশি গার্মেন্টস কোম্পানিগুলোকে পরিবেশবান্ধব উৎপাদন প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করতে হবে। এতে তারা পরিবেশগত চাহিদা পূরণ করে আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হবে।
নতুন সম্ভাবনা ও উদ্যোগ
জিএসপি সুবিধা ফিরে পাওয়ার পাশাপাশি নতুন বাজার খোঁজার উপরও জোর দিতে হবে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের বাইরে অন্যান্য বড় বাজার, যেমন চীন, জাপান এবং মধ্যপ্রাচ্যের বাজারে প্রবেশের সুযোগ বাড়াতে হবে। এ ছাড়া, প্রযুক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধি এবং নতুন উদ্ভাবনী ডিজাইন নিয়ে আসতে হবে যাতে বাংলাদেশি পোশাকগুলো আরও আকর্ষণীয় হয়।
সার্বিক মূল্যায়ন
জিএসপি সুবিধা ফিরে পাওয়া বাংলাদেশের গার্মেন্টস খাতের জন্য এক সুবর্ণ সুযোগ এনে দেবে। তবে, এই সুবিধা পূর্ণাঙ্গভাবে কাজে লাগাতে হলে শিল্পের অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জগুলোর সমাধান করতে হবে। কারখানাগুলোর কার্যক্রমের গুণগত মান উন্নত করতে হবে, উৎপাদন ব্যয় হ্রাস করতে হবে এবং সর্বোপরি শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
নতুন মার্কেট, নতুন প্রযুক্তি, এবং টেকসই উৎপাদনের দিকে মনোনিবেশ করে বাংলাদেশ যদি তার গার্মেন্টস খাতকে আন্তর্জাতিক মানে নিয়ে যেতে পারে, তাহলে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশ অদূর ভবিষ্যতে আরো শক্তিশালী অবস্থান দখল করবে।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য গার্মেন্টস খাতের গুরুত্ব অপরিসীম। জিএসপি সুবিধার পুনঃপ্রাপ্তির মাধ্যমে এই খাত নতুন গতিতে অগ্রসর হবে এবং দেশের আর্থিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করবে।