img

করিম চাচার খোলা চিঠি: হর্নের শব্দে ম্লান আমার শেষ বেলার শান্তি!

প্রকাশিত :  ১৩:০১, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪
সর্বশেষ আপডেট: ১৩:৩২, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪

করিম চাচার খোলা চিঠি: হর্নের শব্দে ম্লান আমার শেষ বেলার শান্তি!

আমার নাম করিম উদ্দিন। বয়স এখন ৮০ ছুই ছুই। শরীরটা আর আগের মতো নেই। হাত-পায়ের জোর আগের চেয়ে কমে গেছে। চোখের দৃষ্টি ঝাপসা, কানেও ঠিকমতো শুনতে পাই না। তবুও, আমার জীবনটা ভালোই চলে যাচ্ছিল। গ্রামের ছোট্ট বাড়ি, একটু জায়গা জমি, চারপাশে গাছগাছালি—এই নিয়েই আমি থাকি। এ বয়সে এসে মানুষের চাওয়ার আর কী থাকতে পারে? শান্তি। হ্যাঁ, শান্তি-ই তো চেয়েছিলাম। কিন্তু, এ দেশে শান্তিতে মরতে পারবো কিনা সেটা নিয়ে বড় সন্দেহ!

ছেলেমেয়ে বড় হয়েছে, তারা এখন শহরে থাকে। কেউ কেউ বিদেশেও থাকে। ওদের সঙ্গে যখন ফোনে কথা হয়, একটাই বিষয় ওরা বারবার বলে—বিদেশে নাকি কেউ রাস্তায় হর্ন বাজায় না। রাস্তায় গাড়ি চলে, কিন্তু সেই গাড়ি যেন শব্দহীন। ওদের কথা শুনে মনে হয়, বিদেশ মানেই যেন এক স্বর্গ! আমি তো জানি না, ওই স্বর্গের আসল চিত্র কেমন। তবে আমার এই ছোট্ট গ্রামে শান্তির ন্যূনতম টুকুও নেই।

গ্রামের রাস্তায় এখন প্রচুর গাড়ি চলে। একটু আগেও যেখানে কাঁঠাল গাছের ছায়ায় বসে বিশ্রাম নিতাম, এখন সেখানে বড় বড় বাস, ট্রাক, প্রাইভেট কার, মোটরসাইকেল দাপিয়ে বেড়ায়। সবচেয়ে কষ্টের বিষয় হচ্ছে, এই সব গাড়ির চালকরা যেন হর্ন না বাজিয়ে থাকতে পারে না। যেখানে যানবাহনের অল্পই প্রয়োজন, সেখানে মানুষ প্রতিনিয়ত হর্ন বাজিয়ে এক ধরনের আতঙ্ক তৈরি করে। হর্নের সেই তীব্র শব্দ আমার বয়স্ক কানে বাজে বুলেটের মতো। হৃদয় যেন থেমে যায় মাঝে মাঝে। মনে হয়, মরার আগেই শান্তি মিলবে না এই দেশে!

ছেলেমেয়েদের বিদেশে যাওয়ার পরে মাঝে মাঝে ওদের সঙ্গে কথা বলি। ওরা বলেছে, বিদেশে কেউ রাস্তায় হর্ন বাজায় না। গাড়ি চলে নিয়ম মেনে, মানুষের প্রতি সম্মান দেখিয়ে। আর আমাদের দেশে? রাস্তায় বেরুলে মনে হয়, মানুষ যেন প্রতিযোগিতায় নেমেছে কে কত জোরে হর্ন বাজাতে পারে। প্রত্যেকটা হর্ন যেন গায়ের মধ্যে কাঁপুনি ধরিয়ে দেয়। এ দেশে কি কেউ মানুষের কানের মর্ম বোঝে না? বয়স্ক মানুষদের প্রতি কি কোনো সম্মান নেই?

শহরে তো হর্নের শব্দ সহ্য করার মতো নয়, কিন্তু গ্রামেও এখন এমন অবস্থা হয়ে গেছে যে শান্তি নেই। রাস্তায় গাড়ি চলবে, এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু, হর্নের দরকার কী? ওরা কি জানে না, হর্ন বাজানোর ফলে শুধু আমার মতো বৃদ্ধরাই কষ্ট পায় না, ছোট ছোট বাচ্চারাও ভয় পায়। আমার নাতি-নাতনিরা যখন আসে, ওদের মুখে কান্নার শব্দ শোনা যায়। এত তীব্র শব্দ, বাচ্চাগুলো ভয়ে কুঁকড়ে যায়। আমি ভাবি, এটাই কি আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ?

আমার আর কিছুদিনই বাঁচার সম্ভাবনা। মরার আগে একটু শান্তি চেয়েছিলাম। কিন্তু এ হর্নের আওয়াজ আমার সেই শেষ বেলার শান্তিটুকু কেড়ে নিয়েছে। প্রার্থনা করি, এ দেশের মানুষ যেন কিছুটা সহানুভূতিশীল হয়। হর্নের জন্য অন্যের কষ্টের বিষয়টা যেন তারা বোঝে। মানুষের কান, হৃদয়—এসবও তো সংবেদনশীল। গায়ের উপর দিয়ে গাড়ি চলে গেলে যেমন ব্যথা হয়, তেমনি হর্নের তীব্র আওয়াজও আমার মাথার মধ্যে কাঁপুনি ধরে। আমি আর পারি না, বুঝলে!

বিদেশে থাকে এমন কিছু মানুষ আমাকে একবার বলেছিল, ওদের রাস্তায় নাকি আইন খুব কঠিন। কেউ হর্ন বাজালে সাথে সাথেই শাস্তি পায়। ভাবলাম, আমাদের দেশে এমন কোনো নিয়ম হবে না কেন? আমাদের দেশেও তো আইন আছে, কিন্তু কেন মানা হয় না? কোথায় সেই শৃঙ্খলা? শুধু গাড়ির চালকেরাই নয়, সবাই যেন হুটহাট যা খুশি তাই করে বেড়ায়। আইন আছে, কিন্তু তার প্রয়োগ নেই। আর তার ফল ভোগ করছি আমরা, সাধারণ মানুষ।

আমার শেষ ইচ্ছা শুধু একটাই—এই দেশটা যেন শান্তি পায়। মানুষের মধ্যে মানবিকতা জাগুক। হর্নের আওয়াজে আমি হয়তো আমার বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেব, কিন্তু আমার মতো যারা বয়স্ক, তাদের কষ্ট যেন আর সহ্য করতে না হয়। তরুণরা যেন এ বিষয়টি নিয়ে ভাবে, এই সমস্যার সমাধান খোঁজে। শুধু বয়স্করাই নয়, এই হর্নের সমস্যা থেকে মুক্তি পেলে শিশুরা নিরাপদে বেড়ে উঠতে পারবে। আমাদের সমাজ, আমাদের দেশ, এসব তো আমাদেরই, তাই আমাদের দায়িত্ব এই দেশটাকে সুন্দর করে তোলা।

এখন হয়তো আমার সময় শেষের দিকে, কিন্তু এই চিঠিটা লিখে রেখে যাচ্ছি তাদের জন্য যারা আমার পরে আসবে। দেশটা এমন হোক, যেখানে রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে মানুষকে হর্নের শব্দে কষ্ট পেতে হবে না।

img

যৌনতা এবং শারীরিক চাহিদা থেকে জীবনের পরিধি আরও অনেক বড় – এ আর রহমানের আত্মোপলব্ধি

প্রকাশিত :  ০৭:৩২, ৩০ নভেম্বর ২০২৪
সর্বশেষ আপডেট: ০৮:১১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪

রেজুয়ান আহম্মেদ

অস্কারজয়ী সঙ্গীতশিল্পী এ আর রহমান, যিনি পৃথিবীকে সুরের মাধ্যমে নতুনভাবে চিনিয়েছেন, সম্প্রতি নিজের জীবনের এক অদেখা অধ্যায় প্রকাশ্যে এনেছেন। সায়রা বানুর সঙ্গে বিবাহ-বিচ্ছেদের পর, এক দীর্ঘ নীরবতার শেষে রহমান তাঁর ব্যক্তিগত যাত্রা সম্পর্কে খোলামেলা কথা বলেছেন। তিনি স্বীকার করেছেন যে জীবনের উদ্দেশ্য এবং মানবিক সম্পর্কের মধ্যে শুধুমাত্র শারীরিক চাহিদার সীমা থাকে না; জীবনের পরিধি আরও অনেক বড় এবং গভীর।

তিনি তাঁর একটি বক্তব্যে বলেন, ‘‘যৌনতার মতো শারীরিক চাহিদা মেটানোই জীবনের সব নয়, কখনও…’’ তাঁর এই উক্তি শুধু একটি সঙ্গীতশিল্পীর দৃষ্টিকোণ নয়, বরং একটি জীবনদৃষ্টি, যেখানে আত্মিক পরিপূর্ণতা এবং মানসিক শান্তি কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠতে পারে। রহমানের মতে, আমাদের জীবনে একটি গভীর শূন্যতা রয়েছে, যা শুধুমাত্র শারীরিক সুখ দ্বারা পূর্ণ হতে পারে না। আমাদের আধ্যাত্মিক বা মানসিক উন্নতির দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত, যা জীবনকে অর্থবহ এবং পূর্ণতা দেয়।

প্রায়ই সমাজে যৌনতা এবং শারীরিক সম্পর্ককে জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য হিসেবে তুলে ধরা হয়। কিন্তু রহমানের অভ্যন্তরীণ জগতের এই খোলামেলা উক্তি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, আমাদের জীবনের অঙ্গনের অনেক বৃহৎ ক্ষেত্র রয়েছে, যেখানে আনন্দ, শান্তি এবং পূর্ণতা আসতে পারে। ‘‘শুধুমাত্র শারীরিক চাহিদা মেটানোই জীবনের সব নয়’’—এই কথায় তিনি একদিকে যেমন জীবনের উদ্দেশ্য অনুসন্ধান করছেন, তেমনি মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্বও তুলে ধরছেন।

এ আর রহমানের মতে, একজন মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য তখনই ভালো থাকতে পারে, যখন সে জীবনের গভীরে প্রবাহিত হতে পারে। তিনি বলছেন, ‘‘অবসাদ ঘিরে ধরে, কারণ আমার মনে হয়, আমাদের সবার মধ্যেই একটা শূন্যতা রয়েছে।’’ এরই মধ্যে গল্পকাররা, দর্শন, বিনোদন, এমনকি কখনও কখনও ওষুধের মাধ্যমে এই শূন্যতা পূর্ণ করা যায়। কিন্তু জীবনের উদ্দেশ্য সেই সব জিনিসে সীমাবদ্ধ নয়।

এখানে উল্লেখযোগ্য হলো, রহমানের ব্যক্তিগত জীবনের অধ্যায়গুলো। তাঁর স্ত্রী সায়রা বানুর সঙ্গে বিবাহ-বিচ্ছেদ এবং তার পরবর্তী ঘটনাবলীর প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি একটি অন্তর্দৃষ্টি দেয়, যে যেখানে তিনি তাঁর শূন্যতা, দুঃখ এবং সঙ্কটের মধ্যে থেকেও জীবনের একটি বৃহত্তর দৃষ্টিকোণ খুঁজে পেয়েছেন। ‘‘এমনকি ভগ্ন হৃদয়ের ভারে ঈশ্বরের সিংহাসনও কেঁপে উঠতে পারে’’—রহমান তাঁর নিজের দুঃখ এবং সংগ্রামকে পৃথিবীর বৃহত্তর দুঃখের সঙ্গে তুলনা করছেন, যেখানে ক্ষতি এবং হতাশা একে অপরকে অনুসরণ করে। তবুও, তিনি এই ভঙ্গুরতার মধ্যে জীবনের অন্য অংশগুলির জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছেন।

এ আর রহমানের এই বক্তব্যে প্রতিটি মানুষের জীবনের বিভিন্ন দিকের প্রশংসা করা হয়েছে—মানসিক শান্তি, আত্মিক উন্নতি, এবং অন্যের জন্য বাঁচার আকাঙ্ক্ষা। তিনি বলেছেন, ‘‘যখন তুমি অন্যের জন্য বাঁচবে, তখন তোমার মধ্যে এই চিন্তাগুলি আসবে না।’’ এর মাধ্যমে তিনি আমাদেরকে জীবনকে শুধুমাত্র নিজের সুখের জন্য না, বরং একটি বৃহত্তর উদ্দেশ্য সাধনের জন্য বাঁচার পরামর্শ দিয়েছেন। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে এমন একটি নৈতিক ভিত্তি খুঁজে পাওয়া উচিত, যা শুধুমাত্র আমাদের শারীরিক চাহিদা পূরণে সীমাবদ্ধ নয়। আমাদের আধ্যাত্মিক এবং মানসিক উন্নতি, আমাদের জীবনের বাস্তব মূল্যমানের পরিচয় দেয়।





রেজুয়ান আহম্মেদ: কলামিস্ট, বিশ্লেষক; সম্পাদক অর্থনীতি ডটকম

মতামত এর আরও খবর