img

মানুষ শারীরিক সক্ষমতার চেয়ে মানসিক শক্তিতে বড় হয়.....

প্রকাশিত :  ০৬:৩১, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪
সর্বশেষ আপডেট: ০৭:০৯, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪

মানুষ শারীরিক সক্ষমতার চেয়ে মানসিক শক্তিতে বড় হয়.....

রেজুয়ান আহম্মেদ

রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকা ফুটফুটে সেই ছেলেটির চেহারা আমাদের হৃদয়ে অমোঘ এক দাগ কেটে গেছে। সে একটি স্বপ্ন দেখত, ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন। কিন্তু জীবন কখনো কখনো নিষ্ঠুর বাস্তবতার মুখোমুখি করে দেয়, যেখানে সব স্বপ্নগুলো যেন মুহূর্তেই ভেঙে পড়ে। তার পা হারিয়ে যাওয়া মানে শুধুমাত্র শারীরিক অসুস্থতা নয়, তার সমস্ত স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষারও বিনাশ। এই বাস্তবতা এতটাই নির্মম যে, তার মতো সাহসী একটি তরুণের চোখেও নিরাশার ছায়া পড়েছে।

ছেলেটির মুখে কথা ফোটে, “স্যার, আমার ক্রিকেট খেলার অনেক শখ ছিল, আমি এখন কিভাবে ক্রিকেট খেলব?” কথাটি শুনে মুহূর্তের জন্য থমকে যান আমাদের মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুস। ড. ইউনুস মানুষের দুঃখ, কষ্ট, স্বপ্ন ও বেদনা বোঝার অসামান্য ক্ষমতা রাখেন। তিনি শুধুমাত্র একজন নেতা নন, তিনি একজন মানবদরদী। তার চোখে তখন অশ্রু চলে আসে, একটি তরুণ হৃদয়ের স্বপ্ন ভাঙার এই মুহূর্তে তার মানবিকতা তাকে গভীরভাবে আঘাত করে।

ড. ইউনুস কিছুক্ষণ নীরব থাকেন। তিনি বুঝতে পারেন, শুধু একটি পা হারানো নয়, এই ছেলেটি তার জীবন হারিয়েছে, তার স্বপ্নগুলোও যেন ঝরে গেছে। কিন্তু ড. ইউনুস একজন লড়াকু মানুষ। তিনি জানেন, জীবনে বড় কিছু করতে গেলে শুধুমাত্র শারীরিক সক্ষমতা নয়, মানসিক শক্তিও অপরিহার্য। তিনি বুঝতে পারছেন, এই ছেলেটির জীবন থেকে ক্রিকেটের স্বপ্ন হারিয়ে গেছে, কিন্তু তার সামনে জীবনের আরও অনেক পথ খোলা।

তিনি সেই ছেলেটির মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, "তুমি শুধু একজন ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলে, কিন্তু তুমি জীবনে আরও অনেক কিছু করতে পারো। পা হারিয়ে গেছে, কিন্তু তোমার ইচ্ছাশক্তি, তোমার মেধা, তোমার মনোবল এখনও অটুট আছে। মানুষ শারীরিক সক্ষমতার চেয়ে মানসিক শক্তিতে বড় হয়। তুমি যদি চেষ্টা করো, তাহলে জীবন তোমাকে অন্য কোনো পথ খুলে দেবে।"

ড. ইউনুসের এই কথাগুলো ছিল শুধু কথাই নয়, এটি ছিল সেই ছেলেটির ভেতরে নতুন করে আশার সঞ্চার করা। জীবন কখনোই থেমে যায় না, এবং একজন প্রকৃত যোদ্ধা জীবনের প্রতিটি ধাপে লড়াই চালিয়ে যায়। ছেলেটি হয়তো তার শারীরিক সামর্থ্য হারিয়েছে, কিন্তু তার মানসিক শক্তি এখনও অপরাজেয়। এই ছেলেটিকে নতুন করে উৎসাহিত করতে ড. ইউনুসের মতো একজন মানবিক নেতার প্রয়োজন ছিল।

জীবনে এমন অনেক পরিস্থিতি আসে যখন আমরা মনে করি, সব শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কিছুই শেষ হয় না। যেখানেই হোক না কেন, জীবনের নতুন দরজা খোলা অপেক্ষা করে। আমাদের নিজেদের মধ্যে সেই মনোবল রাখতে হবে, যে কোনো পরিস্থিতি থেকে ফিরে আসার ক্ষমতা থাকতে হবে। যারা নিজেদের ভেতরের শক্তিকে কাজে লাগায়, তারা কখনোই হেরে যায় না।

এই ছেলেটি যদি নিজের ভেতরে সেই আশার আলো জ্বালাতে পারে, তবে সে জীবনের অন্য কোনো দিক থেকে সফল হতে পারবে। জীবনের একটি দিক বন্ধ হলে, অন্য দিক খুলে যায়। জীবন শুধু শারীরিক সক্ষমতার উপর নির্ভর করে না, এটি আমাদের মন ও মস্তিষ্কের শক্তিতে পরিচালিত হয়।

মানুষের জীবনে অনেক সংগ্রাম আসে, কিন্তু সেই সংগ্রামগুলোই মানুষকে আরও দৃঢ় ও শক্তিশালী করে তোলে। এই ছেলেটির মতো যারা নিজেদের স্বপ্ন হারিয়েছে, তাদের জন্য আমাদের সমর্থন ও ভালোবাসা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের উচিত তাদের পাশে দাঁড়িয়ে নতুন স্বপ্ন দেখতে সাহায্য করা। কারণ জীবন কখনো থেমে থাকে না, জীবন সবসময় এগিয়ে যায়।

ড. ইউনুসের এই হৃদয়বিদারক মুহূর্ত আমাদেরকে শিখিয়ে দেয়, মানুষের জীবনে যতই দুঃখ ও বেদনা আসুক না কেন, সেই বেদনাকে অতিক্রম করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার সাহসিকতা রাখতে হবে। জীবন যতই কঠিন হোক, তার সামনে মাথা নত করতে নেই।




রেজুয়ান আহম্মেদ: কলামিস্ট, বিশ্লেষক; সম্পাদক অর্থনীতি ডটকম

img

নির্বাক মঙ্গল!

প্রকাশিত :  ১৮:০৫, ১৪ অক্টোবর ২০২৪
সর্বশেষ আপডেট: ১৮:২৭, ১৪ অক্টোবর ২০২৪

রেজুয়ান আহম্মেদ

ঢাকার এক ঘিঞ্জি পাড়ায় মঙ্গলের জন্ম। হরিজন সম্প্রদায়ের বস্তি। ঘরের ভেতর চারপাশের অব্যবস্থা আর দুর্ভোগ যেন সেখানকার স্বাভাবিক চিত্র। মঙ্গল যখন ছোট, তখন থেকেই সে অন্য শিশুদের মতো খোলা মাঠে খেলতে পারেনি, স্কুলে যেতে পারেনি। তার চারপাশে ছিল কেবল সংগ্রামের গল্প। তার বাবার রোজকার কাজ ছিল ঢাকা শহরের রাস্তাঘাট পরিষ্কার করা, আর মা নিতান্ত ঘরের কাজ করে জীবন চালাতেন। মঙ্গলের শৈশবটা যেন শহরের অদেখা কষ্টের প্রতিচ্ছবি হয়ে গড়ে উঠছিল।

তার বাড়ির সামনে থাকা জরাজীর্ণ ঘর গুলোতে আরও অনেক শিশুর মতোই মঙ্গলের দিন কাটত—কিছু হাসি, কিছু খেলা, কিন্তু তার পেছনে ছিল তীব্র দারিদ্র্যের ছায়া। সে শিখে গিয়েছিল, সমাজের কাছে তারা অপ্রয়োজনীয়। হরিজন সম্প্রদায় যেন জন্ম থেকে বঞ্চিত।

মঙ্গলের জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই তার জীবনের সংগ্রাম শুরু হয়েছিল। তার মা একদিন গভীর রাতে শীতের কামড়ের মধ্যে প্রসব ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতে তাকে পৃথিবীতে এনেছিলেন। কোনো হাসপাতালের সেবা বা ঔষধের আশ্রয় তখন ছিল দূরস্বপ্ন। এভাবে অনেক শিশু জন্মায় মঙ্গলের পাড়ায়—অসহায়ভাবে, অবহেলায়। মঙ্গলের মা, সুধা, তাকে দেখে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, তার ছেলে বড় হয়ে কিছু একটা করবে, এই দুর্ভাগ্যের জীবন থেকে মুক্তি পাবে। কিন্তু মঙ্গলের ভবিষ্যৎ যেন অনেক আগেই অন্ধকারে লেখা হয়ে গিয়েছিল।

মঙ্গলের দিনগুলো কাটত পাড়ার অন্য শিশুদের সঙ্গে। কিন্তু মনের ভেতর একটা কষ্টবোধ সবসময় ঘিরে থাকত। সে দেখতে পেত, অন্য পাড়ার শিশুরা স্কুলে যায়, রঙিন জামা পরে খেলতে যায়, আর সে? তার জীবন তো বাবার মতো রাস্তা পরিষ্কার করার কাজেই ফুরিয়ে যাবে।

মঙ্গলের পাড়ার অন্য শিশুদের মতোই সে ছোটবেলা থেকেই কাজের সঙ্গে পরিচিত হয়ে পড়েছিল। বাবার সঙ্গে ঢাকার রাস্তায় নেমে ড্রেন পরিষ্কার করা, শহরের গলিপথ ঝাড়ু দেয়া—এটাই ছিল তার জীবনের নিয়মিত অংশ। তার কাঁধে লেগে থাকা ময়লা, শরীরে শুকনো ঘামের গন্ধ, আর অন্তহীন ক্লান্তি যেন তার শৈশবকে ধীরে ধীরে গ্রাস করছিল।

তবুও মঙ্গলকে নিয়ে পাড়ার ছোট ছেলে-মেয়েরা আনন্দ পেত। তার মুখে সবসময় এক চঞ্চল হাসি লেগে থাকত, যা তাদের দুঃখ-দুর্দশার মাঝেও একটুখানি শান্তি এনে দিত। সে যখন সময় পেত, তখন পাড়ার বাচ্চাদের নিয়ে খেলত, গল্প শোনাতো। কিন্তু তার হাসির আড়ালে লুকিয়ে ছিল এক গভীর শূন্যতা।

মঙ্গল যখন কৈশোরে পা দেয়, তখন থেকেই তার উপর আরও বেশি দায়িত্ব এসে পড়ে। বাবার শরীর দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়ছিল, আর তার মা মঙ্গলের ভবিষ্যৎ নিয়ে দিন দিন উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছিলেন। শহরের মানুষগুলো হরিজন সম্প্রদায়কে শুধু ময়লা পরিষ্কার করার দায়িত্ব দিয়েই রেখেছে। তাদের কোনো সম্মান নেই, নেই কোনো সামাজিক নিরাপত্তা। মঙ্গল দেখত, তার বাবাকে লোকে অবজ্ঞা করে কথা বলত, আর তার মায়ের দিকে তাকাতো বিরক্তির দৃষ্টিতে।

এই অবহেলার মধ্যেই মঙ্গল বেড়ে উঠছিল। সে দেখতে পেত, তাদের ঘিঞ্জি পাড়ার শিশুদের কেউই জীবনে কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিয়ে বাঁচে না। তারা জানত, বড় হয়ে তাদেরও হয়তো বাবাদের মতো পরিচ্ছন্নতার কাজে নেমে পড়তে হবে। সমাজ তাদের জন্য কোনো বিকল্প পথ রাখেনি।

মঙ্গলের জীবনে হঠাৎ একদিন ঝড় আসে। এক সকালে মঙ্গল প্রচণ্ড জ্বরে কাঁপতে থাকে। তার শরীর ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ে। তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, কিন্তু সেখানকার কর্মীরা তাদের প্রতি তেমন কোনো সহানুভূতি দেখায় না। মঙ্গলের মা সুধা জানতেন, তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই খারাপ, কিন্তু তবুও ছেলেকে বাঁচানোর জন্য সবকিছু করতে প্রস্তুত ছিলেন।

হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেল, মঙ্গলের চিকিৎসার জন্য অনেক টাকার প্রয়োজন। ডাক্তার বললেন, "বাইরে গিয়ে ওষুধ আর টেস্ট করিয়ে আনতে হবে।" মঙ্গলের বাবার চোখেমুখে তখন একরাশ চিন্তার ছাপ ফুটে উঠল। তারা জানতেন, এত টাকা তাদের নেই। কিন্তু মঙ্গলকে বাঁচাতে তারা আপ্রাণ চেষ্টা করলেন।

মঙ্গলের অসুস্থতা ধীরে ধীরে আরো বাড়তে থাকে। এক সময় সে নিজের নামও ভুলে যেতে শুরু করে। তার জ্বর আরও তীব্র হতে থাকে, এবং শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা শুরু হয়। তার মা-বাবা অসহায়ভাবে ছেলেকে বাঁচানোর জন্য চেষ্টায় লেগে থাকেন, কিন্তু সব প্রচেষ্টা বৃথা হয়ে যায়।

একদিন রাতের অন্ধকারে, মঙ্গল চিরতরে চোখ বন্ধ করে ফেলে। তার মৃত্যু যেন পুরো পাড়ার মাটিতে অন্ধকার নামিয়ে আনে। ছোট ঘরে পড়ে থাকা মঙ্গলের নিথর দেহ যেন সবার জীবনের গল্পকেই প্রতিফলিত করছিল—একটি জীবনের অবহেলা, বঞ্চনা, এবং সংগ্রামের নিষ্ঠুর বাস্তবতা।

মঙ্গলের মৃত্যুতে পাড়ার মানুষগুলো কাঁদতে শুরু করে। তারা জানত, মঙ্গল তাদেরই এক প্রতিনিধি, এক প্রতীক, যার জীবনের প্রতিটি দিন ছিল সংগ্রামের। কিন্তু তারা কোনোদিনই সমাজের কাছে নিজেদের জীবনের গুরুত্ব বোঝাতে পারেনি।

মঙ্গলের মৃত্যুর পর, তার মা প্রতিদিন ছেলের কথা মনে করে কাঁদতেন। তিনি জানতেন, মঙ্গল চলে গেছে, কিন্তু তার সঙ্গে থাকা অবহেলার গল্পগুলো এখনও রয়ে গেছে। পাড়ার লোকেরা মঙ্গলের কষ্টের কথা মনে করে তাকে সম্মান জানায়, কিন্তু তাদের জীবনেও কোনো পরিবর্তন আসে না।

"নির্বাক মঙ্গল" কেবল একটি হরিজন সম্প্রদায়ের ছেলের কাহিনী নয়, এটি সেই সমস্ত অবহেলিত মানুষদের কাহিনী, যারা সমাজের প্রান্তে দাঁড়িয়ে প্রতিদিন নিজেদের অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম করে। মঙ্গলের জীবন ছিল নীরব এক আর্তনাদ, যা সমাজ কখনো শুনতে পায়নি। কিন্তু তার জীবন, তার মৃত্যু যেন সেই সংগ্রামেরই একটি অসীম প্রতিচ্ছবি, যা আমাদের চোখ খুলে দেয়—প্রান্তিক মানুষদের জীবনের গুরুত্ব আর তাদের প্রতি আমাদের অবহেলার বাস্তবতা।