img

গুগলের জন্ম ও অব্যাহত সাফল্যের কথা -রেজুয়ান আহম্মেদ

প্রকাশিত :  ১০:৫৯, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৪
সর্বশেষ আপডেট: ১২:১০, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৪

গুগলের জন্ম ও অব্যাহত সাফল্যের কথা  -রেজুয়ান আহম্মেদ

গুগল, বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং শক্তিশালী ইন্টারনেট সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান, ১৯৯৮ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে। দুই মেধাবী কম্পিউটার বিজ্ঞানী, ল্যারি পেজ এবং সার্গেই ব্রিন, তাদের পিএইচডি গবেষণা থেকে গুগলের শুরুর ধারণা পেয়েছিলেন। তবে, গুগলের জন্মের গল্পটি শুধুমাত্র প্রযুক্তির অগ্রগতি নয়, এটি এক সৃষ্টিশীল দৃষ্টিভঙ্গির এবং অদম্য ইচ্ছাশক্তির সফলতার গল্প।

গুগলের জন্ম

গুগল শুরু হয়েছিল একটি সাধারণ লক্ষ্য নিয়ে—ইন্টারনেটে ছড়িয়ে থাকা বিশাল তথ্যের মধ্যে থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য দ্রুত এবং নির্ভুলভাবে খুঁজে বের করা। ১৯৯৬ সালে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করার সময়, ল্যারি পেজ ও সার্গেই ব্রিন একটি প্রকল্প নিয়ে কাজ করছিলেন যার নাম ছিল “ব্যাকরাব”। এটি ছিল এমন একটি অ্যালগরিদম যা ইন্টারনেটের লিংকগুলোকে ক্রমানুসারে বিশ্লেষণ করে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক তথ্য খুঁজে বের করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছিল। এই প্রকল্পই পরবর্তীতে গুগলের শুরুর মূল ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়।

গুগলের নামটিও বেশ চমকপ্রদ। "গুগল" শব্দটি এসেছে "গোগল" (Googol) থেকে, যা একটি বিশাল সংখ্যার প্রতীক—একটি ১ এর পরে ১০০টি শূন্য। এটি ছিল পেজ এবং ব্রিনের সেই স্বপ্নের প্রতিফলন, যেখানে তারা বিশাল পরিমাণ তথ্যের সহজ অ্যাক্সেস দিতে চেয়েছিলেন।

গুগলের শুরুর উদ্যোগ

গুগল শুরুতে একটি গ্যারেজ থেকে যাত্রা শুরু করেছিল। সিলিকন ভ্যালির একটি বাড়ির গ্যারেজ ভাড়া নিয়ে ল্যারি পেজ ও সার্গেই ব্রিন তাদের প্রথম অফিস স্থাপন করেন। তাদের প্রথম সার্ভারও ছিল বেশ পুরোনো এবং সাধারণ। তবে, গুগলের প্রতিষ্ঠাতাদের উদ্ভাবনী চিন্তা এবং লক্ষ্য ছিল অত্যন্ত বড়। তারা বিশ্বাস করতেন যে ইন্টারনেটের তথ্যগুলিকে সহজে সংগঠিত করে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব।

গুগল প্রতিষ্ঠার শুরুর দিনগুলোতে ল্যারি এবং সার্গেই নিজেরাই প্রোগ্রামিং, সার্ভারের যত্ন, এমনকি অফিসের নিত্যদিনের কাজগুলোও করতেন। তাদের কাজের প্রতি একনিষ্ঠতা এবং সমস্যাগুলো সমাধানের প্রতি মনোযোগই গুগলকে আজকের অবস্থানে নিয়ে এসেছে। তারা একটি স্পষ্ট লক্ষ্য স্থির করেছিলেন—তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করা।

গুগলের সফলতার কারণ

গুগলের সফলতার পেছনে মূলত তিনটি প্রধান কারণ কাজ করেছে। প্রথমত, তাদের অ্যালগরিদম ছিল অত্যন্ত উদ্ভাবনী, যা অন্য কোনো সার্চ ইঞ্জিনের তুলনায় অনেক বেশি নির্ভুল এবং কার্যকর ছিল। গুগলের "পেজর্যাংক" (PageRank) অ্যালগরিদমটি তথ্যের গুরুত্ব নির্ধারণে একটি সম্পূর্ণ নতুন পদ্ধতি ব্যবহার করেছিল, যা ব্যবহারকারীদের প্রয়োজনীয় তথ্য দ্রুত খুঁজে পেতে সাহায্য করত। অন্য সার্চ ইঞ্জিনগুলো যেখানে মূলত কিওয়ার্ড বা শব্দ বিশ্লেষণ করত, গুগল লিংক বিশ্লেষণ করে সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক ফলাফল দেখাতে পারত।

দ্বিতীয়ত, গুগলের প্রতিষ্ঠাতারা প্রযুক্তির উন্নতির পাশাপাশি ব্যবহারকারীদের অভিজ্ঞতাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছিলেন। গুগলের হোমপেজ ছিল অত্যন্ত সহজ এবং পরিস্কার, যেখানে ব্যবহারকারীরা খুব সহজেই তাদের প্রয়োজনীয় সার্চ করতে পারত। এই সরলতা এবং ব্যবহারযোগ্যতা গুগলকে অন্যান্য প্রতিযোগীদের থেকে আলাদা করেছে।

তৃতীয়ত, গুগলের সফলতার পেছনে ছিল তাদের ব্যবসায়িক মডেল। গুগল যখন "অ্যাডওয়ার্ডস" (AdWords) নামে একটি বিজ্ঞাপন প্ল্যাটফর্ম চালু করেছিল, তখন এটি পুরো ইন্টারনেট বিজ্ঞাপনের ধারণাকেই পাল্টে দেয়। গুগল বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে আয় করতে শুরু করেছিল, যা তাদের অর্থনৈতিকভাবে আরও শক্তিশালী করে তোলে এবং বিশ্বের সবচেয়ে লাভজনক প্রতিষ্ঠানগুলোর একটিতে পরিণত করে।

গুগলের উদ্ভাবনী চিন্তা

গুগলের সফলতার আরেকটি কারণ হলো তাদের উদ্ভাবনী চিন্তাভাবনা এবং ক্রমাগত নতুন কিছু করার প্রয়াস। গুগল কেবল একটি সার্চ ইঞ্জিন হিসেবে সীমাবদ্ধ থাকেনি; বরং তারা ক্রমান্বয়ে নতুন নতুন সেবা ও প্রযুক্তি বাজারে নিয়ে এসেছে। জিমেইল, গুগল ডকস, গুগল ম্যাপস এবং ইউটিউবের মতো সেবা গুগলের উদ্ভাবনী ক্ষমতার প্রমাণ বহন করে।

এছাড়াও, গুগলের প্রতিষ্ঠাতারা সবসময় বড় স্বপ্ন দেখতেন এবং সেই স্বপ্ন পূরণের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। তারা কেবল ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে গিয়ে প্রযুক্তিকে মানবকল্যাণে ব্যবহারের ওপর জোর দিয়েছেন। গুগল মিশনও ছিল "বিশ্বের তথ্যকে সংগঠিত করা এবং তা সকলের জন্য সহজে অ্যাক্সেসযোগ্য করা"।

গুগলের ভবিষ্যৎ দৃষ্টি

গুগলের প্রতিষ্ঠাতাদের দৃষ্টি ছিল কেবল বর্তমান নিয়ে নয়, বরং ভবিষ্যতের দিকে। তারা সবসময় ভবিষ্যতের প্রযুক্তি ও সম্ভাবনা নিয়ে কাজ করেছেন। গুগল বর্তমানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, স্বয়ংচালিত গাড়ি, এবং স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে কাজ করছে। গুগলের এমন ভবিষ্যৎমুখী চিন্তা তাদের অন্যসব প্রতিষ্ঠানের তুলনায় এগিয়ে রেখেছে এবং এই গুণটাই তাদের সফলতার সবচেয়ে বড় কারণ।

শেষ কথা

গুগলের সফলতা কেবল একটি সার্চ ইঞ্জিন তৈরি করার গল্প নয়; এটি সৃষ্টিশীলতা, উদ্ভাবনী চিন্তা, এবং অদম্য ইচ্ছাশক্তির ফলাফল। ল্যারি পেজ ও সার্গেই ব্রিনের শুরুটা হয়েছিল একটি গ্যারেজ থেকে, কিন্তু তাদের স্বপ্ন ছিল বিশাল। সেই স্বপ্ন এবং নিরলস পরিশ্রমই গুগলকে পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান কোম্পানিগুলোর একটিতে পরিণত করেছে।


রেজুয়ান আহম্মেদ: কলামিস্ট, বিশ্লেষক; সম্পাদক অর্থনীতি ডটকম

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এর আরও খবর

img

ঊষর মরুর বুকে কেন বাড়ছে সবুজের ছোঁয়া?

প্রকাশিত :  ০৮:৪১, ০৩ অক্টোবর ২০২৪
সর্বশেষ আপডেট: ০৯:০২, ০৩ অক্টোবর ২০২৪

দিনে দিনে সবুজের ছোঁয়া বাড়ছে ঊষর সাহারা মরুভূমির বুকে ! আফ্রিকার বিশাল মরুভূমির উষ্ণ বাদামি শরীরে পড়ছে সবুজের ছোপ। বিশ্বের সবচেয়ে শুষ্ক অঞ্চলে বাড়ছে গাছপালার পরিমাণ। 

সম্প্রতি নাসার উপগ্রহচিত্রে ধরা পড়েছে এমন কিছু দৃশ্য; যা দেখে অবাক হয়েছেন বিজ্ঞানীরা। কৃত্রিম উপগ্রহটি সাহারা মরুভূমির সবুজ শ্যামল রূপ তুলে ধরেছে সকলের সামনে। পৃথিবীর অন্যতম শুষ্ক এবং রুক্ষ স্থানে এমন দৃশ্য দেখে হতবাক হয়েছেন অনেকেই।

চারিদিকে শুধু ধূ-ধূ প্রান্তর। যে দিকে দু’চোখ যায় শুধু বালি আর বালি। দূর-দূরান্তে তাকালেও মরুভূমির বুকে পানির হদিস পাওয়া দুষ্কর। নাসার উপগ্রহের ক্যামেরায় যে ছবি সেপ্টেম্বর মাসে ধরা পড়েছে তাতে দেখা গেছে মাত্র এক মাসের মধ্যেই টলটলে পানি ভরে উঠেছে প্রায় শুকনো হ্রদগুলো। সাধারণত সাহারার হ্রদগুলো শুষ্ক থাকে। বেশির ভাগ হ্রদে পানির লেশমাত্রও থাকে না।

এই ঊষর, প্রাণহীন বালির প্রান্তরে এত সবুজের অস্তিত্বের কারণ কী? প্রকৃতির এই বিপরীতধর্মী আচরণের নেপথ্যে কী লুকিয়ে রয়েছে? প্রকৃতির কোনো খামখেয়ালি আচরণে ভোল বদলে গেল মরু সাহারার?

সাহারার এই পরিবর্তিত রূপের নেপথ্যে রয়েছে এক ঘূর্ণিঝড়। যার জেরে পাল্টে গেছে সাহারার একাংশের ছবি। আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার তরফে জানানো হয়েছে, অতিরিক্ত ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড়ের কারণে গত ৭ এবং ৮ সেপ্টেম্বর সাহারা মরুভূমির উত্তর-পশ্চিমাংশে বৃষ্টি হয়েছে।

অতিক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড়ের প্রকোপে সেপ্টেম্বরের শুরুতে ভারি বৃষ্টি হয়েছে সাহারা মরুভূমির বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। আর তাতেই কার্যত সবুজের বিস্ফোরণ ঘটেছে বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।

প্রতি বছর জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে আফ্রিকার বিষুবরেখার উত্তরে মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে বৃষ্টিপাত বেড়ে যায়। পৃথিবী যত বেশি উষ্ণ হচ্ছে ততই উত্তরে সরে যাচ্ছে ইন্টারট্রপিক্যাল কনভারজেন্স জ়োন বা আন্তঃক্রান্তীয় অভিসারী অঞ্চলের সীমানা।

জার্মানির লাইপজিগ বিশ্ববিদ্যালয়ের জলবায়ু সংক্রান্ত গবেষক কার্স্টেন হাউস্টেইন জানিয়েছেন, সীমানাটি এই বছর সাধারণের চেয়ে অনেক বেশি উত্তরে সরে গেছে। তাই স্বাভাবিকের চেয়ে দুগুণ থেকে ছয় গুণ বেশি আর্দ্র হয়ে উঠছে সাহারা। এছাড়া গোটা পৃথিবীতে এল নিনো (উষ্ণ সামুদ্রিক জলস্রোতের পরিবর্তন) থেকে লা নিনোর (বন্যা-খরার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ) রূপান্তরের প্রভাব তো রয়েছেই।

মৌসুমি ঝড়ের গতিপথ পরিবর্তন হওয়ায় সাহারায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণও বেড়েছে। এমনকি মাঝেমধ্যে বন্যাও দেখা দিচ্ছে বলে জানিয়েছেন আবহাওয়া গবেষকেরা। 

মরক্কো, আলজিরিয়া, তিউনিসিয়া ও লিবিয়ার মতো যে সব অঞ্চলে বৃষ্টি প্রায় হয়ই না, সে সব অঞ্চলগুলো কার্যত ভেসে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।

বিশেষত মরক্কো এবং আলজেরিয়ার ওই শুষ্ক জায়গাগুলোতে এক বছরে যতটা বৃষ্টি হয়, তা দু’দিনেই হয়ে গেছে বলে আবহাওয়া দপ্তর সূত্রে খবর। চাঁদ, সুদান এবং এরিট্রিয়ার কিছু অংশে বৃষ্টিপাত সবচেয়ে বেশি পরিমাণে বেড়েছে।

পৃথিবীর বুকে আফ্রিকার উত্তর অংশই রুক্ষতম। কিন্তু এবার সেপ্টেম্বর মাসে অন্য বছরের তুলনায় পাঁচ গুণ বেশি বৃষ্টি হয়েছে। কিছু জায়গায় বন্যাও হয়েছে।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের কারণে বিশ্বের উষ্ণতা বেড়ে পরিবেশগত পরিবর্তন আসছে। তার ফল ভোগ করছে সাহারাও। অবশ্য এতে শাপে বর হয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে উষ্ণ মরুভূমিটির।

পৃথিবী যত বেশি উষ্ণ হবে, দিনের পর দিন সাহারায় তত সবুজায়ন হবে। চলতি বছরের জুনে নেচারে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে বলা হয়েছে, আগামী কয়েক দশকে সাহারার জলবায়ুতে ব্যাপক পরিবর্তন আসতে থাকবে। সাহারায় সবুজের পরিমাণও বাড়বে বলে আশা প্রকাশ করেছেন জলবায়ু গবেষকেরা।

উডল হোল ওশানোগ্রাফিক ইনস্টিটিউশনের প্রেসিডেন্ট পিটার ডি মেনোকাল জানিয়েছেন, ভারি বৃষ্টি হলে বালির আস্তরণ সরে গিয়ে মাটি বেরিয়ে যায়। সেই সুযোগেই অনুকূল পরিবেশ পেয়ে সবুজ গাছপালা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।

খ্রিস্টপূর্ব ২৫০০ সাল থেকে বর্ষা ক্রমশ দক্ষিণে সরে যেতে শুরু করে, বৃষ্টির অভাবে ধীরে ধীরে মরুভূমিতে পরিণত হয় সাহারা।

তবে মালি, নাইজেরিয়া, বুরকিনা ফাসো, এমনকি পূর্ব আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের কৃষকেরা গত তিন দশকে নিজেদের চেষ্টায় কয়েক কোটি গাছ লাগিয়েছেন। সাহারা মরুভূমির অগ্রগতিকে থামিয়ে দিতে অনেকটাই সক্ষম হয়েছেন।

তথ্যসূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা